নারী কোনো রহস্যময় নিয়তির শিকার নয়; যে-সব বিশিষ্টতা তাকে নির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করে নারী বলে সেগুলোর ওপর আরোপ করা হয় যে-তাৎপর্য, তারই জন্যে গুরুত্ব লাভ করে সেগুলো। অদূর ভবিষ্যতে যখন এগুলোকে বিচার করা হবে নতুন প্রেক্ষিতে, তখন ঐলোকাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। তাই, আমরা যেমন দেখেছি, তার কামের অভিজ্ঞতার ভেতরে নারী বোধ করে এবং প্রায়ই তীব্রভাবে ঘৃণা করেপুরুষের আধিপত্য; তবে এজন্যে কিছুতেই সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারি না যে তার ডিম্বাশয় তাকে দণ্ডিত করে চিরকাল নতজানু অবস্থায়বেঁচে থাকায়। পুরুষধর্মী আক্রমণাত্মকতাকে একটা প্রভুসুলভ সুবিধা বলে মনে হয় শুধু সে-সংয়ে, যেটি সার্বিক চক্রান্ত চালায় পুরুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে; এবং যৌনকর্মে নারী নিজেকে গভীরভাবে অক্রিয় বোধ করে শুধু এ-কারণে যে সে আগে থেকেই নিজেকে এমন মনে করে। বহু আধুনিক নারী, যারা মর্যাদা বোধ করে মানুষ হিশেবে, তারা এখনো তাদের কামজীবনকে দেখে দাসপ্রথার দৃষ্টিকোণ থেকে : একটি পুরুষের নিচে শোয়া, তার দ্বারা বিদ্ধ হওয়া তাদের কাছে অবমাননাকর মনে হয় বলে তারা হয়ে ওঠে কামশীতল। কিন্তু বাস্তবতাটি যদি ভিন্ন হতো, তাহলে কামের ভঙ্গি ও আসনের দ্যোতিত প্রতীকী অর্থও হতো ভিন্ন; উদাহরণস্বরূপ, যে-নারী টাকা দেয় তার প্রেমিককে ও আধিপত্য করে তার ওপর, সে গর্ববোেধ করে তার চমৎকার আলস্যে এবং মনে করে সে ক্রীতদাস করে তুলেছে পুরুষটিকে, যে খাটিয়ে চলছে নিজেকে। এবং এখনই আছে বহু ভারসাম্যপূর্ণ যুগল, জয় ও পরাজয় সম্পর্কে যাদের ধারণার স্থানে দেখা দিচ্ছে বিনিময়ের ধারণা।
বাস্তবিকপক্ষে, পুরুষ, নারীর মতোই, মাংস, সুতরাং অক্রিয়, তার হরমোন ও প্রজাতির ক্রীড়নক, তার কামনার অস্থির শিকার। এবং নারী, পুরুষের মতোই, রক্তমাংসের জুরের মধ্যে, একটি সম্মতিদাত্রী, একটি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত দান, একটি কর্ম; তাদের বিচিত্র রীতিতে তারা যাপন করে অস্তিত্বের এ-অদ্ভুত দ্ব্যর্থতা, যা রূপ নিয়েছে শরীরের। ওই সমস্ত দ্বৈরথে, যাতে তারা পরস্পরের মুখখামুখি হয় বলে মনে করে, তাতে আসলে তারা প্রত্যেকে সংগ্রাম করে নিজের বিরুদ্ধে, তাদের নিজের যেঅংশটিকে তারা নিজের বলে অস্বীকার করে, সেটিকে তারা প্রক্ষেপ করে সঙ্গীটির ওপর; তাদের পরিস্থিতির দ্বৈততাগুলো যাপন করার বদলে, তারা একে অন্যকে বাধ্য। করে হীনতা বইতে এবং চেষ্টা করে সম্মানটুকু নিজের জন্যে রাখতে। তবে উভয়েই যদি এ-দ্ব্যর্থতার ভার নিতো বিচক্ষণ সংযমের সাথে, একটি সত্যিকার গর্বের সাথে, যা পরস্পরসম্পর্কযুক্ত, তাহলে পরস্পরকে দেখতে সমান হিশেবে এবং তাদের কামের নাটক যাপন করতো বন্ধুতাপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে। আমরা যে মানুষ এটা নিরতিশয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ যে-সব বিশিষ্টতার থেকে, যা মানুষকে পরস্পরের থেকে পৃথক করে রাখে; বিদ্যমানতা কখনোই শ্রেষ্ঠত্বসমূহ দান করে না; ‘সদগুণ’, প্রাচীনেরা একে যেমন নাম দিতেন, সংজ্ঞায়িত হয় ‘যা আমাদের ওপর নির্ভরশীল’, তার স্তরে। উভয়লিঙ্গের মধ্যেই অভিনীত হচ্ছে মাংস ও চেতনার, সসীমতা ও সীমাতিক্ৰমণতার একই নাটক; উভয়ই ক্ষয় হচ্ছে সময় দিয়ে এবং অপেক্ষা করছে মৃত্যুর, তাদের উভয়েরই আছে পরস্পরের জন্যে একই অপরিহার্য আবশ্যকতা; এবং তাদের স্বাধীনতা থেকে তারা লাভ করতে পারে একই গৌরব। যদি তারা এর স্বাদ নিতে চাইতো, তাহলে তারা আর বিভ্রান্তিকর বিশেষাধিকার নিয়ে বিতর্কে প্ররোচিত হতো না, এবং তাদের মধ্যে দেখা দিতো ভ্রাতৃত্ব্যবোধ।
আমাকে বলা হবে এসবই ইউটোপীয় অলীক কল্পনা, কেননা নারী রূপান্তরিত হতে পারে না যদি না সমাজ প্রথমে নারীকে প্রকৃতভাবে পুরুষের সমান করে তোলে। এমন পরিস্থিতিতে রক্ষণশীলেরা কখনো সে-দুষ্টচক্রের শরণ নিতে ভুল করে নি; ইতিহাস, অবশ্য, চক্রাকারে ঘোরে না। একটি জাতকে যদি হীনতার অবস্থায় রাখা হয়, সন্দেহ নেই সেটি থাকে হীনতার অবস্থায়ই; তবে স্বাধীনতা ওই চক্রটি ভাঙতে পারে। নিগ্রোদের ভোটাধিকার দাও, তাহলে তারা ভোটাধিকারের উপযুক্ত হয়ে উঠবে; নারীকে দায়িত্বভার দেয়া হোক এবং সেও পালন করতে পারবে। সেগুলো। সত্য হচ্ছে যে উৎপীড়নকারীদের কাছে বিনামূল্যে মহত্ত্ব প্রত্যাশা করা যায়; তবে এক সময় উৎপীড়িতদের বিদ্রোহ, আরেক সময় বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত জাতটির নিজের বিবর্তন, নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে; তাই পুরুষেরা নিজের স্বার্থে নবীদের আংশিক মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে : নারীদের দায়িত্ব ওই সমুথান চালিয়ে যাওয়া, এবং তারা যে-সাফল্য অর্জন করছে এটা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে তা-ই তাদের জন্যে একটি উৎসাহ। এটা প্রায় নিশ্চিত যে আজই হোক বা কালই হোক তারা পুরোপুরি আর্থনীতিক ও সামাজিক সাম্যেপৌছোবে, যা ঘটাবে একটা আন্তর রূপান্তর।
তবে তা যা-ই হোক, কেউ কেউ যুক্তি দেখাবে যে এমন একটি বিশ্ব সম্ভবপর হলেও কাম্য হতে পারে না। যদি নারী ‘একই সমান’ হয় তার পুরুষের, তাহলে জীবন হারিয়ে ফেলবে তার স্বাদ ও গন্ধ। এ-যুক্তিও তার অভিনবত্ব হারিয়ে ফেলেছে : যারা বর্তমান অবস্থা চিরস্থায়ী করে রাখতে আগ্রহী, তারা সব সময়ই নবভবিষ্যৎকে হাসিমুখে গ্রহণের বদলে অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে বিলীয়মান বিস্ময়কর অতীতের জন্যে। এটা খুবই সত্য যে দাসব্যবসা বাতিল হওয়ার অর্থ ছিলো আজেলিয়া ও। ক্যামেলিয়ায় সমৃদ্ধ জমকালো বিশাল চা, তুললা, আখ, তামাকের বাগানগুলোর মৃত্যু, এর অর্থ ছিলো সংস্কৃত দক্ষিণি সভ্যতার সম্পূর্ণ ধ্বংস। সময়ের চিলেকোঠায় সিস্টান কাস্ৰাতির নির্মল শুদ্ধ কণ্ঠের সঙ্গে যোগ দিয়েছে দুর্লভ পুরোনো কারুকার্যময় ফিতে, এবং আছে এক রকম ‘নারীর মোহনীয়তা’, তাও যাত্রা করেছে একই রকম ধুলোপূর্ণ গুদামের পথে। আমি একমত যে সে ছিলো সত্যিই বর্বর, যে মুগ্ধ হতো না অপরূপ পুষ্প, দুর্লভ ফিতে, খোজাদের স্ফটিকস্বচ্ছ স্বর, ও নারীর মোহনীয়তায়।