কিশোরী বোভোয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন যে-ত্রাতার, রাজকুমারের, তাকে তিনি পান সার্ত্রের মধ্যে, এক সুদৰ্শন রাজকুমারের বদলে এক দার্শনিক! বোভোয়ার লিখেছেন : ‘পনেরো বছর বয়সে আমি কল্পনা করেছিলাম যে-ভাবাদর্শ, সার্ত্র হুবহু মিলে যান তাঁর সাথেঃ তিনি আত্মার এমন সঙ্গী, যার মধ্যে আমি পেয়েছি আমার সমস্ত রিপু, যেগুলো এতো উত্তপ্ত হয়ে উঠতো যে পৌছোতো ভাস্থরতায়। তার সাথে আমি অংশীদার হতে পারতাম সব কিছুর।’ এখানে সম্মানসূচক সর্বনাম ব্যবহারের কারণ হচ্ছে ৫১ বছর প্রেমে, মানসিক ও শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে থাকার পরও তারা পরস্পরকে সম্বোধন করতেন ‘আপনি’সর্বনামে। অদ্ভুত লাগে, তাহলে তাদের প্ৰেম, চুম্বন, সঙ্গমও ছিলো দার্শনিক- এক ধরনের বিয়িং অ্যান্ড নাথঃনেস? একসাথে ছিলেন ৫১ বছর, ১৯২৯এ পরিচয় হওয়ার সময় থেকে ১৫ এপ্রিল ১৯৮০তে সার্ত্রের মৃত্যু পর্যন্ত। ঘনিষ্ঠতার পর তাৱা তাদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবেন, ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করেন অস্তিত্ববাদী রীতিতে, সিদ্ধান্তে পৌছেন অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্যে কখনো কখনো ধরা দেবেন। ‘অনিশ্চিত’ বা ‘আকস্মিক’ বা ‘ঘটনাচক্ৰজাত’ বা ‘কান্টিঞ্জেন্ট’ প্রেমের কাছে, যা অনিবার্য নয়, নিতান্তু আকস্মিক, যা তারা দুজনেই করেছেন, এবং জানিয়েছেন। পরস্পরকে। সার্ত্র অবশ্য লুকোচুরি করেছেন। বিয়ে তাঁদের জন্য সুবিধাজনক হতো আর্থিকভাবে, কিন্তু তারা তা বেচে নেন নি; কেননা বিয়ে, এমনকি একত্রবাস, মানুষের জন্যে ক্ষতিকর, তাতে ‘এক’ আরেককে পরিণত করতে চায় ‘অপর’-এ, এক হয়ে উঠতে চায় কর্তা, অপরকে পর্যবসিত করতে চায় কর্মে। সার্ত্র একটি মেয়ে দত্তক নিয়েছিলেন, বোভোয়ার তাও নেন নি; তিনি যেমন নিজের জরায়ু থেকে একটি নকল দ্য বোভোয়ার প্রসব করতে চান নি, তেমনি চান নি সার্ত্রের একটি প্ৰতিলিপি। ১৯৩০-এর দশকের জন্যে তাঁদের সম্পর্ক ছিলো খুবই অসামাজিক, অপ্রথাগত। এতে বোভোয়ারের পরিবারে নানা গোলমাল দেখা দিয়েছিলো; তাঁরা একসাথেও থাকতেন না, লিভ টুগেদার করতেন না, কেননা এটাও এক ধরনের বিয়ে যা ধ্বংস করে মানুষকে; তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় স্বল্পকাল একসাথে ছিলেন। পৃথকভাবে থাকতেন তাঁরা, সাধারণত হোটেলে সন্ধ্যায় দেখা করতেন, পড়তেন ও সমালোচনা করতেন পরস্পরের লেখা। যখন বিখ্যাত হয়ে উহেন তাঁরা সাহিত্যজগতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা অসম্ভব হয়ে ওঠে তাঁদের পক্ষে; তখন তারা সকলের চোখ এড়ানোর জন্যে কাফের পর কাফে বদলাতে থাকেন। বোভোয়ার বেছে নিয়েছিলেন। নারীদের জন্যে প্রথাগত পেশাই, শিক্ষকতা: বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, খুবই ক্ষুদ্র এলাকায়, ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত মার্সেই ও রোয়েঁ-এ লিসে অর্থাৎ ফরাশি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দর্শন পড়াতেন কোন কোন প্লাতো আরিস্ততল? ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৩ পর্যস্ত শিক্ষকতা করেন প্যারিসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি দেখা দেন অস্তিত্ববাদী আন্দোলনের এক প্রধান রূপে।
