স্ত্রীলিঙ্গ স্তন্যপায়ীদের কামাবেগ সাধারণত অক্ৰিয়; সে প্রস্তুত ও অপেক্ষমাণ থাকে পুরুষটিকে গ্রহণ করার জন্যে। স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে এটা ঘটে কখনো কখনো–যেমন কোনো কোনো পাখির ক্ষেত্রে–নারীটি পুরুষটির প্রতি সনির্বন্ধ আবেদন জানায়, তবে সে ডাকাডাকি, প্রদর্শনী, ইঙ্গিতপূর্ণ ছলাকলার বেশি কিছু করে না। সে পুরুষটির ওপর সঙ্গম চাপিয়ে দিতে পারে না। পুরুষটিই সিদ্ধান্ত নেয় পরিশেষে। পাখি আর স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে পুরুষটিই জোর করে সঙ্গম করে, আর অধিকাংশ সময় নারীটি আত্মসমর্পণ করে উদাসীনভাবে, এমনকি বাধাও দেয় পুরুষটিকে।
এমনকি যখন নারীটি ইচ্ছুক, বা উত্তেজকও থাকে, তখনও পুরুষটিই নেয় তাকে, সে নীত হয়। শব্দটি অনেক সময় ব্যবহৃত হয় আক্ষরিকার্থে, কেননা বিশেষ কোনো প্রত্যঙ্গের সাহায্যেই হোক বা বেশি বলের ফলেই হোক, পুরুষটি দখল করে তাকে এবং ধরে রাখে বিশেষ আসনে; পুরুষটিই সম্পন্ন করে সঙ্গমের আন্দোলনগুলো; এবং, পতঙ্গ, পাখি, ও স্তন্যপায়ীদের মধ্যে পুরুষটি বিদ্ধ করে নারীটিকে। এবিদ্ধকরণের ফলে ধর্ষিত হয় তার অভ্যন্তরতা, সে একটি দেয়ালের মতো, যাকে ভেঙেচুরে ভেতরে ঢোকা হয়েছে। এতে পুরুষ তার প্রজাতির ওপর কোনো পীড়ন করছে না, কেননা নিয়ত নতুন হয়েই শুধু টিকে থাকতে পারে কোনো প্রজাতি, এবং শুক্রাণু ও ডিম মিলিত না হলে প্রজাতিটি ধ্বংস হয়ে যাবে; কিন্তু নারী, যার ওপর। ভার দেয়া হয়েছে ডিম রক্ষার, সে তা নিজের ভেতরে ঢেকে রাখে, এবং তার শরীর, ডিমকে আশ্রয় দিতে গিয়ে রক্ষা করে পুরুষের উর্বরায়ণের কর্ম থেকে। তার শরীর হয়ে ওঠে একটি প্রতিরোধ, যাকে ভেঙেচুরে ঢুকতে হয়, আর তাকে বিদ্ধ করে পুরুষ লাভ করে সক্রিয়তার মধ্যে আত্মসিদ্ধি।
পুরুষের আধিপত্য প্রকাশ পায় সঙ্গমের আসনেই প্রায় সব প্রাণীতেই পুরুষটি থাকে নারীটির ওপর। এবং পুরুষটি ব্যবহার করে যে-প্রত্যঙ্গটি, সেটি একটি জড় বস্তু; কিন্তু এটি এখানে দেখা দেয় উত্তেজিত অবস্থায় এটি একটি হাতিয়ার। আর এ-কর্মে নারী প্রত্যঙ্গটি থাকে জড় আধারের স্বভাবে। পুরুষটি পাত করে তার বীর্য, নারীটি গ্রহণ করে। এভাবে, যদিও নারীটি প্রজননে পালন করে মূলত সক্রিয় ভূমিকা, সে বশ্যতা স্বীকার করে সঙ্গমে, যা আক্রমণ করে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে এবং বিদ্ধকরণ ও আভ্যন্তর গর্ভাধানের মধ্য দিয়ে তার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় এক বিরুদ্ধ বস্তু। যদিও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নারী কাম বোধ করতে পারে, কিন্তু সে যেহেতু কামাবেগের সময় চায় পুরুষ, তাই সে কামের অভিজ্ঞতাকে এক আভ্যন্তর ঘটনা হিশেবেই বোধ করে, পৃথিবী ও অন্যদের সাথে কোনো বাহ্যিক সম্পর্ক রূপে নয়।
