তাই নারীকে শুধু একটি লৈঙ্গিক প্রাণী হিশেবে বিবেচনা করা যেতে পারে না, কেননা জৈবিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সেগুলোরই রয়েছে গুরুত্ব, যেগুলো কর্মকাণ্ডে পরিগ্রহ করে বাস্তব মূল্য। নারীর আত্মচেতনাকে শুধুই তার কাম দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না : এটা প্রতিফলিত করে এমন এক পরিস্থিতি, যা নির্ভরশীল সমাজের আর্থনীতিক সংগঠনের ওপর, যেটা আবার নির্দেশ করে মানবমণ্ডলি অর্জন করেছে। প্রযুক্তিগত বিবর্তনের কোন পর্যায়। আমরা দেখেছি জৈবিকভাবে নারীর দুটি মূল। বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : বিশ্বে তার আয়ত্তি পুরুষের থেকে কম বিস্তৃত, এবং সে তার প্রজাতির কাছে অধিকতর দাসত্বে বন্দী।
কিন্তু আর্থনীতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অনুসারে এসব সত্য ধারণ করে বেশ ভিন্ন মূল্য। মানুষের ইতিহাসে বিশ্বের ওপর অধিকার কখনোই নগ্ন শরীর দিয়ে সংজ্ঞায়িত হয় নি : হাত, তার বিরোধসমর্থ বৃদ্ধাঙ্গুলি নিয়ে, হয়ে ওঠে হাতিয়ারের পূর্বরূপ, যা বৃদ্ধি করে ক্ষমতা; প্রাক-ইতিহাসের অতিপ্রাচীন দলিলেও মানুষকে দেখা যায় সশস্ত্ররূপে। যখন ভারি লাঠি উঁচিয়ে ধরে দূরে রাখা হতো বন্যপশুদের, তখনও নারীর শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে সুস্পষ্ট নিকৃষ্টতারূপে : যদি হাতিয়ারটি ব্যবহারের জন্যে দরকার হতো একটু বেশি শক্তি, তাহলে এটাই দেখিয়ে দিতো সে শোচনীয়ভাবে শক্তিহীন। তবে কৌশল হয়তো লোপ করে দিতে পুরুষ ও নারীর পেশিগত অসাম্য : বিশেষ প্রয়োজনেই উদ্ধৃষ্টতার অভাব পূরণ করা হয় প্রাচুর্য দিয়ে, এবং খুব বেশি থাকা পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকার থেকে ভালো নয়। তাই আধুনিক অনেক যন্ত্র চালানোর জন্যে দরকার পড়ে পেশিশক্তির অতিসামান্য অংশ; এবং যা ন্যূনতম দরকার, তা যদি নারীর সামর্থ্যের থেকে বেশি না হয়, তাহলে সে হয়ে ওঠে, একাজের ক্ষেত্রে, পুরুষের সমান। আজ অবশ্য একটি বোতাম টিপেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বিপুল শক্তি। বিভিন্ন দেশের প্রথানুসারে মাতৃত্বের ভার এখন ধারণ করে বিভিন্ন রকম গুরুত্ব : এটা দুমড়েমুচড়ে যাওয়ার মতো হয় যদি নারীটি বাধ্য হয় ঘনঘন গর্ভধারণে ও কারো সাহায্য ছাড়াই সন্তান লালনপালনে; কিন্তু সে যদি স্বেচ্ছায় সন্তান ধারণ করে এবং গর্ভধারণের কালে যদি সমাজ এগিয়ে আসে তার সাহায্যে ও উদ্যোগী থাকে সন্তানের কল্যাণের ব্যাপারে, তাহলে মাতৃত্বের ভার হয় লঘু এবং কাজের অবস্থাগুলোর সুবিধামতো বিন্যাস করে পুষিয়ে নেয়া যায়।
