আমরা দেখেছি পুরুষ কেনো প্রথমে নারীদের দাসত্বে আবদ্ধ করেছিলো; নারীদের অবমূল্যায়ন ছিলো মানুষের বিকাশের এক অত্যাবশ্যক পর্যায়, তবে এটা দুটি লিঙ্গের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টি করতে পারতো; যে-অপরকে সে চুড়ান্তরূপে পীড়ন করে, তার সঙ্গে একাত্মতাবোধের মাধ্যমে অস্তিমানের নিজের থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে পীড়নকে। প্রতিটি পুরুষের মধ্যে আজ বিরাজ করে ওই প্রবণতা; এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠরা এর কাছে আত্মসমর্পণ করে। স্ত্রীর মধ্যে স্বামী পেতে চায় নিজেকে, দয়িতার মধ্যে প্রেমিক পেতে চায় নিজেকে, একটা প্রস্তরমূর্তিরূপে; নারীর মধ্যে সে খাজে তার পৌরুষের, তার সার্বভৌমত্বের, তার অব্যবহিত বাস্তবতার কিংবদন্তি। কিন্তু সে ক্রীতদাস তার নিজের ডবলের : কী প্রয়াস তার একটি মূর্তি তৈরির, যার মধ্যে সব সময় সে বিপন্ন! সব কিছু সত্ত্বেও এতে তার সাফল্য নির্ভর করে নারীর চপল স্বাধীনতার ওপর : এ-শুভকে তার কাছে রাখার জন্যে তাকে অবিরত চেষ্টা চালাতে হয়। নিজেকে পুরুষ, গুরুত্বপূর্ণ, শ্রেষ্ঠরূপে দেখানোর প্রয়াসে পুরুষ ব্যস্ত; সে এর ছল করে বিনিময়ে ছল পাওয়ার জন্যে; সেও আগ্রাসী, অস্থির; সে নারীদের প্রতি শত্রুতা বোধ করে, কেননা সে তাদের ভয় করে, সে তাদের ভয় করে, কেননা সে ভয় করে সম্রান্ত ব্যক্তিকে, মূর্তিকে, যার সঙ্গে সে অভিন্ন করে তোলে নিজেকে। কতো সময় ও শক্তি যে সে অপচয় করে গূঢ়ৈষাগুলোকে খতম করতে, উর্ধ্বগামী করতে, স্থানান্তরিত করতে, নারীদের সম্পর্কে কথা বলে, তাদের কামে প্রলুব্ধ করে, তাদের ভয় করে নারীদের মুক্তির মধ্যে সে পাবে নিজের মুক্তি। তবে ঠিক এটাকেই সে ভয় করে। তাই নারীদের শৃঙ্খলিত রাখার লক্ষ্যে রহস্যীকরণে সে রত থাকে একগুঁয়েভাবে।
একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে উৎপীড়নকারীরা সাধারণত উৎপীড়িতদের কাছে থেকে দুষ্কর্মে যতোটা সহযোগিতা পায়, পুরুষেরা নারীর মধ্যে সহযোগিতা পায় তার থেকে অনেক বেশি। এবং এটা থেকে প্রতারণার উদ্দেশ্যে তারা একথা ঘোষণার অধিকার পায়যে নারীর ওপর তারা যে-নিয়তি আরোপ করেছে, তা নারী কামনা করেছে। আমরা দেখেছি যে নারীর প্রশিক্ষণের সবগুলো দিক মিলিত হয়েতাকে বাধা দেয় বিদ্রোহ ও দুঃসাহসিক কর্মের পথে। সমাজ সাধারণভাবে–তার শ্রদ্ধেয় পিতামাতাদের থেকে শুরু করে–প্রেম, ভক্তি, তার নিজের গুণের সুউচ্চ মূল্যের প্রশংসা করে তার কাছে মিথ্যা কথা বলে, এবং তার কাছে একথা গোপন করে রাখে যে এগুলোর গুরুভার বইতে তার প্রেমিকও রাজি হবে না, স্বামীও রাজি হবে না, এমনকি তার সন্তানেরাও রাজি হবে না। সে আনন্দে বিশ্বাস করে এসব মিথ্যায়, কেননা এগুলো তাকে আমন্ত্রণ করে সহজ ঢাল বেয়ে নেমে যেতে : তার বিরুদ্ধে এতে জঘন্যতম অন্যায় করে অন্যেরা; শৈশব থেকে তার জীবনভর, তারা তাকে নষ্ট ও দূষিত করে এটা নির্দেশ করে যে এ আনুগত্যই তার প্রকৃত বৃত্তি, স্বাধীনতার মধ্যে প্রতিটি অস্তিমানের যা প্রলোভন। যদি কোনো শিশুকে সারাদিন আমোদে রেখে আলস্য শেখানো হয় এবং তাকে কখনো পড়াশুনোয় মন দিতে বলা না হয়, বা এর উপকারিতা দেখানো না হয় তাহলে বলাই বাহুল্য যে বড়ো হয়ে সে হবে অপদার্থ ও মূখ; তবে এভাবেই লালনপালন করা হয় নারীদের, তার নিজের অস্তিত্বের ভার নিজে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা তাকে কখনো বোঝানো হয় না। তাই সে সানন্দে নিজেকে