তাই আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারি জননকোষ দুটি পালন করে মূলত অভিন্ন ভূমিকা; একত্রে তারা সৃষ্টি করে একটি জীবন্ত সত্তা, যার মধ্যে তারা দুজনেই লুপ্ত হয় এবং অতিক্রম করে যায় নিজেদের।
এসব সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে যদি সিদ্ধান্ত নিই যে নারীর স্থান হচ্ছে গৃহ, তাহলে তা হবে গোয়ার্তুমি; তবে গোঁয়ার্তুমিপূর্ণ পুরুষ আছে অনেক। আলফ্রেড ফুইলি, তার ল্য তাঁপেরমাঁ এৎ ল্য কারাকতের বইতে, নারীর সংজ্ঞা তৈরি করেছেন সর্বতোভাবে ডিম ভিত্তি করে, পুরুষের সংজ্ঞা তৈরি করেছেন শুক্রাণু ভিত্তি করে; এবং সন্দেহজনক তুলনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেছেন একরাশ অনুমানসিদ্ধ সুগভীর তত্ত্ব। প্রশ্ন হচ্ছে এসব সন্দেহজনক ধারণা প্রকৃতির কোন দর্শনের অংশ; নিশ্চিতভাবেই বংশানুক্রম সূত্রের অংশ নয়, কেননা এসব সূত্রানুসারে নারী ও পুরুষ একইভাবে উদ্ভূত হয় একটি ডিম ও একটি শুক্রাণু থেকে। আমি অনুমান করতে পারি যে এসব ঝাপসা মনে আজো ভাসে মধ্যযুগের পুরোনো দর্শনের টুকরো, যা শেখাতে যে মহাবিশ্ব হচ্ছে এক অণুবিশ্বের অবিকল প্রতিবিম্ব–ডিমকে কল্পনা করা হতো একটি ছোটো নারী। বলে, আর নারীকে এক বিরাট ডিমরূপে। এসব ঘোর, সে-আলকেমির যুগ থেকেই যা সাধারণত পরিত্যক্ত, উকট উদ্ভটভাবে আজকের উপাত্তের বৈজ্ঞানিক যথাযথতার বিপরীত, আধুনিক জীববিদ্যার সাথে মধ্যযুগের প্রতীকের কোনো মিল নেই। কিন্তু আমাদের তত্তপ্রস্তাবকেরা বিষয়টিকে ঠিকমতো দেখেন না। এটা স্বীকার করতে হবে যে ডিম থেকে নারী খুবই দূরের পথ। অনিষিক্ত ডিমে এমনকি স্ত্রীলিঙ্গতার ধারণাও প্রতিষ্ঠিত হয় না। হেগেল ঠিকই বলেছেন যে লৈঙ্গিক সম্পর্ককে জননকোষের সম্পর্কের কাছে ফেরানো যাবে না। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে নারীসত্তাকে পূর্ণাঙ্গরূপে বিচার করা।
অনেক উদ্ভিদে ও কিছু প্রাণীতে (যেমন শামুকে) দু-ধরনের জননকোষের উপস্থিতির জন্যে দু-ধরনের ব্যক্তির দরকার পড়ে না, কেননা প্রতিটি ব্যক্তিই উৎপাদন করে ডিম ও শুক্রাণু উভয়ই। এমনকি যখন লিঙ্গরা পৃথক, তখনও তাদের পার্থক্য এমন নয় যে তাদের পৃথক প্রজাতির বলে মনে হতে পারে। পুং ও স্ত্রীলিঙ্গদের বরং মনে হয় একই সাধারণ ভিত্তিমূলের বৈচিত্র্য বলে। দুটি লিঙ্গের ভ্রূণবিকাশের সময় যে-গ্রন্থি থেকে পরে গোনাড বা জনগ্রন্থি গঠিত হয়, শুরুতে সেটি থাকে অভিন্ন; বিশেষ এক স্তরেই গড়ে ওঠে অণ্ডকোষ বা ডিম্বাশয়, একইভাবে অন্যান্য যৌন প্রত্যঙ্গেরও প্রথমে থাকে একটি আদি অভিন্ন পর্ব, এ-সময়ে ভ্রূণের বিভিন্ন অংশ, যেগুলো পরে ধারণ করে সুস্পষ্ট পুরুষ বা নারীর গঠন, সেগুলো পরীক্ষা করেও ভ্রণের লিঙ্গ বোঝা সম্ভব নয়। এটা আমাদের উভলিঙ্গতা ও লিঙ্গভিন্নতার মাঝামাঝি অবস্থা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে অনেক সময়ই একটি লিঙ্গ ধারণ করে অন্য লিঙ্গের বৈশিষ্ট্যসূচক কিছু প্রত্যঙ্গ; এর উদাহরণ ভাওয়া ব্যাং, যাতে পুরুষটির ভেতরে থাকে একটি অবিকশিত ডিম্বাশয়, যা নিরীক্ষামূলক অবস্থায় ডিম উৎপাদন করতে পারে। প্রজাতির মধ্যে স্ংখ্যার দিক দিয়ে সমান ও শুরু থেকে একইভাবে বিকশিত পুং ও স্ত্রীলিঙ্গীয়রা মূলতঁ সমতুল্য। প্রত্যেকেরই রয়েছে প্রজনন গ্রন্থি–ডিম্বাশয় ও অণ্ডকোষ–যাদের ভেতরে সমতুল্য প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয় জননকোষ। এ-গ্রন্থিগুলো লিঙ্গানুসারে কম-বেশি জটিল নালির ভেতর দিয়ে নিঃসরণ ঘটায় তাদের উৎপাদিত বস্তু; স্ত্রীলিঙ্গে ডিম্বনালির ভেতর দিয়ে সরাসরি বাইরে বেরোতে পারে ডিম; বা বহিষ্কৃত হওয়ার আগে কিছু সময়ের জন্যে থাকতে পারে অবসারণী অথবা জরায়ুর মধ্যে; পুংলিঙ্গে বীর্য রক্ষিত হতে পারে বাইরে বা থাকতে পারো কোনো কামপ্রত্যঙ্গ, যা দিয়ে এটা ঢুকিয়ে দেয়া হয় নারীদেহে। এসব ক্ষেত্রে স্ত্রীলিঙ্গ ও পুংলিঙ্গ পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত থাকে এক সমরূপ সম্পর্কে।
স্ত্রীলিঙ্গ বা নারীর সাধারণভাবে সিদ্ধ কোনো সংজ্ঞা দেয়া অত্যন্ত কঠিন। নারীকে ডিমবহনকারী ও পুরুষকে শুক্রাণুবহনকারী বলে সংজ্ঞায়িত করা যথেষ্ট নয়, কেননা জননকোষের সাথে জীবটির সম্পর্ক বেশ অনিয়ত। আবার, সব মিলিয়ে জীবটির ওপর সরাসরি বিশেষ প্রভাব নেই জননকোষের পার্থক্যের।
জীবন জটিলতম রূপ পরিগ্রহ করে স্তন্যপায়ীদের মধ্যে, এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র হয় সবচেয়ে অগ্রসর ও বিশিষ্ট। সেখানে পরিপোষণ ও সৃষ্টি বাস্তবায়িত হয় লিঙ্গপার্থক্যের মধ্যে; এ-গোত্রে, মেরুদণ্ডীদের মধ্যে, জননীই সন্তানদের সাথে রক্ষা করে ঘনিষ্ঠতম সস্পর্ক, আর জনক তাদের প্রতি দেখায় কম আগ্রহ। স্ত্রীলিঙ্গ জীব সম্পূর্ণরূপে মাতৃত্বের সাথে খাপ খাওয়ানো ও মাতৃতুসহায়ক, আর কামের উদ্যোগ গ্রহণই হচ্ছে পুংলিঙ্গের বিশেষ অধিকার।
স্ত্রীলিঙ্গ তার প্রজাতির শিকার। বছরের বিশেষ বিশেষ সময় জুড়ে, প্রত্যেক প্রজাতির জন্যে যা নির্দিষ্ট, তার সম্পূর্ণ জীবন নিয়ত্রিত থাকে এক লৈঙ্গিক চক্র (ঋতুচক্র) দিয়ে, বিভিন্ন প্রজাতিতে যার স্থিতিকাল ও ঘটনাপরম্পরা ভিন্ন। এ-চক্রের আছে দুটি পর্ব : প্রথম পর্বে ডিমগুলো (প্রজাতি অনুসারে যাদের সংখ্যা বিভিন্ন) পরিপকু হয় এবং পুরু ও নালিময় হয় জরায়ুর আভ্যন্তর আবরণ; দ্বিতীয় পর্বে (যদি নিষিক্ত না হয়) ডিমগুলো লুপ্ত হয়, ভেঙে পড়ে জরায়ুর প্রাসাদ, এবং বস্তুরাশি প্রবাহিত হয়ে বেরিয়ে আসে, নারী ও বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের স্তন্যপায়ীদের বেলা যাকে বলা হয় ঋতুস্রাব। যদি গর্ভসঞ্চার ঘটে, তাহলে দ্বিতীয় পর্বের স্থানে দেখা দেয় গর্ভ। ডিমনিঃসরণের (প্রথম পর্বের শেষে) কাল ওয়েস্ট্রাস বা গর্ভসঞ্চারকাল নামে পরিচিত এবং এটা হচ্ছে কামোত্তেজনা বা সঙ্গমের কাল।