তাই নারীর নিয়তি ও সমাজতন্ত্রের নিয়তি পরস্পরের সাথে গভীরভাবে বাধা, যা বেবেলের নারী সম্পর্কিত মহাগ্রন্থেও দেখানো হয়েছে। নারী ও সর্বহারা, তিনি বলেন, উভয়ই উৎপীড়িত। উভয়কেই মুক্ত করতে হবে আর্থনীতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে, যা ঘটবে শিল্পযন্ত্রপাতির মধ্য দিয়ে সংঘটিত সামাজিক অভ্যুত্থানের ফলে। নারীর সমস্যাকে পরিণত করা হয়েছে শ্রমে তার সামর্থ্যের সমস্যার পর্যায়ে। যখন কৌশল ছিলো তার সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তখন প্রভাবশালী থেকে, যখন সে তা ব্যবহার করতে পারে নি তখন সিংহাসনচ্যুত হয়ে, আধুনিক কালে নারী পুনরুদ্ধার করে পুরুষের সাথে তার সাম্য। প্রাচীন পুঁজিবাদী পিতৃসুলভ শাসনের প্রতিরোধের ফলে অনেক দেশেই এ-সাম্য বাস্তবায়িত হতে পারছে না; যখন এ-প্রতিরোধ ভেঙে পড়বে, তখন এটা বাস্তবায়িত হবে, সোভিয়েত প্রচার অনুসারে যা ঘটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নে। এবং যখন সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, তখন আর কেউ পুরুষ বা নারী থাকবে না, সবাই হবে সমান মর্যাদার শ্রমিক।
এঙ্গেলস যে-চিন্তাধারার রূপরেখা তৈরি করেছেন, তা যদিও আমাদের আলোচিত চিন্তাধারাগুলো থেকে নির্দেশ করে অগ্রগতি, তবু এ আমাদের হতাশ করে–সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোকেই এখানে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। সব ইতিহাসের বাঁক নেয়ার বিন্দু হচ্ছে গোষ্ঠিগত মালিকানা থেকে ব্যক্তিগত মালিকানায় উত্তরণের পথটুকু, এটা কীভাবে ঘটেছে তা এতে কোনোভাবেই নির্দেশ করা হয় নি। এঙ্গেলস নিজে পরিবারের উদ্ভব-এ ঘোষণা করেছেন যে বর্তমানে আমরা এ-সম্বন্ধে কিছুই জানি না; ঐতিহাসিক বিস্তৃত বিবরণ সম্বন্ধে তিনি শুধু অজ্ঞই নন, এমনকি তিনি কোনো ব্যাখ্যাও দেন নি। একইভাবে, এটাও স্পষ্ট নয় যে ব্যক্তিগত মালিকানাই অবধারিতভাবে নারীদের বন্দী করেছে দাসত্বে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এমন সব ঘটনাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নিয়েছে যেগুলোর ব্যাখ্যা দরকার : এঙ্গেলস আলোচনা না করেই ধরে নিয়েছেন যে স্বার্থের বন্ধনই পুরুষকে গ্রথিত করে সম্পত্তির সাথে; কিন্তু এ-স্বার্থ, যা সামাজিক সংস্থাসমূহের উৎস, তার উৎস কোথায়? তাই এঙ্গেলসের বিবরণ অগভীর, এবং যে-সব সত্য তিনি প্রকাশ করেছেন, সেগুলো আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাচক্ৰজাত, আকস্মিক। কিন্তু সত্য হচ্ছে যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সীমা পেরিয়ে না গিয়ে আমরা ওগুলোর অর্থ নির্ণয় করতে পারি না। আমরা যেসব সমস্যা তুলেছি, এটা সেগুলোর সমাধান দিতে পারে না, কেননা এগুলোর বিষয় সম্পূর্ণ মানুষ, শুধু সে-বিমূর্তকরণ : হোমো ওএকোনোমিকাস নয়।
