যখন তার সমস্ত চমৎকারিত্ব নিয়ে দেখা দেয় ‘মোহিনী নারী’, সে তখন অনেক বেশি পরমানন্দদায়ক বস্তু ওইসব ‘নির্বোধ চিত্রকলা, তোরণ, দৃশ্য, বিনোেদনকারীর চটকালো সংকেত, জনপ্রিয় অবিকল নকল চিত্র’-এর থেকে, যা উত্তেজিত করেছে। রাববাকে; অতিশয়আধুনিক দক্ষতায় ভূষিত হয়ে নতুনতম কৌশলে প্রসাধিত হয়ে, সে আসে সুদূর যুগযুগান্ত থেকে, থিবি থেকে, ক্রিট থেকে, শিশেন-ইটজা থেকে; এবং সে আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত টোটেমও; সে হেলিকপ্টার এবং সে পাখি; এবং এখানে আছে সব বিস্ময়ের শ্রেষ্ঠ বিস্ময় : তার ছোপলাগানো কেশরাজির নিচে আরণ্যক গুঞ্জন হয়ে ওঠে চিন্তা, এবং তার স্তনযুগল থেকে উৎসারিত হয় শব্দমালা। পুরুষেরা লোলুপ হাত বাড়ায় এ-বিস্ময়ের দিকে, কিন্তু যখন তারা এটি আঁকড়ে ধরে, তখনই এটি বিলীন হয়ে যায়; স্ত্রী, দয়িতা অন্য সকলের মতোই কথা বলে তাদের মুখ দিয়ে : তাদের কথার মূল্য তা-ই, যা ওগুলোর মূল্য; তাদের স্তনযুগলেরও। এমন একটি পলাতক অলৌকিকত্ব এবং যা এতোই দুর্লভ–তা কি ন্যায়সঙ্গতভাবে আমাদের দিয়ে চিরস্থায়ী করাতে পারে এমন একটি পরিস্থিতি, যা উভয় লিঙ্গের জন্যেই অশুভ? আমরা উপভোগ করতে পারি পুষ্পের সৌন্দর্য, নারীর মোহনীয়তা, এবং তাদের প্রকৃত গুণের জন্যে দিতে পারি প্রভূত মূল্য; যদি এসব সম্পদ রক্তপাত বা দুর্দশা ঘটায়, তাহলে ওগুলোকে বলি দিতেই হবে।
প্রথম স্থানে, পুরুষ ও নারীর মধ্যে সব সময়ই থাকবে বিশেষ কিছু পার্থক্য; নারীর কামের, তাই তার কামের জগতের, থাকবে একটি বিশেষ নিজস্ব রূপ এবং তাই এটা এক বিশেষ প্রকৃতির ইন্দ্রিয়পরায়ণতার, সংবেদনশীলতার কারণ না হয়ে পারে না। এর অর্থ হচ্ছে তার নিজের শরীরের সাথে, পুরুষটির সাথে, শিশুটির সাথে তার সম্পর্ক কখনোই অভিন্ন হবে না তার সাথে, পুরুষটি যা বোধ করে তার শরীরের সাথে, নারীটির সাথে, এবং শিশুটির সাথে যারা ভিন্নতার মধ্যে সাম্যকে বড়ো করে তোলে তারা স্বেচ্ছায় আমার কাছে সাম্যের মধ্যে ভিন্নতা থাকার সম্ভবপরতা স্বীকার না করে পারে নি। তারপর আবার, প্রতিষ্ঠানগুলোই সৃষ্টি করে অসাম্য। হারেমের ক্রীতদাসীরা, যুবতী ও রূপসী, সুলতানের আলিঙ্গনের ভেতরে তারা সবাই অভিন্ন; খ্রিস্টধর্ম যখন একটি নারীকে অধিকারী করেছে একটি আত্মার, তখন কামকে দিয়েছে পাপের ও কিংবদন্তির স্বাদগন্ধ; সমাজ নারীকে তার সার্বভৌম ব্যক্তিতা ফিরিয়ে দিলে ধ্বংস হবে না হৃদয়কে আলোড়িত করার জন্যে প্রেমের আলিঙ্গনের শক্তি।
