আবার এখানে মানবিক পরিস্থিতিকে অন্য কোনো পরিস্থিতিতে পর্যবসিত করা যাবে না; প্রথমত মানুষদের একক ব্যক্তিসত্তারূপে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না; পুরুষেরা ও নারীরা কখনো পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয় নি; যুগলটি হচ্ছে এক আদি মিটজাইন, এক মৌল সমবায়; এবং কোনো বৃহৎ যৌথতায় এটা সব সময়ই দেখা দিয়েছে একটি স্থায়ী বা অস্থায়ী উপাদানরূপে।
এমন এক সমাজে প্রজাতির কাছে কোনটি বেশি দরকারি, পুরুষ না নারী? জননকোষের স্তরে, সঙ্গম ও গর্ভধারণের জৈবিক ভূমিকার স্তরে, আমরা যেমন দেখেছি পুরুষনীতি রক্ষণের জন্যে সৃষ্টি করে, নারীনীতি সৃষ্টির জন্যে রক্ষণ করে; তবে সামাজিক জীবনের বিভিন্ন রূপে এ-শ্রমবিভাজনের বিচিত্র বৈশিষ্ট্য কী? এ-সহযোগিতা চূড়ান্তভাবে অপরিহার্য হয়ে ওঠে সে-প্রজাতিতে, যাতে শাবকেরা দুধ ছাড়ার পর দীর্ঘকাল ধরে নিজেদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে অসমর্থ; এখানে পুরুষটির সহায়তা হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা যে-সব জীবন সে জন্ম দিয়েছে, তাকে ছাড়া সে-সব জীবন রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় না। একটি পুরুষ প্রতিবছর গর্ভবতী করতে পারে অনেকগুলো নারীকে; তবে সন্তানদের জন্মের পর তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে, শক্রদের থেকে তাদের রক্ষা করার জন্যে, তাদের চাহিদা মেটানোর জন্যে প্রকৃতি থেকে সামর্থ্য ছিনিয়ে আনার জন্যে প্রতিটি নারীর দরকার পড়ে একটি পুরুষ।
এভাবে জীববিজ্ঞানের সত্যগুলো আমাদের দেখতে হবে অস্তিত্বের স্বরূপগত, আর্থনীতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবেশের আলোকে। প্রজাতির কাছে নারীকে দাসত্বে বন্দী করা আর ভারসক্তির নানা রকম সীমাবদ্ধতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য; নারীর শরীর পৃথিবীতে তার পরিস্থিতির মধ্যে একটি অত্যাবশ্যক উপাদান। তবে তাকে নারী হিশেবে সজ্ঞায়িত করার জন্যে তার শরীরই যথেষ্ট নয়; একজন সচেতন ব্যক্তি তার নিজের কাজের ভেতর দিয়ে যা প্রকাশ করে, তা ছাড়া আর কোনো সত্যিকার জীবন্ত বাস্তবতা নেই। আমাদের সামনে যে-প্রশ্নটি : নারী কেনো অপর?, তার উত্তর দেয়ার জন্যে জীববিজ্ঞান যথেষ্ট নয়। আমাদের দায়িত্ব কীভাবে। ইতিহাসব্যাপী নিয়ন্ত্রিত হয়েছে নারীর প্রকৃতি, তা আবিষ্কার করা; আমাদের খুঁজে বের করার বিষয় হচ্ছে মানবজাতি কী করে তুলেছে নারীকে।
মনোবিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ
মনোবিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ
প্রথম খণ্ড । ভাগ ১ – নিয়তি । পরিচ্ছেদ ২
