কিন্তু তার বাসনা, যেমন দেখেছি আমরা, অনেক বেশি দ্ব্যর্থবোধক : সে চায়, একটি স্ববিরোধী রীতিতে, এ-সীমাতিক্ৰমণতা পেতে, এতে মনে করা যায় সে একই সাথে একে শ্রদ্ধা করে ও অস্বীকার করে, একই সঙ্গে সে এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় এবং একে রাখতে চায় নিজের মধ্যে। এর অর্থ হচ্ছে লৈঙ্গিক স্তরে নাটকটি উন্মোচিত হয় না; আরো, লৈঙ্গিক পরিচয় কখনোই নিজের মধ্যে মানবাচরণের চাবি সরবরাহ করে একটি নিয়তি নির্দেশ করে বলে আমাদের মনে হয় নি, বরং এটি প্রকাশ করে একটি পরিস্থিতির সমগ্রতা, যাকে সংজ্ঞায়িত করতে এটি সাহায্য করে। পুরুষ ও নারীর দেহসংস্থানে নিহিত নেই লিঙ্গের সংগ্রাম। সত্য হচ্ছে যখন কেউ এর আশ্রয় নেয়, তখন সে এটাকে অবধারিত বলে মনে করে যে ভাবনার জগতে অনন্ত কাল ধরে যুদ্ধ চলছে চিরন্তন নারী ও চিরন্তন পুরুষ নামের দুটি অস্বচ্ছ সারসত্তার মধ্যে; এবং সে এ-সত্যটি উপেক্ষা করে যে ইতিহাসের দুটি ভিন্ন মুহূর্তের সাথে সঙ্গতি রেখে পৃথিবীতে এ-দানবিক দ্বৈরথ পরিগ্রহ করে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ।
যে-নারী আটকে আছে সীমাবদ্ধতায়, সে পুরুষকেও আবদ্ধ করতে চায় ওই কারাগারে; এভাবে কারাগার হয়ে উঠবে বিশ্বের সাথে পরস্পরপরিবর্তনীয়, এবং নারী আর ভোগ করবে না সেখানে বন্দী হয়ে থাকার যন্ত্রণা : মা, স্ত্রী, প্রিয়া হচ্ছে। কারারক্ষক। পুরুষদের দ্বারা বিধিবদ্ধ হয়ে সমাজ বিধান জারি করে যে নারী নিকৃষ্ট : সে এ-নিকৃষ্টতা এড়াতে পারে শুধু পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব ধ্বংস করে। সে লেগে যায়। পুরুষের অঙ্গহানি করতে, পুরুষের ওপর আধিপত্য করতে, সে পুরুষের বিরোধিতা করে, সে অস্বীকার করে পুরুষের সত্য ও মূল্যবোধ। কিন্তু এটা করতে গিয়ে সে শুধু নিরাপত্তাবিধান করছে নিজের কোনো অপরিবর্তনীয় সারসত্তা বা ভুলক্রমে বাছাই তাকে সীমাবদ্ধতায়, নিকৃষ্টতায় দণ্ডিত করে নি। এগুলো চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার ওপর। সব অত্যাচারই সৃষ্টি করে একটি যুদ্ধাবস্থা। এবং এটিও কোনোব্যতিক্রম নয়। যে-অস্তিমানকে গণ্য করা হয় অপ্রয়োজনীয়, সে তার সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি না জানিয়ে থাকতে পারে না।
আজ দ্বৈরথটি নিয়েছে এক ভিন্ন আকার; পুরুষকে কারাগারে ঢোকানোর ইচ্ছের বদলে নারী মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে কারাগার থেকে; সে আর পুরুষকে সীমাবদ্ধতার রাজ্যে টেনে নিতে চায় না, বরং সে নিজে বেরিয়ে আসতে চায় সীমাতিক্ৰমণতার আলোতে। এখন পুরুষের মনোভাব সৃষ্টি করে একটি নতুন বিরোধ : পুরুষ নারীকে মুক্তি দিতে চায় অনিচ্ছেয়। সে নিজে সুখ পায় সার্বভৌম কর্তা, পরম শ্রেষ্ঠ, অপরিহার্য সত্তারূপে থাকতে; সে