উপরন্তু, নারীনিয়তির সমস্যাটি আমি তুলবো সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে : আমি নারীকে স্থাপন করবো এক মূল্যবোধের বিশ্বে, এবং তার আচরণকে দেবো এক স্বাধীনতার মাত্রা। আমি বিশ্বাস করি নিজের সীমাতিক্ৰমণতা জ্ঞাপন ও বস্তু হিশেবে তার বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যে কোনটিকে নিতে হবে, তা বাছাই করার শক্তি তার আছে; সে পরম্পবিরোধী উদ্যমের খেলার পুতুল নয়; সে নৈতিক মানদণ্ডে সমাধান করে বিচিত্র মূলবোধের সমস্যা। মূল্যবোধের বদলে আধিপত্যকে বাছাইয়ের বদলে উদ্যমকে গ্রহণ করে মনোবিশ্লেষণ উপহার দিয়েছে এক এরসাট্জ্–নৈতিকতার এক বিকল্পস্বাভাবিকতার ধারণা। এ-ধারণা বিশেষ কার্যকর চিকিৎসাবিদ্যায়, কিন্তু মনোবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এক উদ্বেগজাগানো মাত্রায় এটি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। বর্ণনামূলক ছককে প্রস্তাব করা হচ্ছে সূত্ররূপে; এবং এটা সুনিশ্চিত যে একটি যান্ত্রিকতাবাদী মনোবিজ্ঞান স্বীকার করে নিতে পারে না নৈতিক উদ্ভাবনের ধারণাকে; কড়াকড়ির মধ্যে এটা বিবরণ দিতে পারে শুধু কম-এর এবং কখনোই বিবরণ দিতে পারে না বেশির; কড়াকড়ির মধ্যে এটা স্বীকার করতে পারে শুধু নিয়ন্ত্রণকে, কখনোই স্বীকার করে নিতে পারে না সৃষ্টিকে। যদি কোনো বিষয়ী তার সমগ্রতার মধ্যে সে-বিকাশ দেখাতে না পারে, যাকে গণধকার স্বাভাবিক বলে, তাহলে বলা হবে যে তার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেছে, এবং এ-রুদ্ধতাকে ব্যাখ্যা করা হবে একটি ন্যূনতারূপে, একটি নেতিরূপে, কখনোই একে ইতিবাচক সিদ্ধান্তরূপে ব্যাখ্যা করা হবে না। এটাই, আরো বহু কিছুর সঙ্গে, মহাপুরুষদের মনোবিশ্লেষণকে করে তোলে মর্মান্তিক : আমাদের বলা হয় যে এই-এই সংক্রম, এই-ওই উগতি তাঁদের মধ্যে সংঘটিত হয় নি; জ্ঞাপন করা হয় না যে হয়তো নিজেদের জন্যে যথাযথ কারণবশত তাঁরা এ-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে রাজি হন নি। তাই মনোবিশ্লেষকেরা কখনোই একটি অসত্য চিত্রের বেশি কিছু দেন না; এবং অসত্যের জন্যে স্বাভাবিকতা ছাড়া আর কোনো মানদণ্ড পাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। নারীনিয়তি সম্পর্কে তাদের বিবৃতি এর সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। মনোবিশ্লেষকেরা যে-অর্থে বুঝে থাকেন পরিভাষাটি, এক কাঠামোতে মাতা বা পিতার সাথে নিজেকে অভিন্ন বোধ করা হচ্ছে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা, এটা হচ্ছে কারো নিজের অস্তিত্বের স্বতস্ফূর্ত প্রকাশের থেকে বাইরের কোনো মূর্তিকে বেশি পছন্দ করা, এটা হচ্ছে সত্তা সত্তা খেলা। আমাদের কাছে নারীদের দেখানো হয় দু-ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ দ্বারা প্ররোচিতরূপে। স্পষ্টত পুরুষ পুরুষ খেলা নারীর জন্যে হবে এক হতাশার উৎস; তবে নারী নারী খেলাও এক মতিবিভ্রম : নারী হওয়ার অর্থ বস্তু হওয়া, অপর হওয়া–এ-সত্ত্বেও তার হালছাড়া ভাবের মধ্যেও অপর থেকে যায় কর্তা।
