আজকাল এটা ভালোভাবেই জানা যে সন্তানের লিঙ্গ নির্ণীত হয় গর্ভাধানের সময় ক্রোমোসমের সংগঠন দিয়ে প্রজাতি অনুসারে এ-কাজটি সম্পন্ন করে থাকে পুরুষ জননকোষ অথবা নারী জননকোষ। স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে এ-কাজটি করে শুক্রাণু, যাতে উৎপাদিত হয় সমসংখ্যক দু-ধরনের উপাদান, এক ধরনের উপাদানে থাকে একটি X ক্রোমোসোম (যা থাকে সব ডিমেই), আরেক ধরনের উপাদানে থাকে একটি Y ক্রোমোসোম (যা থাকে না ডিমে)। X ও Y ক্রোমোসোম ছাড়াও শুক্রাণু ও ডিমে থাকে সমানসংখ্যক এ-ধরনের উপাদান। যখন শুক্রাণু ও ডিম মিলিত হয়ে গর্ভসঞ্চার ঘটে, তখন নিষিক্ত ডিমটিতে থাকে পূর্ণ দুই প্রস্থ ক্রোমোসোম। যদি গর্ভসঞ্চার ঘটে কোনো X বাহী শুক্রাণু দিয়ে, তাহলে নিষিক্ত ডিমটিতে থাকে দুটি x ক্রোমোসোম, এবং এটি পরিণত হয় স্ত্রীলিঙ্গে (XX)। যদি Y বাহী শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত হয় ডিমটি, তাহলে ডিমটিতে উপস্থিত থাকে মাত্র একটি X ক্রোমোসোম, এবং এটি হয় পুংলিঙ্গ (XY)। পাখি ও প্রজাপতির বেলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়, যদিও রীতিটি থাকে একই; ডিমই ধারণ করে X বা Y, তাই ডিমই নির্ধারণ করে সন্তানের লিঙ্গ। মেন্ডেলের সূত্র দেখিয়েছে যে বংশানুক্রমে পিতা ও মাতার ভূমিকা সমান। ক্রোমোসোমগুলো ধারণ করে বংশানুক্রমের নিয়ন্ত্রকগুলো (জিন), এবং এগুলো সমপরিমাণে থাকে ডিমে ও শুক্রাণুতে।
এ-পর্যায়ে যা আমাদের বিশেষভাবে লক্ষ্য করার কথা, তা হচ্ছে যে জননকোষের কোনো একটিকে অপরটি থেকে উৎকৃষ্ট মনে করতে পারি না; যখন তারা মিলিত হয় তখন উভয়েই নিষিক্ত ডিমের মধ্যে হারিয়ে ফেলে নিজেদের স্বাতন্ত্র। প্রচলিত রয়েছে দুটি সাধারণ অনুমান, যে-দুটি অন্তত জৈবিক স্তরে স্পষ্টভাবে ভুল। প্রথমটি, অর্থাৎ নারীর অক্রিয়তার ব্যাপারটি, ভুল বলে প্রমাণিত হয় এ-ঘটনা থেকে যে নব জীবনের উদ্ভব ঘটে দুটি জননকোষের মিলনের ফলে; জীবনের স্ফুলিঙ্গ এ-দুটির কোনোটিরই একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ডিমের কেন্দ্রটি শুক্রাণুর কেন্দ্রের মতোই এক জীবন্ত সক্রিয়তার এলাকা। দ্বিতীয় ভুল অনুমানটি অবশ্য প্রথমটির বিরোধী। এটির মতে প্রজাতির স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয় নারীর দ্বারা, পুরুষ নীতি নিতান্তই এক বিস্ফোরক ও অস্থায়ী প্রকৃতির। তবে সত্য হচ্ছে ভ্রূণ বহন করে পিতা ও মাতা উভয়েরই জীবাণু, এবং মিলিতভাবে সে-দুটিকে সঞ্চারিত করে দেয় সন্তানসন্ততির ভেতরে, যাদের কেউ পুরুষ কেউ নারী। এটা যেনো এক উভলিঙ্গ জীবাণু প্রাণরস, যা পুরুষ ও নারীকে পেরিয়ে বেঁচে থাকে যখন তারা উৎপাদন করে সন্তান।
