ফ্রয়েড নারীর নিয়তির প্রতি কখনো বেশি আগ্রহ দেখান নি; তিনি পুরুষের নিয়তি সম্পর্কে তার বিশ্লেষণকে সামান্য সংশোধন করে খাপ খাইয়ে দিয়েছেন নারীর নিয়তির সাথে। এর আগে যৌনবিজ্ঞানী মারানো বলেছিলেন যে বিশেষ শক্তি হিশেবে, আমরা বলতে পারি লিবিডো পুরুষধর্মী শক্তি। আমরা পুলক সম্পর্কেও একথাই বলবো। তাঁর মতে, যে-সব নারী পুলক অনুভব করে, তারা পুরুষধর্মী নারী; কামপ্রণোদনা একমুখি আর নারী এগিয়েছে এর মাত্র অর্ধেক পথে। ফ্রয়েড কখনো এতোটা চরমে যান নি; তিনি স্বীকার করেন যে পুরুষের মতো নারীর কামও পুরোপুরি বিকশিত; তবে তিনি বিশেষভাবে এ নিয়ে কাজ করেনি। তিনি লিখেছেন : সারসত্তায় লিবিডো অবিরত ও নিয়মিতভাবে পুরুষ, তা পুরুষের মধ্যেই দেখা যাক বা দেখা যাক নারীর মধ্যে। তিনি স্বীকার করেন না যে নারী-লিবিডোর আছে নিজস্ব মৌলিক স্বভাব, তাই তাঁর কাছে একে মনে হবে সাধারণ মানবলিবিডোর এক জটিল বিকৃতি বলে। তার মতে এটা শুরুতে দু-লিঙ্গে অভিন্নভাবে বিকশিত হয়। প্রতিটি শিশু প্রথমে যায় মুখগহ্বর পর্বের ভেতর দিয়ে, যা তাকে নিবদ্ধ করে মায়ের স্তনের প্রতি, এবং তারপর যায় পায়ু পর্বের ভেতর দিয়ে; পরিশেষে পৌঁছে কামপ্রত্যঙ্গ পর্বে, যখন ভিন্ন হয়ে ওঠে দুটি লিঙ্গ।
ফ্রয়েড এছাড়াও প্রকাশ করেছেন একটি তথ্য, যার গুরুত্ব এখনো ভালোভাবে অনুধাবন করা হয় নি : সেটা হচ্ছে পুরুষের কাম যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে স্থিত শিশ্নে, সেখানে নারীর রয়েছে দুটি সুস্পষ্ট পৃথক কামসংশ্রয় : একটি ভগাঙ্কুরীয়, যা বিকশিত হয় শৈশবে, আরেকটি যোনীয়, যার বিকাশ ঘটে বয়ঃসন্ধির পর। কোনো ছেলে যখন পৌঁছে তার কামপ্রত্যঙ্গ পর্বে, তখন সম্পূর্ণ হয় তার বিকাশ; তবে তাকে পেরিয়ে যেতে হয় তার স্বতঃকামী প্রবণতা, যাতে সুখ আত্মগত, থেকে বিষমকামী প্রবণতার দিকে, যাতে সুখ জড়িত হয় অন্য কোনো বস্তুর সাথে, যা সাধারণত নারী। বয়ঃসন্ধির কালে একটি আত্মপ্রেমমূলক পর্বের ভেতর দিয়ে ঘটে এ-উত্তরণ। কিন্তু শিশ্ন থাকে, যেমন শৈশবে ছিলো, কামের সুনির্দিষ্ট প্রত্যঙ্গ। নারীর লিবিডোও আত্মপ্রেমমূলক একটি পর্ব পেরিয়ে এগোয় বস্তুর দিকে, সাধারণত পুরুষের দিকে; তবে এ-প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি জটিল, কেননা নারীকে ভগাঙ্কুরীয় সুখ থেকে পৌঁছোতে হয় যোনীয় সুখের দিকে। পুরুষের আছে মাত্র একটি কামপ্রত্যঙ্গ পর্ব, কিন্তু নারীর আছে দুটি; তার একটি বড়ো ঝুঁকি আছে যে সে তার কামবিকাশের শেষ পর্যায়ে নাও পৌঁছোতে পারে, থেকে যেতে পারে শিশুপর্বে, এবং তার মধ্যে দেখা দিতে পারে মনোবিকলন।
