পুরুষটি সাধারণত ভারগ্রহণে সম্মত হয়, কেননা সে ভালোভাবেই জানে যে সে আছে সুবিধাজনক ধারে, সে বিবেকহীন; এবং যদি সে মোটামুটি বিবেকবান হয়, তাহলে উদারভাবে সে অসাম্যের ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করে। তবে সে তার করুণার জন্যে গর্ববোধ করে, এবং প্রথমবার অমিল হওয়ার সঙ্গেই সে নারীকে গণ্য করে অকৃতজ্ঞ বলে এবং বিরক্তির সঙ্গে ভাবে : আমি তার জন্যে বেশি ভালো। নারীটি বোধ করে সে আচরণ করছে ভিখিরির মতো, যদিও সে নিশ্চিত যে তার আছে অসাধারণ গুণাবলি, এবং এটা তাকে অবমানিত করে।
এমন একটি বিশ্ব, যেখানে পুরুষ ও নারী হবে সমান, তার রূপ মনশ্চক্ষে দেখা বেশ সহজ, কেননা সোভিয়েত বিপ্লব দিয়েছে ঠিক তারই প্রতিশ্রুতি : পুরুষের মতো একইভাবে লালিতপালিত ও প্রশিক্ষিত নারীরা কাজ করবে একই অবস্থায় এবং পাবে একই মজুরি।কামস্বাধীনতা অবশ্য স্বীকৃত হতে হবে সমাজকে দিয়ে, তবে যৌনকর্মকে বিবেচনা করা যাবে না এমন একটি ‘সেবা’ বলে, যার জন্যে অর্থ পরিশোধ করতে হবে; নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্যে নারীকে গ্রহণ করতে হবে অন্য কোনো উপায়; বিয়ের ভিত্তি হবে একটি স্বাধীন চুক্তি, যা চুক্তিবদ্ধ পক্ষরা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাঙতে পারবে; মাতৃত্ব হবে ঐচ্ছিক, যার অর্থ হচ্ছে জন্মনিরোধ ও গর্ভপাত হবে অনুমোদিত এবং বিয়ের মধ্যে বা বাইরে সব মা ও সন্তানের থাকবে ঠিক একই অধিকার; গর্ভধারণের ছুটির ব্যয় বইবে রাষ্ট্র, যে দায়িত্ব নেবে সন্তানদের, যার তাৎপর্য এ নয় যে তাদের বাবা-মার কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে সন্তানদের, বরং এটা যে সন্তানদের পরিত্যাগ করা হবে না তাদের মা-বাবার কাছে।
তবে পুরুষ ও নারীদের প্রকৃতভাবে সমান হওয়ার জন্যে আইন, প্রতিষ্ঠান, প্রথা, জনমত, এবং সমগ্র সামাজিক পরিস্থিতি বদলানোই কি যথেষ্ট? ‘নারীরা চিরকালই থাকবে নারী’, বলে থাকে সংশয়বাদীরা। অন্য দ্রষ্টারা ভবিষ্যদ্বাণী করে যে নারীত্ব। বিসর্জন দিয়ে নারীরা নিজেদের পুরুষ করে তুলতে পারবে না, বরং তারা হয়ে উঠবে দানব। এর মানে হচ্ছে একথা স্বীকার করে নেয়া যে আজকের নারী প্রকৃতির সৃষ্টি; একথা আরেকবার পুনরাবৃত্তি করা আবশ্যক যে মানবসমাজে কিছুই প্রাকৃতিক নয় এবং নারী, অন্য অনেক কিছুর মতোই, সভ্যতার উৎপাদিত সামগ্রী। তার নিয়তিতে অন্যদের হস্তক্ষেপ এক মৌল ব্যাপার : এ-প্রক্রিয়া যদি যেতো অন্য দিকে, তাহলে এর ফল হতো বেশ ভিন্ন। নারী তার হরমোন বা রহস্যময় প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত সে-রীতি দিয়ে, যার ফলে তার নিজের ছাড়া অন্যদের কর্মকাণ্ড দিয়ে পরিবর্তিত হয় তার শরীর ও বিশ্বের সাথে তার সম্পর্ক। যে-অতল গহ্বর বিচ্ছিন্ন করে রাখে কিশোর ও কিশোরীকে, তাদের মধ্যে সেটা স্বেচ্ছাকৃতভাবে প্রসারিত করা হয় আদিশৈশব থেকেই; তারপর, নারীকে যে-রূপে তৈরি করা হয়েছে, নারী তার থেকে অন্য কিছু হতে পারতো না, এবং অতীত অবশ্যই জীবনভর ছায়াপাত করবে তার ওপর। যদি আমরা এর প্রভাব বুঝতে পারি, তাহলে স্পষ্টভাবে দেখতে পাই যে তার নিয়তি চিরকালের জন্যে নির্ধারিত নয়।
