সুতরাং, যে-নারীবাহিনী শিল্পসাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করে, তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই অধ্যবসায়ী হয়; এবং এমনকি যারা পেরিয়ে যান এ-প্রথম বাধা, তারাও প্রায়ই ছিন্নভিন্ন হন তাঁদের আত্মরতি ও হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষার মধ্যে। নিজেদের ভুলে। যাওয়ার অসামর্থ্য এমন এক ক্রটি, যা অন্যান্য পেশার নারীদের ওপর যতোটা চেপে থাকে, তাদের ওপর চেপে থাকে অনেক বেশি; যদি সত্তার বিমূর্ত সুনিশ্চিত ঘোষণা, সাফল্যের আনুষ্ঠানিক সন্তোষ হয় তাদের মূল লক্ষ্য, তাহলে তারা বিশ্ব সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনায় নিজেদের নিয়োজিত করবেন না : তারা একে পুনসৃষ্টি করতে অসমর্থ হবেন শিল্পকলায়। মারি বাশকির্তসেভ ছবি আঁকবেন বলে ঠিক করেন, কেননা তিনি বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন; তার খ্যাতির আবেশ এসে দাঁড়ায় তার ও বাস্তবতার মাঝখানে। তিনি আসলে ছবি আঁকা পছন্দ করেন না : শিল্পকলা একটা উপায় মাত্র; তাঁর উচ্চাভিলাষী ও শূন্যগর্ভ স্বপ্নগুলো একটি রঙের বা মুখের তাৎপর্য প্রকাশ করবে তাঁর কাছে। নারী যে-কাজের ভার নেয়, তাতে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার বদলে প্রায়ই সে একে মনে করে তার জীবনের নিতান্ত একটা অলঙ্করণ, বই বা চিত্র হচ্ছে জনগণের কাছে সে-অপরিহার্য সত্য প্রদর্শনের পরিহার্য উপায় : তার নিজের সত্তা। উপরন্তু, তার নিজের সত্তাই তার আগ্রহের প্রধান–অনেক সময় অনন্য–বিষয় : মাদাম ভিগি-ব্ৰুে কখনোই তার মৃদুহাস্যরত মাতৃত্বকে তাঁর চিত্রপটে উপস্থাপনে ক্লান্ত হন নি। কোনোলেখিকা যখন সাধারণ বিষয় নিয়ে কথা বলেন, তখনও তিনি নিজের। সম্পর্কেই কথা বলেন : লেখিকার দেহগঠন ও অত্যধিক মাংসলতা, তার চুলের রঙ, এবং তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে না জেনে কারো পক্ষে কোনো কোনো নাটকীয় মন্তব্য পড়া সম্ভব নয়।
একথা সত্য, অহং সব সময়ই কদর্য নয়। কিছু স্বীকারোক্তির থেকে বেশি চাঞ্চল্যকর বই কমই আছে, তবে ওগুলোকে সৎ হতে হবে, এবং স্বীকারোক্তির মতো কিছু থাকতে হবে লেখকের। নারীর আত্মরতি তাকে সমৃদ্ধ করার বদলে দীনতর করে তোলে; কিছু না করে শুধু নিজের ধ্যান করে নারী নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে; এমনকি তার আত্মপ্রেমও ছকবাঁধা : তার লেখায়সে অকৃত্রিম অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে না, বরং প্রকাশ করে গতানুগতিক বুলিতে তৈরি এক কাল্পনিক মূর্তি। কনস্ট্যান্ট বা তেঁদাল যেভাবে করেছেন, সেচাবে সে যদি নিজেকে প্রক্ষেপ করে তার উপন্যাসে, তাহলে কেউ তাকে তিরস্কার করতে পারে না; কিন্তু বিপদ এখানে যে সে নিজেও প্রায়ই তার ইতিহাসকে দেখে একটা নির্বোধ রূপকথারূপে। কল্পনার সহায়তায় অল্পবয়স্ক মেয়ে নিজের কাছে গোপন করে রাখে সে-বাস্তবতা, যার স্থূলতায় সে সন্ত্রস্ত বোধ করে, তবে এটা শোচনীয় যে যখন সে নারী হয়ে ওঠে তখনও সে বিশ্বকে, তার চরিত্রগুলোকে এবং নিজেকে নিমজ্জিত করে কাব্যিক কুয়াশায়। যখন এ-ছদ্মবেশের ভেতর থেকে সত্য প্রকাশ পায়, তখন কখনো কখনো অর্জিত হয় আনন্দদায়ক ফল: তবে তখনও একটি ডাস্টি অ্যান্ডার ও একটি কনস্ট্যান্ট নিম্ফ-এর জায়গায় পাওয়া যায় কতোশতো নিষ্প্রভ ও নিষ্প্রাণ পলায়নের উপন্যাস।
