বিশেষ করে যাদের দণ্ডিত করা হয়েছে নিশ্চল নিরুদ্যমতায়, তাদের সাধারণত সুখী বলে ঘোষণা করা হয় এ-অজুহাতে যেনো নিশ্চল থাকার মধ্যেই আছে সুখ। আমরা প্রত্যাখ্যান করি এ-ধারণা, কেননা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অস্তিত্ববাদী নীতিবিদ্যার। প্রতিটি কর্তাই কাজ করে নিজের সীমা অতিক্রমের লক্ষ্যে; সে অন্যান্য মুক্তি অর্জনের ধারাবাহিক প্রয়াসের মধ্য দিয়েই শুধু অর্জন করে মুক্তি। বর্তমান অস্তিত্বের কোনো যৌক্তিকতা থাকে না, যদি না তা সম্প্রসারিত হতে পারে অনির্দিষ্ট মুক্ত ভবিষ্যতে। যতোবারই সীমাতিক্রমণ প্রবণতা পিছু হটে পরিণত হয় অন্তর্ভবতায়, নিশ্চলতায়, ততোবারই অস্তিত্ব অধঃপতিত হয় এ-সোয়ে বিশেষ অবস্থায় জীবনের পাশবিক বশ্যতায় এবং মুক্তি পর্যবসিত হয় সীমাবদ্ধতায় ও আকস্মিক ঘটনাচক্রে। কর্তা যদি এতে সম্মতি দেয়, তাহলে এ-অধঃপতন নির্দেশ করে তার নৈতিক ত্রুটি; এটা যদি চাপিয়ে দেয়া হয় তার ওপর, তাহলে দেখা দেয় হতাশা ও পীড়ন। উভয় ক্ষেত্রেই। এটা এক চরম অশুভ। প্রতিটি মানুষ, যে প্রতিপন্ন করতে চায় তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা, অনুভব করে যে মুক্তভাবে কাজ করার জন্যে তার অস্তিত্বের মধ্যে রয়েছে নিজেকে অতিক্রম করার এক অসংজ্ঞায়িত প্রয়োজন।
এখন, যা উৎকটভাবে লক্ষণীয় করে নারীর পরিস্থিতি, সেটি হচেছ যে নারীঅন্যান্য মানুষের মতো এক স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সত্তা–দেখতে পায় সে বাস করছে এমন এক বিশ্বে, যেখানে পুরুষ তাকে বাধ্য করে অপর-এর অবস্থানে থাকতে। তারা তাকে একটি বস্তু হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, পর্যবসিত করতে চায় আকস্মিক ঘটনাচক্রে, কেননা তার অস্তিত্বের সীমাতিক্ৰমণতা ছায়াবৃত ও চিরকালের জন্যে সীমাতিক্রান্ত হয় আরেকটি অহং (নীতিচেতনা) দিয়ে, যেটি অপরিহার্য ও সার্বভৌম। নারীর নাটক ঘটে প্রতিটি কর্তার (অহং) মৌল আকাঙ্খর–যে সব সময় আত্মকে গণ্য করে অপরিহার্য বলে–এবং সে-পরিস্থিতির চাপের বিরোধের মধ্যে, যেখানে নারী হচ্ছে অপ্রয়োজনীয়। নারীর পরিস্থিতির মধ্যে কোনো মানুষ কীভাবে লাভ করতে পারে সিদ্ধি? তার সামনে খোলা আছে কোন কোন রাস্তা? কোনগুলো বন্ধ? পরাশ্রিত অবস্থার মধ্যে কী করে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব স্বাধীনতা? কী পরিস্থিতি সীমিত করে নারীর স্বাধীনতা এবং সেগুলো পেরোনো যায় কীভাবে? এগুলোই হচ্ছে সে-সব মৌল প্রশ্ন, যেগুলোর ওপর আমি কিছুটা আলোকপাতের চেষ্টা করবো। এর অর্থ হচ্ছে আমি ব্যক্তির ঐশ্বর্যের প্রতি আগ্রহী সুখের শর্তে নয়, বরং মুক্তির শর্তে।
যদি আমরা বিশ্বাস করতাম নারীর নিয়তি অবধারিত ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, বা আর্থনীতিক শক্তি দিয়ে, তাহলে স্পষ্টত এ সমস্যা হতো তাৎপর্যহীন। এখন থেকে সবার আগে আমি আলোচনা করবো যে আলোক নারীকে দেখা হয়। জীববিদ্যায়, মনোবিজ্ঞানে, ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদে। তারপর আমি দেখাতে চেষ্টা করবো ঠিক কীভাবে আকার দেয়া হয়েছে ‘খাঁটি নারী’ ধারণাটিকে–কেননা নারীকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে অপর-রূপে, এবং পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এর ফল কী হয়েছে। তারপর আমি বিশ্বকে বর্ণনা করবো নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে, যে-বিশ্বে অবশ্যই বাস করতে হবে নারীকে; এবং এভাবে আমরা মনে মনে ছবি আঁকতে সমর্থ হবে তাদের পথের বিপদগুলোর, যার মুখোমুখি হতে হবে তাদের এ-যাবৎ তাদের জন্যে নির্ধারিত এলাকা থেকে মুক্তির প্রয়সা চালাতে গিয়ে, যখন তারা পোষণ করে মানবজাতির পূর্ণ সদস্য হওয়ার আকাঙ্খা।
দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকা
আজকের নারীরা ন্যায়সঙ্গতভাবে বর্জন করতে পারে নারীত্বের কিংবদন্তিটি; সুনির্দিষ্ট উপায়ে দৃঢ়ভাবে তারা ঘোষণা করতে শুরু করছে তাদের স্বাধীনতা; কিন্তু পরিপূর্ণরূপে মানুষের জীবন যাপনে তারা সহজে সমর্থ হচ্ছে না। নারীদের জগতে নারীদের দ্বারা লালিত হয়ে তাদের স্বাভাবিক নিয়তি হচ্ছে বিয়ে, যা বাস্তবে আজো বোঝায় পুরুষের অধীনতা; তার কারণ পুরুষের মর্যাদা আদৌ লুপ্ত হচ্ছে না, তা আজো দাঁড়িয়ে আছে দৃঢ় অর্থনীতিক ও সামাজিক ভিত্তির ওপর। তাই আমাদের নারীর প্রথাগত নিয়তি ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করতে হবে বিশেষ যত্নের সাথে। দ্বিতীয় খণ্ডে আমি বর্ণনা করতে চেষ্টা করবো নারী কীভাবে যায় তার শিক্ষানবিশির ভেতর দিয়ে, কীভাবে সে অভিজ্ঞতা লাভ করে তার অবস্থানের, কী ধরনের বিশ্বে সে আটকে আছে, কী তার মুক্তির উপায়। তাহলেই শুধু আমরা বুঝতে পারবো নারীর সমস্যাগুলো, যারা দুর্বহ অতীতের উত্তরাধিকারী, যারা চেষ্টা করছে এক নতুন ভবিষ্যৎ তৈরির। যখন আমি ব্যবহার করি নারী বা নারীত্ব শব্দগুলো, তখন আমি অবশ্যই কোনো অপরিবর্তনীয় আদিরূপের প্রতি ইঙ্গিত করি না; আমার বহু মন্তব্যের শেষে পাঠকদের বুঝে নিতে হবে শিক্ষা ও রীতিনীতির বর্তমান অবস্থায়’ পদটি। শাশ্বত সত্য ঘোষণা এখানে আমাদের লক্ষ্য নয়, বরং আমরা বর্ণনা করতে চাই সে-সাধারণ ভিত্তি, যা আছে প্রতিটি নারী অস্তিত্বের ভিত্তিমূলে।
জীববিজ্ঞানের উপাত্ত
১.১ জীববিজ্ঞানের উপাত্ত
ভাগ ১ – নিয়তি । পরিচ্ছেদ ১ – জীববিজ্ঞানের উপাত্ত
নারী? খুবই সরল, বলেন সরল সূত্রের অনুরাগীরা : সে একটি জরায়ু, ডিম্বাশয়; সে একটি মেয়েলোক–এ-শব্দই তার সংজ্ঞার জন্যে যথেষ্ট। পুরুষের মুখে স্ত্রীলিঙ্গ কথাটি অবমাননাকর শোনায়, তবু পুরুষ তার পাশবিক স্বভাব সম্পর্কে লজ্জিত হয় না; বরং কেউ যদি তার সম্পর্কে বলে : ‘সে পুরুষ!’ তখন সে গর্ব বোধ করে। স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি অমর্যাদাকর, এ-কারণে নয় যে এটি জোর দেয় নারীর পাশবিকতার ওপর, বরং এজন্যে যে এটি তাকে বন্দী করে রাখে তার লিঙ্গের মধ্যে; আর এমনকি নিরীহ বোবা পশুর মধ্যেও লিঙ্গ ব্যাপারটি যে পুরুষের কাছে ঘৃণ্য ও ক্ষতিকর মনে হয়, তার মূলে আছে নারী, যে পুরুষের মনে জাগিয়ে রাখে এক অস্বস্তিকর বৈরিতা। সে জীববিদ্যার মধ্যে খুঁজে পেতে চায় তার ভাবাবেগের যৌক্তিকতা। স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি মনে জাগিয়ে তোলে এক ভীতিকর চিত্রকল্প–একটি বিশাল, গোল ডিম্বাণু প্লাবিত ও নপুংসক করছে একটি ক্ষিপ্র শুক্রাণুকে; দানবিক ও স্ফীত রানী পতঙ্গ শাসন করছে পুরুষ দাসদের; আরাধনাকারী নারী ম্যান্টিস ও মাকড়সা, প্রেমে পরিতৃপ্ত হওয়ার পর, ভেঙে চুরমার করে খেয়ে ফেলছে তাদের সঙ্গীদের; কামোন্মত্ত কুকুরী তার পেছনে দূষিত গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে ছুটে চলছে গলিপথ দিয়ে; বানরী অশীলভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে পাছা এবং তারপর পালিয়ে যাচ্ছে ছেনালিপনার সাথে; এবং অত্যুকৃষ্ট বন্যপ্রাণী–বাঘিনী, সিংহিনী, চিতাবাঘিনী–ক্রীতদাসীর মতো ধরা দিচ্ছে তাদের পুরুষদের রাজকীয় আলিঙ্গনের তলে। পুরুষ নারীর ওপর চাপিয়ে দেয় নিষ্ক্রিয়, আগ্রহী, চতুর, নির্বোধ, উদাসীন, কামুক, হিংস্র, নিচ প্রভৃতি বিশেষণ। এবং সত্য ঘটনা হচ্ছে সে স্ত্রীলিঙ্গ। তবে আমরা যদি মামুলি কথা অনুসারে চিন্তা করা বাদ দিই, তখন অবিলম্বে উত্থাপিত হয় দুটি প্রশ্ন : প্রাণীজগতে স্ত্রীলিঙ্গ কী বোঝায়? আর নারীর মধ্যে প্রকাশ পায় কোন বিশেষ ধরনের স্ত্রীলিঙ্গ?