নারীর জন্যে সত্যিকার সমস্যা হচ্ছে বাস্তবতা থেকে এসব পলায়নকে প্রত্যাখ্যান করা এবং সীমাতিক্ৰমণতার মধ্যে আত্মসিদ্ধি খোজা। তাই যা করতে হবে, তা হচ্ছে দেখতে হবে যাকে বলা হয় পুরুষসুলভ ও মেয়েলি প্রবণতা, তার ভেতর দিয়ে তার জন্যে খোলা আছে কী কী পথ। এমনকি অ্যাডলারও মনে করেন ক্ষমতা লাভের ঈপ্সা একটা উদ্ভট ধরনের শক্তি; সীমাতিক্ৰমণতার সবগুলো পরিকল্পনাকে তিনি বলেন। পুরুষসুলভ প্রতিবাদ। যখন কোনো বালিকা গাছে চড়ে, অ্যাডলারের মতে সে দেখাতে চায় যে সে বালকদের সমকক্ষ; এটা তার মনে পড়ে না যে বালিকাটি গাছে চড়তে পছন্দ করে। মায়ের কাছে তার শিশু শিশ্নের সমতুল্য কিছুর থেকে ভিন্ন। জিনিশ। ছবি আঁকা, লেখা, রাজনীতি করা–এগুলো হচ্ছে নিতান্তই উদাতি; আমরা মনে করি এসব কাজ করা হয় এসব কাজ করার জন্যেই। এটা অস্বীকার করা হচ্ছে। মানবিক সব ইতিহাসের অসত্যীকরণ।।
পাঠক এ-বিবরণ ও মনোবিশ্লেষকদের বিবরণের মধ্যে এক ধরনের সমান্তরলতা লক্ষ্য করবেন। সত্য হচ্ছে যে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে–পুরুষ ও নারী মনোবিশ্লেষকেরা উভয় শ্ৰেণীই যা গ্রহণ করেছেন–বিচ্ছিন্নতার সাথে সংশ্লিষ্ট আচরণকে গণ্য করা হয় নারীধর্মী বলে, আর বিষয়ী যে-আচরণের সাহায্যে জ্ঞাপন করে তার সীমাতিক্ৰমণতা, তাকে গণ্য করা হয় পুরুষধর্মী বলে। ডোনাল্ডসন, নারীর এক ঐতিহাসিক, মন্তব্য করেছেন যে : পুরুষ হচ্ছে একজন পুংলিঙ্গ মানুষ, নারী হচ্ছে একজন স্ত্রীলিঙ্গ মানুষ, এ-সংজ্ঞাগুলোকে বিকৃত করা হয়েছে বিষমরূপে; এবং বিশেষভাবে মনোবিশ্লেষকদের মধ্যেই পুরুষকে সংজ্ঞায়িত করা হয় একজন মানুষ হিশেবে এবং নারীকে স্ত্রীলিঙ্গ হিশেবে–যখনই সে মানুষরূপে আচরণ করে তখনই বলা হয় যে সে পুরুষের অনুকরণ করছে। আমাদের কাছে নারী হচ্ছে এমন একজন মানুষ, যে মূল্যবোধের বিশ্বে খুঁজছে মূল্যবোধ, এবং এ-বিশ্বটির আর্থ ও সামাজিক সংগঠন জানা অত্যাবশ্যক। আমরা নারীর সমগ্র পরিস্থিতির ওপর যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে নারীকে বিচার করবো অস্তিত্ববাদী পরিপ্রেক্ষিতে।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ
প্রথম খণ্ড । ভাগ ১ – নিয়তি । পরিচ্ছেদ ৩
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তত্ত্বটি প্রকাশ করেছে কিছু অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ সত্য। মানুষ কোনো পশুপ্রজাতি নয়, এটি এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। মানব সমাজ এক অর্থে প্রকৃতির বিরোধী; এটা অক্রিয়ভাবে প্রকৃতির অধীনতা স্বীকার করে না, বরং নিজের পক্ষে হাতে তুলে নেয় প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ। এ-দখলকর্মটি অন্তর্গত, মন্ময় কাজ নয়; বাস্তব কাজের ভেতর দিয়ে বস্তুগতভাবে এটা সম্পন্ন করা হয়।