শরীর হচ্ছে সাধারণত্ব।
প্রতীক স্বর্গ থেকে নেমে আসে নি আবার রসাতলের গভীরতা থেকেও উঠে আসে নি–একে, ভাষার মতোই, বিশদভাবে নির্মাণ করা হয়েছে মানুষের সে-বাস্তবতা দ্বারা যা যুগপৎ মিটজাইন ও বিচ্ছিন্নতা; এবং এটাই ব্যাখ্যা করে কেননা ব্যক্তিক উদ্ভাবনেরও একটি স্থান আছে, যা মতবাদের কথা বিবেচনা না করে বাস্তবিকভাবে মেনে নিতে হয় মনোবিশ্লেষণকে। শিশ্নের ওপর যে-ব্যাপক মূল্য আরোপ করা হয়ছে, আমাদের পরিপ্রেক্ষিত সাহায্য করে সেটা বুঝতে। অস্তিত্বের একটি সত্য থেকে প্রস্থান না করে এটা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব : সেটি হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার প্রতি বিষয়ীর প্রবণতা। তার স্বাধীনতা তার মধ্যে সঞ্চার করে যে-উদ্বেগ, তা তাকে পরিচালিত করে বস্তুর মধ্যে নিজেকে খুঁজে দেখতে, এটা নিজের থেকে এক ধরনের পলায়ন। এ-প্রবণতা এতো মৌলিক যে মারের দুধ ছাড়ার সাথেসাথেই, যখন সে পৃথক হয়ে যায় অখণ্ড থেকে, শিশু বাধ্য হয় নিজের বিচ্ছিন্ন সত্তাকে দর্পণে এবং পিতামাতার দৃষ্টিপাতের মধ্যে দেখতে। আদিম মানুষেরা বিচ্ছিন্নতা বোধ করে মানায়, টোটেমে; সভ্য মানুষেরা তাদের স্বতন্ত্র আত্মায়, তাদের অহংয়ে, তাদের নামে, তাদের সম্পত্তিতে, তাদের কাজে। শিশুর বেলা শিশ্ন নিজের অবিকল নকল হিশেবে কাজ করতে সমর্থ এটা তার কাছে একই সঙ্গে এক পৃথক জিনিশ ও সে নিজে; এটা একটি খেলনা, একটি পুতুল, এবং তার নিজের মাংস; আত্মীয়রা আর সেবিকারা এটির প্রতি এমন আচরণ করে যে মনে হয় এটি এক ছোট্ট মানুষ। তাই দেখা সহজ কীভাবে এটি শিশুর জন্যে হয়ে ওঠে একটি বিকল্প সত্তা সাধারণত বেশি চতুর, বেশি বুদ্ধিমান, এবং বেশি ধূর্ত (এলিস বালিঁ, লা ভি এঁতিম দ্য ল’আঁফাঁ: শিশুর অন্তরঙ্গ জীবন, প ১০১)। শিশ্নধারী শিশ্নকে একই সাথে গণ্য করে নিজেকে বলে এবং অন্য কেউ বলে, কেননা প্রস্রাব ও পরে শিশ্নের দাঁড়ানোর ব্যাপারগুলো স্বেচ্ছাকৃত ও অস্বেচ্ছাকৃত কর্মের মাঝামাঝি প্রক্রিয়া, এবং যেহেতু এটিকে মনে হয় চপল এবং আনন্দের এক বাহ্যিক উৎস বলে। ব্যক্তির বিশেষ সীমাতিক্ৰমণতা মূর্ত হয় শিশ্নে এবং এটা গর্বের এক উৎস। শিশ্নকে এভাবে পৃথক করে রেখে পুরুষ তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের সাথে। সমন্বিত করতে পারে এটির থেকে উৎসারিত জীবনকে। এটা দেখা সহজ যে শিশ্নের দৈর্ঘ্য, প্রস্রাবের বেগ, দাঁড়ানোর ও বীর্যপাতের শক্তি শিশ্নধারীর কাছে হয়ে ওঠে তার নিজের মোগ্যতার মানদণ্ড।
এভাবে শিশের মধ্যে সীমাতিক্ৰমণতা মূর্ত হয়ে ওঠা একটি ধ্রুবক; এবং নিজের সীমাতিক্ৰমণতা অনুভব করার জন্যে শিশুর কাছেও এটা যেহেতু একটি ধ্রুবক–যার সীমাতিক্ৰমণতা খর্ব করে পিতা–তাই আমরা ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করি। খোজাগুঢ়ৈষা নামের ফ্রয়েডীয় ধারণাটিকে। কোনো বিকল্প সত্তা নেই বলে বালিকা কোনো বস্তুতে বোধ করে না বিচ্ছিন্নতা এবং সে তার সংহতি পুনরুদ্ধার করতে পারে