তার সঙ্গীকে বাস্তবিকভাবে তার সমান বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তার ওপর পুরুষের আস্থাহীনতার জবাব দেয় সে একটি আক্রমণাত্মক মনোভাব গ্রহণ করে। এটা আর সে-ব্যক্তিদের মধ্যে যুদ্ধের ব্যাপার নয়, যারা প্রত্যেকে আটকে আছে তার নিজের এলাকায় : একটি জাত আক্রমণ করে তার অধিকার দাবি করে এবং প্রতিহত হয় সুবিধাভোগী জাতটি দিয়ে। এখানে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দুটি সীমাতিক্ৰমণতা; পরস্পরকে স্বীকার করে নেয়ার বদলে একটি মুক্ত সত্তা আধিপত্য করতে চায় অন্যটির ওপর।
মনোভাবের এ-পার্থক্য প্রকাশ পায় যেমন লৈঙ্গিক স্তরে, তেমনি আধ্যাত্মিক স্তরে। নারীধর্মী নারী নিজেকে শিকারের বস্তু করে তুলতে গিয়ে চেষ্টা করে পুরুষকেও তার দৈহিক অক্রিয়তায় পর্যবসিত করতে; সে নিজেকে ব্যস্ত রাখে পুরুষকে তার ফাঁদে ফেলার জন্যে, সে পুরুষের মধ্যে জাগায় যে-কামনা, তা দিয়ে নিজেকে একটি অনুগত বস্তু করে তুলে সে শৃঙ্খলিত করতে চায় পুরুষকে। মুক্তিপ্রাপ্ত নারী, এর বিপরীতে, হতে চায় সক্রিয়, একজন গ্রহীতা, এবং সে মেনে নেয় না সে-অক্রিয়তা, পুরুষ যা চাপাতে চায় তার ওপর। ‘আধুনিক’ নারী গ্রহণ করে পুরুষের মূল্যবোেধ : পুরুষের মতো একই শর্তে সে গর্ববোধ করে চিন্তায়, ব্যবস্থা গ্রহণ করে, কাজ করে, সৃষ্টি করে; পুরুষদের অবজ্ঞা না করে সে নিজেকে ঘোষণা করে তাদের সমান বলে।
পুরুষ ও নারী যতো কাল পরস্পরকে সমান বলে গণ্য করতে ব্যর্থ হবে, ততো কাল চলবে এ-কলহ; এর অর্থ হচ্ছে, যতো কাল যেমন আছে তেমন অবস্থায়ই স্থায়ী করে রাখা হবে নারীদের। কোন লিঙ্গটি বেশি ব্যগ্র এটা বজায় রাখার জন্যে? নারী, যে মুক্তি পাচ্ছে এর থেকে, সেও বজায় রাখতে চায় এর বিশেষ সুবিধাগুলো; এবং পুরুষ, সে-ক্ষেত্রে, চায় যে নারী ধারণ করবে এর সীমাবদ্ধতাগুলো। ‘অন্য লিঙ্গটিকে ক্ষমা করার থেকে একটি লিঙ্গকে অভিযুক্ত করা সহজ,’ বলেছেন মতেইন। প্রশংসা ও নিন্দা ভাগাভাগি করা বৃথা। সত্য হচ্ছে দুষ্টচক্রটি ভাঙা যে এতো কঠিন, তার কারণ। দুটি লিঙ্গ একই সঙ্গে পরস্পরের ও নিজের শিকার। শুদ্ধ-স্বাধীনভাবে পরস্পরের। মুখোমুখি দুটি প্রতিপক্ষের মধ্যে সহজেই একটি চুক্তিতে পৌছোনো যেতো : আরো বেশি সম্ভব হতো, কেননা যুদ্ধে কেউই লাভবান হবে না। কিন্তু পুরো ব্যাপারটি এজন্যেই জটিল হয়ে ওঠে যে প্রতিটি শিবিরই সাহায্য ও আরাম দেয় শত্রুদের; নারী রত থাকছে আনুগত্যের স্বপ্নে, পুরুষ রত থাকছে একাত্মতাবোধের স্বপ্নে। যথার্থতার অভাব থেকে উপকার পাওয়া যায় না: সহজ পথের প্রলোভনে পড়ে পুরুষ বা নারী যে-অসুখবোধ করেছে, তার জন্যে তারা পরস্পরকে দোষী করে; পুরুষ ও নারী পরস্পরের মধ্যে যা অপছন্দ করে, তা হচ্ছে প্রত্যেকের নিজের প্রতারণা ও হীনতার ভেঙে চুরমার করার মতো হতাশা।