উদাহরণস্বরূপ, এটা স্পষ্ট যে ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণাটি বোধগম্য হতে পারে শুধু অস্তিত্বশীলের আদি অবস্থার প্রসঙ্গে। কেননা এটা বোঝা যায় যে প্রথমে এমন। একটা অবস্থা ঘটেছিলো, যখন অস্তিত্বশীল নিজের অস্তিত্বের স্বায়ত্তশাসন ও পার্থক্য ঘোষণার জন্যে নিজেকে মনে করেছিলো একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা। এ-ঘোষণা থেকে গিয়েছিলো মন্ময়, অন্তর্গত, বৈধতাহীন, যতো দিন তার এটা কাগতভাবে বাস্তবায়নের কৌশলগত উপায় ছিলো না। উপযুক্ত হাতিয়ার ছাড়া বিশ্বের ওপর সে নিজের কোনো ক্ষমতা বোধ করে নি, প্রকৃতিতে ও নিজের গোত্রে সুপ্ত অবস্থায় সে নিজেকে বোধ করেছে অক্রিয়, সন্ত্রস্ত, অবোধ্য শক্তিরাশির ক্রীড়নক। কঠিন ও উৎপাদনশীল শ্রমের অভিজ্ঞতার মধ্যে ব্রোঞ্জ আবিষ্কারই মানুষকে সমর্থ করে নিজেকে স্রষ্টা হিশেবে আবিষ্কার করতে; প্রকৃতির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পর সে আর তাকে ভয় পায় নি, এবং নানা বাধা পেরিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সে সাহস পায় নিজেকে স্বায়ত্তশাসিত সক্রিয় শক্তি হিশেবে দেখার এবং ব্যক্তি হিশেবে আত্মসিদ্ধি অর্জনের।
আবার, তার নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ঘোষণাই সম্পত্তি ব্যাখ্যার জন্যে যথেষ্ট নয় : প্রতিটি সচেতন ব্যক্তি কি, সংগ্রাম, এবং একক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে প্রয়াস চালাতে পারে নিজেকে সার্বভৌমত্বে উন্নীত করার।
সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানার ফলেই ঘটেছে নারী উৎপীড়ন, এ-সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোও অসম্ভব। এখানেও এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট। তিনি দেখেছেন যে নারীর পেশিগত দুর্বলতা প্রকৃত নিকৃষ্টতার ব্যাপার হয়ে ওঠে শুধু ব্রোঞ্জ ও লৌহ হাতিয়ারের সম্পর্কে এসে; কিন্তু তিনি দেখেন নি যে শ্রমের সীমিত সামর্থ্যই নারীর জন্যে বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে হয়ে ওঠে অসুবিধাজনক। নারীর অসামর্থ তার বিনাশ ডেকে আনে, কেননা পুরুষ নারীকে বিবেচনা করেছে তার সমৃদ্ধিলাভ ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু কেননা নারী উৎপীড়িত হয়েছে, এ পরিকল্পনাও ব্যাখ্যা করার জন্যে যথেষ্ট নয়, কেননা দু-লিঙ্গের মধ্যে শ্রববিভাজন হয়ে উঠতে পারতো একটা প্রীতির সম্পর্ক। যদি মানুষের চেতনায় না থাকতো অপর নামে একটি আদি ধারণা এবং অপর-এর ওপর আধিপত্যের এক আদি আকাঙ্খা, তাহলে ব্রোঞ্জের হাতিয়ার উদ্ভাবনের ফলে নারীপীড়ন ঘটতো না।
এঙ্গেলস এ-পীড়নের বিশেষ ধরনটিও ব্যাখ্যা করেন নি। দু-লিঙ্গের বৈরিতাকে তিনি দিতে চেয়েছেন শ্রেণীসংগ্রামের রূপ, তবে এ-উদ্যোগে তিনি ছিলেন নিরুদ্যম; তাঁর তত্ত্ব একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা সত্য যে লিঙ্গানুসারে শ্রমবিভাজন ও পরিণামে পীড়ন মনে জাগিয়ে তোলে শ্রেণী অনুসারে সমাজবিভাজনের ধারণাটি, তবে এ-দুটিকে গুলিয়ে ফেলা অসম্ভব। এক দিকে, শ্রেণীবিভক্তির কোনো জৈবিক ভিত্তি নেই। আবার, শ্রমিক তার অতিপরিশ্রমের মধ্যেও প্রভুর বিপরীতে সচেতন থাকে নিজের সম্বন্ধে; এবং সর্বহারারা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সব সময়ই পরখ করে নিয়েছে তাদের অবস্থা, এবং শোষকদের জন্যে তৈরি করে রেখেছে একটি হুমকি। এবং তারা চেয়েছে একটি শ্রেণী হিশেবে নিজেদের অবলুপ্তি। ভূমিকায় আমি দেখিয়েছি নারীর পরিস্থিতি কতো ভিন্ন।