এ-পরিপ্রেক্ষিতেই এঙ্গেলস নারীর ইতিহাস বর্ণনা করেছেন পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে, এবং দেখিয়েছেন যে এ-ইতিহাস প্রধানত নির্ভর করেছে কৌশলের ওপর। প্রস্তর যুগে, যখন যৌথভাবে জমির মালিক ছিলো গোত্রের সমস্ত সদস্য, আদিম কোদাল ও নিড়ানির অবিকশিত অবস্থার জন্যেই কৃষির সম্ভাবনা ছিলো সীমিত, তাই নারীর শক্তি ছিলো উদ্যানপালনের উপযুক্ত। আদিম এ-শ্রমবিভাজনে দুটি লিঙ্গ গড়ে তুলেছিলো দুটি শ্রেণী, এবং এ-দুটি শ্রেণীর মধ্যে ছিলো সাম্য। পুরুষ যখন শিকার করে ও মাছ ধরে, নারী তখন থাকে বাড়িতে; তবে গৃহস্থালির কাজের মধ্যেও থাকে উৎপাদনশীল শ্রম—হাঁড়িপাতিল তৈরি, তাঁত বোনা, বাগান করা এবং ফলত আর্থনীতিক জীবনে নারী পালন করে বৃহত্তর ভূমিকা। তামা, টিন, ব্রোঞ্জ, ও লোহা আবিষ্কার ও লাঙলের উদ্ভবের ফলে কৃষিকর্মের সীমা বৃদ্ধি পায়, এবং বনপরিষ্কার ও জমি চাষের জন্যে দরকার হয়ে পড়ে নিরবচ্ছিন্ন শ্রম। তখন পুরুষ আদায় করে নেয় অন্য পুরুষের শ্রম, যাদের সে পরিণত করে দাসে। দেখা দেয় ব্যক্তিগত মালিকানা : দাসের ও জমির প্রভু, পুরুষ হয়ে ওঠে নারীরও মালিক। এটা ছিলো নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়। নতুন হাতিয়ার আবিষ্কারের ফলে পুরোনো শ্রমবিভাজন বিপর্যস্ত করে এটা ঘটে। সে-একই কারণ, যা নারীকে দেয় গৃহের কর্তৃত্ব–যেমন, গৃহস্থালিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়া–সেই একই কারণ পুরুষকে দেয় আধিপত্য, কেননা এর পর নারীর গৃহস্থালির কাজ পুরুষের উৎপাদনশীল কাজের পাশে হয়ে ওঠে তুচ্ছ–পরেরটি হয় সব কিছু, আগেরটি হয়ে ওঠে তুচ্ছরূপে গৌণ তখন মাতৃ-কর্তৃত্ব নিজের অধিকার তুলে দেয় পিতৃ-কর্তৃত্বের কাছে, কেননা পিতার কাছে থেকে পুত্র পেতে থাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার; আগের মতো আর নারীর কাছে থেকে তার গোত্র পায় না সম্পত্তির উত্তরাধিকার। এখানেই আমরা দেখতে পাই সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা ভিত্তি করে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের উদ্ভব। এ-ধরনের পরিবারে নারী হয় পরাভূত। নিজের সার্বভৌমত্বের মধ্যে পুরুষ, আরো অনেক কিছুর সাথে, নিজেকে লিপ্ত করে কামলীলায়–সে সঙ্গম করতে থাকে দাসীর বা বারবনিতার সাথে বা করতে থাকে বহুবিবাহ। যেখানে সম্ভব হয়, স্ত্রীরা প্রতিশোধ নিতে থাকে অসতীত্বের মধ্য দিয়ে বিয়ে তার স্বাভাবিক সার্থকতা লাভ। করে ব্যভিচারে। যে-গার্হস্থ্য দাসীত্বে বন্দী নারী, তার বিরুদ্ধে এটাই তার আত্মরক্ষার একমাত্র উপায়; এবং এ-আর্থনীতিক পীড়ন থেকেই উদ্ভূত হয় সামাজিক পীড়ন, যা ভোগ করতে হয় তাকে। যে-পর্যন্ত না এই দু-লিঙ্গ আইনে সমান অধিকার পাবে, সেপর্যন্ত সাম্য পুনপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে না; কিন্তু এ-সমানাধিকারের জন্যে দরকার সাধারণ শ্রমে নারীর অংশগ্রহণ। তখনই শুধু নারীর মুক্তি ঘটতে পারে, যখন সে বৃহৎ সামাজিক মাত্রায় অংশ নিতে পারবে উৎপাদনে এবং গৃহস্থালির কাজে অংশ নেবে খুবই কম মাত্রায়। এবং এটা সম্ভব হয়েছে শুধু আধুনিক কালের বৃহৎ শিল্পে, যেটা শুধু ব্যাপক হারে নারীশ্রম কাজেই লাগায় না, বরং এটা আনুষ্ঠানিক ভাবে চায়…