নারীর জন্যে খুবই স্বাভাবিক যে সে পালানোর উদ্যোগ নেবে এ-বিশ্ব থেকে, যেখানে সে প্রায়ই বোধ করে যে তাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে ও ভুল বোঝা হচ্ছে; তবে আক্ষেপের কথা হচ্ছে সে একজন জেরার দ্য নেভাল, একজন এডগার অ্যালান পোর মতো দুঃসাহসী পলায়নের ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ নেয় না। তার ভীরুতার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। খুশি করাই হচ্ছে তার প্রথম কাজ; এবং প্রায়ই সে ভয় পায় যে সে লেখে, শুধু এ-কারণেই নারী হিশেবে সে বিরক্তিকর হয়ে উঠবে; নীলমুজো অভিধাটি, যদিও নিরর্থক হয়ে উঠেছে, তবু এটা এক অপ্রীতিকর দ্যোতনা জ্ঞাপন করে চলছে; এছাড়া, লেখক হিশেবে বিরক্তিকর হওয়ার সাহস তার নেই। মৌলিকত্বসম্পন্ন লেখক, যদি মৃত না হয়, সব সময়ই অতি জঘন্য, কলঙ্ককর; অভিনবত্ব বিঘ্ন সৃষ্টি করে ও বীতস্পৃহা জাগায়। চিন্তার জগতে, শিল্পকলার জগতে–একটি পুরুষের জগতে প্রবেশ করে নারী আজো বিস্ময় ও শ্লাঘা বোধ করে। সে সুশীলতম আচরণ করে; সে ভয় পস বিশৃঙ্খলা ঘটাতে, অনুসন্ধান করতে, ফেটে পড়তে; সে মনে করে তার সাহিত্যিক অভিমানের জন্যে সে মার্জনা চেয়ে নেবে তার বিনয় ও সুরুচির সাহায্যে। সে ভরসা করে প্রথাগত রীতি অনুসরণের নিশ্চিত মূল্যের ওপর; সাহিত্যকে সে ঠিকঠাকভাবে দান করে সে-সব ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, যা তার কাছে প্রত্যাশা করা হয়, যা আমাদের মনে পড়িয়ে দেবে যে সে নারী, যার আছে সুচয়িত কিছু সৌষ্ঠব, মেকি আচরণ, ও কৃত্রিমতা। এসবই তাকে সাহায্য করে বেস্ট-সেলার উৎপাদনে অন্যদের ছাড়িয়ে যেতে; কিন্তু আমরা তার কাছে বিস্ময়কর পথে দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় বেরিয়ে পড়ার আশা করবো না।
এমন নয় যে এ-স্বাধীন নারীদের আচরণ বা অনুভূতির মধ্যে মৌলিকত্বের অভাব আছে; বরং, তাদের অনেকে এতো অসাধারণ যে তাদের তালাবদ্ধ করে রাখা উচিত; সব মিলিয়ে, তাদের মধ্যে আছে বহু, যারা অনেক বেশি খামখেয়ালপূর্ণ, অনেক বেশি বাতিকগ্রস্ত পুরুষদের থেকে, যাদের শৃঙ্খলা তারা প্রত্যাখ্যান করে। তবে তাদের জীবনপদ্ধতিতে, কথোপকথনে, ও চিঠিপত্রে তারা তাদের প্রতিকাকে প্রয়োগ করে অস্বাভাবিকতার কাজে; যদি তারা লিখতে শুরু করে, তাহলে তারা অভিভূত হয়ে পড়ে সংস্কৃতির বিশ্ব দিয়ে, কেননা এটা পুরুষের বিশ্ব, সুতরাং তারা পারে শুধুতোতলাতে। অন্য দিকে, নিজেকে প্রকাশের জন্যে যে-নারী পুরুষের কলাকৌশল অনুযায়ী বেছে নিতে চায় যুক্তি, সে শ্বাসরোধ করে তুলবে সে-সে-মৌলিকত্বের, যাকে অবিশ্বাস করার তার কারণ আছে; ছাত্রীর মতো, তার আছে পড়ুয়া ও পণ্ডিতসুলভ হওয়ার প্রবণতা; সে অনুকরণ করবে পুরুষের কঠোরতা ও বলিষ্ঠতার। সে হয়ে উঠতে পারে একজন চমৎকার তাত্ত্বিক, আয়ত্ত করতে পাতে প্রকৃত যোগ্যতা; তবে সে বাধ্য হবে তার মধ্যে ভিন্ন যা-কিছু আছে, তা অস্বীকার করতে। বহু নারী আছে, যারা পাগল এবং যুক্তিনির্ভর ধরনের নারী আছে বহু; এমন কেউ নেই, যার ধরনের মধ্যে আছে সেই পাগলামো, যাকে আমরা বলি প্রতিভা।