নারীবাদীদের যুক্তিগুলোও কম সন্দেহের চোখে বিচার করলে চলবে না, কেননা অনেক সময়ই তাদের বিতর্কিত লক্ষ্য তাঁদের বঞ্চিত করে প্রকৃত মূল্য থেকে। নারী সমস্যাটিকে যদি তুচ্ছ বলে মনে হয়, তার কারণ হচ্ছে পুরুষালি উগ্রতা একে পরিণত করেছে একটি ঝগড়ায়; এবং ঝগড়ারত মানুষ কখনো ঠিকমতো যুক্তি প্রয়োগ করে না। অনেকে বলে আদমের পর সৃষ্টি হয়েই নারী পরিণত হয়েছে একটি গৌণ সত্তায়; অন্যরা বলে এর উল্টো যে আদম ছিলো একটি অসমাপ্ত খসড়া এবং বিধাতা যখন হাওয়াকে সৃষ্টি করেন তখনই তিনি সফল হন বিশুদ্ধভাবে মানুষ সৃষ্টিতে। নারীর মস্তিষ্ক ক্ষুদ্রতর; হ্যাঁ, কিন্তু সেটি তুলনামূলকভাবে বৃহৎ। খ্রিস্টকে পুরুষরূপে। সৃষ্টি করা হয়েছিলো; হ্যাঁ, তা হয়তো তার মহত্তর বিনয়ের জন্যে। প্রতিটি যুক্তিই সাথেসাথে নির্দেশ করে তার বিপরীতকে, এবং দুটিই অধিকাংশ সময় বিভ্রান্তিকর। ব্যাপারটি বুঝতে চাইলে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে এসব বাধাপথ থেকে; বাদ দিতে হবে উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট, সাম্য প্রভৃতি অস্পষ্ট ধারণা, যেগুলো দূষিত করেছে এবিষয়ের প্রতিটি আলোচনাকে। আমাদের শুরু করতে হবে নতুনভাবে।
বেশ, কিন্তু কীভাবে আমরা উপস্থাপন করবো প্রশ্নটি? আর আমরা এটি উপস্থাপনের কে? পুরুষ একই সাথে বিচারক ও বিবাদী; আর নারীও তাই। আমাদের দরকার একটি দেবদূত–পুরুষও নয় নারীও নয়। কিন্তু কোথায় পাবো দেবদূত? তারপর, এ-বিষয়ে দেবদূতের কথা বলার যোগ্যতা খুবই কম কেননা দেবদূত এসমস্যার মৌলিক সত্যগুলো সম্বন্ধে অজ্ঞ। উভলিঙ্গকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না, কেননা এ-ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হবে খুবই উৎকট; উভলিঙ্গ কোনো সম্পূর্ণ পুরুষ ও সম্পূর্ণ নারীর মিলিত রূপ নয়, বরং সে গঠিত প্রত্যেকের অংশবিশেষে; তাই সে নারীও নয় পুরুষও নয়। আমার মনে হয় কিছু নারী আছেন, যাঁরা নারীর পরিস্থিতি ব্যাখ্যার জন্যে সবচেয়ে যোগ্য। আমরা যেনো এ-কূটতর্ক দিয়ে বিভ্রান্ত না হই যে এপিমেনিদেস যেহেতু ছিলেন ক্রিটের অধিবাসী, তাই অবশ্যই ছিলেন মিথ্যেবাদী; কোনো রহস্যময় কারণ পুরুষ ও নারীকে সরল বিশ্বাসে বা প্রতারণার উদ্দেশ্যে কাজ করতে বাধ্য করে না, তাদের পরিস্থিতি তাদের সত্যসন্ধানে উদ্যোগী করে। আজকালকার নারীদের অনেকেই নিরপেক্ষ হতে সমর্থ। আমরা আমাদের আদর্শান্ধ অগ্রজাদের মতো নই; খেলায় আমরা অনেকটা জিতেই গেছি। নারীর মর্যাদা সম্পর্কে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক বিতর্কগুলোতে অবিচলভাবে মেনে নেয়া হয়েছে যে লিঙ্গের সাম্য এখন হয়ে উঠছে এক বাস্তবতা, এবং আমরা অনেকেই আমাদের নারীত্বের মধ্যে কোনো অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা বোধ করি নি। বিশেষ কিছু সমস্যা আছে যেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে কিছু সমস্যাকে মনে হয় বেশি জরুরি; এবং এই নিরাসক্তির জন্যে