এ-পরাজয়বাদের পরিণতিরূপে নারী সহজেই মেনে নেয় পরিমিত সাফল্য; সে অতিশয় উচ্চ লক্ষ্য পোষণের সাহস করে না। অগভীর প্রস্তুতি নিয়ে তার পেশায় ঢুকে নারী অবিলম্বে নির্ধারণ করে তার অভিলাষের সীমা। নিজের জীবিকা নিজে উপার্জন করতে পারলেই নিজেকে তার যথেষ্ট মেধাবী মনে হয়; আরো অনেকের মতো সে একটি পুরুষের কাছে সমর্পণ করতে পারতো তার ভাগ্য। তার স্বাধীনতা লাভের। বাসনা পোষণ করে যাওয়ার জন্যে দরকার পড়ে একটা প্রচেষ্টা, এতে সে গর্ববোধ করে, কিন্তু এটা তাকে শেষ করে ফেলে। তার মনে হয় সে কিছু করতে মনস্থ করেই যথেষ্ট করে ফেলেছে। ‘এটাই একটি নারীর জন্যে বিশেষ মন্দ নয়’, সে ভাবে। এক নারী, যে কাজ করছিলো একটা অপ্রথাগত পেশায়, একবার বলেছিলো : যদি আমি পুরুষ হতাম, তাহলে আমি শীর্ষে পৌছোনোর কথা ভাবতাম; তবে এমন একটি পদে অধিষ্ঠিত ফ্রান্সে আমিই একমাত্র নারী : এ-ই আমার জন্যে যথেষ্ট। এপরিমিতিবোধের মধ্যে দূরদর্শিতা রয়েছে। নারী ভয় পায় বেশি দূরে যাওয়ার চেষ্টা করে সে তার মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলবে।
বলা আবশ্যক যে স্বাধীন নারী ন্যায্যভাবেই বিচলিত বোধ করে একথা ভেবে যে তার ওপর লোকজনের আস্থা নেই। সাধারণভাবে, উচ্চবর্ণ বিরূপ থাকে নিম্নবর্ণ থেকে আসা নবাগতের প্রতি : শাদা মানুষেরা কোনো নিগ্রো চিকিৎসক দেখাবে না, পুরুষেরা দেখাবে না কোনো নারী ডাক্তার; কিন্তু নিম্নবর্ণের লোকেরা, তাদের বিশেষ নিকৃষ্টতা সম্পর্কে ধারণাবশত এবং তাদের বর্ণের যে-লোকটি তার প্রথাগত ভাগ্যের ওপরে উঠেছে, তার প্রতি তীব্র বিরাগবশত, তারাও পছন্দ করবে প্রভুদের কাছে যেতে। অধিকাংশ নারী পুরুষের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভক্তির ফলে ব্যথভাবে পুরুষ খোঁজে ডাক্তারের মধ্যে, আইনজীবীর মধ্যে, অফিসের ব্যবস্থাপক প্রভৃতির মধ্যে। একজন নারীর অধীনে পুরুষও থাকতে চায় না নারীও থাকতে চায় না। তার উতনেরা তার সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করলেও সব সময়ই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থেকে কিছুটা প্রসন্নতা দেখাবে তার প্রতি; নারী হওয়া একটা ক্রটি না হলেও অন্তত একটা অদ্ভুতত্ব। নারীকে অবিরাম অর্জন করতে হয়আস্থা, যা প্রথম তার প্রতি পোষণ করা হয় না : শুরুতে সে হয় সন্দেহের পাত্র, তাকে প্রমাণ করতে হয় তার যোগ্যতা। যোগ্যতা থাকলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, তারা এরকম বলে। তবে যোগ্যতা কোনো পূৰ্বদত্ত সারবস্তু নয়; এটা একটি সফল বিকাশের পরিণতি। কোনো একজনের বিরুদ্ধে একটা প্রতিকূল পূর্বসংস্কারের ভার বোধ করা খুব কম সময়ই তাকে তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। প্রারম্ভিক হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষা সাধারণত তাকে চালিত করে প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়ার দিকে, যা ধারণ করে একটি অতিরঞ্জিত কর্তৃত্বের কৃত্রিম আচরণের রূপ।
অধিকাংশ নারী চিকিৎসক, উদাহরণস্বরূপ, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত বা অতিশয় কম কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ করেন। যদি তারা স্বাভাবিক আচরণ করেন, তাঁরা ব্যর্থ হন নিয়ন্ত্রণে, কেননা সামগ্রিকভাবে জীবন তাদের প্রস্তুত করে প্রলুব্ধ করার জন্যে, কর্তৃত্ব করার জন্যে নয়; যে-রোগী শাসিত হতে চায়, সে হতাশ হবে সরলভাবে দেয়া পরামর্শে। এ-ব্যাপারে সচেতন হয়ে নারী চিকিৎসকেরা কথা বলেন গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে, চরম কর্তৃত্বপূর্ণ কঠে; তবে এতে তিনি হারিয়ে ফেলেন সে-রুক্ষ কিন্তু সরল ও স্পষ্টবাদী স্বভাব, যা নিজের সম্বন্ধে নিশ্চিত চিকিৎসকের আকর্ষণীয়তা।