অর্পণ করে অন্যদের সুরক্ষা, প্রেম, সহায়তা ও তত্ত্বাবধানের কাছে, সে কিছু না করে আত্মসিদ্ধির আশায় মোহিত হয়। এ-প্রলোভনে সাড়া দিয়ে সে ভুল করে; তবে পুরুষ তাকে দোষী করার মতো অবস্থানে নেই, কেননা সে-ই এ-প্রলোভনে তাকে প্রলুব্ধ করেছে। যখন তাদের মধ্যে বিরোধ বাধে, এ-পরিস্থিতির জন্যে একজন দায়ী করে অন্যজনকে; নারী যা হয়েছে তার জন্যে বকবে পুরুষকে : ‘কেউ আমাকে যুক্তি প্রয়োগ করতে বা আমার নিজের জীবিকা অর্জন করতে শেখায় নি’; এ-পরিণতি স্বীকার করে নেয়ার জন্যে পুরুষ তাকে বকবে : ‘তুমি কিছু জানো না, তুমি একটা অপদার্থ’, এবং এমন আরো। প্রতিটি লিঙ্গ মনে করে আক্রমণ করে সে নিজের যাথার্থ্য প্রতিপাদন করতে পারে; তবে একজনের অন্যায় কাজ আরেকজনকে নিরপরাধ করে না।
এ-অসাম্য বিশেষভাবে প্রকাশ পায় এ-ঘটনায় যে তারা যে-সময়টুকু একত্রে কাটায়–যা বিভ্রান্তিকরভাবে একই সময় বলে মনে হয়–সেটার মূল্য উভয় সঙ্গীর কাছে এক নয়। প্রেমিক তার দয়িতার সঙ্গে কাটায় যে-সন্ধ্যাটি, সে-সময়টায় সে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে, ব্যবসায়িক সম্পর্ক পাতিয়ে, বিনোদন খুঁজে তার কর্মজীবনের জন্যে সুবিধাজনক কিছু একটা করতে পারতো; সমাজে স্বাভাবিকভাবে বিন্যস্ত পুরুষের কাছে সময় একটি ইতিবাচক মূল্য : অর্থ, খ্যাতি, বিনোদন। অলস, একঘেয়েমিক্লান্ত নারীর কাছে, এর বিপরীতে, এটা এক বোঝা, যার থেকে সে মুক্তি পেতে চায়; যখন সে সফল হয় সময় কাটাতে, তখন সেটা তার জন্যে একটা উপকার : পুরুষটির উপস্থিতি হচ্ছে খাঁটিলাভ। একটি অবৈধ যৌন সম্পর্কের মধ্যে পুরুষকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে যা আকৃষ্ট করে, অনেক ক্ষেত্রে, তা হচ্ছে এর থেকে সে যে-যৌন উপকার লাভ করে, সেটা : দরকার হলে, যৌনকর্মের জন্যে যতোটা সময় দরকার তার থেকে বেশি সময় দয়িতার সঙ্গে না কাটাতে হলেই সে সুখ পায়; কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদে–দয়িতা চায় তার হাতে যে-অতিরিক্ত সময় আছে, সেটা কাটাতে; এবং সেই শজিবিক্রেতার মতোক্রেতা শালগম না কিনলে যে আলু বিক্রি করবে নাসে দেহদান করবে না যদি না তার প্রেমিক ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে কথাবার্তায় এবং একটা ‘রফা’ করে। একটা আপোসরফায় পেছোনো হয় যদি না, সব কিছু মিলে, পুরুষটির কাছে খরচটা খুব বেশি মনে হয়, এবং এটা অবশ্যই নির্ভর করে তার কামনার তীব্রতা এবং সে যা ত্যাগ করছে, তার ওপর সে কতোটা গুরুত্ব দেয়, তার ওপর। কিন্তু নারীটি যদি চায়–দেয়–খুব বেশি সময়, তাহলে নারীটি, তীরপ্লবী নদীর মতো, হয়ে ওঠে পুরোপুরি অবাঞ্ছিতপ্রবেশী, এবং পুরুষটি তখন অতি বেশি পাওয়ার থেকে কিছু না পেতেই বেশি পছন্দ করবে। তখন নারীটি কমিয়ে আনে তার দাবিদাওয়া; তবে প্রায়ই দ্বিগুণ স্নায়বিক চাপের মূল্যে পৌছোনোহয় মীমাংসায় : নারীটি বোধ করে যে পুরুষটি তাকে সুলভ মূল্যে ‘পেয়েছে’, এবং পুরুষটি মনে করে নারীটির দাম অত্যন্ত বেশি। এ-বিশ্লেষণ, অবশ্য, করা হয়েছে কিছুটা কৌতুককর। ভাষায়; তবে–সে-সব ঈর্ষাকাতর ও একান্ত কামনার ক্ষেত্র বাদে, যাতে পুরুষটি চায়নারীটির পুরোপুরি মালিকানা—এ-বিরোধ অবিরাম দেখা দেয় স্নেহ, কামনা, এমনকি প্রেমের বেলা। পুরুষটি সময়ের মধ্যে সব সময়ই অন্য কিছু করার আছে; আর নারীটির আছে বিপুল সময় যা তাকে কাটাতে হবে; এবং পুরুষটি মনে করে নারীটি তাকে যে-সময় দেয়, তার অধিকাংশই উপহার নয়, বরং ভার।