তবে যে-পরিস্থিতিগুলো নারীকে সৃষ্টিশীল কাজে প্রবৃত্ত করে, সেগুলোই হয়ে ওঠে এমন বাধা, যা কাটিয়ে উঠতে নারী প্রায়ই অসমর্থ হয়। যখন সে শুধু তার কর্মহীন দিনগুলোকে ভরেতোলার জন্যে ছবি আঁকার বা লেখার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ছবি আঁকা বা লেখাকে গণ্য করা হবে শখের কাজ বলে; সে ওগুলোর প্রতি বিশেষ সময় ও যত্ন নিয়োগ করবে না, এবং ওগুলো হবে একই মূল্যের। প্রায়ই ঋতুবিরতির সময় তার অস্তিত্বের ক্রটির ক্ষতিপূরণ করার জন্যে নারী স্থির করে হাতে তুলি বা কলম। তুলে নেয়া; তবে তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে, এবং সনিষ্ঠ প্রশিক্ষণের অভাবে সে কখনোই একটি আনাড়ির বেশি কিছু হবে না। এমনকি সে যখন বেশ আগেই শুরু করে, তখনও কদাচিৎ সে শিল্পকলাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে কল্পনা করে; আলস্যে অভ্যস্ত হয়ে, তার জীবনের ধরনের মধ্যে কখনো কঠোর নিয়মানুবর্তিতার আবশ্যকতা বোধ না করে, সে কখনোই অব্যাহত ও অটল উদ্যোগ গ্রহণে সমর্থ হবে, সে কখনো একটি সুষম কৌশল আয়ত্ত করতে সক্ষম হবে না। সে বীতস্পৃহ হয়ে ওঠে সে-কাজের প্রতি, যাতে নিরর্থকভাবে, নিঃসঙ্গ অন্ধের মতো হাতড়ে ফিরতে হয়, যে-কাজ কখনো দিনের আলো দেখতে পায় না, যা অবশ্যই নষ্ট করতে হবে এবং শত বার সম্পন্ন করতে হবে; অন্যদের খুশি করার জন্যে শৈশব থেকে যেমন তাকে শেখানো হয়েছে ছলচাতুরি করতে, তেমনি সে উতরে যেতে চায় কিছু কৌশল প্রয়োগ করে। মারি বাশকিসেভ স্বীকার করেন ঠিক এটাই : হ্যা, আমি কখনো ছবি আঁকার কষ্ট স্বীকার করি না। আমি আজ নিজেকে দেখেছি। আমি ঠকাই। নারী কাজ কাজ খেলতে খুবই প্রত, কিন্তু সে কাজ করে না; অক্রিয়তার যাদুকরী গুণাবলিতে বিশ্বাসী হয়ে সে তালগোল পাকিয়ে ফেলে মন্ত্রোচ্চারণ ও কর্মের মধ্যে, প্রতীকী অঙ্গভঙ্গি ও কার্যকর আচরণের মধ্যে। সে চারুকলার ছাত্র হওয়ার ভান করে, সে নিজেকে সজ্জিত করে তুলির সাজসরঞ্জামে; কিন্তু যেই সে বসে ইজেলের সামনে, তার চোখ নিরুদ্দেশ ঘুরে বেড়ায় শাদা কাপড় থেকে তার আয়না পর্যন্ত; তবে ফুলের গুচ্ছটি বা আপেলের ডালাটি নিজেদের ইচ্ছেয় গিয়ে দেখা দেবে না চিত্রপটে। তার ডেস্কের সামনে বসে, তার অস্পষ্ট গল্পগুলোকে মনে মনে আন্দোলন করে, নারী উপভোগ করে এ-সহজ ভানটা যে সে লেখক: কিন্তু তাকে বাস্তবিকভাবে শাদা। কাগজের ওপর কাটতে হবে কালো দাগ, তাকে ওগুলোকে অন্যদের চোখের কাছে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হবে। তখনই ধরা পড়ে প্রতারণাটি। খুশি করার জন্যে মরীচিকা সৃষ্টি করাই যথেষ্ট; তবে শিল্পকলা কোনো মরীচিকা নয়, এটা এক কঠিন বস্তু; এটা রূপায়িত করার জন্যে জানতেকুর রীতিনীতি।
শুধু তার প্রতিভা ও মেজাজের কারণেই কলেৎ একজন মহৎ লেখক হয়ে ওঠেন নি; তাঁর কলম প্রায়ই হয়ে উঠেছে তার অবলম্বনের উপায়, এবং দক্ষ কারিগর যেমন তার হাতিয়ারের কাছে প্রত্যাশা করে ভালো কাজ, তিনিও এর কাছে চেয়েছেন একই রকম ভালো কাজ। ক্লদিন থেকে নেসাঁস দ্য জুর-এর মধ্যে শৌখিন লেখকটি হয়ে ওঠেন পেশাদার, এবং এ-ক্রান্তিকাল একটা কঠোর প্রশিক্ষণ পর্বের উপকারগুলো দীপ্তভাবে প্রদর্শন করে। তাদের যোগাযোগের বাসনা যে-সব সমস্যা উপস্থিত করে, অধিকাংশ নারী, অবশ্য, সেগুলো বুঝতে পারে না; এবং এর মূলে বেশির ভাগই আছে তাদের আলস্য। সব