এর বিপরীতে, যে-নারী নিজেকে বাতিকগ্রস্তরূপে দেখাতে চায় না, সে খাপ খাওয়াবে প্রচলিত রীতির সাথে। যদি ইতিবাচকভাবে কার্যকর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত না থাকে, তাহলে একটা উদ্ধত মনোভাব গ্রহণ করা অবিবেচনাপ্রসূত : এটা যতোটা সময় ও শক্তি বাঁচার, তার চেয়ে অনেক বেশি অপচয় করে। যে-নারীর আহত করার বা নিজেকে সামাজিকভাবে হেয় করার কোনো সাধ নেই, সে তার নারীধর্মী পরিস্থিতিতে নারীধর্মী রীতিতেই জীবন যাপন করবে; এবং অধিকাংশ সময় এজন্যে যে তার পেশাগত সাফল্য এটা দাবি করে। তবে পুরুষের জন্যে খাপখাওয়ানো যেখানে খুবই স্বাভাবিক প্রথা যেহেতু একজন স্বাধীন ও সক্রিয় ব্যক্তি হিশেবে তারই প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আর সেখানে যে-নারীও যখন কর্তা, সক্রিয়, তখনও তার দরকার পড়বে নিজেকে ধীরে ধীরে সুকৌশলে সে-বিশ্বে প্রবেশ করানো, যা তাকে দণ্ডিত করেছে অক্রিয়তায়। এটাকে করে তোলা হয় আরো বেশি দুর্বহ, কেননা নারীর এলাকায় আটকে থাকা নারীরা এর গুরুত্ব ভীষণভাবে বহু গুণে বাড়িয়ে তুলেছে : তারা বেশবাস ও গৃহস্থালির কাজকে পরিণত করেছে দুরূহ কলায়। পুরুষকে তার পোশাকের কথা ভাবতেই হয় না, কেননা তার পোশাক সুবিধাজনক, তার সক্রিয় জীবনের উপযোগী, ওগুলো অপরিহার্যরূপে মার্জিত নয়; ওগুলো তার ব্যক্তিত্বের কোনো অংশই নয়। এছাড়া, কেউ আশা করে না যে সে নিজে যত্ন নেবে তার পোশাকের : কোনো একটি সহৃদয় ইচ্ছুক বা ভাড়া করা নারী তাকে রেহাই দেয় এ-জ্বালাতন থেকে।
নারী, এর বিপরীতে, জানে যে যখন কেউ তাকায় তার দিকে, তখন সে তাকে তার আকৃতির থেকে ভিন্ন করে দেখে না : তাকে বিচার, শ্রদ্ধা, কামনা করা হয় তার প্রসাধন দিয়ে ও প্রসাধনের মাধ্যমে। তার পোশাকের মূল উদ্দেশ্য ছিলো তাকে ক্লীব করে তোলা, এবং সেগুলো রয়ে গেছে ব্যবহারের অনুপযোগী : লম্বা মোজা ফেঁসে যায়, নিচু হয়ে যায় জুতোর খুড়ের দিকটা, ময়লা হয়ে যায় হাল্কা রঙের ব্লাউজ ও ফ্রক, কাপড়ের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যায়। তবে সারাইয়ের অধিকাংশ কাজ করতে হয় তার নিজেকেই; অন্য নারীরা দয়াপরবশ হয়ে তাকে সাহায্য করতে আসবে না এবং যেকাজ সে নিজে করতে পারে, তার জন্যে সে টাকা ব্যয় করতে চাইবে না : দীর্ঘস্থায়ীগুলোতে, কেশবিন্যাসে, প্রসাধনসামগ্রিতে, নতুন পোশাকে এরমাঝেই অনেক খরচ হয়ে গেছে। সারাদিনের কাজের পর যখন ঘরে ফেরে ছাত্রী ও সহকারিণীরা, তখন তারা সব সময়ই পায় একটা লম্বা মোজা, যেটা ছিড়ে গেছে বলে রিপু করতে হবে, একটা ব্লাউজ, যা ধুতে হবে, একটা স্কার্ট, যা ইস্ত্রি করতে হবে। যে-নারী ভালো আয় করে, সে নিজেকে মুক্তি দেবে এসব নীরস একঘেয়ে খাটুনি থেকে, তবে তাকে রক্ষা করতে হবে আরো জটিল আভিজাত্য; তার সময় নষ্ট হবে কেনাকাটায়, পোশাক মানানসই করায়, ও আরো বহু কিছুতে। প্রথা আরো চায় এমনকি একলা নারীকেও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে তার বাসস্থানের প্রতি। নতুন কোনো নগরে দায়িত্ব পেয়েছে, এমন কোনো কর্মকর্তা সহজেই একটি হোটেলে আবাসন পাবে; কিন্তু একই পদের একটি নারী চাইবে থাকার জন্যে তার নিজের একটি জায়গা। তাকে এটা রাখতে হবে নিখুঁতভাবে পরিচ্ছন্ন, কেননা লোকজন নারীর বেলা অবহেলা ক্ষমা করবে, যা তারা স্বাভাবিক বলেই মনে করবে পুরুষের বেলা।
