পুরুষ যেমন প্রায়ই রক্ষিতা রাখে, সেভাবে একটি স্থায়ী প্রেমিক রাখা, এবং তার ভরণপোষণ করা বা আর্থিকভাবে তাকে সাহায্য করা সম্ভব শুধু ধনাঢ্য নারীদের পক্ষে। অনেকে আছে, যারা এ-ব্যবস্থাকে প্রীতিকর মনে করে; টাকা দিয়ে তারা পুরুষটিকে পরিণত করে নিতান্তই একটি হাতিয়ারে এবং তাকে ব্যবহার করতে পারে ঘৃণ্য অসংযমের সাথে। তবে সাধারণত, কাম ও আবেগকে এতোটা স্থূলভাবে বিচ্ছিন্ন। করার জন্যে ওই নারীদের হতে হয় বুড়ো। অনেক পুরুষ আছে, যারা কখনো দেহ ও চৈতন্যকে পৃথক করা মেনে নেয় না; এবং আরো অধিক কারণবশত অধিকাংশ নারীই এটা গ্রহণ করতে সম্মত হবে না। তাছাড়াও, এতে আছে প্রতারণা, যার প্রতি তারা পুরুষের থেকেও বেশি সংবেদনশীল; কেননা টাকা ব্যয় করে যে-খরিদ্দার, সে নিজেও হয়ে ওঠে একটি হাতিয়ার, কেননা তার সঙ্গী তাকে ব্যবহার করে জীবিকার উপায় হিশেবে। উপায় থাকলেও একটি পুরুষ ক্রয় করাকে নারী কখনোই একটি সন্তোষজনক সমাধানরূপে মেনে নেবে না।
আছে একটি নারীধর্মী কাজ, যা সম্পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যে সম্পন্ন করা বাস্তবিকভাবে প্রায়-অসম্ভব। এটা মাতৃত্ব। ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় এবং অন্য কিছু দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কল্যাণে কোনো নারী নিজের ইচ্ছে অনুসারে অন্তত গর্ভধারণে রাজি নাও হতে পারে। ফ্রান্সে তাকে প্রায়ই ঠেলে দেয়া হয় যন্ত্রণাদায়ক ও ব্যয়বহুল গর্ভপাতের দিকে; নইলে তাকে বহন করতে হয় একটি অবাঞ্ছিত সন্তানের দায়, যা ধ্বংস করে দিতে পারে তার পেশাগত জীবন। এটা যে একটি ভারি দায়ভার, তার কারণ হচ্ছে। প্রথা নারীকে তার যখন ইচ্ছে তখন সন্তান জন্ম দিতে দেয় না। অবিবাহিত মা সমাজের একটি কেলেঙ্কারি; এবং অবৈধ জন্ম শিশুটির জন্যে একটি কলঙ্ক; বিয়ের শেকল না পরে বা গোত্রচ্যুত না হয়ে মা হওয়া খুব কম সময়ই সম্ভব। কৃত্রিম পরিনিষেকর ধারণাটি যে বহু নারীকেই আকৃষ্ট করে, তার কারণ এ নয় যে তারা পুরুষের সাথে সঙ্গম এড়াতে চায়; এর কারণ হচ্ছে তারা আশা করে অবশেষে সমাজ স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে মাতৃত্বের স্বাধীনতাকে। এ-সাথে বলা দরকার যে সুবিধাজনক দিবা শিশুপালনকেন্দ্র ও কিন্ডারগার্টেন থাকা সত্ত্বেও একটি শিশু থাকা নারীর কর্মকাণ্ডকে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করার জন্যে যথেষ্ট; সে শুধু তখনই কাজে যেতে পারে যদি সে একে রেখে যেতে পারে আত্মীয়দের, বন্ধুদের, বা ভৃত্যদের কাছে। সে বেছে নিতে বাধ্য হয় বন্ধ্যাত্ব, যা প্রায়ই অনুভূত হয় একটি যন্ত্রণাদায়ক হতাশা, এমন বোঝারূপে, যা কর্মজীবনের সাথে আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এভাবেই