সময়ই তারা নিজেদের দত্ত বলে গণ্য করে; তারা মনে করে যে তাদের যোগ্যতা উৎসারিত হয় কোনো অন্তর্নিহিত বর থেকে এবং ভাবে না যে যোগ্যতাকে জয় করা যায়। প্রলুব্ধ করার জন্যে তারা জানে শুধু নিজেদের প্রদর্শনের রীতি; এতে তাদের মোহনীয়তা কাজ করে বা করে না, এর সাফল্য বা ব্যর্থতায় তাদের সত্যিকার কোনো হাত নেই। সদৃশ রীতিতে তারা অনুমান করে যে একজন কী, তা দেখানোই প্রকাশের জন্যে, যোগাযোগের জন্যে যথেষ্ট; ভাবনাচিন্তার সাহায্যে তাদের লেখাকে বিশদ করার বদলে তারা নির্ভর করে স্বতস্ফূর্ততার ওপর। লেখা ও মৃদুহাসি তাদের কাছে একই জিনিশ; তারা তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখে, সাফল্য আসবে বা আসবে না। যদি আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয় যে বইটি বা চিত্রটি কোনোপ্রয়াস ছাড়াই সাফল্যমণ্ডিত হবে; যদি ভীরু হয়, তাদের সমালোচনায় তারা হতোদ্যম হয়ে পড়ে। তারা জানে না যে একটা ভুল উন্মোচিত করে দিতে পারে অগ্রগতির পথ, ভুলকে তারা বিকলাঙ্গতার মতো অসংশোধনীয় মহাবিপর্যয় বলে গণ্য করে। এজন্যে তারা প্রায়ই দেখিয়ে থাকে একটা বিপর্যয়কর যুক্তিহীন অস্থিরতা : তারা তাদের ভুলগুলো থেকে লাভজনক শিক্ষা নেয়ার বদলে ভুলগুলোকে গ্রহণ করে বিরক্তি ও নিরুৎসাহের সঙ্গে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বতস্ফূর্ততা আয়ত্ত করা যতোটা সহজ বলে মনে হয় ততোটা সহজ নয় : গতানুগতিকের কূটাভাস হচ্ছে যে–যেমন ফ্ল্যর দ্য তারবেতে পলহা। ব্যাখ্যা করেছেন–মন্ময় বোধের সরাসরি উপস্থাপনের সঙ্গে একে প্রায়ই তালগোল পাকিয়ে তোলা হয়। তাই একজন হবু-লেখিকা, অন্যদের গোণার মধ্যে না ধরে, যেমুহূর্তে মনে করে যে তার নিজের মনে যে-ছবিটি গড়েউঠেছে, সেটি সে উপস্থাপন করেছে অতিশয় মৌলিকভাবে, তখন সে আসলে একটা মামুলি অতিব্যবহৃত বুলি পুনরুদ্ভাবনের বেশি কিছু করে না। কেউ তাকে একথা বললে সে বিস্মিত হয়; সে। অস্থির হয়ে ওঠে ও তার কলম ছুঁড়ে ফেলে দেয়; সে এটা বোঝে না যে জনগণ পড়ে চোখ ও ভাবনাকে অন্তর্মুখি করে এবং সামগ্রিকভাবে কম টাটকা একটা প্রকাশভঙ্গি মনে জাগিয়ে তুলতে পারে নানা প্রিয় স্মৃতি। নিজের মনের ভেতরে ছিপ ফেলে কিছু পাওয়া ও সেগুলোকে প্রাণবন্ত প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে ভাষার বাইরের স্তরে নিয়ে আসতে পারা সত্যিই এক বহুমূল্য সহজাত ক্ষমতা। আমরা শ্রদ্ধা করি কলেতের স্বতস্ফূর্ততাকে, যা কোনো পুরুষ লেখকের মধ্যে দেখা যায় না; তবে তার মধ্যে আমরা পাই এক সুচিন্তিত স্বতস্ফূর্ততা–যদিও এ-দুটি শব্দকে পরস্পরবিরোধী মনে হয়। তিনি তার বিষয়ের কিছু রাখেন এবং বাকি সবসময়ই জেনে-শুনে বাদ দেন। আনাড়ি লেখিকা শব্দকে আন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগের, অন্যদের অনুভূতিতে নাড়া দেয়ার একটি উপায় বলে গণ্য না করে তার নিজের অনুভূতির প্রত্যক্ষ প্রকাশ বলে গণ্য করে; বাছাই করা, মুছে ফেলাকে তার কাছে তার নিজের একটি অংশকে ত্যাজ্য করা বলে মনে হয়; সে তার শব্দরাশির কোনোটিকেই ত্যাগ করতে চায়না, এটা যুগপৎ এজন্যে যে সে যা, তা নিয়েই সে সন্তষ্ট এবং এ-কারণে যে অন্য কিছু হওয়ার কোনো আশা তার নেই। তার বন্ধ্যা অহমিকা উদ্ভূত হয় এ-ঘটনা থেকে যে সে অত্যন্ত ভালোবাসে নিজেকে, নিজেকে বিশ্লেষণের সাহস না করে।