যে-নারী তার শক্তি ব্যয় করে, যার আছে দায়িত্ব, যে জানে বিশ্বের বিরোধিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম কতো কঠোর, পুরুষের মতোই–শুধু বাস্তব কামনা পরিতৃপ্ত করলেই তার চলে না, তার আরো দরকার পড়ে প্রীতিকর যৌন রোমাঞ্চের মধ্য দিয়ে বিনোদন ও আমোদপ্রমোদ উপভোগ। এখন, আজো আছে বহু সামাজিক বৃত্ত, যেখানে এব্যাপারে তার স্বাধীনতা স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়নি; সে এটা প্রয়োগ করলে তার ঝুঁকি থাকে মানসম্মান, চাকুরি হারানোর; কমপক্ষে তাকে করতে হয় একটা ক্লেশকর ভণ্ডামমা। সমাজে যতো বেশি দৃঢ়ভাবে সে প্রতিষ্ঠা করে তার অবস্থান,লোকজন ততো বেশি প্রস্তুত থাকে চোখ বুজে থাকতে; কিন্তু বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলগুলোতে সচরাচর তার ওপর চোখ রাখা হয় চরম কঠোরভাবে। এমনকি সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশে–যেখানে জনমতের ভীতি সামান্য। সেখানেও এ-ব্যাপারে তার পরিস্থিতি পুরুষের সমতুল্য নয়। এ-পার্থক্য নির্ভর করে প্রথাগত মনোভাব ও নারীর কামের বিশেষ প্রকৃতি উভয়েরই ওপর।
নারীর জন্যে একটি সম্ভবপর সমাধান হচ্ছে রাস্তা থেকে এক রাত বা এক ঘণ্টার জন্যে একটি সঙ্গী নিয়ে আসা–মনে করা যাক নারীটি যেহেতু সংরাগপূর্ণ ধাতের এবং সে কাটিয়ে উঠেছে তার সব সংকোচ, তাই সে ঘেন্না না করে এটা মনস্থ করতে পারে–তবে এ-সমাধান পুরুষের জন্যে যতোটা বিপজ্জনক নারীর জন্যে তার থেকে অনেক বেশি। তার যৌনব্যাধির ঝুঁকি গুরুতর, কেননা পুরুষটিরই দায়িত্ব সংক্রমণের বিরুদ্ধে সাবধানতা অবলম্বনের; এবং যতোই সাবধান হোক-না-কেনো নারীটি কখনোই গর্ভধারণের বিপদ থেকে সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত নয়। কিন্তু অপরিচিতদের মধ্যে এমন সম্পর্কে–যে-সম্পর্ক স্থাপিত একটা বর্বরতার স্তরে–যা সবচয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে তাদের শারীরিক শক্তির পার্থক্য। পুরুষ যে-নারীটিকে বাসায় আনে, তার থেকে পুরুষটির ভয় পাওয়ার বিশেষ কিছু নেই; তাকে নিতান্তই যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রস্তুত থাকতে হয় আত্মরক্ষার জন্যে। যে-নারী বাসায় পুরুষ আনে, তার জন্যে এটা একই ব্যাপার নয়। আমাকে দুটি নারীর কথা বলা হয়েছিলো, যারা সদ্য এসেছিলো প্যারিসে এবং আগ্রহ বোধ করেছিলো ‘জীবন দেখা’র জন্যে; তারা রাতে একটু ঘোরাঘুরির পর দুটি আকর্ষণীয় মৎমাৎ চরিত্রকে নিমন্ত্রণ করে রাতের ভোজে। ভোরবেলা তারা দেখে ডাকাতি হচ্ছে বাসায়, তাদের প্রহার করা হচ্ছে, এবং গোপন কথা ফাঁস করে দেয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে। আরো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে চল্লিশ বছর বয়স্ক, বিচ্ছেদপ্রাপ্ত, এক নারীর ক্ষেত্রে, যে সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করতে তিনটি সন্তান ও বুড়ো পিতামাতাকে পালনের জন্যে। তখনো সে আকর্ষণীয়, কিন্তু সামাজিক জীবনের জন্যে বা ছেনালিপনার জন্যে এবং একটা প্রেমের সম্পর্ক তৈরির জন্যে প্রথানুসারী কার্যকলাপের জন্যে তার একটুও সময় ছিলো না। তবে তার ছিলো তীব্র অনুভূতি, এবং সে বিশ্বাস করতো যে তার অধিকার আছে ওগুলো পরিতৃপ্ত করার। তাই সে মাঝেমাঝে রাতে বেরোতো রাস্তায় এবং একটা পুরুষ ধরতো। তবে এক রাতে, বোই দ্য বলনের ঝোপঝাড়ে দু এক-ঘণ্টা কাটানোর পর, তার ক্ষণিকের প্রেমিক তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়না; একসাথে বাসের ব্যবস্থা করার জন্যে সে চায় নারীটির নাম ও ঠিকানা, আবার দেখা করতে চায় তার সাথে। নারীটি রাজি না হওয়ায় পুরুষটি তাকে প্রচণ্ড মারধোর করে এবং শেষে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে প্রায় মৃত্যুর আতঙ্কে ফেলে রেখে চলে যায়।