পরিশেষে নারী তার প্রজাতির লৌহমুষ্টি থেকে মুক্তি পায় আরেক গুরুতর সংকটের মধ্য দিয়ে : সেটি হচ্ছে ঋতুবন্ধ, বয়ঃসন্ধির যা বিপ্রতীপ, যা দেখা দেয় পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যে। কমতে কমতে থেমে যায় ডিম্বাশয়ের ক্রিয়াকলাপ, যার ফলে হ্রাস পায় নারীটির জীবনশক্তি। দেখা দেয় উত্তেজনার নানা চিহ্ন, যেমন, উচ্চ রক্তচাপ, মুখের হঠাৎ তপ্ত রক্তিমাভা, বিচলন, এবং কখনো কখনো কামাবেগ বৃদ্ধি। অনেক নারীর শরীরে এ-সময় বাড়ে মেদ; অনেকে হয়ে ওঠে পুরুষধর্মী। অনেকের মধ্যে স্থাপিত হয় এক নতুন অন্তঃক্ষরণের ভারসাম্য। নারী এখন মুক্তি পায় তার নারীপ্রকৃতি কর্তৃক তার ওপর চাপিয়ে দেয়া দাসত্ব থেকে, কিন্তু তাকে খোজার সাথে তুলনা করা যায় না, কেননা তার জীবনশক্তি নষ্ট হয়ে যায় নি। তাছাড়াও, সে আর শিকার নয় বিপর্যয়কর শক্তিরাশির; সে হচ্ছে নিজে, সে আর তার শরীর এখন। অভিন্ন। কখনো কখনো বলা হয় যে বিশেষ বয়সে নারী হয়ে ওঠে একটি তৃতীয় লিঙ্গ’; এবং সত্য হচ্ছে এ-সময়ে তারা পুরুষ না হলেও তারা আর নারীও নয়। নারীশারীরবৃত্ত থেকে এ-মুক্তি কখনো কখনো প্রকাশ পায় তার স্বাস্থ্যে, ভারসাম্যে, বলিষ্ঠতায়, যা আগে তার ছিলো না।
প্রধান লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলো ছাড়াও নারীর আছে কতকগুলো অপ্রধান লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য, যা হরমোনের ক্রিয়ার ফলে প্রত্যক্ষভাবে কিছুটা কম-বেশি প্রথমটিরই। পরিণতি। সাধারণত নারী পুরুষের থেকে খাটো ও কম ভারি, তার কঙ্কাল অনেক বেশি ভঙ্গুর, এবং গর্ভধারণ ও প্রসবের প্রয়োজনে শ্রোণীদেশ বৃহত্তর; তার সংযোগী কলাতন্তুরাশি জমায় বেশি মেদ আর তার দেহরেখা পুরুষের থেকে বেশি গোলগাল। সাধারণভাবে আকৃতি গঠন, ত্বক, চুল–দু-লিঙ্গে স্পষ্টভাবে ভিন্ন। নারীর মধ্যে পেশিশক্তি অনেক কম, প্রায় পুরুষের তিন ভাগের দু-ভাগ, ফুসফুল ও শ্বাসনালি ছোটো বলে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শক্তিও কম। তার স্বরযন্ত্র তুলনামূলকভাবে ছোটো, এর ফলে নারীর কণ্ঠস্বর উচ্চ। নারীর রক্তের আপেক্ষিক গুরুত্ব কম এবং তাতে হিমোগ্লোবিন, লাল কণিকা, কম; তাই নারীরা কম বলিষ্ঠ এবং পুরুষের থেকে বেশি ভোগে রক্তাল্পতায়। তাদের ধমনীর স্পন্দন বেশি দ্রুত, তাদের সংবহনতন্ত্র কম সুস্থিত, তাই সহজেই গাল রাঙা হয়ে ওঠে, সাধারণভাবে অস্থিতিশীলতা নারীর সংস্থানের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এ-সুস্থিতি ও নিয়ন্ত্রণের অভাবই রয়েছে নারীর আবেগপরায়ণতার মূলে, যা জড়িয়ে আছে তার রক্তসংবহনের ওঠানামার সাথে–হৎপিণ্ডের কম্পন, গাল রঙ দুওেঠা ইত্যাদি–আর এজন্যেই নারী দেখিয়ে থাকে নানা উত্তেজনা, যেমন অশ্রুপাত, উন্মত্ত হাস্য, এবং নানা স্নায়বিক সংকট।
