কিছু বস্তুবাদী পণ্ডিতপ্রবর সমস্যাটি আলোচনা করেছেন বিশুদ্ধ অনড় রীতিতে; মনোদৈহিক সমান্তরলতার তত্ত্ব দিয়ে প্রভাবিত হয়ে তাঁরা পুরুষ ও নারী প্রাণীসত্তার মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন গাণিতিক তুলনা–এবং তাঁরা কল্পনা করেছেন যে এসব পরিমাপ সরাসরিভাবে নির্দেশ করে দুটি লিঙ্গের ভূমিকাগত সামর্থ্য। উদাহরণস্বরূপ, পুরুষ ও নারীর মস্তিষ্কের ধ্রুব ও আপেক্ষিক ওজন সম্পর্কে বিস্তৃত তুচ্ছ আলোচনায় নিয়োজিত থেকেছে এসর ছাত্র–সব কিছু সংশোধনের পর পৌঁচেছে অসিদ্ধান্তমূলক ফলাফলে। তবে যা ঐসব সতর্ক গবেষণার আকর্ষণীয়তা নষ্ট করে, তা হচ্ছে মস্তিষ্কের ওজন ও বুদ্ধিমত্তার মাত্রার মধ্যে কোনো রকম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি। এবং পুরুষ ও নারী হরমোনের রাসায়নিক সূত্রের মানসিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়েও একই রকমে হতবুদ্ধি হতে হয়।
এ-পর্যেষণায় আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করি মনোদৈহিক সমান্তরলতার ধারণা, কেননা এটা এমন এক মতাদর্শ যার ভিত্তিমূলকে দীর্ঘকাল ধরে পুরোপুরিভাবে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি যে আদৌ এর উল্লেখ করছি, তার কারণ হচ্ছে এর দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দেউলেত্ব সত্ত্বেও আজো অনেকের মনে এটা প্রেতের মতো আনাগোনা করে। আমি সে-সব তুলনামূলক সংশ্রয়কেও প্রত্যাখ্যান করি, যেগুলো ধরে নেয় যে মূল্যবোধের আছে একটা প্রাকৃতিক স্তরক্ৰম বা মানদণ্ড–যেমন, একটা বিবর্তনমূলক স্তরক্রম। নারীশরীর কি পুরুষের শরীরের থেকে অধিকতর বালধর্মী বা বালধর্মী নয়, এটা কি কম-বেশি বানরের দেহের সদৃশ ইত্যাদি জিজ্ঞেস করা নিরর্থক এসব নিবন্ধ, যেগুলো একটা অস্পষ্ট প্রাকৃতবাদকে মিশ্রিত করে আরো অস্পষ্ট কোনো নীতিশাস্ত্র বা নন্দনতত্ত্বের সাথে, সেগুলো খাঁটি শব্দবাচালতা মাত্র। মানবপ্রজাতির নারী ও পুরুষের মধ্যে আমরা তুলনা করতে পারি শুধু মানবিক পরিপ্রেক্ষিতে। তবে পুরুষের সংজ্ঞা দেয়া হয় এমন একজনরূপে, যে চিরস্থির নয়, সে তা যা সে সৃষ্টি করে নিজেকে। মারলিউ-পোন্তি যথার্থই বলেছেন যে মানুষ কোনো প্রাকৃতিক প্রজাতি নয় : সে একটি ঐতিহাসিক ধারণা। নারী কোনো পরিসমাপ্ত বাস্তবতা নয়, বরং সে এক হয়ে ওঠা, এবং তার হয়ে ওঠার সাথেই তুলনা করতে হবে পুরুষকে; অর্থাৎ সংজ্ঞায়িত করতে হবে তার সম্ভাবনারাশিকে।
