নিজেদের তত্ত্বের পক্ষে উপাত্তগত প্রমাণ পেতে মনোবিশ্লেষকদের সামান্যও কষ্ট হয় নি। আমরা জানি যে বহু কাল ধরে টলেমীয় পদ্ধতি অনুসারে গ্রহগুলোর অবস্থান ব্যাখ্যা করা গেছে সহজেই, শুধু ব্যাখ্যা করার জন্যে যখন-তখন কোনো-না-কোনো সূক্ষ্ম জটিলতা যোগ করতে হয়েছে; এবং ইডিপাস গূঢ়ৈষার ওপর আরেকটি বিপ্রতীপ ইডিপাস গূঢ়ৈষা চাপিয়ে দিয়ে, সব উদ্বেগের মধ্যে কামনা আরোপ করে সে-সব তথ্যকে সমন্বিত করা হয়েছে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে, যেগুলো সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করে তঁার তত্ত্বের বৈধতার। সব মনোবিশ্লেষকই সুশৃঙ্খলভাবে প্রত্যাখ্যান করেন বাছাই-এর ধারণাটি এবং এর সাথে সম্পর্কিত মূল্যের ধারণাটি, এবং এখানেই নিহিত এসংশ্রয়ের সহজাত দুর্বলতা। অস্তিত্বশীলের স্বাধীন বাছাই থেকে বাধ্যবাধকতা ও নিষিদ্ধকরণকে বিচ্ছিন্ন করে ফ্রয়েড তাদের উদ্ভবের ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন। তিনি সেগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ বলে গণ্য করেন। তিনি মূল্যের ধারণাটির বিকল্পে চেষ্টা করেছেন কর্তৃত্বের ধারণাটি গ্রহণ করতে; তবে তিনি মোজেস অ্যান্ড মনোথিজম-এ স্বীকার করেছেন যে কর্তৃত্বের ব্যাপারটির কোনো ব্যাখ্যা তার নেই। অজাচার, উদাহরণস্বরূপ, নিষিদ্ধ, কেননা পিতা একে নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু তিনি কেননা একে নিষিদ্ধ করলেন? এটা এক রহস্য। সুপার ইগো আত্মস্থ করে নেয় এক স্বেচ্ছাচারী স্বৈরাচার থেকে উদ্ভূত বিধান ও নিষেধ, এবং সেখানে আছে প্রবৃত্তিগত প্রেষণাগুলো, কেননা আছে তা অবশ্য আমরা জানি না : এ-বাস্তবতা দুটি সম্পর্কহীন, কেননা নৈতিকতাকে মনে করা হয় কামের প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে। মানুষের ঐক্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ব্যক্তি থেকে সমাজে ঢোকার কোনো পথ নেই; তাদের মিলন ঘটানোর জন্যে ফ্রয়েড বাধ্য হয়েছিলেন কিছু অদ্ভুত গল্প বানাতে, যেমন বানিয়েছেন তিনি টোটেম ও ট্যাবুতে। অ্যাডলার স্পষ্ট দেখেছেন যে শুধু সামাজিক পরিস্থিতিতে খোজাগূঢ়ৈষা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়; তিনি মূল্যায়নের সমস্যার মধ্যে খুঁজেছিলেন এর সমাধান, কিন্তু তিনি সমাজস্বীকৃত মূল্যবোধের উৎস খোঁজেন নি ব্যক্তির মাঝে, যার ফলে তিনি ভুল করেন কামের গুরুত্ব বিচারে।
জীবনে কাম নিশ্চিতভাবেই পালন করে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা; বলা যেতে পারে কাম থাকে জীবনকে সম্পূর্ণরূপে পরিব্যাপ্ত করে। শারীরবিজ্ঞান থেকে আমরা জেনেছি যে অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয়ের সক্রিয়তা সাধারণতভাবে সমন্বিত হয় শরীরের সক্রিয়তার সাথে। মানুষ কামজ, মানুষ এক যৌন শরীর, এবং অন্যান্য মানুষ, যারা নিজেরাও যৌন শরীর, এর পরিণতিরূপে তাদের