বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবন্ধ পর্যন্ত নারী হচ্ছে তার ভেতরে অভিনীত এক নাটকের রঙ্গমঞ্চ এবং তার সাথে সে ব্যক্তিগতভাবে সংশ্লিষ্ট নয়। অ্যাংলো-স্যাক্সনরা ঋতুস্রাবকে বলে অভিশাপ’; সত্যিই ঋতুস্রাবচক্র একটি বোঝা, এবং ব্যক্তিটির দৃষ্টিকোণ থেকে এটা এক নিরর্থক বোঝ। আরিস্ততলের সময়ে বিশ্বাস করা হতো যে প্রত্যেক মাসে রক্তস্রাব ঘটে এ-কারণে যে যদি গর্ভসঞ্চার হয়, তাহলে ওই রক্তে গড়ে উঠবে শিশুর রক্তমাংস; এবং এ-পুরোনো বিশ্বাসের মধ্যে সত্যটা এখানে যে নারী বারবার অঙ্কন করে গর্ভধারণের ভিত্তিমূলের রূপরেখা। নিম্নস্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে গর্ভসঞ্চারচক্র সীমিত থাকে বিশেষ ঋতুতে, এবং এর সাথে কোনো রক্তস্রাব ঘটে না; সর্বোচ্চ শ্রেণীর স্তন্যপায়ীদের (বানর, বনমানুষ, এবং মানবজাতি) ক্ষেত্রেই শুধু প্রতি মাসে কম-বেশি যন্ত্রণার সাথে ঘটে রক্তক্ষরণ। যে- গ্রাফীয় থলি ডিমগুলোকে ঢেকে রাখে, প্রায় চোদ্দো দিনে তার একটি আয়তনে বাড়ে ও পরিপক্ক হয়, এর ফলে নিঃসরণ ঘটে ফোলিকিউলিন (এস্ট্রিন) হরমোনের। ডিম্বনিঃসরণ ঘটে মোটামুটিভাবে চোদ্দো দিনের দিন : একটি থলি ডিম্বাশয়ের ভেতর দিয়ে বাইরে বেরোতে শুরু করে এবং ভেঙে বেরিয়ে যায় (এতে সামান্য রক্তক্ষরণ ঘটে), ডিমটি গিয়ে পড়ে ডিম্বনালিতে; এবং ক্ষতটি পরিণত হয় হলুদ বস্তুতে। হলুদ বস্তুটি নিঃসরণ ঘটাতে শুরু করে প্রোজেসটেরোন হরমোন, যা ঋতুচক্রের দ্বিতীয় পর্বে কাজ করতে থাকে জরায়ুর ওপর। জরায়ুর দেয়াল-আস্তরণ হয়ে ওঠে পুরু ও গ্রন্থিল ও রক্তনালিতে পূর্ণ, একটি নিষিক্ত ডিমকে গ্রহণ করার জন্যে জরায়ুর ভেতর তৈরি করে একটি দোলনা। কোষের এ-বিস্তার যেহেতু উল্টোনো অসম্ভব, তাই ডিম্বনিষিক্তি না ঘটলে এ-সৌধ টিকিয়ে রাখা হয় না। নিম্নস্তরের স্তন্যপায়ীতে এ-আবর্জনা ক্রমশ বেরিয়ে যায়; কিন্তু নারী ও অন্যান্য উচ্চস্তন্যপায়ীতে এ-পুরু দেয়াল-আস্তরণ (এন্ডোমেট্রিয়াম) হঠাৎ ভেঙে পড়ে, খুলে যায় রক্তনালি ও রক্তের এলাকা, এবং রক্তিম বস্তুরাশি রক্তপ্রবাহরূপে চুইয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর যখন প্রত্যাবৃত্ত হয় হলুদ বস্তু, তখন আবার গড়ে ওঠে জরায়ুর আস্তরণের ঝিল্লি এবং শুরু হয় চক্রের আরেক ডিম্বথলীয় পর্ব।
এ-জটিল প্রক্রিয়া, যা আজো তার নানা এলাকায় রহস্যপূর্ণ, চলে নারীর সম্পূর্ণ সত্তাটিকে জড়িয়ে। অধিকাংশ নারী–শতকরা ৮৫জনেরও বেশি–ঋতুস্রাবের সময় ভোগে কম-বেশি যন্ত্রণায়। ঋতুস্রাব শুরুর আগে বাড়ে নারীর রক্তচাপ এবং পরে যায় কমে; বাড়ে ধমনীর স্পন্দন ও মাঝেমাঝে শরীরের তাপ, তাই মাঝেমাঝেই দেখা দেয় জ্বর; তলপেট ব্যথা করে; কখনো কখনো দেখা দেয় কোষ্ঠকাঠিন্য ও তারপর। উদরাময়; মাঝেমাঝে দেখা দেয় যকৃতে প্রদাহ; অনেকের গলা জ্বালা করে ও অনেকে কানে কম শোনে চোখে কম দেখে; ঘাম বাড়ে, এবং রক্তস্রাবের শুরুতে দেখা দেয়। একটা দুর্গন্ধ সুই গেনেরিস, যা