পুরুষ ও নারী দু-ধরনের সত্তা, বিশেষ প্রজাতির মধ্যে যাদের পৃথক করা হয় তাদের প্রজনন ভূমিকা অনুসারে; তাদের সংজ্ঞায়িত করা যায় শুধু পরস্পরসম্পর্কিত ভাবেই। তবে প্রথমেই এটা মনে রাখতে হবে যে বিশেষ প্রজাতিকে দুটি লিঙ্গে বিভক্ত করার ব্যাপারটি সব সময় সুনির্দিষ্ট নয়।
প্রকৃতিতে এটা সর্বজনীনভাবে প্রকাশিত নয়। প্রাণীদের কথা যদি বলি, এটা সুবিদিত যে এককোষী আণুবিক্ষণিক রূপসমূহে–ইনফিউসোরিয়া, অ্যামিবা, স্পোরাজোয়ান, এবং এ-জাতীয়তে–সংখ্যাবৃদ্ধি যৌনতা থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন। প্রতিটি কোষ বিশ্লিষ্ট ও উপবিশ্লিষ্ট হয় নিজে নিজেই। বহুকোষী প্রাণীদের মধ্যেও যৌনতা ছাড়াই বংশবৃদ্ধি ঘটতে পারে, কখনো এটা ঘটতে পারে বিশ্লিষ্টীকরণ প্রণালিতে, অর্থাৎ একটি দুই বা বহু টুকরো হয়ে, যেগুলো পরে হয়ে ওঠে একেকটি নতুন প্রাণী, এবং কখনো ঘটতে পারে পৃথকীকরণ প্রণালিতে, অর্থাৎ কুঁড়ি পৃথক হয়ে গড়ে তোলে নতুন প্রাণী। মিষ্টি পানির হাইড্রা, স্পঞ্জ, পোকা, টিউনিকেইট প্রভৃতিতে কুঁড়ি পৃথকীকরণ বেশ পরিচিত উদাহরণ। অসঙ্গম বংশবিস্তারে কুমারী স্ত্রীটির ডিম পুরুষের দ্বারা নিষিক্ত না হয়েই বিকশিত হয় ভ্রূণরূপে; তাই নাও থাকতে পারে পুরুষের ভূমিকা। মৌমাছিতে সঙ্গম ঘটে, কিন্তু ডিম পাড়ার সময় সেগুলো নিষিক্ত হতেও পারে, নাও হতে পারে। অনিষিক্ত ডিমগুলোর বিকাশের ফলে জন্মে পুরুষ মৌমাছি এবং জাবপোকার বেলা পুরুষ অনুপস্থিত থাকে প্রজন্ম পরম্পরায়, এবং অনিষিক্ত ডিমগুলো থেকে জন্মে স্ত্রীলিঙ্গ জাবপোকা। অসঙ্গম বংশবিস্তারের প্রক্রিয়াটি কৃত্রিমভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে সমুদ্রশল্য, তারামাছ, ব্যাং, এবং অন্যান্য প্রজাতির ওপর। এককোষী প্রাণীদের (প্রোটোজোয়া) মধ্যে অবশ্য দুটি কোষ মিলে গঠন করতে পারে জাইগোট বা জ্বণাণু, আর মৌমাছিতে নিষিক্তকরণ দরকার হয় যদি ডিমগুলো জন্ম দিতে চায় স্ত্রী মৌমাছি। জাবপোকার ক্ষেত্রে পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ই আবির্ভূত হয় শরৎকালে এবং এ-সময়ে উৎপাদিত ডিম খাপ খাইয়ে নেয় শীতের সাথে।
অতীতে কোনো কোনো জীববিজ্ঞানী এসব ঘটনা থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলেন যে এমনকি যে-সব প্রজাতি সঙ্গমহীন বংশবিস্তারে সমর্থ, সেগুলোর ক্ষেত্রেও প্রজাতির বলিষ্ঠতা নবায়নের জন্যে মাঝেমাঝে দরকার পড়ে নিষিক্তীকরণ–দুটি সত্তার বংশানুক্রমিক উপাদান মিশিয়ে নবযৌবন অর্জন। এ-প্রকল্প অনুসারে জীবনের সবচেয়ে জটিল রূপগুলোতে যৌনতাকে মনে হয় এক অপরিহার্য ব্যাপার; শুধু নিম্ন প্রাণীসত্তাগুলোই পারে যৌনতা ছাড়া বংশবিস্তার করতে; এবং এখানেও একটা বিশেষ সময়ের পর নিঃশেষিত হয়ে পড়ে প্রাণশক্তি। তবে এখন মোটামুটিভাবে এ-প্রকল্প পরিত্যাগ করা হয়েছে; গবেষণার ফলে এটা প্রতিপন্ন হয়েছে যে উপযুক্ত অবস্থায় কোনো লক্ষণীয় অবক্ষয় ছাড়াই চলতে পারে সঙ্গমহীন বংশবিস্তার।।