পুরুষ ও নারী বাস্তব ব্যাপারগুলোতে সমান হলে সম্ভব হবে না হৈচৈ করে আনন্দোপতভাগ, পাপ, পরমমাল্লাসমত্ততা, সংরাগ, একথা বলা আহাম্মকি; চৈতন্যের বিপরীতে দেহ, মহাকালের বিপরীতে মুহুর্ত, সীমাতিক্ৰমণতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিপরীতে সীমাবদ্ধতার মূর্ছা, বিস্মৃতির শূন্যতার বিপরীতে পরমানন্দের বিরোধের কখনো। মীমাংসা হবে না; কামের মধ্যে চিরকালই থাকবে স্নায়বিক চাপ, তীব্র মানসিক যন্ত্রণা, আনন্দ, হতাশা, ও অস্তিত্বের বিজয়োল্লাস। নারীকে মুক্ত করা হচ্ছে পুরুষের সাথে সে বহন করে যে-সব সম্পর্ক, সেগুলোতে আটকে থাকাকে অস্বীকার করা, তার সাথে ওই সম্পর্কগুলোকে অস্বীকার করা নয়; তাকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে দাও, তাহলে সে বেঁচে থাকবে পুরুষের জন্যেও : পরস্পরকে কর্তারূপে মেনে নিয়ে তারা প্রত্যেকে অপরের জন্যে হয়ে থাকবে অপর। তাদের সম্পর্কের পারস্পরিকতা নষ্ট করবে না ওই অলৌকিকতাগুলোকে কামনা, অধিকার, প্রেম, স্বপ্ন, রোমাঞ্চকে, যেগুলো তৈরি করা হয়েছিলো মানুষকে দুটি ভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে; এবং যে-সব শব্দ আলোড়িত করে আমাদের দান, জয়, মিলন–হারাবে না তাদের অর্থ। বরং এর বিপরীতে, যখন আমরালোপ করবো মানবমণ্ডলির অর্ধেকের দাসত্ব, এবং তার সাথে লোপ করবো তার অন্তর্নিহিত ভণ্ডামো, তখনই মানবমন্ডলির ‘বিভাজন’ প্রকাশ করবে তার শুদ্ধ তাৎপর্য এবং মানব-যুগল পাবে তার সত্যিকার রূপ। ‘মানবপ্রাণীর প্রত্যক্ষ, স্বাভাবিক, আবশ্যিক সম্পর্ক হচ্ছে নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্ক’, বলেছেন মার্ক্স। ‘এ-সম্পর্কের প্রকৃতিই স্থির করে কতো দূর পর্যন্ত পুরুষ নিজে গণ্য হবে একটি গোষ্ঠিগত সত্তা হিশেবে, মানবরূপে, নারীর সঙ্গে পুরুষের সম্পর্ক হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে স্বাভাবিক সম্পর্ক। এটা দিয়েই, সুতরাং, প্রদর্শিত হয়। পুরুষের স্বাভাবিক আচরণ হয়ে উঠেছে কতো দূর মানবিক বা কতো দূর পর্যন্ত মানবিক সত্তা হয়ে উঠেছে তার স্বাভাবিক সত্তা, কতো দূর পর্যন্ত মানবিক স্বভাব হয়ে উঠেছে তার স্বভাব’।
বিষয়টি এর থেকে আর ভালোভাবে বিবৃত করা সম্ভব নয়। পুরুষকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিদ্যমান বিশ্বের মাঝে মুক্তির রাজত্ব। পরম বিজয় লাভের জন্যে, এক দিকে, এটা দরকার যে পুরুষ ও নারীরা তাদের প্রাকৃতিক পার্থক্যকরণের সাহায্যে ও মাধ্যমে দৃঢ়তার সাথে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করবে তাদের ভ্রাতৃত্ববোধ।