যা আরো গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সরল বিশ্বাসে নারীকে শুধু শ্রমিক হিশেবে গণ্য করা যায় না; কেননা তার প্রজননগত ভূমিকা তার উৎপাদন সামর্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, ব্যক্তিগত জীবনে যতোটা সামাজিক অর্থনীতিতেও তার থেকে কম নয়। কোনো কোনো পর্বে, সত্যিই, ভূমিকৰ্ষণের থেকে সন্তান প্রসব অনেক বেশি উপকারী। এঙ্গেলস সমস্যাটিকে উপেক্ষা করেছেন শুধু এ-মন্তব্য করে যে সমাজতান্ত্রিক। জনগোষ্ঠি লোপ করবে পরিবার প্রথাকে–এটা নিশ্চিতভাবেই একটি বিমূর্ত সমাধান। আমরা জানি উৎপাদনের অব্যবহিত প্রয়োজন ও জনসংখ্যাবৃদ্ধির প্রয়োজনের মধ্যে সম্পর্কের অদলবদলের ফলে কতো ঘনঘন এবং কতো মৌলভাবে সোভিয়েত রাশিয়াকে বদলাতে হয়েছে পরিবার সম্বন্ধে তার নীতি। তবে পরিবার প্রথা লোপ করা মানেই নারীর মুক্তি নয়। স্পার্টা ও নাটশি শাসনের উদাহরণ প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও পুরুষের দ্বারা নির্যাতিত হতে পারে নারী।
নারীর অবস্থা যে-সমস্যা তুলে ধরে, তাতে খুবই ব্ৰিত বোধ করবে একটি প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতা, যা স্বাধীনতা খর্ব না করে সমর্থন করে ন্যায়বিচার এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র লুপ্ত না করে ব্যক্তির ওপর দেয় দায়িত্ব। গর্ভধারণকে কোনো দায়িত্ব, কোনো কাজ, বা সামরিক পেশার মতো কোনো পেশার সাথে সমীকরণ খুবই অসম্ভব নাগরিকদের চাকুরির বিধিমালার থেকে সন্তানের জন্যে দাবি নারীর জীবনকে বিপর্যস্ত করে অনেক তীব্রভাবে–কোনো রাষ্ট্রই কখনো বাধ্যতামূলক সঙ্গমের বিধান দেয় নি। সঙ্গমে ও মাতৃত্বে নারীর জন্যে জড়িত থাকে সময় ও শক্তির থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যবোধ। যৌক্তিক বস্তুবাদ বৃথাই চেষ্টা করে কামের এ-নাটকীয় বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করতে; কেননা কামপ্রবৃত্তিকে কোনো বিধিমালার অধীনে আনা অসম্ভব। সত্যিই, যেমন ফ্রয়েড বলেছেন, এটা নিশ্চিত নয় যে এটা নিজের ভেতরেই বহন করে কি না নিজের সন্তুষ্টির অস্বীকৃতি। যা নিশ্চিত, তা হচ্ছে এটা সমাজের সাথে সংহতির অনুমতি দেয় না, কেননা কামে আছে সময়ের বিরুদ্ধে এক বিশেষ মুহূর্তের দ্রোহ, আছে সর্বজনীনের বিরুদ্ধে ব্যক্তির দ্রোহ।