তবু এটা বলা হবে যে শরীর যদি কোনো বস্তু নাও হয়, তবে এটা একটি পরিস্থিতি, আমি আলোচনায় নিয়েছি এ-দৃষ্টিভঙ্গিই–হাইডেগার, সাত্র, ও মারলিউপোন্তির দৃষ্টিভঙ্গি : এটা বিশ্বের ওপর আমাদের অধিকার বিস্তারের হাতিয়ার, আমাদের প্রকল্পের জন্যে এটা একটি সীমাবদ্ধকর উপাদান। নারী পুরুষের থেকে দুর্বল, তার পেশিশক্তি কম, তার লাল রক্তকণা কম, ফুসফুসের শক্তি কম, সে। দৌড়োয় পুরুষের থেকে ধীরে, তুলতে পারে কম ওজন, পুরুষের সাথে কোনো খেলায়ই পেরে ওঠে না; সে পুরুষের সাথে মারামারিতে পারে না। এসব দুর্বলতার সাথে যোগ করতে হবে তার অস্থিতিশীলতাকে, তার নিয়ন্ত্রণের অশক্তি, এবং তার ভঙ্গুরতা : এগুলো সত্য। পৃথিবীর ওপর তার অধিকার তাই সীমিত; কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যে তার দৃঢ়তা কম ও স্থিরতা কম, তাই সাধারণত সে ওগুলো বাস্তবায়নের জন্যে কম সামর্থ্যসম্পন্ন। অন্যভাবে বলা যায় যে পুরুষের তুলনায় তার ব্যক্তিজীবন কম ঐশ্বর্যপূর্ণ।
নিশ্চয়ই এসব সত্য অস্বীকার করা যায় না–তবে এগুলোর নেই কোনো বিশেষ তাৎপর্য। একবার যদি আমরা গ্রহণ করি মানবিক পরিপ্রেক্ষিত, শরীরকে ব্যাখ্যা করি অস্তিত্বের ভিত্তিতে, তাহলে জীববিজ্ঞান হয়ে ওঠে এক বিমূর্ত বিজ্ঞান; যখন। শারীরবৃত্তিক তথ্য (উদাহরণস্বরূপ, পেশীয় নিকৃষ্টতা) অর্থ গ্রহণ করে, তখন এ-অর্থকে দেখা হয় সম্পূর্ণ পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল বলে; এ-দুর্বলতা প্রকাশ পায় শুধু পুরুষ কোন লক্ষ্য নিশে করছে, তার আছে কী কী হাতিয়ার, এবং সে কী বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করছে, তার আলোকে। যদি সে বিশ্বকে অধিকার করতে না চায়, তাহলে বস্তুর ওপর অধিকারের ধারণার কোনো তাৎপর্য থাকে না; এ-অধিকারের কাজে যখন নূ্যনতম বলের থেকে বেশি শারীরিক বলের সম্পূর্ণ প্রয়োগ দরকার হয় না, তখন বলের পার্থক্যগুলো বাতিল হয়ে যায়; যেখানে হিংস্রতা রীতিবিরোধী, সেখানে পেশিশক্তি আধিপত্যের ভিত্তি হতে পারে না। সংক্ষেপে দুর্বলতার ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে শুধু অস্তিত্ব, অর্থনীতি ও নৈতিক বিবেচনা অনুসারে। বলা হয়েছে যে মানবপ্রজাতিটি অ-প্রাকৃতিক, এটা ঠিক মন্তব্য নয়, কেননা মানুষ সত্য অস্বীকার করতে পারে না; তবে সে যেভাবে তাদের সাথে আচরণ করে সে-অনুসারেই প্রতিষ্ঠা করে তাদের সত্য : তার কাজের মধ্যে প্রকৃতি যতোখানি জড়িত প্রকৃতি তার কাছে ততোখানি বাস্তব–বাদ দেয়া হচ্ছে না এমনকি তার নিজের প্রকৃতিকেও। নিজের প্রজাতির কাছে নারীর দাসত্ব কম-বেশি প্রচণ্ড, সেটা ঘটে সমাজ তার কাছে কতোগুলো সন্তানপ্রসব চায়, সে-অনুসারে। উচ্চস্তরের পশুদের বেলা এটা সত্য যে ব্যক্তিগত অস্তিত্বের ব্যাপারটি স্ত্রীলিঙ্গের থেকে পুংলিঙ্গের পশুটিই জ্ঞাপন করে প্রবলতরভাবে, কিন্তু মানবপ্রজাতিতে ব্যক্তির সম্ভাবনা নির্ভর করে আর্থনীতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ওপর।