তবে স্তন্যপায়ী নারী ও পুরুষের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এখানে : শুক্রাণু, যার ভেতর দিয়ে পুরুষটির জীবন সম্প্রসারিত হয় আরেকজনের মধ্যে, ওই মুহূর্তেই তার কাছে হয়ে ওঠে অচেনা এবং বিচ্ছিন্ন হয় তার শরীর থেকে; তাই পুরুষটি তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে সে-মুহূর্তেই ঠিকঠাক ফিরে পায় যখন সে অতিক্রম করে যায় এটির সীমা। ডিমটি, অন্য দিকে, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে নারীর শরীর থেকে যখন সেটি পূর্ণ বিকশিত হয়ে থলি থেকে বেরিয়ে এসে পড়ে ডিম্বনালিতে; কিন্তু বাইরের কোনো জননকোষ দিয়ে নিষিক্ত হলে এটা আবার প্রথিত হয়ে সংযোজিত হয় জরায়ুতে। প্রথম ধর্ষিত হয়ে, তারপর বৈরী হয়ে–নারী আংশিকভাবে, হয়ে ওঠে নিজের থেকে ভিন্ন আরেকজন। সে তার পেটের ভেতরে বহন করে ভ্রূণ যে-পর্যন্ত না সেটি পৌঁছে বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ে যা বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভিন্ন গিনিপিগ জন্মে প্রায় প্রাপ্তবয়স্করূপে, ক্যাঙ্গারু জন্মে প্রায় ভ্রূণরূপেই। অন্যের ভাড়া খেটে, গর্ভধারণের কাল ভরে যে ফায়দা লোটে তার ওপর, নারী একই সময়ে হয়ে ওঠে নিজে এবং নিজের থেকে ভিন্ন আরেকজন; আর জন্মের পর সে নবজাতককে পান করায় নিজের বুকের দুধ। তাই এটা স্পষ্ট নয় ঠিক কখন এ-নতুন সত্তাটিকে গণ্য করা যেতে পারে স্বায়ত্তশাসিত ব’লে : গর্ভসঞ্চারের মুহূর্তে, জন্মের মুহূর্তে, বুকের দুধ ছাড়ানোর মুহূর্তে? লক্ষণীয় যে নারীটি পৃথক ব্যক্তিসত্তারূপে দেখা দেয় যতোবেশি স্পষ্টভাবে, জীবন তার পার্থক্যের ওপর ততোবেশি কর্তৃত্বের সাথে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে। মাছ ও পাখি, যারা বিকাশের আগেই নিজেদের ভেতর থেকে বের করে দেয় ভ্রূণ, স্ত্রীলিঙ্গ স্তন্যপায়ীদের থেকে কম দাসত্বে বন্দী থাকে শাবকদের কাছে। যেসময়গুলোতে মুক্ত থাকে মাতৃত্বের দাসত্ব থেকে, তখন স্ত্রীলিঙ্গটি মাঝেমাঝেই সমান হয়ে উঠতে পারে পুংলিঙ্গ জীবটির; অশ্বী অশ্বের মতোই দ্রুতগামী, শিকারী কুকুরীর ঘ্রাণশক্তি পুরুষ কুকরের মতোই তীক্ষ্ণ, বানরীও দেখায় বানরের সমান বুদ্ধিমত্তা। তবে এ-স্বাতন্ত্রেকে দাবি করা হয় না নিজের বলে; প্রজাতির মঙ্গলের জন্যে স্ত্রীলিঙ্গটি ত্যাগ করে এ-দাবি। প্রজাতি তার কাছে দাবি করে এ-ত্যাগস্বীকার।।