নারীকে প্রসবে সরাসরি বাধ্য করার কোনো উপায় নেই : যা সম্ভব, তা হচ্ছে তাকে ফেলতে হবে এমন পরিস্থিতিতে যেখানে তার জন্যে মাতৃত্বই একমাত্র পরিণতি–আইন বা লোকাচার দিতে পারে বিয়ের আবশ্যিক বিধান, নিষিদ্ধ করতে পারে জন্মনিয়ন্ত্রণ, বিবাহবিচ্ছেদকে করতে পারে অবৈধ। এসব প্রাচীন পিতৃতান্ত্রিক বিধিনিষেধ আজ আবার ফিরিয়ে আনছে সোভিয়েত ইউনিয়ন; রাশিয়া পুনরুজ্জীবিত করছে বিয়ের পিতৃশাসনসুলভ ধারণাকে। এটা করতে গিয়ে সে নারীকে আবার নির্দেশ দিচ্ছে নিজেকে কামসামগ্রি করে তুলতে : সাম্প্রতিক এক ঘোষণায় রাশিয়ার নারী নাগরিকদের অনুরোধ করা হয়েছে তাদের কাপড়চোপড়ের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে, প্রসাধন ব্যবহার করতে, স্বামীদের বশে রাখার জন্যে ছেনালিপনার আশ্রয় নিয়ে তাদের কামাগ্নি জাগিয়ে রাখতে। এ-ঘটনা স্পষ্ট নির্দেশ করে যে নারীকে শুধু একটি উৎপাদনের শক্তি হিশেবে গণ্য করা অসম্ভব : পুরুষের জন্যে সে কামের সঙ্গী, প্রসবকারিণী, কামসামগ্রি–এক অপর, যার ভেতর দিয়ে পুরুষ খোঁজে নিজেকে। নারীর অবস্থা বোঝার জন্যে আমাদের তাকাতে হবে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ পেরিয়ে, যা পুরুষ ও নারীকে আর্থ এককের বেশি কিছু বলে গণ্য করে না।
একই কারণে আমরা ফ্রয়েডের যৌন অদ্বৈতবাদ ও এঙ্গেলসের আর্থনীতিক অদ্বৈতবাদ উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করি। মনোবিশ্লেষক নারীর সমস্ত সামাজিক দাবিকে বিশ্লেষণ করেন পুরুষসুলভ প্রতিবাদ বলে; অন্য দিকে, মার্ক্সবাদীর কাছে নারীর কাম কম-বেশি জটিল, পরোক্ষভাবে, প্রকাশ করে তার আর্থনীতিক পরিস্থিতি। তবে ভগাঙ্কুরীয় ও যোনীয় ধারণাগুলো, বুর্জোয়া বা সর্বহারা ধারণাগুলোর মতোই বাস্তব নারীকে সার্বিকভাবে ব্যক্ত করতে সমান অসমর্থ। মানুষের আর্থনীতিক ইতিহাসের তলে যেমন থাকে, তেমনি সব ব্যক্তিগত নাটকের তলে আছে এক অস্তিত্ববাদী ভিত্তি, যা আমাদের পূর্ণরূপে বুঝতে সাহায্য করে সত্তার সে-বিশেষ রূপকে, যাকে আমরা বলি মানবজীবন। মানুষের সম্পূর্ণ বাস্তবতার সাথে জড়িত না করা হলে কাম ও প্রযুক্তি কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারে না। এ-কারণেই ফ্রয়েডের সুপার-ইগোর নিষেধগুলো আর ইগোর উদ্যমগুলোকে ঘটনাচক্ৰজাত বলে মনে হয়, এবং এঙ্গেলসের নারীর ইতিহাসের বিবরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিকাশগুলো রহস্যময় ভাগ্যের খেয়ালখুশিতে ঘটেছে বলে মনে হয়। আমাদের নারী আবিষ্কারের উদ্যোগে জীববিজ্ঞান, মনোবিশ্লেষণ, ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কিছু কিছু অবদানকে আমরা। প্রত্যাখ্যান করবো না; তবে আমরা ধারণা পোষণ করবো যে শরীর, কামজীবন, ও প্রযুক্তির সম্পদগুলো মানুষের জন্যে ততোটাই আছে, তাদের সে যতোটা উপলব্ধি করে নিজের অস্তিত্বের সার্বিক পরিপ্রেক্ষিতে। পেশিশক্তির, শিশ্নের, হাতিয়ারের মূল্য সংজ্ঞায়িত হতে পারে শুধু এক মূল্যবোধের বিশ্বে; এটা নিয়ন্ত্রিত হয় সে-মৌল পরিকল্পনা দিয়ে, যার সাহায্যে মানুষ খোঁজে সীমাতিক্রমণতা।
যাযাবর
প্রথম খণ্ড । ভাগ ২ – ইতিহাস । পরিচ্ছেদ ১