আজকের স্বাধীন নারী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার পেশাগত আগ্রহ ও তার কামজীবনের সমস্যার মধ্যে; এ-দুয়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য স্থাপন করা তার পক্ষে কঠিন; যদি সে পারে, তাহলে এটা করতে হয় অধিকার ছাড় ও ত্যাগস্বীকারের মূল্যে, যার ফলে তাকে থাকতে হয় এক স্থায়ী স্নায়বিক চাপের মধ্যে। শারীরবৃত্তিক তথ্যে নয়, এখানেই খুঁজতে হবে সে-স্নায়ুদৌর্বল্য ও ভঙ্গুরতার কারণ, যা প্রায়ই দেখা যায় তার মধ্যে। নারীর শারীরিক গঠন তার জন্যে কতোটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তা নির্ণয় করা কঠিন। মাঝেমাঝেই অনুসন্ধান চালানো হয়, উদাহরণস্বরূপ, ঋতুস্রাব কতোটা বাধা সৃষ্টি করে সম্পর্কে। যে-নারীরা প্রকাশনা বা অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁরা এর ওপর খুবই কম গুরুত্ব দিয়ে থাকেন বলে মনে হয়। এর কারণ কি, প্রকৃতপক্ষে, তারা তাদের সাফল্যের জন্যে ঋণী তাদের আপেক্ষিকভাবে কিঞ্চিৎ মাসিক অসুস্থতার কাছে? প্রশ্ন করা যায় এটা কি এ-কারণে নয় যে, এর বিপরীতে, তাদের সক্রিয় ও উচ্চাভিলাষী জীবনই আছে এ-সুবিধার মূলে; নারী তার ব্যাধির প্রতি বোধ করে যে-আগ্রহ, তাই বাড়িয়ে তোলে ব্যাধির প্রকোপ। যে-নারীরা খেলাধুলো ও অন্যান্য সক্রিয় কর্মকাণ্ডে জড়িত, তারা অন্যদের থেকে ব্যাধিতে কম ভোগে, কেননা তারা এর দিকে বিশেষ খেয়ালই করে না। জৈবিক কারণও রয়েছে নিশ্চিতভাবেই, এবং অতি-উদ্যমী নারীদেরও আমি মাসে একবার চব্বিশ ঘণ্টা ধরে বিছানায় কাটাতে দেখেছি, তখন তারা নির্মম পীড়নের এক শিকার; কিন্তু এ-বিপদ তাদের কর্মকাণ্ডে সাফল্য লাভকে ব্যাহত করতে পারে নি।
যখন আমরা নারীর পেশাগত সাফল্য বিচার করি, এবং তার ভিত্তিতে নারীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুর্দান্তভাবে অনুমান করি, তখন এসব ব্যাপার ভুলে গেলে চলবে না। সে কর্মজীবন শুরু করে মানসিকভাবে উৎপীড়িত অবস্থার মধ্যে এবং যখন সে আছে প্রথাগতভাবে নারীত্ব ব্যক্তিগতভাবে তার ওপর যে-বোঝা চাপিয়ে দেয়, তার ভারের নিচে। বাস্তব পরিস্থিতিগুলোও তার অনুকূল নয়। এমন একটি সমাজ, যা বৈরী, বা কমপক্ষে সন্দিগ্ধ, তার ভেতর দিয়ে একটি নতুন পথ তৈরির চেষ্টা নবাগতের জন্যে সব সময়ই কঠিন। ব্ল্যাক বয়-এ রিচার্ড রাইট দেখিয়েছেন শুরু থেকেই কীভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে একটি মার্কিন নিগ্রো তরুণের উচ্চাভিলাষ এবং যে-স্তরে শাদাদের সমস্যা শুরু হয়, সে-স্তরে উঠতেই তাকে কী লড়াই করতে হয়েছে। আফ্রিকা থেকে ফ্রান্সে আগত নিগ্রোরাও মুখখামুখি হয় এমন বাধার তাদের নিজেদের সাথে ও চারপাশের সঙ্গে–যেগুলো, নারীরা যে-সব বাধার মুখোমুখি হয়, সেগুলোর মতো।