। এজন্যে সে তার সমস্ত সত্তাকে পরিণত করে একটি বস্তুতে, নিজেকেই প্রতিষ্ঠিত করে অপর রূপে। সে বালকের সাথে তুলনার যোগ্য কি অযোগ্য, তা সে জানুক বা না জানুক, সেটা গৌণ; গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যদি সে তা নাও জানে, তবু শিশ্নের অভাব তাকে বাধা দেয় নিজেকে একটি যৌনসত্তা হিশেবে ভাবতে। এর পরিণাম অনেক। কিন্তু যেধ্রুবকগুলোর কথা আমি বলেছি, এজন্যে সেগুলো কোনো চিরস্থির নিয়তি প্রতিষ্ঠা করে না–শিশ্ন যে এতো মহিমা ধারণ করে, তার কারণ হচ্ছে এটি হয়ে ওঠে অন্যান্য। এলাকায় প্রয়োগ করা আধিপত্যের প্রতীক। নারী যদি নিজেকে কর্তা হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো, তাহলে সেও উদ্ভাবন করতো শিশ্নের সমতুল্য কিছু; আসলে, পুতুল, যা হচ্ছে ভবিষ্যতে যে শিশু আসবে, সে-প্রতিশ্রতির প্রতিমূর্তি, তাও হয়ে উঠতে পারে শিশ্নের থেকে বেশি মূল্যবান সম্পদ। সত্য হচ্ছে শুধু মোট পরিস্থিতির ফলেই একটি দেহগত সুবিধার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি সত্যিকার মানবিক সুবিধা। মনোবিশ্লেষণ তার সত্যগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে পারে শুধু ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে।
সে একটি নারী, একথা বলে নারীকে যতোটা সংজ্ঞায়িত করা যায়, তার থেকে নিজের নারীত্ব সম্পর্কে নারীর চেতনা দিয়ে নারীকে বেশি সন্তোষজনকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না, কেননা সে এ-চেতনা অর্জন করে নিজের সমাজের পরিস্থিতি থেকে, যে-সমাজের সে একজন সদস্য। অবচেতনা ও সম্পূর্ণ মনোজীবনকে আত্মস্থ করে মনোবিশ্লেষণের বিশেষ ভাষাই নির্দেশ করে যে ব্যক্তির নাটকটি উনন্মাচিত হয় তারই ভেতরে–গূঢ়ৈষা, প্রবণতা প্রভৃতি শব্দ এ-ই জ্ঞাপন করে। কিন্তু জীবন হচ্ছে বিশ্বের সাথে একটি সম্পর্ক, এবং প্রতিটি ব্যক্তি নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে চারপাশের বিশ্বে নিজের বাছবিচার দিয়ে। আমরা যে-সব প্রশ্ন নিয়ে ব্যস্ত, সেগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্যে তাই আমাদের তাকাতে হবে বিশ্বের দিকে। মনোবিশ্লেষণ বিশেষভাবে ব্যর্থ নারী কেনো অপর, তা ব্যাখ্যা করতে। কেননা ফ্রয়েড নিজেই স্বীকার করেছেন যে। শিশ্নের মর্যাদা ব্যাখ্যা করা হয় পিতার সার্বভৌমত্ব দিয়ে, এবং, আমরা দেখেছি, তিনি স্বীকার করেছেন পুংলিঙ্গের আধিপত্যের উদ্ভব সম্পর্কে তিনি অজ্ঞ।
সুতরাং আমরা মনোবিশ্লেষণপদ্ধতিকে মেনে নিতে অস্বীকার করি, তবে এবিজ্ঞানের সব অবদান আমরা অস্বীকার করি না, বা অস্বীকার করি না এর কিছু অন্তদৃষ্টির উর্বরতাকে। প্রথমে, কামকে বিদ্যমান কিছু বলে গণ্য করে আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধ করতে চাই না। এ-দৃষ্টিভঙ্গির দারিদ্র্য ধরা পড়ে নারীলিবিডো বর্ণনায়; আমি আগেই বলেছি মনোবিশ্লেষকেরা একে কখনো সরাসরি বিচার করেন নি, শুধু পুরুষ লিবিডো থেকে একটু সরে এসে বর্ণনা করেছেন একে। অক্রিয় লিবিডোর ধারণাটি বিভ্রান্তিকর, কেননা পুরুষ ভিত্তি করে লিবিডোর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে একটি প্রেষণা, একটি শক্তি হিশেবে। আমরা বাস্তবতাকে আরো বেশি করে ধারণ করতে পারবো যদি লিবিডোকে শক্তির মতো অস্বচ্ছ শব্দ দিয়ে সংজ্ঞায়িত না করে কামের তাৎপর্যকে সম্পর্কিত করি মানুষের অন্যান্য প্রবণতা–নেয়া, ধরা, খাওয়া, তৈরি করা, আনুগত্য স্বীকার করা প্রভৃতির সাথে। কামসামগ্রিগুলোর গুণাবলি শুধু সঙ্গমের সময় নয়, সাধারণভাবেও বিচার করা আমাদের দায়িত্ব। এমন অনুসন্ধান ছাড়িয়ে যাবে মনোবিশ্লেষণের কাঠামো, যার বিবেচনায় কাম অপর্যসেয়।