আমাদের, নিশ্চিতভাবে একথা বিশ্বাস করলে চলবে না যে তাকে রূপান্তরিত করার জন্যে শুধু নারীর আর্থনীতিক অবস্থার বদলই যথেষ্ট, যদিও এ-ব্যাপারটি তার বিকাশে ছিলো এবং এখনো আছে মৌল ব্যাপার হয়ে; তবে যে-পর্যন্ত না এটা নৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও অন্যান্য পরিণতি সংঘটিত করবে, এটা যার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং এর জন্যে যা দরকার, সে-পর্যন্ত নতুন নারী দেখা দিতে পারে না। এ-মুহূর্তে এগুলো কোথাও বাস্তবায়িত হয় নি, রাশিয়ায়ও নয়, ফ্রান্সে বা যুক্তরাষ্ট্রেও নয়; এবং এটাই ব্যাখ্যা করে কেননা আজকের নারী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝে। পুরুষের ছদ্মবেশে প্রায়ই সে দেখা দেয় ‘খাঁটি নারী’রূপে, এবং সে নিজের দেহে যেমন অস্বস্তি বোধ করে তেমনি অস্বস্তি বোধ করে পুরুষের পোশাকে। তাকে ছেড়ে দিতে হবে তার পুরোনো খোলস এবং বানাতে হবে নিজের নতুনপোশাক। এটা সে করতে পারতো শুধু একটা সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে। কোনো একক শিক্ষকই আজ এমন একটি নারী মানুষ তৈরি করতে পারবেন না যে হবে একটি পুরুষ মানুষ-এর যথাযথ তুল্যরূপ; তাকে যদি ছেলের মতো লালনপালন করা হয়, তাহলে বালিকা মনে করে সে একটি অদ্ভুত জিনিশ এবং তাই তাকে দেয়া হয় একটা নতুন ধরনের লিঙ্গ পরিচয়। তেঁদাল এটা বুঝেছিলেন, যখন তিনি বলেছিলেন : ‘হঠাৎ গাছ বুনতে হবে অরণ্যে’। কিন্তু আমরা যদি, এর বিপরীতে, কল্পনা করি এমন একটি সমাজের, যাতে বস্তুগতভাবে বাস্তবায়িত হবে লৈঙ্গিক সাম্য, তাহলে প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে এ-সাম্য লাভ করবে নতুন প্রকাশ।
ছোটো মেয়েকে, তার ভাইদের মতো, যদি শুরু থেকেই বড়ো করা হতো একই দাবি ও পুরস্কার, একই কঠোরতা ও একই স্বাধীনতার মধ্যে, যদি তাকে অংশ নিতে দেয়া হতো একই পড়াশুনোয়, একই খেলাধুলোয়, তাকে যদি প্রতিশ্রুতি দেয়া হতো একই ভবিষ্যতের, যদি তার চারপাশের নারী ও পুরুষদের তার কাছে নিঃসন্দেহে। সমান মনে হতো, তাহলে গভীরভাবে বদলে যেতো খোজা গূঢ়ৈষা ও ইডিপাস গূঢ়ৈষার অর্থ। পিতার সঙ্গে একই ভিত্তিতে দম্পতির বস্তুগত ও নৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করে মাও উপভোগ করতে একই স্থায়ী মর্যাদা; শিশু তার চারদিকে দেখতে পেতো, পুরুষের জগত নয়, একটি নারীর জগত। যদি সে তার পিতার দিকে আবেগগতভাবে বেশি আকৃষ্ট হতো–যা এমনকি নিশ্চিত নয়। তাহলে পিতার প্রতি তার প্রেম রঞ্জিত হতো পিতার সমকক্ষ হওয়ার সাধনার ইচ্ছে দিয়ে, শক্তিহীনতার বোধ দিয়ে নয়; অক্রিয়তার দিকে সে চালিত হতো না। ছেলেদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ ও খেলার অনুমতি পেয়ে সে শিশ্নের অভাবকে সন্তান লাভের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে যার ক্ষতিপূরণ করা হয়–হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষা জন্ম দেয়ার জন্যে যথেষ্ট মনে করতো না; পরস্পরসম্পর্কিতভাবে ছেলেরও থাকতো না একটা শ্রেষ্ঠতাগূঢ়ৈষা, যদি না তা ঢুকিয়ে দেয়া হতো তার ভেতরে এবং যদি সে পুরুষদের মতো নারীদেরও সমান শ্রদ্ধা করতো। বালিকা বন্ধ্যা ক্ষতিপূরণ খুঁজতো না আত্মরতি ও স্বপ্নের মধ্যে, সে তার ভাগ্যকে অবধারিত বলে মনে করতো না; সে যা করছে তার প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করতো, নিজেকে সংবরণ না করে সে ঝাঁপিয়ে পড়তো কর্মোদ্যোগে।