খুবই তীব্র এবং থাকতে পারে সারা ঋতুচক্র ভ’রে। বৃদ্ধি পায় মৌলবিপাকের হার। রক্তের লাল কণিকা হ্রাস পায়। আক্রান্ত হয় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, তার ফলে মাথা ধরে মাঝেমাঝেই, বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র স্নায়ুতন্ত্র; কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্যে অসচেতন নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পায়, দেখা দেয় খেঁচুনিপূর্ণ। প্রতিবর্ত, যার ফলে ঘটে মেজাজের খামখেয়ালিপনা। এ-সময়ে নারী হয় স্বাভাবিকের থেকে বেশি আবেগপরায়ণ, বেশি বিচলিত, বেশি খিটখিটে, এবং তার দেখা দিতে পারে মারাত্মক মানসিক বিকলন। ঋতুস্রাবের সময়ই নারী তার শরীরকে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে অনুভব করে এক অবোধ্য, বিরোধী জিনিশ হিশেবে; এটা এমন এক একগুঁয়ে ও বাহ্যিক জীবনের শিকার, যে প্রতিমাসে তার ভেতরে তৈরি করে ও ভেঙে ফেলে একটি দোলনা; প্রতিমাসেই সব কিছু প্রস্তুত করা হয় একটি শিশুর জন্যে, তারপর নিঃসরণ করে দেয় রক্তিম ধারায়। নারী, পুরুষের মতোই, নিজের শরীর; তবে তার শরীর তার নিজের থেকে ভিন্ন এক জিনিশ।
নারী অভিজ্ঞতা অর্জন করে আরো গভীর এক বিচ্ছিন্নতাবোধের, যখন ঘটে গর্ভাধান এবং বিশ্লিষ্ট ডিম এসে পড়ে জরায়ুতে ও বিকশিত হতে থাকে। এটা সত্য যে স্বাস্থ্য ভালো থাকলে গর্ভধারণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এটা মায়ের জন্যে ক্ষতিকর নয়; তখন তার ও ভ্রূণের মধ্যে ঘটে কিছু পারস্পরিক ক্রিয়া, যা তার জন্যে বেশ উপকারী। তবে সামাজিক প্রয়োজন থাকলেও গর্ভধারণ অবসাদের কাজ, যা শারীরিকভাবে নারীর ব্যক্তিগত কোনো উপকারে আসে না, বরং তার কাছে দাবি করা হয় বড়ো রকমের ত্যাগস্বীকার। প্রথম মাসগুলোতে মাঝেমাঝেই দেখা দেয় ক্ষুধাহীনতা ও বমনপ্রবণতা, যা কোনো গৃহপালিত স্ত্রীলিঙ্গ পশুতে দেখা যায় না; এটা নির্দেশ করে আক্রমণকারী প্রজাতিরবিরুদ্ধে নারীর বিদ্রোহ। প্রসবের সময় মাঝেমাঝে ঘটে নানা মারাত্মক দুর্ঘটনা বা গর্ভধারণের কালে তার মধ্যে ঘটে নানা বিকলন; আর নারীটি যদি শক্তিশালী না হয়, যদি না নেয়া হয় স্বাস্থ্যগত সাবধানতা, তাহলে বারবার গর্ভধারণের ফলে নারীটি হয়ে ওঠে অকালে বৃদ্ধ, বা ঘটে মৃত্যু, যা গ্রামের দরিদ্র নারীদের ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘটে। প্রসবের ব্যাপারটি যন্ত্রণাদায়ক ও ভয়ঙ্কর। এ-সংকটের সময় দেখা যায় যে নারীর শরীরটি সব সময় প্রজাতি ও ব্যক্তি উভয়েরই জন্যে সুবিধাজনক রীতিতে কাজ করে না; নবজাতকের মৃত্যু ঘটতে পারে, এটি জন্ম নিতে গিয়ে হত্যা করতে পারে মাকে বা তার মধ্যে জন্মাতে পারে দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি। বলা হয়ে থাকে যে নারীর ‘তলপেটে আছে দুর্বলতা’; এবং এটা সত্য যে তাদের অভ্যন্তরে থাকে এক বিরূপ উপাদান–তার মর্মস্থানে প্রজাতির এক ধারাবাহিক দংশন।