সঙ্গে তার সম্পর্কে সব সময়ই জড়িয়ে থাকে কাম। কিন্তু শরীর ও কাম যদি হয় অস্তিত্বের মূর্ত প্রকাশ, তাহলে অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত করেই আবিষ্কার করা যেতে পারে এদের তাৎপর্য। এ-পরিপ্রেক্ষিতের অভাবে মনোবিশ্লেষণ অব্যাখ্যাত সত্যকে গ্রহণ করে স্বতঃসিদ্ধ বলে। উদাহরণস্বরূপ, বলা হয় যে পাছার কাপড় তুলে উবু হয়ে বসে প্রস্রাব করতে বালিকা লজ্জা পায়–কিন্তু কোথা থেকে আসে এ-লজ্জা? এবং পুরুষ তার শিশ্নের জন্যে গর্বিত কি না বা তার গর্ব শিশ্নে প্রকাশিত হয় কি না, এ প্রশ্ন করার আগে জেনে নেয়া দরকার যে গর্ব কী এবং কারো উচ্চাকাঙ্গ কীভাবে মূর্ত হতে পারে কোনো বস্তুতে। মনোবিশ্লেষকেরা মনে করেন মানুষ সম্বন্ধে প্রধান সত্য হচ্ছে তার নিজের শরীর এবং তার গোষ্ঠির সহবাসীদের শরীরের সাথে তার সম্পর্ক; কিন্তু যে-প্রাকৃতিক বিশ্ব তাকে ঘিরে আছে, তার বন্ধুরাশির প্রতি মানুষের রয়েছে এক আদিম ঔৎসুক্য এবং তাকে সে আবিষ্কার করতে চায় কাজে, খেলায়, এবং গতিময় কল্পনার সমস্ত অভিজ্ঞতায়। মানুষ বস্তুগতভাবে একাত্ম হতে চায় সম্পূর্ণ বিশ্বের সাথে, তাকে বুঝতে চায় সব দিকে। মাটি কেটে বাঁধ বাঁধা, গর্ত খোড়া প্রভৃতি আলিঙ্গন, সঙ্গমের মতোই মৌলিক কাজ; এবং তাঁরা প্রতারিত করেন নিজেদের যারা এগুলোতে যৌন প্রতীক ছাড়া আর কিছু দেখতে পান না। গর্ত, নরম পিচ্ছিল কাদা, গভীর ক্ষত, কাঠিন্য, শুদ্ধতা প্রভৃতি হচ্ছে প্রধান বাস্তবতা; এবং এগুলোর প্রতি মানুষের যে-আগ্রহ, তা লিবিডোর আদেশে ঘটে না। শুদ্ধতা নারীর কুমারীত্বের প্রতীক বলে পুরুষ শুদ্ধতার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে; বরং শুদ্ধতার প্রতি তার অনুরাগের ফলেই সে মূল্যবান মনে করে কুমারীত্বকে। কাজ, যুদ্ধ, খেলা, শিল্পকলা নির্দেশ করে বিশ্বের সাথে জড়িত হওয়ার উপায়, যাকে অন্য কিছুতে পর্যবসিত করা সম্ভব নয়; এগুলো প্রকাশ করে সে-সব গুণ, যেগুলো সংঘর্ষে আসে যৌনতার প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যের সাথে। যুগপৎ ওগুলোর আলোকে ও এসব যৌন অভিজ্ঞতার আলোকেই প্রতিটি ব্যক্তি প্রয়োগ করে তার বাছাই করার। ক্ষমতা। তবে শুধু অস্তিত্বের স্বরূপবিষয়ক একটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ, সত্তাসম্পর্কিত একটি সাধারণ বোধ, আমাদের সাহায্য করে এ-বাছাইয়ের ঐক্য পুনরুদ্ধার করতে।
এ-বাছাইয়ের ধারণাটিকেই, বস্তুত, মনোবিশ্লেষণ প্রচণ্ডভাবে প্রত্যাখ্যান করে নিয়ন্ত্ৰণবাদ ও যৌথ অচৈতন্য-এর নামে; এবং ধারণা করা হয় যে এ-অচৈত্যনই মানুষকে সরবরাহ করে প্রাকগঠিত চিত্রকল্প ও একটা সর্বজনীন প্রতীক। এভাবেই এটা ব্যাখ্যা করে স্বপ্নের, উদ্দেশ্যহীন কার্যকলাপের, চিত্তবৈকল্যজাত স্বপ্নবিভাবের, রূপকের, এবং মানুষের নিয়তির পর্যবেক্ষিত সাদৃশ্যগুলো। শরীরসংস্থানই নিয়তি, বলেছেন ফ্রয়েড; আর এ-পদটিকেই প্রতিধ্বনিত করে মারলিউ-পোন্তির এ-পদটি :