তিনি ঘটনা বর্ণনা করতে, দার্শনিক তত্ত্ব তৈরি করতে, এবং স্মৃতিচারণ করতে পছন্দ করতেন, যা তিনি নিন্দে করেছেন দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ সীমাবদ্ধ, গৃহবন্দী, নারীদের এক প্রিয় ব্যাপার ব’লে: তিনি বর্ণনা করেছেন ছোটো মেয়ে বোভোয়ার মায়ের সাথে ভোরবেলা যাচ্ছে খ্রিস্টের নৈশভোজের পর্ব উদযাপনে, মাসে; এর মধুর স্মৃতি সত্ত্বেও স’রে আসেন। তিনি ধর্ম থেকে, দেখতে পান ধর্ম একটা ধ্যাপ্পা; বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন তাঁর বিদ্যালয়, ক্যুর আদেলি দেসির, কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে, এবং কৈশোরেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন ধর্মে, এটা তাঁর ক্যাথলিক মা ও তাঁর মধ্যে সৃষ্টি করে একটি দেয়াল। মগজ থাকলে হৃদয় থাকবে না। কাম থাকবে না, এটা কোনো কথা নয়; বরং দেখা গেছে মগজি নারীরা প্ৰেমে-কামে অদ্বিতীয়, এটাও এক সৃষ্টিশীলতা; ১৫ বছর বয়সে তার মনে হয় তিনি প্রেমে পড়েছেন খালাতে ভাই শাঁপিনেলের, যে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ফ্রান্সের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ লেখকের লেখার সাথে; তার মা ওসব বইয়ের আপত্তিকর পাতাগুলো পিন দিয়ে আটকে রাখতেন। শাপিনেলের সাথে প্ৰেম তেতো হয়ে ওঠে, যখন শপিনেলে তার বোহেমীয় জীবন ছেড়ে বিয়ে করে এক ধনী নারীকে, যে নিয়ে আসে একটা বড়ো মাপের পণ। পণের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ; ফ্রান্সে এটা ছিলো, এবং তিক্তিভাবে ছিলো দ্য বোভোয়ারের মনে।
তিনি নিজের মধ্যে মিলিয়েছিলেন কর্ম ও জ্ঞানকে; তাই তিনি থেকেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কেন্দ্রে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫) তিনি নাটশি অবরোধের বিরুদ্ধে ফরাশি প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন; এ-অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন লে মাদারে (১৯৫৪) উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাস উপস্থাপন করে অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রধান সিদ্ধান্তগুলো, দ্য বোভোয়ার সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন একগুচ্ছ উপন্যাস দিয়ে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ল এভিতে (১৯৪৩: সে থাকতে এসেছে) এটিতে ব্যক্ত হয়েছে যে-দর্শন তা দেখা যায় দ্বিতীয় লিং-এ। এটিতে এক দম্পতির সাথে আরেকটি তরুণী বাস করে দীর্ঘকাল ধরে, এতে তাদের সম্পর্ক কী সূক্ষ্মভাবে ভেঙে পড়ে, তার রূপ দেখিয়েছেন তিনি; এবং দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ যা দেখিয়েছেন পাতায় পাতায়। একটি সত্তার সাথে আরেকটি সত্তার সম্পর্কের সমস্যা, যাতে একটি সত্তা মৌলরুপে হয়ে উঠে খাদক, অন্যটি হয়ে ওঠে খাদ্য, শিকারী ও শিকার, এর বিকাশ ঘটে এ-উপন্যাসেই। এর ঘটনা এসেছে বোভোয়ার ও সার্ত্রের ব্যক্তিগত জীবন থেকেই, নিজের জীবনকে তিনি পরিণত করেন উপন্যাস : সার্ত্রের তরুনী ছাত্রী, ওলগা কোসাকিওইজ, থাকতো তাঁদের সাথে, থাকার মধ্যে ছিলো একটা প্রথাবিরোধী চুক্তি, যা রূপ নেয় উপন্যাসে। দ্বিতীয় উপন্যাসে, অন্যদের রক্ত-এ, আর ব্যক্তিগত জীবন নয়, বিষয় হয় দার্শনিক সমস্যা; এর নায়িকা হেলেন বেরত্রা যখন দেখে একটি ছোটো ইহুদি মেয়েকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে গোস্টাপোরা, সে তখন অংশ নেয়। ফ্রান্সে জর্মন অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধসংগ্রামে, এবং বিশ্বাস পোষণ কয়ে যে হিটলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার একটিই উপায়ঃ হিংস্ৰতা। যে-অমানবিক হত্যাযজ্ঞ ঘটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে, তাতে মৃত্যুর প্রতি নিবদ্ধ হয় তার সংবেদনশীলতা, এবং তিনি লেখেন সব মানুষই মরণশীল (১৯৪৬)। এর নায়ক অমর, সে তেরো থেকে বিশশতক পর্যন্ত সাতটি শতাব্দী ভ্ৰমণ করে; এবং উপন্যাসটি বুঝিয়ে দেয় যে অমরতা কোনো সমাধান নয়, মৃত্যু থেকেই উঠে আসে জীবনের অর্থ।