মনোদেহতত্ত্বের থেকে মনোবিশ্লেষণ যে প্রচণ্ড অগ্রগতি লাভ করেছে তা এ-দৃষ্টিতে যে মানবিক তাৎপর্য গ্রহণ না করে কোনো কারণই মানসিক জীবনে জড়িত হয় না; জীববিজ্ঞানীরা যে-দেহ-বস্তু বর্ণনা করেন, তা যে আসলেই অস্তিত্বশীল, এমন নয়, আছে সেই দেহটি বিষয়ী যা যাপন করে। নারী ততোখানি নারী যতোখানি সে নিজেকে নারী মনে করে। তার আছে জৈবিকভাবে অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্য, তবে সেগুলো তার সত্য, অভিজ্ঞ পরিস্থিতির অংশ নয় : তাই এতে প্রতিফলিত হয় না ডিমের গঠন, বরং জৈবিকভাবে বিশেষ গুরুতপূর্ণ নয় এমন একটি প্র্ত্যঙ্গ, যেমন ভগাঙ্কুর, এতে পালন করে প্রধান পর্যায়ের ভূমিকা। প্রকৃতি নারীকে সংজ্ঞায়িত করে না; তার আবেগগত জীবনে প্রকৃতির সাথে নিজের মতো করে কাজ করতে গিয়ে সে নিজেই সংজ্ঞায়িত করে নিজেকে।
এ-পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে একটি সম্পূর্ণ সংশ্রয়, যার পুরোটাকে আমি সমালোচনা করতে চাই না, শুধু দেখতে চাই নারীবিশ্লেষণে এর অবদানটুকু। মনোবিশ্লেষণবিদ্যাকে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা সহজ কাজ নয়। সব ধর্মের মতোই–যেমন খ্রিস্টধর্ম বা মার্কবাদ–কিছু অনড় ধারণার ভিত্তির ওপর এটা প্রদর্শন করে থাকে এক বিব্রতকর নমনীয়তা। বহু শব্দ অনেক সময় ব্যবহৃত হয় চরম আক্ষরিক অর্থে, যেমন ফ্যালাস (শিশ্ন) শব্দটি বুঝিয়ে থাকে মাংসের সে-উত্থান, যা নির্দেশ করে পুরুষকে; তারপর এগুলোকে সম্প্রসারিত করা হয় সীমাহীনভাবে এবং দেয়া হয়। প্রতীকী অর্থ, তাই শিশ্ন এখন বুঝিয়ে থাকে পৌরুষ ও তার পরিস্থিতি। যদি আপনি এ-মতবাদকে আক্রমণ করেন, তাহলে মনোবিশ্লেষক প্রতিবাদ করেন যে আপনি ভুল বুঝেছেন এর মূলচেতনাকে; আর আপনি যদি প্রশংসা করেন এর মূলচেতনার, তাহলে তিনি তৎক্ষণাৎ আপনাকে বন্দী করতে চান ওই মতবাদে। মতবাদের কোনো গুরুত্ব নেই, কেউ কেউ বলেন, মনোবিশ্লেণ হচ্ছে একটি পদ্ধতি; কিন্তু পদ্ধতির সাফল্য মতবাদীর বিশ্বাসকে দৃঢ়তর করে তোলে। সব সত্ত্বেও কোথায় পাওয়া যাবে মনোবিশ্লেষণের প্রকৃত মুখাবয়ব যদি না পাওয়া যায় মনোবিশ্লেষকদের মধ্যে? কিন্তু এঁদের মধ্যেও আছেন বিরুদ্ধ মতাবলম্বী, যেমন আছেন খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ও মার্ক্সবাদীদের মধ্যে; এবং একাধিক মনোবিশ্লেষক ঘোষণা করেছেন মনোবিশ্লেষণের নিকৃষ্টতম শত্রু হচ্ছে মনোবিশ্লেষকেরা। মধ্যযুগীয় বিদ্যাধর্মীয় যথাযথতা সত্ত্বেও যা প্রায়ই হয়ে ওঠে পণ্ডিতিসুলভ, রয়ে যায় বহু অস্পষ্টতা, যেগুলো দূর করা দরকার। সার্ত্র ও মারলিউ-পোন্তি যেমন লক্ষ্য করেছেন যে যৌনতা অস্তিত্বের সাথে সমবিস্তৃত, এ-প্রস্তাবটিকে দুটি অত্যন্ত ভিন্ন উপায়ে বোঝা সম্ভব; এটা বোঝাতে পারে যে অস্তিত্বশীলের প্রতিটি অভিজ্ঞতারই রয়েছে একটি যৌন তাৎপর্য, বা প্রতিটি যৌন প্রপঞ্চেরই আছে একটি আস্তিত্বিক তাৎপর্য। এ-দুটি বিবৃতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব, তবে প্রায়ই আমরা একটি থেকে পিছলে গিয়ে পড়ি আরেকটিতে। এছাড়াও, যখনই যৌনকে ভিন্ন করা হয় যৌনাঙ্গীয় থেকে, তখনই যৌনতার ধারণাটি হয়ে ওঠে খুবই অস্পষ্ট।