এসব বলার পর আমরা চোখ দিতে পারি শুক্রাণু ও ডিমের গৌণ পার্থক্যগুলোর ওপর। ডিমের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর রয়েছে ভ্রূণ লালন-পালনের শক্তি; এটি সংরক্ষণ করে এমন বস্তু, যা দিয়ে ভ্রূণটি গঠন করে গ্রন্থি। পরিণামে ডিমটি হয়ে ওঠে বিশাল, সাধারণত গোলাকার ও তুলনামূলকভাবে প্রকাণ্ড। পাখির ডিমের আকার সুপরিচিত; কিন্তু নারীর ডিম অনেকটা আণুবিক্ষণিক, আকারে মুদ্রিত যতিচিহ্নের সমান (ব্যাস .১৩২-.১৩৫ মিমি), তবে পুরুষের শুক্রাণু আরো অনেক ছোটো (দৈর্ঘ্য .০৪-.০৬ মিমি), এতো ছোটো যে এক ঘনমিটারে থাকতে পারে ৬০,০০০টি। শুক্রাণুর রয়েছে সুতোর মতো একটি লেজ ও ছোটো, চ্যাপ্টা ডিম্বাকার মাথা, যাতে থাকে ক্রোমোসোমগুলো। এর ওপর নেই কোনো জড়বস্তুর ভার; এটি পুরোপুরি জীবন্ত। এর পুরো কাঠামোই গতিশীল। আর সেখানে ডিমটি, প্রাণের ভবিষ্যৎ নিয়ে বৃহৎ, স্থিতিশীল; নারীর দেহাভ্যন্তরে বন্দী বা বাহ্যিকভাবে জলের ওপর ভাসমান অবস্থায় এটি অক্রিয়ভাবে অপেক্ষায় থাকে নিষিক্ত হওয়ার। পুংজননকোষটিই একে। খুঁজে বের করে। শুক্রানুটি সব সময়ই একটি নগ্ন কোষ; আর প্রজাতি অনুসারে ডিমটি কোনো খোল বা ঝিল্লিতে সংরক্ষিত থাকতেও পারে, নাও পারে, কিন্তু সব সময়ই যখন শুক্রাণু ডিমের সংলগ্ন হয় তখন চাপ প্রয়োগ করে ডিমের ওপর, কখনো কখনো ঝাকুনি দেয়, এবং গর্ত করে ঢোকে এর ভেতরে। খসে পড়ে লেজটি এবং বৃদ্ধি পায় মাথা, গঠন করে পুংকেন্দ্ৰপরমাণু, এবং এটি এগিয়ে চলে ডিম কেন্দ্ৰপরমাণুর দিকে। এ-সময়ে ডিমটি দ্রুত তৈরি করে একটি ঝিল্লি, যা ভেতরে অনুপ্রবেশে বাধা দেয় অন্য শুক্রাণুদের। ডিমের থেকে অনেক ছোটো বলে শুক্রাণু উৎপাদিত হয় অনেক বেশি পরিমাণে; তাই ডিমের অনুরাগপ্রার্থী অসংখ্য।
তাই ডিম, তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যে, কেন্দ্ৰপরমাণুতে, সক্রিয়; কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে অক্রিয়; নিজের ভেতরে আটকানো এর সংহত ভর জাগিয়ে তোলে রাত্রির অন্ধকার ও অন্তর্মুখি দ্রিাতুরতার বোধ। প্রাচীনদের কাছে গোলকের গঠন নির্দেশ করতে সীমাবদ্ধ বিশ্বকে, অনুপ্রবেশঅসম্ভব অণুকে। গতিহীন, ডিমটি অপেক্ষায় থাকে; এর বিপরীতে