যেমন প্রায় সব পশুর ক্ষেত্রে তেমনি মানুষের ক্ষেত্রেও নারীপুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান, পশ্চিমে লৈঙ্গিক অনুপাত হচ্ছে যেখানে ১০৫.৫টি পুরুষ আছে নারী আছে ১০০টি। দুটি লিঙ্গেরই ভ্রূণগত বিকাশ ঘটে একইভাবে; তবে, নারী ভ্রূণে আদিম জীবাণুজাত এপিথেলিয়ম (যা থেকে বিকাশ ঘটে অণ্ডকোষ বা ডিম্বাশয়ের) বেশি সময় ধরে থাকে নিরপেক্ষ, তাই এটি দীর্ঘতর সময় ধরে থাকে হরমোনের প্রভাবে। এর ফলে অনেক সময়ই এর বিকাশ সম্পূর্ণ উল্টে যেতে পারে। এজন্যেই হয়তো অধিকাংশ ছদ্মউভলিঙ্গ জিনের ধাচ-অনুসারে নারী, যারা পরে পুরুষে পরিণত হয়। মনে করতে পারি যে পুংলিঙ্গ সূচনায়ই তার রূপ পরিগ্রহ করে, আর স্ত্রীলিঙ্গ ভ্রূণ তার নারীত্ব গ্রহণ করে বেশ ধীরে; তবে জণজীবনের এ-আদিপ্রপঞ্চ সম্পর্কে আমরা আজো বেশ কমই জানি, তাই নিশ্চিতভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না।
হরমোনের রাসায়নিক সূত্র বা শরীরসংস্থান দিয়ে নারীকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। তার ভূমিকাগত বিকাশই নারীকে বিশেষভাবে পৃথক করে পুরুষ থেকে।
পুরুষের বিকাশ তুলনামূলকভাবে সরল। জন্ম থেকে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত তার বৃদ্ধির প্রায় পুরোটাই নিয়মিত; পনেরো-ষোলো বছর বয়সে শুরু হয় তার শুক্রাণু উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং চলে বুড়ো বয়স পর্যন্ত; এর উদ্ভবের সাথে উৎপাদন শুরু হয় সেহরমোনের, যা গড়ে তোলে তার দেহের পুরুষসূচক বৈশিষ্ট্য। এ-সময় থেকে পুরুষের যৌনজীবন সাধারণত সমম্বিত হয় তার ব্যক্তিক অস্তিত্বের সাথে : কামনায় ও সঙ্গমে প্রজাতির দিকে তার সীমাতিক্ৰমণতা অভিন্ন হয়ে ওঠে তার আত্মগততার সাথে সে হচ্ছে তার শরীর।
নারীর কাহিনী অনেক বেশি জটিল। তার জণজীবনেই সরবরাহ শুরু হয়ে যায় ওসাইট বা অপুষ্ট ডিম্বাণুর, ডিম্বাশয় ধারণ করে প্রায় ৪০,০০০ অপরিণত ডিম। এদের প্রতিটি থাকে একটি করে ফলিকল বা থলিতে, এবং এগুলোর মধ্যে হয়তো ৪০০টি পৌঁছে পরিণতিতে। জন্ম থেকেই প্রজাতিটি কবলিত করে নারীকে এবং তার মুঠো ক্রমশ শক্ত করতে থাকে। ওসাইটগুলো হঠাৎ বৃদ্ধি পায় বলে পৃথিবীতে আসার সময়ই নারী লাভ করে এক ধরনের বয়ঃসন্ধির অভিজ্ঞতা; তারপর এক সময় ডিম্বকোষটি হ্রাস পেয়ে হয়ে ওঠে আগের আকারের পাঁচ ভাগের একভাগ, বলা যায় যেনো স্থগিত করা হয় শিশুটির শাস্তি। যখন বিকাশ ঘটতে থাকে তার শরীরের, তখন তার কামসংশ্রয়টি থাকে প্রায় স্থিতিশীল; কিছু ফলিকল আয়তনে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পরিণতি লাভ করে না। বালিকার বিকাশ বালকের বিকাশের মতোই; একই বয়সে বালিকা কখনো কখনো বেশি লম্বা থাকে বালকের থেকে এবং তার ওজন হয় বেশি। কিন্তু বয়ঃসন্ধির সময় প্রজাতিটি পুনরায় তোলে তার দাবি। ডিম্বাশয়ের নিঃসরণের প্রভাবে বিকাশমান ফলিকলের সংখ্যা বাড়ে, ডিম্বাশয়টি লাভ করে বেশি রক্ত এবং আকারে বাড়ে, পরিপক্কতা লাভ করে একটি ফলিকল, ঘটে ডিমনিঃসরণ, এবং শুরু হয় ঋতুস্রাবচক্র; কামসংশ্রয় ধারণ করে তার চূড়ান্ত আকার ও গঠন, শরীর ধারণ করে রমণীয় রূপরেখা, এবং প্রতিষ্ঠিত অন্তঃক্ষরণের ভারসাম্য।
