সর্বোপরি, এ-যুক্তিযুক্ত পরিমিতিবোধই এ-পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে নারীপ্রতিভার সীমা। বহু নারী এড়িয়ে গেছে এবং এখন উত্তরোত্তর এড়িয়ে যাচ্ছে–আত্মরতি ও ভ্রান্ত যাদুর ফাঁদ; কিন্তু বিদ্যমান বিশ্বের বাইরে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টায় কেউই কখনো সমস্ত বিমৃষ্যকারিতাকে পায়ে মাড়িয়ে যায় নি। প্রথমে, অবশ্যই আছে অনেকে, যারা সমাজ যেমন আছে তেমনভাবেই মেনে নেয়; তাদের মধ্যে বুর্জোয়াধারার মহিলা কবিরা সর্বপ্রধান, কেননা এ-হুমকিগ্রস্ত সমাজের সবচেয়ে রক্ষণশীল উপাদানের তারা প্রতিনিধিত্ব করেন। সুনির্বাচিত বিশেষণের সাহায্যে তাঁরা মনে জাগিয়ে তোলেন এমন এক সমাজের পরিশীলনের কথা, যাকে নির্দেশ করা হয় ‘উৎকর্ষ’-এর সভ্যতা বলে; তাঁরা মহিমান্বিত করেন কল্যাণের মধ্যবিত্তসুলভ আদর্শকে এবং কাব্যিক রঙ চড়িয়ে তারা ঢেকে রাখেন তাদের শ্রেণীর স্বার্থকে; তারা সংযোগ করেন সে-মহারহস্যীকরণের সুর, যার লক্ষ্য নারীকে ‘নারীধর্মী থাকতে’ প্ররোচিত করা। প্রাচীন গৃহ, ভেড়ার খোয়াড় ও শক্তি বাগান, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বুড়োরা, পাজি শিশুরা, ধােয়া, সংরক্ষণ, পারিবারিক উৎসব, প্রসাধন, বসার ঘর, বলনাচ, অসুখী তবে আদর্শ স্ত্রীরা, ভক্তি ও ত্যাগের সৌন্দর্য, দাম্পত্য প্রেমের ছোটোখাটো দুঃখ ও বিরাট সুখ, যৌবনের স্বপ্ন, বার্ধক্যের দাবিত্যাগ–ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার নারী ঔপন্যাসিকেরা এসব বিষয় ব্যবহার করেছেন তলানি পর্যন্ত; এভাবে তারা খ্যাতি ও অর্থ লাভ করেছেন, তবে নিশ্চিতভাবেই আমাদের বিশ্বদৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করেন নি।
অনেক বেশি আকর্ষণীয় সে-সব বিদ্রোহী নারীরা, যারা দ্বন্দ্বে আহ্বান করেছেন এঅসৎ সমাজকে; প্রতিবাদের সাহিত্য জন্ম দিতে পারে আন্তরিক ও শক্তিশালী গ্রন্থ; তার বিদ্রোহের উৎস থেকে জর্জ এলিয়ট এঁকেছেন ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের রূপ, যা একই সঙ্গে অনুপুঙ্খ ও নাটকীয়; তবে, ভার্জিনিয়া উ যেমন দেখিয়েছেন আমাদের, জেইন অস্টিনকে, ব্রোন্টি বোেনদের, জর্জ এলিয়টকে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্যে নেতিবাচকভাবে এতোটা শক্তি ব্যয় করতে হয় যে তাঁদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে সে-স্তরে পৌছোতে, যেখানে থেকে মহাপরিসরসম্পন্ন পুরুষ লেখকেরা শুরু করেন যাত্রা; তাঁদের বিজয়ে লাভবান হওয়ার এবং যে-সব রজু তাঁদের বেঁধে রেখেছে, সেগুলো ঘেঁড়ার মতো যথেষ্ট শক্তি আর তাদের অবশিষ্ট থাকে না। তাঁদের মধ্যে আমরা পাই না, উদাহরণস্বরূপ, একজন স্তেদালের বক্রাঘাত, সাবলীলতা, তার প্রশান্ত আন্তরিকতাও পাই না। তাঁদের ছিলো না একজন দস্তোয়েভস্কির, একজন তলস্তয়ের অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধিও : এটাই ব্যাখ্যা করে চমৎকার মিডলমার্চ কেনো ওয়ার অ্যান্ড পিস-এর সমতুল্য নয়; তার মহিমা সত্ত্বেও কেনো উদারিং হাইটস-এ নেই দি ব্রাদার্স কারামাজোভ-এর নিরন্তর অব্যাহত প্রবাহ।