পুরুষ নিজের অধিকার দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে অভ্যস্ত; তার খরিদ্দাররা বিশ্বাস করে তার যোগ্যতায়; সে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে : সে অভ্রান্তভাবে প্রভাব। বিস্তার করে। নারী একই রকম নিরাপত্তার বোধ জাগায় না; সে অহঙ্কারী আচরণের ভাব করে, তা ছেড়ে দেয়, সে এটা অতিরঞ্জিত করে। ব্যবসায়, প্রশাসনিক কাজে, সে যথাযথ, বুৎপুঁতে, সে সহজেই দেখায় আগ্রাসিতা। যেমন তার পড়াশুনোয়, তার অভাব স্বাচ্ছন্দ্য, তেজস্বিতা, দুঃসাহসের। সাফল্য অর্জনের প্রয়াসে সে হয়ে ওঠে উত্তেজিত। তার কর্মকাণ্ড হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতার ও আত্মঘোষণার পরম্পরা। এটাই সে-সাংঘাতিক ক্রটি, যা উদ্ভূত হয় আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকে : কর্তা ভুলতে পারে নিজেকে। সে অকুতোভয়ে কোনো লক্ষ্যের দিকে নিবিষ্ট থাকে না : নির্ধারিত পথেই সে বরং উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়। সাহসের সাথে লক্ষ্যের দিকে এগোনোর মধ্যে মানুষ খুঁকি নেয় আশাভঙ্গের, তবে সে অভাবিত ফলও লাভ করে; সাবধানতা দণ্ডিত করে মাঝারিত্বে।
খুব কম সময়ই স্বাধীন নারীর মধ্যে আমরা দেখতে পাই দুঃসাহসিক অভিযাত্রা এবং অভিজ্ঞতার জন্যে অভিজ্ঞতা অর্জনের রুচি, বা কোনো নিরাসক্ত ঔৎসুক্য; সে অর্জনের চেষ্টা করে একটি কর্মজীবন যেমন অন্য নারীরা গড়ে তোলে সুখের নীড়; সে নিয়ন্ত্রিত, পরিবৃত থাকে পুরুষের জগত দিয়ে। তার দুঃসাহস নেই এর ছাদ। ভেঙেচুরে বেরিয়ে যাওয়ার, সে সংরক্তভাবে নিজেকে তার কর্মপরিকল্পনায় নিয়োগ করে না। এখনও সে তার জীবনকে গণ্য করে একটা সীমাবদ্ধ কর্মোদ্যোগরূপে : কোনো বস্তুগত লক্ষ্য অর্জন তার উদ্দেশ্য নয়, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে লক্ষ্যবস্তুর মাধ্যমে তার মন্ময় সাফল্য অর্জন করা। এ মনোভাব, উদাহরণস্বরূপ, খুবই দেখা যায় মার্কিন নারীদের মধ্যে; তারা এটা প্রকাশ করতে খুবই পছন্দ করে যে তারা একটি চাকুরি করতে এবং এটা খুবই ভালোভাবে সমাধা করতে সমর্থ; তবে তারা তাদের কাজের। আধের প্রতি সংরক্তভাবে আকর্ষণ বোধ করে না। একই রকমে নারীর প্রবণতা আছে যে সে অতিশয় গুরুত্ব দেয় ছোটোখাটো বাধাবিপত্তি ও সামান্য সাফল্যের ওপর; সে পদে পদে নিরুৎসিত হয় বা অহমিকায় স্ফীত হয়ে ওঠে। যখন কোনো সাফল্যের প্রত্যাশা দেখা দেয়, তখন মানুষ তা ধীরভাবে গ্রহণ করে; কিন্তু যখন এটা লাভ সম্পর্কে সে ছিলো সন্দেহপরায়ণ, তখন এটা হয় এক মাদকতাপূর্ণ বিজয়োল্লাস। এটাই সে-অজুহাত, যখন নারীরা তালগোল পাকিয়ে ফেলে প্রতিপত্তিতে এবং আঁকালো গৌরব বোধ করে তাদের তুচ্ছ সাফল্যে। তারা কতো দূর এসেছে, তা দেখার জন্যে তারা সব সময়ই পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকে, এবং ব্যাহত করে তাদের অগ্রগতি। এ-পদ্ধতিতে তারা সম্মানজনক সাফল্য অর্জন করতে পারে কর্মজীবনে, কিন্তু অসাধারণ কিছু অর্জন করতে পারে না। এটাও বলা করা দরকার যে বহু পুরুষও কর্মজীবনে মাঝারি সাফল্যের বেশি কিছু অর্জন করতে পারে না। শুধু পুরুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠদের সঙ্গে তুলনায়ই–অতিশয় দুর্লভ ব্যতিক্রমগুলো বাদে–নারী পেছনে পড়ে আছে বলে আমাদের মনে হয়। আমি যে-কারণগুলো দেখিয়েছি, সেগুলোই এটা ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করে, এবং কোনোক্রমেই সেগুলো বন্ধক দেয় না ভবিষ্যৎকে। অসামান্য কোনো কাজ করার জন্যে নারী আজ মূলত যার অভাব বোধ করে, তা হচ্ছে তার আত্মবিস্মৃতি; কিন্তু নিজেকে ভুলে যাওয়ার জন্যে প্রথমে যা দরকার, তা হচ্ছে এটা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া যে এখন এবং ভবিষ্যতের জন্যে সে লাভ করেছে নিজেকে। পুরুষের বিশ্বে ভিন্নভাবে এসে, তাদের দ্বারা স্বাভাবিক দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে দীনহীন কাজে নিযুক্ত হয়ে, নারী আজো আত্মানুসন্ধানে ব্যস্ত।