এক শ্রেণীর নারী আছে, যাদের ক্ষেত্রে এসব মন্তব্য প্রযোজ্য নয়, কেননা তাদের কর্মজীবন তাদের নারীত্বকে বাধাগ্রস্ত করে না, বরং দৃঢ়তর করে। তারা সে-নারী, যারা শৈল্পিক প্রকাশের মাধ্যমে পেরিয়ে যেতে চায় তাদের বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো; তারা অভিনেত্রী, নর্তকী, ও গায়িকা। তিন শতাব্দী ধরে তারাই শুধু সে-নারী, যারা সমাজে রক্ষা করে এসেছে মূর্ত স্বাধীনতা, এবং বর্তমানেও তারা সমাজে বজায় রাখছে একটা বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত স্থান। গির্জার কাছে আগে অভিনেত্রীরা ছিলো এক অভিশপ্ত বস্তু, এবং ওই কঠোরতার আতিশয্য সব সময়ই তাদের দিয়েছে আচরণের বিরাট স্বাধীনতা। তারা প্রায়ই প্রান্তবর্তী হয় নাগরালির এলাকার এবং বারবনিতাদের মতো, তারা তাদের অধিকাংশ সময় কাটায় পুরুষের সংস্পর্শে; তবে নিজেদের জীবিকা অর্জন করে ও তাদের কর্মের মধ্যে তাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে, তারা মুক্ত থাকে পুরুষের জোয়াল থেকে। তাদের বড়ো সুবিধা হচ্ছে যে তাদের পেশাগত সাফল্যপুরুষদের সাফল্যের মতোই বাড়িয়ে তোলে তাদের লৈঙ্গিক মূল্য; তাদের আত্মসিদ্ধির মধ্যে, মানুষ হিশেবে নিজেদের বৈধতাপ্রতিপাদনের মধ্যে, নারী হিসেবে তারা লাভ করে আত্মচরিতার্থতা : তারা পরস্পরবিরোধী আকাথায় ছিন্নভিন্ন হয় না। বরং তাদের কাজের মধ্যে তারা লাভ করে তাদের আত্মরতির যাথার্থ প্রতিপাদন; পোশাক, রূপচর্চা, মোহনীয়তা তাদের পেশাগত দায়িত্বের অংশ। নিজের ভাবমূর্তির প্রেমমুগ্ধ নারীর কাছে এটা এক বড়ো সন্তোষের ব্যাপার হচ্ছে সে যা, শুধু তা প্রদর্শন করাই একটা কিছু করা, এবং একটা কাজের বিকল্প রূপে মনে হওয়ার জন্যে, যেমন বলেছেন জর্জেৎ লেব্লা, এ-প্রদর্শনীর জন্যে দরকার পড়েযথেষ্ট পর্যেষণা ও দক্ষতা। একজন বড়ো অভিনেত্রীর লক্ষ্য আরো উচ্চ : তিনি বিদ্যমানকে প্রকাশ করতে গিয়ে বিদ্যমানকে অতিক্রম করে যাবেন; তিনি হবেন প্রকৃতই একজন শিল্পী, একজন স্রষ্টা, যিনি বিশ্বকে অর্থপূর্ণ করে অর্থপূর্ণ করেন নিজের জীবনকে।
তবে এসব অসাধারণ সুবিধা ফাঁদগুলো লুকিয়ে রাখে : তার আত্মরতিপরায়ণ আত্ম-প্রশ্রয় ও লৈঙ্গিক স্বাধীনতাকে তার শৈল্পিক জীবনের সঙ্গে সংহতিবিধানের বদলে অভিনেত্রী প্রায়ই ডুবে যায় আত্মপুজোয় বা নাগরালিতে; আমি ইতিমধ্যেই সে-সব ছদ্মশিল্পীদের কথা বলেছি, যারা চলচ্চিত্রে বা রঙ্গমঞ্চে নিজেদের জন্যে একটা নাম। করতে চায়, যা হয়ে ওঠে পুরুষের বাহুর ভেতরেশোষণের একটি পুঁজি। কর্মজীবনের ঝুঁকি ও সব ধরনের প্রকৃত কাজের নিয়মানুবর্তিতার তুলনায় অনেক বেশি প্রলোভন জাগায় পুরুষের পৃষ্ঠপোষকতার সুবিধা। নারীধর্মী নিয়তির বাসনা–স্বামী, গৃহ, সন্তান এবং প্রেমের মোহিনীশক্তির সঙ্গে সাফল্য লাভের ইচ্ছের সঙ্গতিবিধান সহজ নয়। তবে, সর্বোপরি, তার অহমিকার প্রতি তার মুগ্ধতাবোধ বহু