সে-পুরুষদেরই আমরা মহৎ বলি, যারা–একভাবে বা অন্যভাবে নিজেদের কাঁধে নিয়েছে বিশ্বের ভার; তারা উৎকৃষ্টতর কাজ করেছেন বা নিকৃষ্ট কাজ করেছেন; তাঁরা একে পুনসৃষ্টি করতে সফুল হয়েছেন বা ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু প্রথমে তারা ধারণ করেছেন ওই বিপুল ভার। এটাই সে-কাজ, যা কোনো নারী কখনো করে নি, যা তারা কেউ করতে পারে নি। বিশ্বকে নিজের বলে গণ্য করা, এর ত্রুটিগুলোর জন্যে নিজেকে দোষী করা এবং এর অগ্রগতির জন্যে নিজে গৌরব বোধ করার জন্যে তাকে অন্তর্ভুক্ত হতে হয় সুবিধাপ্রাপ্ত বর্ণের; বিশ্বকে বদলে দিয়ে, এর সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে, একে উঘাটিতে করে এর যাথার্থ প্রতিপাদন শুধু তাদেরই দায়িত্ব, যারা আছে কর্তৃত্বে; শুধু তারাই নিজেদের চিনতে পারে এর ভেতরে এবং প্রয়াস চালাতে পারে এখানে বিখ্যাত হওয়ার। এ পর্যন্ত মানুষের পক্ষে নিজেকে মূর্ত করা সম্ভব হয়েছে পুরুষের মধ্যে, নারীর মধ্যে নয়। কেননা যে-ব্যক্তিদের আমাদের অসাধারণ মনে হয়, যদের প্রতিভা নামে সম্মান করা হয়, তারা হচ্ছেন সে-সব পুরুষ, যারা চেয়েছেন সমগ্র মানবমণ্ডলির ভাগ্য নিজেদের ব্যক্তিগত অস্তিত্বের মধ্যে রূপায়িত করতে, এবং কোনো নারীই বিশ্বাস করে নি যে এটা করার অধিকার তার আছে।
কী করে ভ্যান গগ জন্ম নিতে পারতেন নারীরূপে? কোনো নারীকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হতো না বোরিনাজে বেলজিয়ামের কয়লা খনিতে, তাই সে কখনোই খনিশ্রমিকদের দুর্দশাকেবোধ করতো না নিজের অপরাধ বলে, সে চাই তো না পরিত্রাণ; সুতরাং সে কখনো আঁকতো না ভ্যান গগের সূর্যমুখি। উল্লেখ করার দরকার নেই যে ওই চিত্রকরের জীবনপদ্ধতি–আর্লেতে তাঁর নিঃসঙ্গতা, কাফেতে ও বেশ্যালয়ে তার ঘন ঘন যাতায়াত, যা কিছু ভ্যান গগের সংবেদনশীলতাকে পুষ্ট করে পুষ্ট করেছে তার চিত্রকলাকে–নিষিদ্ধ হতো তার জন্যে। কোনো নারী কখনোই হতেপারতো না কাফকা : তার সন্দেহ ও তার উদ্বেগের মধ্যে সে কখনোই বুঝতে পারতো স্বর্গচুত মানুষের নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা। সেইন্ট তেরেসা ছাড়া কদাচিৎ আছে এমন নারী, যে সম্পূর্ণ পরিত্যাগের মধ্যে পেরিয়ে গেছে মানুষের পরিস্থিতি : আমরা দেখেছি কেনো। পার্থিব স্তরক্ৰমের বাইরে তার অবস্থান গ্রহণ করে, ক্রুশের সেইন্ট জনের মততা, তিনি নিজের মাথার ওপর কোনোআশ্বাসদায়ক চালের উপস্থিতি অনুভব করেন নি। উভয়ের জন্যেই ছিলো একই অন্ধকার, একই আলোর ঝলকানি, সত্তায়। একই শূন্যতা, বিধাতায় একই প্রাচুর্য। যখন অবশেষে প্রতিটি মানুষের পক্ষে, স্বাধীন অস্তিত্বের শ্রমসাধ্য মহিমায়, সম্ভব হবে তার গর্বকে লৈঙ্গিক বৈষম্যের বাইরে স্থাপন। করতে, তখনই শুধু নারী সমর্থ হবে তার ব্যক্তিগত ইতিহাসকে, তার সমস্যাগুলোকে, তার সন্দেহগুলোকে সমগ্র মানবমণ্ডলির ইতিহাস, সমস্যা, সন্দেহের সঙ্গে অভিন্ন করে বুঝতে; তখনই শুধু সে সমর্থ হবে তার জীবন ও কর্মের মধ্যে শুধু তার ব্যক্তিগত সত্তাকে নয়, সমগ্র বাস্তবতাকে প্রকাশ করতে। যতো কাল তাকে মানুষ হয়ে ওঠার জন্যে সংগ্রাম করতে হবে, ততো কাল সে স্রষ্টা হয়ে উঠতে পারবে না।