চারিত্রিক এসব বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলোই উদ্ভূত হয় নিজের প্রজাতির কাছে নারীর অধীনতার কারণে; এবং এখানেই আমরা পাই এ-জরিপের সবচেয়ে চমকপ্রদ উপসংহার : উদাহরণস্বরূপ, নারী সব স্তন্যপায়ী স্ত্রীলিঙ্গের মধ্যে এমন একজন, যে সবচেয়ে গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন (তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বাহ্যিক শক্তির শিকার), এবং যে এবিচ্ছিন্নবোধকে প্রতিরোধ করে সবচেয়ে প্রচণ্ডভাবে; আর কারো মধ্যেই প্রজননের কাছে দাসত্বের ব্যাপারটি এতো বেশি কর্তৃত্বব্যঞ্জক নয় বা আর কেউ এতো অনিচ্ছায় গ্রহণ করে না একে। বয়ঃসন্ধি ও ঋতুবন্ধের সংকট, মাসিক অভিশাপ’, দীর্ঘ ও অনেক সময় কষ্টকর গর্ভধারণ, বেদনাদায়ক ও অনেক সময় ভয়ঙ্কর সন্তানপ্রসব, অসুখ, অপ্রত্যাশিত রোগের লক্ষণ ও জটিলতা–এসব হচ্ছে মানব স্ত্রীলিঙ্গের বৈশিষ্ট্য। তার সাথে তুলনায় পুরুষ পেয়েছে অসীম সুবিধা : ব্যক্তি হিশেবে তার কামজীবন তার অস্তিত্বের বিরোধী নয়, এবং জৈবিকভাবে এর বিকাশ নিয়মিত, এর কোনো সংকট নেই এবং সাধারণত নেই কোনো দুর্ঘটনা। গড়ে নারী বাঁচে পুরুষেরই সমান, বা বেশি; কিন্তু তারা অসুস্থ থাকে বেশি, এবং অনেক সময় তাদের নিজেদের ওপর থাকে না তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ।
এ-জৈবিক ব্যাপারগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীর ইতিহাসে এগুলো পালন করে প্রধান ভূমিকা এবং হয়ে ওঠে তার পরিস্থিতির এক অত্যাবশ্যক উপাদান। আমাদের পরবর্তী আলোচনা ভ’রে এগুলোকে আমরা সব সময় মনে রাখবো। কেননা, শরীর যেহেতু বিশ্বকে উপলব্ধি করার জন্যে আমাদের হাতিয়ার, তাই বিশ্বকে এক ধরনে উপলব্ধি করলে যেমন মনে হবে অন্য ধরনে উপলব্ধি করলে মনে হবে খুবই ভিন্ন জিনিশ বলে। এজন্যেই আমরা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি জৈবিক সত্যগুলো; এগুলো নারীকে বোঝার অন্যতম চাবি। তবে আমি স্বীকার করি না যে এগুলো তার জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছে এক চিরস্থির ও অবধারিত নিয়তি। কোনো লৈঙ্গিক স্তরক্রম সৃষ্টির জন্যে এগুলো যথেষ্ট নয়; এগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে না নারী কেননা অপর; এগুলো নারীকে চিরকালের জন্যে অধীন ভূমিকায় থাকার দণ্ডে দণ্ডিত করে না।
মাঝেমাঝেই মনে করা হয়েছে যে শুধু শরীরসংগঠনেই খুঁজতে হবে এসব প্রশ্নের উত্তর : দু-লিঙ্গেরই কি ব্যক্তিগত সাফল্যের সুযোগ সমান? প্রজাতির মধ্যে কোনটি পালন করে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা? তবে মনে রাখতে হবে যে এসব পার্থক্যের মধ্যে প্রথমগুলো অন্যান্য স্ত্রীলিঙ্গের সাথে তুলনায় অনেক ভিন্ন নারীর বেলা; পশু প্রজাতিতে এগুলো স্থির এবং তাদের চিরস্থিরতার ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়–শুধু পর্যবেক্ষণ সংকলন করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারি অশ্বী অশ্বের সমান দ্রুতগামী কি না, বা বুদ্ধির পরীক্ষায় পুরুষ শিম্পাঞ্জি ছাড়িয়ে যায় কি না তাদের স্ত্রীলিঙ্গদের–কিন্তু মানবপ্রজাতি চিরকাল ধরে আছে পরিবর্তনশীল অবস্থায়, হয়ে উঠছে চিরকাল ধরে।