তার শিক্ষানবিশির পর্বে নারী নিজেকে দেখতে পায় এক হীনতার অবস্থানে, তরুণীর প্রসঙ্গে যে-বিষয়টি ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে, তবে তা এখন আরো যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার। তার পড়াশুনোর কালে ও তার কর্মজীবনের প্রথম নিশ্চায়ক বছরগুলোতে, খুব কম সময়ই নারী তার সুযোগগুলো সরাসরি ব্যবহার করে এবং তাই প্রায়ই খারাপভাবে শুরু করে পরে সে হয় প্রতিবন্ধকতাগ্রস্ত। যে-সব। সংঘাতের কথা আমি বলেছি, সেগুলো, প্রকৃতপক্ষে, সর্বাধিক তীব্রতায় পৌছে আঠারো থেকে তিরিশ বছর বয়সের মধ্যে, ঠিক সে-সময়ে, যখন পেশাগত ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে। নারীটি তার পরিবারের সঙ্গেই থাকুক বা বিবাহিতই হোক তার পরিবার পুরুষের কাজের প্রতি যে-শ্রদ্ধা দেখায়, তার কাজের প্রতি কদাচিৎ দেখায় সমান শ্রদ্ধা; তারা তার ওপর চাপিয়েদেয় নানা দায়িত্ব ও কাজ এবং খর্ব করে তার স্বাধীনতা। সে নিজেই গভীরভাবে প্রভাবিত থাকে তার লালনপালন দিয়ে, বড়োরা যে-সব মূল্যবোধ দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছে, সেগুলোর প্রতি সে থাকে শ্রদ্ধাশীল, থাকে তার শৈশব ও বয়ঃসন্ধির স্বপ্ন দিয়ে গ্রস্ত; তার অতীতে উত্তরাধিকার ও তার ভবিষ্যতের আগ্রহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে সে পড়ে বিপদে। অনেক সময় সে প্রকাশ্যে শপথ নেয় তার নারীত্ব পরিহারের, সে দ্বিধাণ্বিত থাকে সতীত্ব, সমকামিতা, ও একটা আক্রমণাত্মক রণচণ্ডী মনোভাবের মধ্যে; সে বাজে বেশবাস করে বা পুরুষের পোশাক পরে; এবং এ-ক্ষেত্রে সে প্রচুর সময় নষ্ট করে ঔদ্ধত্য দেখিয়ে, ভাব দেখিয়ে, রাগে ফুঁসে উঠে। অধিকাংশ সময়ই সে জোর দিতে চায় তার নারীসুলভ গুণাবলির ওপর : সে হয় ছেনালধর্মী, সে ধাইরে যায়, সে ফষ্টিনষ্টি করে, সে প্রেমে পড়ে, দুলতে থাকে মর্ষকাম ও আক্রমণাত্মকতার মধ্যে। সে প্রশ্ন করে, বিক্ষুব্ধ হয়, দিকে দিকে সে বিক্ষিপ্ত করে নিজেকে। এসব বাহ্যিক কর্মকাণ্ডই তাকে তার কর্মোদ্যোগে পুরোপুরি নিবিষ্ট হওয়ায় বাধা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট; সে এ দিয়ে যতো কম উপকৃত হয়, সে ততো বেশি প্ররোচিত বোধ করে এটা ছেড়ে দিতে।
যে-নারীর লক্ষ্য স্বাবলম্বী হওয়া, তার জন্যে যা চরমভাবে মনোবল ভেঙে দেয়ার মতো ব্যাপার, তা হচ্ছে তার একই মর্যাদার অন্যান্য নারীদের অস্তিত্ব, শুরুর দিকে যাদের ছিলো একই পরিস্থিতি ও একই সুযোগসুবিধা, যারা আছে পরগাছার মতো। পুরুষ ক্ষোভ বোধ করতে পারে বিশেষ সুবিধাভোগী পুরুষের প্রতি, তবে সে সংহতি বোধ করে তার শ্রেণীর সাথে; সাধারণত যারা একই সুযোগসুবিধা নিয়ে শুরু করে জীবনে, তারা একই সাফল্য অর্জন করে। আর সেখানে একই পরিস্থিতির নারীরা পুরুষের মধ্যস্থতায় অর্জন করতে পারে খুবই ভিন্ন ধরনের সৌভাগ্য। যে-নারী নিজে সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করছে, তার পথে একটা প্রলোভন হয়ে দেখা দেয়। আরামদায়কভাবে বিবাহিত বা পুরুষের ভরণপোষণপ্রাপ্ত কোনো একটি বান্ধবী; সে বোধ করে যে অত্যন্ত কঠোর পথে যাত্রা করে সে নিজেকে অযৌক্তিকভাবে নষ্ট করছে; প্রতিটি বাধার মুখে সে ভাবে ভিন্ন পথ নেয়াই হয়তো ভালো ছিলো। ‘যখন আমি ভাবি যে আমার নিজের মগজ দিয়েই আমাকে পেতে হবে সব কিছু!’ যেনো ওই চিন্তা তাকে বিমূঢ় করে ফেলেছে, এমনভাবে একটি দারিদ্রগ্রস্ত ছাত্রী আমাকে একথা বলেছিলো। পুরুষ মেনে চলে এক অত্যাবশ্যক জরুরি প্রয়োজনকে; নারীকে অবিরত দৃঢ়ভাবে পুনর্ব্যক্ত করতে হয় তার অভিপ্রায়। সে একটি লক্ষ্যের ওপর স্থিরভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সামনের দিকে এগোয় না, বরং তার চারদিকের প্রতিটি অভিমুখে ঘুরতে থাকে তার দৃষ্টি এবং তার চলার ভঙ্গিও ভীরু ও অনিশ্চিত। যতোই সে নিজের পথে এগোতে থাকে বলে মনে হয় ততই তার অন্য সুযোগগুলো লোপ পেতে থাকে; একটি নীলমুজো হয়ে, মস্তিষ্কশীল নারী হয়ে, সে সাধারণত পুরুষের কাছে নিজেকে করে তুলবে আকর্ষণহীন, বা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে সে অবমানিত করবে তার স্বামী বা প্রেমিককে। তাই সে আরো বেশি করে আভিজাত্য ও চটুলতাই শুধু দেখাতে থাকবে না, সে নিয়ন্ত্রণ করবে তার উচ্চাকাঙ্খা। নিজের দায়িত্ব নিজে নেয়া থেকে একদিন সে মুক্তি পাবে, এ-আশা এবং যদি কখনো তা পায়, তাহলে তা হারিয়ে ফেলার ভয় একত্র হয়ে তাকে বাধা দেয় নিঃশেষে নিজেকে তার পড়াশুনোয় ও তার কর্মজীবনে নিয়োজিত করতে।
নারী যতোটা নারী হতে চায়, তার স্বাধীন মর্যাদা ততোটা সৃষ্টি করে হীনম্মন্যতা ঘূঢ়ৈষা : অন্য দিকে, তার নারীত্ব তাকে সন্দেহী করে তোলে তার পেশাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। এটা এক অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা দেখেছি যে চোদ্দো বছরের মেয়েরা একজন অনুসন্ধানকারীর কছে ঘোষণা করেছে : ‘ছেলেরা মেয়েদের থেকে শ্ৰেষ্ঠ; তারা অধিকতর ভালো কর্মী’। তরুণী মেয়েনিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে তার সামর্থ সীমিত। পিতামাতারাও শিক্ষকেরা যেহেতু স্বীকার করে যে মেয়েদের মেধার স্তর ছেলেদের থেকে নিম্ন, ছাত্রছাত্রীরাও তা অবিলম্বে স্বীকার করে নেয়; এবং বাস্তবিকপক্ষে, সমান পাঠক্রম সত্ত্বেও, ফ্রান্সের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের শিক্ষাগত সাফল্য অনেক নিচে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, দর্শনে মেয়েদের শ্রেণীর সব সদস্য, উদাহরণস্বরূপ, সুস্পষ্টভাবেই ছেলেদের শ্রেণীর নিচে। ছাত্রীদের মধ্যে অধিকাংশ আর পড়াশুনো চালাতে চায় না, এবং খাটে অগভীরভাবে; আর অন্যদের অভাব রয়েছে সমকক্ষ হওয়ার সাধনা করার উদ্দীপকের। খুব সহজ পরীক্ষায় তাদের অযোগ্যতা অতিশয় স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে না, তবে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ছাত্রীটি সচেতন হয়ে উঠবে তার দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে। সে এজন্যে তার প্রশিক্ষণের মাঝারিত্বকে দায়ী করবে না, দায়ী করবে তার নারীত্বের অন্যায় অভিশাপকে; নিজেকে এ-অসাম্যের কাছে সমর্পণ করে সে বাড়িয়ে তোলে এটি; তাকে প্ররোচিত করা হয় যে তার সাফল্যের সুযোগ আসতে পারে শুধু তার ধৈর্য ও প্রয়োগের মধ্যে; সে গ্রহণ করে তার সময় ও শক্তির ব্যাপারে যথাসম্ভব মিতব্যয়ী হওয়ার দৃঢ়সংকল্পনিশ্চিতভাবেই একটা খারাপ পরিকল্পনা।