আর একবার, নারীর সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যার জন্যে আবাহন করতে হবে নারীর পরিস্থিতিকে, কোনো রহস্যময় সারসত্তাকে নয়; তাই ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই উনুক্ত। এ-বিষয়ের লেখকেরা পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অটলভাবে মত পোষণ করেন যে নারীদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা নেই; এ-তত্ত্বই সমর্থন করেছেন মাদাম মার্থে বোরেলি, এক কুখ্যাত নারীবাদবিরোধী; তবে বলা যায় তার বইগুলো এতো স্ববিরোধী যে তিনি ওগুলোকে করে তুলতে চেয়েছেন নারীসুলভ অযৌক্তিকতা ও নির্বুদ্ধিতার জীবন্ত প্রমাণ। এছাড়াও, ‘নারী চিরন্তনী’ ধারণাটির মতোই, সত্যিকার অস্তিত্বশীল বস্তুর পুরোনো তালিকা থেকে, বর্জন করতে হবে সৃষ্টিশীল সহজাত প্রবৃত্তির ধারণাটি। কিছু কিছু নারীবিদ্বেষী জোরের সঙ্গে, কিছুটা বেশি সুনির্দিষ্টভাবে, ঘোষণা করেন নারী, যেহেতু স্নায়ুবৈকল্যগ্রস্ত, মূল্যবান কিছু সৃষ্টি করতে পারে না; তবে প্রায়ই ওই একই লোকেরা প্রতিভাকে এক ধরনের স্নায়ুবৈকল্য বলে ঘোষণা করেন। তা যা-ই হোক, প্রস্তের উদাহরণ স্পষ্টভাবে দেখায় যে মনোশারীরিক ভারসাম্যহীনতা ক্ষমতার। অভাবও দ্যোতনা করে না, মাঝারিত্বও দ্যোতনা করে না।
ইতিহাস থেকে নেয়া যুক্তিটির কথা বলতে গেলে, ওইটি সম্পর্কে কী মনে করবো আমরা ঠিক তা-ই বিবেচনা করছিলাম; ঐতিহাসিক সত্য কোনো চিরন্তন সত্য প্রতিষ্ঠা করে না; এটা নির্দেশ করতে পারে শুধু একটা পরিস্থিতি, যা ঐতিহাসিক প্রকৃতির, বিশেষ করে এ-কারণে যে এটা এখন বদলে যাচ্ছে। কী করে কখনো থাকতে পারতো নারীর প্রতিভা, যখন তাদের কোনোপ্রতিভাজাত শিল্পকর্ম বা শুধুই একটি শিল্পকর্ম–সম্পন্ন করার সমস্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে? প্রাচীন ইউরোপ আগেকার দিনে ঘৃণা ঢেলে দিতে মার্কিন বর্বরদের ওপর, গর্ব করার মতোযাদের কোনো চিত্রকরও ছিলো না লেখকও ছিলো না। আমাদের অস্তিত্বের যাথার্থ্য প্রমাণ করার আগে আমাদের অস্তিত্বশীল হতে দাও, জেফারসন উত্তর দিয়েছেন, সত্যিকার অর্থে। কখনোএকজন হুইটম্যান বা একজন মেলভিল জন্ম দেয় নি বলে নিগ্রোদের তিরস্কার করে যে-জাতিশ্রেষ্ঠতাবাদীরা, নিগ্রোরা তাদের দেয় একই উত্তর। ফরাশি সর্বহারারাও উপস্থিত করতে পারে না রাসিন বা মালার্মের সঙ্গে তুলনীয় কোনো নাম।
মুক্ত নারী সবে মাত্র জন্ম নিচ্ছে; যখন সে জয় করবে নিজের মালিকানা তখনই হয়তো ফলবে ব্র্যাবোর ভবিষ্যদ্বাণী : ‘কবিরা থাকবে! যখন নারীর অমিত দাসত্ব ভাঙবে, যখন সে নিজের জন্যে ও নিজের মাধ্যমে বাঁচবে, পুরুষ–এ-পর্যন্ত ঘৃণ্যতাকে মুক্তি দেবে, তখন সেও হবে কবি! নারী জানতে পাবে অজানাকে! তার ভাবনাগত বিশ্বগুলো কি ভিন্ন হবে আমাদেরগুলো থেকে? সে মুখোমুখি হবে অদ্ভুত, অতল, অনাকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক জিনিশের; আমরা তাদের গ্রহণ করবো, আমরা তাদের উপলব্ধি করবো’। এটা নিশ্চিত নয় যে তার ‘ভাবনাগত বিশ্বগুলো’ ভিন্ন হবে পুরুষেরগুলো থেকে, কেননা পুরুষের মতো একই