এসব সংঘটন রূপ নেয় এক সংকটের। নারীর শরীর প্রতিরোধ ছাড়াই প্রজাতির হাতে নিজের অধিকার তুলে দেয় না, আর এ-যুদ্ধ দুর্বলকর ও ভয়ঙ্কর। বয়ঃসন্ধির আগে ছেলে ও মেয়ের মৃত্যুর হার সমান; চোদ্দো থেকে আঠারো বছর বয়সে যেখানে ১২৮টি মেয়ে মারা যায় সেখানে ছেলে মারা যায় ১০০টি, এবং আঠারো থেকে বাইশ বছর বয়সের মধ্যে যেখানে ১০৫টি মেয়ে মারা যায় সেখানে ছেলে মারা যায় ১০০টি। এ-সময়ে মাঝামাল্পৈলেখা দেয় পাণ্ডুরোগ, যক্ষ্মা, মেরুদণ্ডবক্রতা, অস্থিপ্রদাহ। অনেক ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি ঘটে অস্বাভাবিকভাবে অকালে, চার বা পাঁচ বছর বয়সে। অনেকের বেলা আবার বয়ঃসন্ধি ঘটেই না, তারা থেকে যায় শিশুসুলভ এবং ভোগে ঋতুস্রাবের বিশৃঙ্খলায় (রজঃরোধ বা ঋতুযন্ত্রণায়)। কিছু কিছু নারীর মধ্যে বৃক্কসংলগ্ন গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত রস ক্ষরণের ফলে দেখা দেয় পুরুষসূচকচিহ্ন।
এসব অস্বাভাবিকতা নিজের প্রজাতির ওপর ব্যক্তিসত্তার বিজয় নির্দেশ করে না; মুক্তির কোনো পথ নেই, যেহেতু এটা দাসত্বে বন্দী করে ব্যক্তিকে, তাই প্রজাতিটি একে যুগপৎ সমর্থন ও পরিতোষণ করে। এ-দ্বৈততা প্রকাশ পায় ডিম্বাশয়ের। ক্রিয়াকর্মের স্তরে, যেহেতু নারীর প্রাণশক্তির মূল রয়েছে ডিম্বাশয়ে, যেমন পুরুষের রয়েছে তার অণ্ডকোষে। উভয় লিঙ্গেই খোজা ব্যক্তিসত্তা শুধুমাত্র বন্ধ্যা নয়; সে ভোগে প্রত্যাবৃত্তিতে, সে অধঃপতিত হয়। ঠিকমতো গঠিত না হওয়ার ফলে সম্পূর্ণ জীবটিই হয় নিঃস্ব এবং হয়ে পড়ে ভারসাম্যহীন; এটি বাড়তে ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে শুধু তখনই যদি বাড়ে ও সমৃদ্ধি লাভ করে তার কামপ্রত্যঙ্গসংশ্রয়। আবার অনেক প্রজননগত প্রপঞ্চ তার জীবনের প্রতি নির্বিকার এবং হয়ে উঠতে পারে নানা বিপদের উৎস। স্তনগ্রন্থি, যার বিকাশ শুরু হয় বয়ঃসন্ধির সময়, নারীর ব্যক্তিগত কোনো কাজেই আসে না : জীবনের যে-কোনো সময়ে সেগুলো কেটে ফেলে দেয়া যায়। ডিম্বাশয়ের কিছু নিঃসরণ কাজ করে ডিমের কল্যাণে, সাহায্য করে তার পরিণতি লাভে এবং জরায়ুকে গড়ে তোলে তার চাহিদা অনুসারে; জীবটিকে সব মিলিয়ে ধরলে দেখা যায় এগুলো শৃঙ্খলার বদলে সৃষ্টি করে ভারসাম্যহীনতা–নারী নিজের চাহিদা অনুসারে নিজেকে না গড়ে নিজেকে খাপ খাওয়ায় ডিমের চাহিদার সাথে।