ক্ষেত্রে সীমিত করে অভিনেত্রীর সাফল্যকে; তার সশরীরে উপস্থিতির মূল্য সম্পর্কে সে এতো বেশি মোহাচ্ছন্ন থাকে যে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কাজকে মনে হয় নিরর্থক। সব কিছুর ওপরে সে ব্যস্ত থাকে জনগণের চোখের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে এবং রঙ্গমঞ্চীয় হাতুড়েপনার কাছে সে বলি দেয় সে-চরিত্রটিকে, যেটিকে সে ব্যাখ্যা করছে। তার অভাব আছে নিজেকে ভুলে থাকার সহৃদয়তার; সত্যিই দুর্লভ রাশেলরা, দুশেরা, যাঁরা এড়িয়ে যান এসব শৈলশিরা এবং শিল্পকলার মধ্যে তাঁদের অহমিকার একটি সেবককে দেখার বদলে তারা তাদের দেহকে করে তোলেন শিল্পকলার হাতিয়ার। উপরন্তু, একটি নিকৃষ্ট অভিনেত্রী তার ব্যক্তিগত জীবনে অতিশায়িত করে তুলবে তার সমস্ত আত্মরতিপরায়ণ ত্রুটিগুলো : সে নিজেকে প্রদর্শন করবে অসার, বিরক্তিকর, নাটকীয়ভাবে; সে সমগ্র বিশ্বকে গণ্য করবে একটি রঙ্গমঞ্চ।
আজকাল অভিনয়কলাই শুধু উন্মুক্ত নয় নারীর সামনে; অনেকেই চালাচ্ছে বিচিত্র ধরনের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের প্রচেষ্টা। নারীর পরিস্থিতি নারীকে প্রবৃত্ত করে সাহিত্য ও শিল্পকলায় নিজের পরিত্রাণ খুঁজতে। পুরুষের জগতের প্রান্তিক অবস্থানে বাস করে সে একে এর বিশ্বজনীন রূপে দেখতে পায় না, দেখে তার বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে। তার কাছে এটা হাতিয়ার ও ধারণার একত্রীভবন নয়, বরং এটা ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও আবেগের এক উৎস; বিভিন্ন বস্তুর গুণাবলির প্রতি সে আকৃষ্ট হয় ওই সব বস্তুর ভিত্তিহীন ও গুপ্ত উপাদান দ্বারা। একটা নেতিবাচক ও অস্বীকারের মনোভাব গ্রহণ করে সে আসল বস্তুতে নিবিষ্ট হয় না : সে প্রতিবাদ করে এর বিরুদ্ধে, শব্দ দিয়ে। প্রকৃতির ভেতর দিয়ে সে খোঁজে তার আত্মার প্রতিমা, সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে স্বল্পপ্রয়াণে, সে অর্জন করতে চায়তার সত্তা–কিন্তু সে হয় হতাশাগ্রস্ত; সে এটা ফিরে পেতে পারে শুধু কল্পনার রাজ্যে। একটি আন্তর জীবন, যার কোনো ব্যবহার্য লক্ষ্য নেই, সেটিকে শূন্যতায় ডুবে যাওয়া থেকে নিবৃত করতে, দুর্দমনীয়ভাবে সে সহ্য করে যে-বিদ্যমান। অবস্থা, তার বিরুদ্ধে নিজেকে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করার জন্যে, যে-বিশ্বে তার সত্তা সে চরিতার্থ করতে পারে না, তার থেকে ভিন্ন একটি বিশ্ব সৃষ্টি করতে গিয়ে, তাকে আশ্রয় নিতে হয় আত্ম-প্রকাশের। তারপরও, সকলেই জানে যে সে এক অনর্থক বকবককারী ও হিজিবিজিলেখক; কথোপকথনে, চিঠিপত্রে, অন্তরঙ্গ দিনপঞ্জিতে সে খুলে ধরে নিজের বক্ষ। একটু উচ্চাভিলাষ থাকলে সে শুরু করবে স্মৃতিকথা লেখা, তার জীবনীকে পরিণত করবে উপন্যাসে, কবিতায় সে প্রকাশ করবে তার অনুভূতি। যেবিপুল অবকাশ সে উপভোগ করে, তা এসব কর্মকাণ্ডের অনুকূল।