শুক্র ও ডিম, এ-দু-রকম জননকোষ উৎপাদন অবধারিতভাবে বোঝায় না যে। থাকতেই হবে দুটি পৃথক লিঙ্গ; সত্য হচ্ছে যে ডিম ও শুক্র, দুটি অত্যন্ত পৃথক প্রজনন কোষ, উভয়ই উৎপাদিত হতে পারে একই ব্যক্তির দ্বারা। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে বংশবিস্তারের দুটি রীতি সহাবস্থান করে প্রকৃতিতে, তারা উভয়ই বিশেষ বিশেষ প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে সমর্থ, এবং জননকোষকে দুটি ভাগে পৃথক করার ব্যাপারটি নিতান্তই আকস্মিক। তাই বিভিন্ন প্রজাতিকে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ বলে নির্দেশ করা পর্যবেক্ষণের ন্যূনতম সত্য মাত্র।
ব্যাখ্যা না করেই অধিকাংশ দর্শনে এ-ব্যাপারটিকে গ্রহণ করা হয়েছে স্বতসিদ্ধ বলে। পাততায়ী উপকথা অনুসারে শুরুতে ছিলো পুরুষ, নারী, ও উভলিঙ্গ। প্রতিটি ব্যক্তির ছিলো দুটি মুখ, চারটি বাহু, চারটি পা, এবং দুটি সংযুক্ত শরীর। এক সময়ে তাদের বিশ্লিষ্ট করা হয় দু-ভাগে; এবং সেই থেকে এক ভাগ পুনরায় মিলিত হতে চায় আরেক ভাগের সাথে। পরে দেবতারা ঘোষণা করে যে বিসদৃশ দুই অর্ধাংশ যোগ করে সৃষ্টি করা হবে নতুন মানুষ। তবে এ-গল্প দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চাওয়া হয়েছে। প্রেম; শুরুতেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে লিঙ্গবিভাজন। আরিস্ততলও ব্যাখ্যা করেন নি এ-বিভাজনকে; কেননা যদি বস্তু ও গঠনকে পারস্পরিক সহযোগিতা করতে হয় সব কাজে, তাহলে সক্রিয় ও অক্রিয় নীতিকে দুটি ভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তিতে পৃথক করার দরকার পড়ে না। তাই সেইন্ট টমাস নারীকে ঘোষণা করেন ‘আকস্মিক সত্তা ব’লে, পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বোঝায় যৌনতার আকস্মিক বা সংযত প্রকৃতি। তবে যুক্তির প্রতি হেগেলের সংরাগ অসত্য বলে গণ্য হতো যদি তিনি এর একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যার উদ্যোগ না নিতেন। তাঁর মতে যৌনতা নির্দেশ করে সে-মাধ্যমটিকে, যা দিয়ে কর্তা অর্জন করে বিশেষ এক জাতিতে অন্তর্ভুক্তির বোধ। কর্তার জাতিবোধ সমতাবিধান করে তার ব্যক্তিগত বাস্তবতার অসম বোধের, তার নিজের প্রজাতির কারো সাথে মিলিত হয়ে সে তার মধ্যে বোধ করতে চায় নিজেকে, সম্পূর্ণ করতে চায় নিজেকে, এবং এভাবে সে নিজের প্রকৃতিতে একীভূত করতে চায় জাতিকে এবং তাকে করতে চায় অস্তিত্বশীল। এই হচ্ছে সঙ্গম। (প্রকৃতির দর্শন, খণ্ড ৩, উপপরিচ্ছেদ ৩৬৯)। হেগেল পরে বলেন যে মিলনপ্রক্রিয় সম্পন্ন করার জন্যে প্রথমে থাকতে হবে লৈঙ্গিক ভিন্নতা। কিন্তু তার ব্যাখ্যা বিশ্বাসযোগ্য নয়।