পুংলিঙ্গের ভাগ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। পরবর্তী প্রজন্মের দিকে তার সীমাতিক্রমণের মধ্যে সে নিজেকে দূরে রাখে, এবং নিজের মধ্যে রক্ষা করে নিজের স্বাতন্ত্র। পতঙ্গ থেকে উচ্চতম প্রাণী পর্যন্ত এ-বৈশিষ্ট্যটি স্থির। কামনা ও তৃপ্তির মধ্যে রয়েছে দূরত্ব, পুরুষটি তা কাটিয়ে ওঠে সক্রিয়ভাবে; সে নারীটিকে ঠেলে, খুঁজে বের করে, ছোঁয়, শৃঙ্গার করে, এবং বিদ্ধ করার আগে তাকে ত্যাগ করে। এ-কাজে ব্যবহৃত প্রত্যঙ্গগুলো অধিকাংশ সময়ই নারীর থেকে পুরুষে উৎকৃষ্টতর রূপে বিকশিত হয়েছে। এটা লক্ষ্য করার মতো যে-জীবনপ্রণোদনা উৎপাদন করে বিপুল পরিমাণ শুক্রাণু, তা-ই পুংলিঙ্গে প্রকাশ পায় উজ্জ্বল পালকভারে, দ্যুতিময় আঁশ, শিং, শিংয়ের শাখা, কেশরে, তার কণ্ঠধ্বনিতে, তার প্রাণোচ্ছলতায়। আমরা আর বিশ্বাস করি না যে কামোত্তেজনার সময় পুংলিঙ্গ সাজে যে-’বিয়ের সাজসজ্জায়, সেগুলোর, বা তার প্রলুব্ধকর ঠাটঠমকের আছে কোনো নির্বাচনমূলক তাৎপর্য; তবে এগুলো প্রতীয়মান করে জীবনশক্তি, যা পুংলিঙ্গের মধ্যে উদ্ভিন্ন হয় অপ্রয়োজনীয় ও চমকপ্রদ মহিমায়। এ-জৈবনিক অতিপ্রাচুর্য, যৌনমিলনের উদ্দেশ্যে এসব কর্মকাণ্ড, আর সঙ্গমের সময় স্ত্রীলিঙ্গের ওপর তার ক্ষমতার আধিপত্যশীল দৃঢ় ঘোষণা–এ-সবই পুরুষটির জীবন্ত সীমাতিক্ৰমণতার স্বাধিকার জ্ঞাপন। এ-ক্ষেত্রে হেগেল পুরুষের মধ্যে দেখেছেন যে-আত্মগত উপাদান, তা ঠিকই, আর নারীটি মোড়া থাকে নিজের প্রজাতিতে। আত্মগততা ও পৃথকতা নির্দেশ করে বিরোধ। কামোত্তেজিত পুংলিঙ্গের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আক্রমণাত্মকতা; একে কামসঙ্গী লাভের প্রতিযোগিতা বলে ব্যাখ্যা করা যায় না, কেননা স্ত্রীলিঙ্গের সংখ্যা প্রায় পুংলিঙ্গের সমানই; বরং একে ব্যাখ্যা করতে হবে যুদ্ধ করার ইচ্ছের প্রতিযোগিতা হিশেবে। সঙ্গম একটি দ্রুত কর্ম এবং এতে পুরুষের শক্তি ক্ষয় হয় খুবই কম। সে পিতাসুলভ কোনো সহজাত প্রবর্তনাই দেখায় না অধিকাংশ সময়ই সে সঙ্গমের পরই বর্জন করে স্ত্রীলিঙ্গটিকে। যখন সে কোনো পরিবার সংঘের–একপতিপত্নীক পরিবার, হারেম, বা যূথের প্রধান হিশেবে স্ত্রীলিঙ্গটির কাছে থাকে, সে পালন ও রক্ষা করে সারাটি গোষ্ঠিকেই; খুব কম সময়েই সে কোনো শাবকের প্রতি পোষণ করে বিশেষ আগ্রহ।