পরিস্থিতি লাভ করার মাধ্যমেই সে পাবে মুক্তি; কতোটা মাত্রায় সে ভিন্ন থাকবে, এ-ভিন্নতাগুলো কতটা মাত্রায় রক্ষা করবে তাদের গুরুত্ব, সে-কথা বলা–এটা দুঃসাহসিক ভবিষদ্বাণীর ঝুঁকি নেয়া হবে বটে। যা নিশ্চিত, তা হচ্ছে এ-পর্যন্ত নারীর সম্ভাবনাগুলো নিরুদ্ধ করা হয়েছে এবং হারিয়ে গেছে মানবমণ্ডলির থেকে, এবং তার নিজের স্বার্থে এবং সকলের স্বার্থে তাকে তার সুযোগগুলো গ্রহণের অনুমতি দেয়ার এখখুনি সময়।
উপসংহার
‘না, নারী আমাদের ভাই নয়; আলস্য ও কপটতার মাধ্যমে আমরা করে তুলেছি তাকে একটি ভিন্ন সত্তা, অজ্ঞাত, তার কাম ছাড়া আর কোনো অস্ত্র নেই, যা শুধু নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহই বোঝায় না বরং বোঝায় অন্যায় যুদ্ধ–ভক্তি বা ঘৃণা, কিন্তু কখনই সোজাসুজি বন্ধু নয়, একটি সত্তা এসপ্রি দ্য কর্প ও সহমর্মীদের সঙ্গে অসংখ্যের এক বাহিনী–চিরন্তন ক্ষুদ্র দাসের স্পর্ধিত ভঙ্গি’।
বহু পুরুষ আজো একমত হবে লাফর্গের এসব কথার সাথে; অনেকে মনে করে সব সময়ই ঘটবে দ্বন্দ্ব ও কলহ, যেমন বলেছেন মতেইন, এবং কখনোই সম্ভবপর হবে না ভ্রাতৃত্ব। সত্য হচ্ছে আজকাল পুরুষ বা নারী কেউই পরস্পরকে নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু এটা জানা দরকার যে রয়েছে কি-না কোনো আদি অভিশাপ, যা তাদের বাধ্য করে পরস্পরকে বিদীর্ণ করতে, না-কি তারা পরস্পরবিরোধী যে-বিরুদ্ধতায়, সেগুলো নিতান্তই চিহ্নিত করে মানব-ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালীন মুহূর্তকে।
কিংবদন্তি সত্ত্বেও, কোনো শারীরবৃত্তিক নিয়তি নারী ও পুরুষের মধ্যে চিরন্তন বৈরিতা চাপিয়ে দেয় নি; এমনকি বিখ্যাত আরাধনাকারী ম্যান্টিসও পুরুষটিকে খায় শুধু অন্য খাদ্যের অভাবে এবং প্রজাতির কল্যাণে : প্রাণীজীবনের মাপদণ্ডের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই প্রজাতির অধীন। এছাড়া, মানবমণ্ডলি নিতান্ত একটি প্রজাতির থেকেও বেশি কিছু : এটা ঐতিহাসিক বিবর্তন; এটি কী আচরণ করে তার প্রাকৃতিক, স্থির বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে, এর ফাঁকতিসিতের সাথে, সে-অনুসারে একে। সংজ্ঞায়িত করতে হবে। সত্যিই, এমনকি চরম প্রতারণার উদ্দেশ্যে হলেও পুরুষ ও নারীর মধ্যে প্রকৃত কোনো শারীরবৃত্তিধর্মী বৈরিতার অস্তিত্ব দেখানো অসম্ভব। আরো, তাদের বৈরিতা হয়তো বণ্টন করা হয়েছে জীববিদ্যা ও মনোবিজ্ঞানের মাঝামাঝি এক অঞ্চলে : মনোবিশ্লেষণে। নারী, বলা হয়েছে আমাদের, পুরুষকে ঈর্ষা করে তার শিশ্নের জন্যে এবং খোজা করতে চায় তাকে; কিন্তু একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর জীবনে শিশ্নের জন্যে বালখিল্য বাসনা তখনই শুধু গুরুত্বপূর্ণ যখন সে তার নারীত্বকে মনে করে একটি অঙ্গহানি বলে; এবং তখন সে এটিকে পুরুষের সমস্ত সুযোগসুবিধার প্রতীক হিশেবে ধরে আত্মসাৎ করতে চায় পুরুষের লিঙ্গটি। আমরা এটা স্বীকার করতে প্রস্তুত যে তার খোজা করার স্বপ্নের আছে এ-প্রতীকী তাৎপর্য : মনে করা হয় যে সে চায় পুরুষকে তার সীমাতিক্ৰমণতা থেকে বঞ্চিত করতে।