শুক্রাণুটি–মুক্ত, হালকাপাতলা, ক্ষিপ্র–জ্ঞাপন করে অস্তিত্বের অধীরতা ও অস্থিরতা। তবে এ-রূপককে বেশি দূর ঠেলে নেয়া ঠিক হবে না। ডিমকে অনেক সময় তুলনা করা হয়েছে অন্তর্ভবতার সাথে আর শুক্রাণুকে সীমাতিক্ৰমণতার সাথে; বলা হয়েছে শুক্রাণু যখন বিদ্ধ করে ডিমকে, তখন হারিয়ে ফেলে তার সীমাতিক্ৰমণতা, চলনশীলতা; যখন এটি হারিয়ে ফেলে তার লেজ, এক নিশ্চল ভর একে গ্রাস করে অবরুদ্ধ করে, নপুংসক করে। এটা ঐন্দ্রজালিক কাজ, খুবই উদ্বিগ্নকর, যেমন সব অক্রিয় কাজই উদ্বিগ্নকর, আর সেখানে পুংজননকোষের কাজগুলো যুক্তিসঙ্গত; এটি হচ্ছে গতি, যা স্থানকাল দিয়ে পরিমাপ করা যায়। এসব ধারণা মনের খেয়াল ছাড়া আর কিছু নয়। পুং ও স্ত্রী জননকোষ সংমিশ্রিত হয় নিষিক্ত ডিমে; তারা উভয়ই নিষ্ক্রিয় হয়ে সৃষ্টি করে এক নতুন পূর্ণাঙ্গতা। এটা মিথ্যে কথা যে ডিমটি লুব্ধতার সাথে গিলে ফেলে শুক্রাণুটি, এবং এও একই রকম মিথ্যে যে শুক্রাণুটি বিজয়ীর মতো জোরপূর্বক দখল করে ডিমটির এলাকা, কেননা সংমিশ্রণের ফলে উভয়েই হারিয়ে ফেলে স্বাতন্ত্র্য। যান্ত্রিক মনের কাছে গতিকে এক মহান যৌক্তিক প্রপঞ্চ ব’লে মনে হতে পারে, কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কাছেও এটা স্পষ্ট নয়। তাছাড়া জননকোষের মিলনের পেছনে কী কী শারীর-রাসায়নিক ক্রিয়া কাজ করে, তা প্রমাক্তিতভাবে জানি না। তবে দুটি জননকোষের তুলনা থেকে আমরা পৌঁছোতে পারি একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে। জীবনের রয়েছে দুটি পরস্পরসম্পর্কিত গতিময় বৈশিষ্ট্য : অতিক্রম করেই শুধু একে রক্ষা করা যায়, আবার একে রক্ষা করলেই শুধু এ পেরিয়ে যেতে পারে নিজেকে। এ-দুটি হেতু সব সময়ই কাজ করে একসঙ্গে, এবং এদের পৃথক করার চেষ্টা খুবই অবাস্তব কাজ। এ-জননকোষের দুটি যখন মেশে পরস্পরের সাথে, তখনই তারা নিজেদের অতিক্রম ও স্থায়ী করে। কিন্তু নিজের গঠনের মধ্যেই ডিমটি বুঝতে পারে ভবিষ্যৎ চাহিদাগুলো, একে গঠন করা হয়েছে এমনভাবে যে এর মাঝে দেখা দেবে যে-জীবন, তা পোষণ করতে হবে তাকে। শুক্রাণুটি নিজের জাগানো ভ্রুণটিকে বিকশিত করার মতো কোনো সম্পদই ধারণ করে না। আবার, ডিমটি এমনভাবে স্থান বদলে করতে পারে না, যাতে জ্বলে উঠতে পারে একটি নতুন জীবন, কিন্তু শুক্রাণুটি পারে এবং ভ্রমণ করে। ডিমটির দূরদৃষ্টি ছাড়া নিষ্ফল হতে শুক্রাণুর আগমন; তবে শুক্রাণুর উদ্যোগ ছাড়া ডিমটিও চরিতার্থ করতে পারতো না তার জীবন্ত সম্ভাবনা।