স্বতঃকামী পর্বে থাকা অবস্থায় শিশু কমবেশি জড়িত হয় কোনো বস্তুর সাথে। বালক জড়িত হয় তার মায়ের সাথে এবং নিজেকে অভিন্ন করে তুলতে চায় পিতার সাথে; এ-ধৃষ্টতা তাকে ভীত করে, সে ভয় পেতে থাকে যে শাস্তি হিশেবে পিতা। হয়তো তার অঙ্গচ্ছেদ করবে। এভাবে ইডিপাসগূঢ়ৈষা থেকে তার মধ্যে দেখা দেয়। খোজাগূঢ়ৈষা। পিতার প্রতি বাড়ে তার হিংস্রতা, তবে একই সময়ে বালক আত্মস্থ করে নেয় পিতার কর্তৃত্ব; এভাবে বালকের মধ্যে গড়ে ওঠে সুপার ইগো, অধি অহং, যা দমন করে তার অজাচারী প্রবণতা। এগুলো দমিত হয়, গূঢ়ৈষাটি ধ্বংস হয়, এবং পুত্র মুক্তি পায় পিতার ভীতি থেকে। এ-সময় সে নৈতিক উপদেশের সাহায্যে মনের মধ্যে অধিষ্ঠিত করে পিতাকে। সুপার ইগো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, কেননা ইডিপাসগূঢ়ৈষাকে প্রতিরোধ করা হয় কঠোরভাবে।
ফ্রয়েড প্রথমে বালিকার ইতিহাস বর্ণনা করেছেন পুরোপুরি একইভাবে, পরে বিকাশের এ-নারীরূপের নাম দিয়েছেন তিনি ইলেক্টাঢ়ৈষা; তবে এটা স্পষ্ট যে তিনি একে এর নিজের ওপর ভিত্তি করে সংজ্ঞায়িত করার বদলে বর্ণনা করেছেন পুংলিঙ্গের বিন্যাসের অনুকরণে। তিনি এ-দুয়ের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য : বালিকা প্রথমে বোধ করে মায়ের প্রতি সংবন্ধন, কিন্তু বালক কখনোই তার পিতার প্রতি কামানুরাগ বোধ করে না। বালিকার এ সবন্ধন নির্দেশ করে যে তার ভেতরে টিকে আছে মুখ-পর্ব। তারপর বালিকা পিতার সাথে অভিন্ন ভাবতে শুরু করে নিজেকে; তবে পাঁচ বছর বয়সের দিকে সে আবিষ্কার করে দু-লিঙ্গের দেহসংস্থানের পার্থক্য; তার শিশ্ন নেই বলে সে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, এবং অর্জন করে খোজাগূঢ়ৈষাসে কল্পনা করতে থাকে যে তার অঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছে, এবং এ-ভাবনা তাকে পীড়িত করতে থাকে। তখন সে পুরুষসুলভ অভিমান ছেড়ে দিয়ে মায়ের সঙ্গে অভিন্ন করে তোলে নিজেকে এবং কামে প্রলুব্ধ করতে চায় পিতাকে। এভাবে খোজাগূঢ়ৈষা ও ইলেক্টাগূঢ়ৈষা পরস্পরকে করে শক্তিশালী। তার হতাশার অনুভূতি হয় তীব্র, কেননা পিতাকে ভালোবেসে বৃথাই সে চায় পিতার মতো হতে; আবার, তার মনস্তাপ বাড়িয়ে তোলে তার প্রেম, কেননা পিতার ভেতরে জাগিয়ে তোলা প্রীতির সাহায্যেই শুধু সে ক্ষতিপূরণ করতে পারে নিজের নিকৃষ্টতার। ছোটো বালিকা তার মায়ের প্রতি পোষণ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বৈরিতার বোধ। তারপর তার মধ্যেও গড়ে ওঠে সুপার ইগো, দমিত হয় অজাচারী প্রবণতাগুলো; তবে তার সুপার ইগো বেশি শক্তিশালী নয়। তার কামপ্রত্যঙ্গগুলোর বিকাশের মতোই বালিকার সম্পূর্ণ কামনাট্যটি তার ভাইদের থেকে অনেক বেশি জটিল। এর পরিণতিতে সে বিরূপ হয়ে উঠতে পারে খোজাগূঢ়ৈষার প্রতি এবং অস্বীকার করতে পারে তার নারী, ধারাবাহিকভাবে কামনা করতে পারে একটি শিশ্ন, নিজেকে অভিন্ন বোধ করতে পারে পিতার সাথে। এ-প্রবণতা তাকে রেখে দেয় ভগাঙ্কুরীয় পর্বে, তাকে করে তোলে কামশীতল, বা লিপ্ত করতে পারে সমকামে।