আমরা মনে করতে পারি যে বংশবিস্তারের প্রপঞ্চটি রয়েছে প্রাণীর সত্তার মধ্যেই। তবে আমাদের সেখানেই থামতে হবে। প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে লৈঙ্গিক ভিন্নতার দরকার পড়ে না। তবে একথা সত্য যে প্রাণীদের মধ্য এ-ভিন্নতা এতো ব্যাপক যে একে অস্বিত্বের যে-কোনো বাস্তবসম্মত সংজ্ঞার মধ্যেই গ্রহণ করতে হয়। একথা সত্য শরীর ছাড়া মন এবং অমর মানুষ অসম্ভব, কিন্তু অসঙ্গমী ও উভলৈঙ্গিক সমাজের কথা আমরা কল্পনা করতে পারি।
দুটি লিঙ্গের ভূমিকা সম্পর্কে পুরুষ পোষণ করে এসেছে বিচিত্র ধরনের বিশ্বাস। প্রথম দিকে সেগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিলো না, সেগুলো প্রকাশ করতে শুধু সামাজিক কিংবদন্তি। দীর্ঘকাল ধরে ধারণা করা হতো, এবং আজো কোনো কোনো আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বিশ্বাস করা হয় যে গর্ভসঞ্চারে পুরুষের কোনো ভূমিকা। নেই। পূর্বপুরুষদের প্রেতাত্মা সজীব জীবাণুরূপে মায়ের শরীরে ঢোকে বলে মনে করা হয়। পিতৃতান্ত্রিক সংস্থাগুলোর উদ্ভবের সাথে পুরুষ ব্যথভাবে দাবি জানাতে থাকে। বংশধরদের ওপর। জন্মদানে মায়ের একটি ভূমিকা স্বীকার করে নেয়াও দরকার হয়, তবে এটুকু স্বীকার করে নেয়া হয় যে সে শুধু ধারণ ও লালন করে একলা পিতার দ্বারা সৃষ্ট সজীব বীজটিকে। আরিস্ততল মনে করতেন ভ্রূণ উদ্ভূত হয় শুক্রাণু ও ঋতুস্রাবের রক্তের মিলনে, যাতে নারী সরবরাহ করে অক্রিয় বস্তু, আর পুরুষ দান করে শক্তি, সক্রিয়তা, গতি, জীবন। হিপ্পোক্রাতিস পোষণ করতেন একই রকম ধারণা; তাঁর মতে বীজ দু-ধরনের, দুর্বল বা নারীধর্মী, সবল বা পুরুষধর্মী। আরিস্ততলের তত্ত্ব মধ্যযুগ ধরে চলেছে এবং আধুনিক কাল পর্যন্ত টিকে আছে।
সতেরো শতকের শেষের দিকে হারভে সঙ্গমের পরপরই হত্যা করে দেখেন মাদি কুকুরদের এবং জরায়ুর শৃঙ্গে তিনি দেখতে পান ছোটো ছোটো থলে, যেগুলোকে তিনি ডিম বলে মনে করেন, তবে ওগুলো আসলে ছিলো ভ্রূণ। ডেনমার্কের শবব্যবচ্ছেদবিজ্ঞানী স্টেনো নারীর জননগ্রন্থির নাম দেন ডিম্বাশয়, যাকে আগে বলা হতো ‘নারীর অণ্ডকোষ’; সেগুলোর ওপর দেখতে পান ছোটো ছোটো স্ফীতি। ১৬৭৭ অব্দে ফন গ্রাফ এগুলোকে ডিম বলে মনে করেছিলেন, এবং এখন এগুলোকে বলা হয় গ্রাফীয় ডিম্বথলি। ডিম্বাশয়কে তখনও মনে করা হতো পুরুষের গ্রন্থির সদৃশ বলে। তবে একই বছরে আবিষ্কৃত হয় শুক্রাণু অণুজীব এবং এটা প্রমাণিত হয় যে এগুলো প্রবিষ্ট হয় নারীর জরায়ুতে; তবে মনে করা হয় সেখানে এগুলো নিতান্তই লালিত হয় এবং সেখানেই উদ্ভূত হয় নতুন সত্তাটি। ১৬৯৪-এ একজন ওলন্দাজ, হার্টসাকের, ছবি আঁকেন শুক্রাণুর মধ্যে গুপ্ত এক ‘মনুষ্যপ্রাণীর’, এবং ১৬৯৯-এ আরেক বিজ্ঞানী বলেন যে তিনি দেখতে পেয়েছেন শুক্রাণু লোম ঝরিয়ে চলছে, যার নিচে আবির্ভূত হয়েছে একটি মানুষ। তিনি তার ছবিও আঁকেন। এসব কল্পিত প্রকল্পে নারীর কাজ হচ্ছে এক সক্রিয় সজীব নীতিকে লালন করা। এসব ধারণা সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয় নি, তবে উনিশ শতকেও এগুলোর পক্ষে যুক্তি প্রয়োগ করা হতো। অণুবীক্ষণযন্ত্র ব্যবহার করে ১৮২৭ অব্দে ফন বায়েরের পক্ষে গ্রাফীয় ডিম্বথলির মধ্যে আবিষ্কার করা সম্ভব হয় স্তন্যপায়ী প্রাণীর ডিম। অল্প কালের মধ্যেই সম্ভব হয় ডিমের বিদারণ পর্যবেক্ষণ করা–অর্থাৎ কোষ বিভাজনের মধ্য দিয়ে বিকাশের সূচনা-স্তরগুলো দেখা; এবং ১৮৩৫-এ আবিষ্কৃত হয় সারকোড, পরে যাকে বলা হয় প্রোটোপ্লাজম। এর মধ্য দিয়েই ধরা পড়তে থাকে কোষের আসল প্রকৃতি। ১৮৭৯ অব্দে পর্যবেক্ষণ করা হয় তারামাছের ডিমের ভেতরে শুক্রাণুর অনুপ্রবেশ, এবং এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় দুটি জননকোষের কেন্দ্র, ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর সমতুল্যতা। নিষিক্ত ডিমের ভেতরে তাদের মিলনের প্রক্রিয়া বিস্তৃতভাবে উদ্ঘাটন করেন বেলজিয়ামের প্রাণীবিজ্ঞানী ভ্যান বেনেডেন।
