১৯৪৯-এ বেরোয় তাঁর ল্য দ্যজিয়েম সেক্সঃ দ্বিতীয় লিঙ্গ পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় অপর, অপ্রয়োজনীয়, খাদ্য, রুদ্ধ, সীমাবদ্ধ, বিকলাঙ্গ, দাসী ও কামসামগ্রির স্তরে থাকার জন্যে দণ্ডিত নারীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অদ্বিতীয় গ্রন্থ; ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, ও শিল্পসৌন্দর্যে যা অতুলনীয়।
দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর পর বোভোয়ার আক্কার ফিরে আসেন উপন্যাসে; লেখেন তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস লে মাঁদাঁরে (১৯৫৪: দি মান্ডারিন্স্ : মন্ত্রীরা)। ফরাশি মাদারে শব্দটি নেয়া হয়েছে সংস্কৃত ‘মন্ত্ৰিণ’ থেকে, তবে এটা এখন ঠিক মন্ত্রী বোঝায় না, বোঝায় শিক্ষিত অভিজাতদের। এটির জন্যে তিনি পান প্রি গকুর পুরস্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফরাশি বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে তাদের ‘ম্যান্ডারিন’ মর্যাদা ছেড়ে রাজনীতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলো, এটি তার বিবরণে পূর্ণ। অনেকে মনে করে এটি লিখিত সার্ত্র, কাম্যু, ও তার নিজের সম্পর্ক নিয়ে, তবে দ্য বোভোয়ার তা স্বীকার করেন না, যদিও উপন্যাসের ঘটনাগুলোর সাথে মিল আছে তাদের জীবনের। তিনি চারটি দার্শনিক বইও লিখেছেন: এর একটি পুর ওঁয়ে মরাল দ্য ল অ্যামবিগুইতে (১৯৪৭; দ্ব্যৰ্থবোধকতার নীতিশাস্ত্ৰ)। ভ্ৰমণকাহিনীও লিখেছেন দুটি: লা লঁগ মার্শ: এসে সিইর ল চিন (১৯৪৭: দীর্ঘ যাত্ৰা); এবং যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিয়ে ল’আমেরিক অ জুত্র দ্য জুর (১৯৪৮ আমেরিকা: দিনের পর দিন)। তারপর বোভোয়ার লিখতে শুরু করেন স্মৃতিকথা, ভঙ্গিতে যেগুলো অভিনব; তাঁর আত্মজৈবনিক বই চারটি : মেমোয়ার দা’ওঁয়ে জোন ফ্রিই রাঁজে কুঁৎ (১৯৫৮; কৰ্তব্যপরায়ণ কন্যার স্মৃতিকথা), ল ফার্স দ্য ল’আজ (১৯৬০; যৌবনকাল, এটি উৎসর্গ করেন সার্ত্রের নামে) ল ফর্স দে শোজে (১৯৬৩:অবস্থার চাপ), এবং তু কঁৎ ফো (১৯৭২: সব বলা ও করা হয়ে গেছে))। এগুলো ব্যক্তিগত ব্যাপার পেরিয়ে হয়ে উঠেছে ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ফরাশি বুদ্ধুজীবীদের জীবন ও মননের চিত্র। নারীবাদ ছাড়া তার বিশেষ আগ্রহের বিষয় জরায়ণ ও মৃত্যু: হাসপাতালে মায়ের মৃত্যু নিয়ে লেখেন ওয়ে মর্ত ত্রে দুসে (১৯৬৪: একটি খুব সহজ মৃত্যু), বৃদ্ধদের প্রতি সমাজের ঔদাসীন্য সম্পর্কে লেখেন লৈ ভেইয়স। (১৯৭০: বৃদ্ধকাল)। ১৯৮১তে লেলেখেন সার্ত্রের শেষ জীবনের বেদনাদায়ক বিবিরণ ল সেরেমোনি দে অদিয় (বিদায়: সার্ত্রের প্রতি চিরবিদায়)।