তবে আরিস্ততলের ধারণাগুলো একেবারে বাতিল হয়ে যায় নি। হেগেল ধারণা পোষণ করতেন যে প্রয়োজনেই দুটি লিঙ্গ ভিন্ন, একটি সক্রিয় এবং অপরটি অক্রিয়, এবং অবশ্যই স্ত্রীলিঙ্গটিই অক্রিয়। ‘তাই এ-পার্থক্যের পরিণতিরূপে পুরুষ হচ্ছে সক্রিয় নীতি আর নারী হচ্ছে অক্রিয় নীতি, কেননা সে তার সংহতির মধ্যে থাকে অবিকশিত’ (হেগেল, প্রকৃতির দর্শন)। এমনকি ডিম্বাণু সক্রিয় নীতিরূপে গৃহীত হওয়ার পরও পুরুষেরা এর শান্ততার বিপরীতে শুক্রাণুর সজীব গতিশীলতাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছে। আজকাল অনেক বিজ্ঞানী দেখিয়ে থাকেন এর বিপরীত প্রবণতা। অসঙ্গম বংশবিস্তার সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে তারা দেখতে পেয়েছেন শুক্রাণুর ভূমিকা নিতান্তই এক শারীর-রাসায়নিক প্রতিক্রিয়াসাধকের। এটা দেখানো হয়েছে যে অনেক প্রজাতিতে কোনো এসিডের উদ্দীপনায় বা একটা সূচের খোচায়ও ডিমের বিদারণ ঘটতে পারে এবং বিকাশ ঘটতে পারে ভ্রূণের। এটা ভিত্তি করে প্রস্তাব করা হয়েছে যে শুক্রাণু গর্ভসঞ্চারের জন্যে জরুরি নয়, এটা বড়োজোর একটি ভ্রূণকে গজিয়ে তুলতে সাহায্য করে; সম্ভবত ভবিষ্যতে প্রজননে পুরুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে।
বিপুল সংখ্যক প্রজাতিতে পুরুষ ও নারী সহযোগিতা করে প্রজননে। তাদের পুরুষ ও নারী হিশেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় প্রধানত তাদের উৎপাদিত জননকোষ–যথাক্রমে শুক্রাণু ও ডিম, অনুসারে। কিছু নিম্নপর্যায়ের উদ্ভিদ ও প্রাণীতে যে-কোষগুলো মিলিত হয়ে জাইগোট গঠন করে, সেগুলো অভিন্ন; এবং এ-সমজননকোষতার ঘটনাগুলো তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা তারা নির্দেশ করে জননকোষের মৌলিক সাম্য। সাধারণভাবে জননকোষগুলো পৃথক, তবে তাদের সাম্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য। দু-লিঙ্গেই একই ধরনের আদিকালীন জীবাণু কোষ থেকে বিকশিত হয় শুক্রাণু ও ডিম। আদিকালীন কোষ থেকে স্ত্রীলিঙ্গের ভেতরে বিকশিত অপুষ্ট ডিম্বকোষ ও পুরুষের ভেতরে উদ্ভূত অপুষ্ট শুক্রকোষ প্রধানত ভিন্ন হয় প্রোটোপ্লাজমে, কিন্তু সংঘটিত প্রপঞ্চগুলো একই ধরনের। ১৯০৩ অব্দে জীববিজ্ঞানী অ্যান্সেল মত প্রকাশ করেন যে আদিকালীন জীবাণু কোষটি নিস্পৃহ, এবং যে-ধরনের জননগ্রন্থিতে এটি থাকে, অণ্ডকোষে বা ডিম্বাশয়ে, সে-অনুসারে এটি বিকশিত হয় শুক্রাণু বা ডিমরূপে। তবে এটা যাই হোক, প্রত্যেক লিঙ্গের আদিকালীন জীবাণু কোষেই থাকে একই সংখ্যক ক্রোমোসোম (যা ধারণ করে বিশেষ প্রজাতিটির বৈশিষ্ট্য), যা পুং ও স্ত্রীলিঙ্গে একই প্রক্রিয়ায় হ্রাস পায় অর্ধেক সংখ্যায়। বিকাশের এ-প্রক্রিয়াগুলোর শেষে (পুরুষের ক্ষেত্রে একে বলা হয় শুক্রাণু উৎপাদন প্রক্রিয়া, আর নারীর ক্ষেত্রে বলা হয় ডিম উৎপাদন প্রক্রিয়া) জননকোষগুলো পূর্ণবিকশিত হয়ে রূপ নেয় শুক্রাণু ও ডিমের; কিছু ব্যাপারে তাদের মধ্যে থাকে বিপুল পার্থক্য, তবে সাদৃশ্য থাকে এতে যে এদের প্রত্যেকে ধারণ করে এক প্রস্থ সমমূল্যের ক্রোমোসোম।