দ্বিতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে কথা বলার আগে একটি ব্যাপার সম্পর্কে ভাবতে চাই, যা নারী ও পুরুষের জন্যে অশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এবং ছিলো দ্য বোভোয়ারের জন্যেও, তা হচ্ছে প্রেম ও শরীর। শেষ জীবনে তাঁর এমন একটি ভাবমূৰ্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিলো যেনো তিনি বিশুদ্ধ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অকম্প্র মূর্তি, তাতে কোনো কামনা বাসনা হাহাকার অশ্রু নেই, তা কখনো কাপে না; তবে তিনি কোনো মর্মরে গঠিত মোমবাতি ছিলেন না। জ্ঞানের সাথে প্ৰেম কাম ক্ৰন্দনের কোনো বিরোধ নেই, বরং জ্ঞানীরা, সৃষ্টিশীলেরাই প্রেম কাম হাহাকারে হতে পারেন অদ্বিতীয়, আর সৃষ্টিশীল নারীরা প্রেমেকামে যে-চুড়ো ছোঁয়, তা পারে না একান্ত নারীধর্মী, সীমাবদ্ধ, পতিদের পরিচারিকা, ও কামসামগ্রি স্ত্রীরা। তারা ক্লান্ত সব কিছুতে, প্রেমেও, কামেও। প্রেম এবং কামও সৃষ্টিশীল ব্যাপার, তাঁর জন্যে প্রতিভা দরকার, তা শুধু যৌনাঙ্গের উত্তেজনা নয়, যদিও ওটা অবশ্যই থাকা দরকার, এবং সঙ্গে দরকার তীব্র মানবিক প্রতিভা; এটা দেখতে পাই সব প্রধান নারী ও পুরুষের মধ্যেই, দেখতে পাই মেরি ওলস্টোনক্রাফটে, যিনি কাঁপতেন প্রেমে ও কামে, দেখতে পাই সিমোন দ্য বোভোয়ারে; জাঁ-পল সার্ত্রের সাথে তিনি চিরসঙ্গীত্বে ছিলেন, তাতে অন্য প্রেমিকের জন্যে প্রেমে মন দুলতে, দেহে পুলক লাগতে তাঁর বাধে নি।
মেরি ছিলেন তীব্র প্রেমিকা, হয়তো প্রেমিকের পদতলে চুমো খেতে খেতে স্বপ্ন দেখতেন নারীমুক্তির; আমাদের বন্দিনী বিপ্লবী রোকেয়ার কথা জানা যায় না, তবে তাঁর চিঠিগুলো ভরে আছে কামহতাশার দীর্ঘশ্বাসে, কান পাতলেই সেগুলোর হাহাকার শোনা যায়। একটি বহুমূত্রগ্রস্ত বুড়োকে নিয়ে তাঁর দিনরাত্রিগুলোর কথা ভেবে আমরা শিউরে উঠি। দ্য বোভোয়ার অন্য বিশ্বের, সার্ত্রের সাথে ছিলো তাঁর আমৃত্যু সম্পর্ক, চুক্তি ছিলো তারা নিতে পারবেন অন্যান্য প্রেমিকপ্রেমিক। সার্ত্রের অনেক নারী ছিলো। বোভোয়ারও নিয়েছেন প্রেমিক, তাদের কথা তিনি লিখেছেনও; লিখেছেন। নেলসন অ্যালগ্রেন এবং পরে ক্লাদ লাঁজমান নামে আরেকজনের কথা; সমকামী সম্পর্কও তাঁর ছিলো; সম্প্রতি জানা গেছে মননশীলতার চূড়ান্তরূপ, রূপসী, দ্য বোভোয়ার ছিলেন পল্লীর রাখালী মেয়ের থেকেও আবেগপরায়ণ, রমণীয় ছিলেন অনারীবাদীরূপে যে ‘চিরন্তনী নারী’কে তিনি বাতিল করেছিলেন, সেটিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন নিজেরই ভেতরে; ভাবতে কি পারি একটি পুরুষের জন্যে দ্য বোভোয়ার কাঁদছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বা ভাবছেন তাঁর কাপড় ইন্ত্রি করার কথা, তাঁর জন্যে রান্নার বা ঘর সাজানোর কথা? ক-বছর আগে বেরিয়েছে বোভোয়ারের প্রেমপত্র বিলাভেড শিকাগো ম্যান : লেটার্স টু নেলসন অ্যালগ্লেন ১৯৪৭-৬৪। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত ১৭ বছর ধ’রে লেখা ৩০৪টি চিঠি! কে আলগ্নেন? এক গৌণ মার্কিন ঔপন্যাসিক। কাতর এসব চিঠি মনে করিয়ে দেয় জন মডেলটন মারিকে লেখা বিরহিণী ক্যাথেরিন ম্যান্সফিল্ডের চিঠিগুলোকে, যা উদ্ধৃত ক’রে দ্য বোভোয়ার দেখিয়েছেন প্রেমিকা কতোটা পাগল থাকে প্রেমিককে তাঁর প্রিয় জিনিশটি, এমনকি বক্ষবন্ধনীটি দেখানোর জন্যে। তাঁর চিঠিগুলোতে যা বিস্ময়কর, তা হচ্ছে প্রেমিকের প্রতি তাঁর অতিশয় আনুগত্য; প্রেমিককে তিনি ডেকেছেন ‘কুমির’ ‘পশু’ ও “আমার প্রিয়তম স্বামী”: নিজেকে বলেছেন “তোমার অনুগত আরব স্ত্রী, যে-আরব স্ত্রীর শোচনীয় রূপ এঁকেছেন তিনি দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ। তিনি যখন লিখেছেন দ্বিতীয় লিঙ্গ, তখনই আলগ্রেনের কাছে লিখছিলেন কোমল, কাতর পল্লীবালার চিঠি; ১৯৪৯-এর এক সন্ধ্যায় আলগ্রেনকে লিখেছেন, ‘হায় বিধাতা! নারীরা যতো বই লিখেছে ও নারীদের সম্বন্ধে যতো বই লেখা হয়েছে, আমি সব পড়েছি এবং আমায় ঘেন্ন ধ’রে গেছে। আমি আমার আপন পুরুষ চাই!’ ১৭ বছর ধরে দ্য বোভোয়ার ইংরেজিতে, মাঝেমাঝে মধুর ভুল ইংরেজিতে, আলগ্রেনকে লিখেছেন প্রেমপত্র। তিনি রূপসী ছিলেন, তবে আলগ্রেনের সাথে দেখা হওয়ার আগে রূপ নিয়ে ভাবেন নি। ১৯৪৩-এ তাঁর একটি দাঁত পড়ৈ যায়, তিনি সেটি বাঁধান নি, কেননা তা খুবই ব্যয়বহুল ও ক্লান্তিকর ও নিরর্থক’; কিন্তু ১৯৪৮-এ, তিনি লিখেছেন, “তোমার জন্যে সপ্তাহে তিনবার আমি গেছি। দন্তচিকিৎসকের কাছে।” তিনি চেয়েছিলেন যাতে আলগ্রেন “পায় সম্পূর্ণ হাসিসহ একটি মেয়ে’। তাদের দেখা হয়। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে: দা বোভোয়ার ৩৯, আলগ্রেন ৩৮। এর বারো বছর আগে বেরিয়েছিলো অ্যালগ্রেনের প্রথম উপন্যাস, তাতে টাকা বা খ্যাতি কিছুই আসে নি; ১৯৪৯-এ বেরোয় তাঁর সোনালি বাহুর পুরুষ, এটা তাকে কিছুটা অর্থ ও খ্যাতি এনে দেয়। দ্য বোভোয়ার তাকে সম্বোধন করেছেন ‘আমার চমৎকার, বিস্ময়কর, ও প্রিয় স্থানীয় তরুণ’, ‘আমার মূল্যবান, প্রিয়তম শিকাগোর পুরুষ’ এবং “আমার প্রিয়তম স্বামী। তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন আলগ্রেন; তাঁর প্রতি বিশ্বস্তু ছিলেন বছরখানেক! বোভোয়ার লিখেছেন; আমি এখন বুঝি ওটা ছিলো বোকামি, কেননা কোনো বাহুই উষ্ণ নয়, যখন তা থাকে সমুদ্রের ওপারে।’ তিনি প্যারিস ছাড়তে পারতেন, কিন্তু সার্ত্রকে নয়। আলগ্রেনকে লিখেছেন, ”তোমার সাথে আমৃত্যু দিনরাত কাটিয়ে আমি সুখ পাবো শিকাগোতে, প্যারিসে বা চিচিকাস্টেনেসোতে; তোমাকে আমি দেহে ও হৃদয়ে ও আত্মায় যতোটা ভালোবাসি, তাঁর চেয়ে বেশি ভালোবাসা সম্ভব নয়। কিন্তু যে আমার সুখের জন্যে সব কিছু করেছে, তাকে আঘাত দেয়ার থেকে বরং আমি মরে যাবো।” ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি যতো পুরুষের সাথে ঘুমিয়েছেন, তাঁর থেকে বেশি ঘুমিয়েছেন নারীদের সাথে। সার্ত্রের সাথে তাঁর যৌনজীবন টিকেছে ন-বছর। বোভোয়ায় লিখেছেন : “তিনি সবখানেই উষ্ণ, প্রাণবন্ত পুরুষ, কিন্তু শয্যায় নয়। শিগগিরই বুঝতে পেরেছিলাম, যদিও আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না; এবং প্রেমিকপ্রেমিকা হিশেবে চালিয়ে যাওয়াকে একটু একটু ক’রে মনে হতে থাকে নিরর্থক, এবং এমনকি অশ্লীল।’