আশা করতে পারি যে আমাদের মনোভাব হবে বস্তুনিষ্ঠ। পুরুষদের থেকে নারীর বিশ্বকে আমরা জানি অনেক বেশি অন্তরঙ্গভাবে, কেননা আমাদের শেকড় রয়েছে এর ভেতরেই, একটি মানুষের কাছে নারী হওয়ার অর্থ কী, তা আমরা জানি পুরুষের থেকে অনেক বেশি প্রত্যক্ষভাবে; এবং আমাদের কাছে এ-জ্ঞানই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি বলেছি আছে কিছু অধিকতর জরুরি সমস্যা, কিন্তু নারী হওয়া জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে, সে-সম্পর্কে প্রশ্ন করা থেকে এটা আমাদের বিরত করে না। আমাদের দেয়া হয়েছে কী কী সুবিধা এবং কী কী দেয়া হয় নি? আমাদের অনুজাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে কী ভাগ্য, কোন দিকে তারা এগোবে? এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে আমাদের সময়ে নারীদের সম্পর্কে নারীদের লেখা বইগুলোতে সাধারণত অধিকারের দাবি বেশি জানানো হয় না, বরং চেষ্টা করা হয় বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝাতে। আমরা যখন অতিরিক্ত বিতর্কের যুগ পেরিয়ে আসছি, তখন আরো অনেক কিছুর সাথে এ-মন্তব্যের সত্যতা প্রমাণেরও একটি উদ্যোগরূপে উপস্থাপিত করা হচ্ছে এ-বইটি।
তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে কোনো মানবিক সমস্যা পক্ষপাতহীন মনে আলোচনা করা অসম্ভব। যেভাবে উপস্থাপন করা হয় প্রশ্নগুলো, নেয়া হয় যেদৃষ্টিকোণ, তাতে থাকে স্বার্থের আপেক্ষিকতা; সব বৈশিষ্ট্যই নির্দেশ করে মূল্য, এবং তথাকথিত সব বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনার পেছনেই থাকে বিশেষ নৈতিক পটভূমি। মূলসূত্রগুলো গোপন করে রাখার চেষ্টা না করে শুরুতেই সেগুলো খোলাখুলি বলে দেয়াই ভালো। এতে প্রতি পাতায় আর ব্যাখ্যা করতে হবে না উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট, ভালো, মন্দ, অগ্রগতি, প্রতিক্রিয়া, এবং এমন আরো অনেক শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে কী অর্থে। নারী সম্পর্কিত কিছু বই জরিপ করলেই দেখতে পাই যে বারবার নেয়া হয় একটি দৃষ্টিকোণ, সেটি হচ্ছে জনগণের মঙ্গল, জনগণের স্বার্থ; আর তাতে সমাজের মঙ্গল বলতে সব সময়ই বোঝান তারা সমাজকে যেভাবে রাখতে বা গড়তে চায়, সে-ব্যাপারটি। আমরা বিশ্বাস করি যা নিশ্চিত করে নাগরিকদের ব্যক্তিগত মঙ্গল, তাই শুধু জনগণের মঙ্গল; আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিচার করবো এ-অনুসারে যে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ওগুলো কতোটা বাস্তব সুবিধা দিতে সমর্থ। ব্যক্তিগত স্বার্থের ধারণাকে ব্যক্তিগত সুখের ধারণার সাথে গুলিয়ে ফেলতে চাই না, যদিও এটি আরেকু সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি। ভোটাধিকারী নারীর থেকে কি হারেমের নারীরা বেশি সুখী নয়? গৃহিণী কি বেশি সুখী নয় কর্মজীবী নারীর থেকে? তবে সুখী শব্দটি ঠিক কী বোঝায় তা অস্পষ্ট; আর এর মুখোশের আড়ালে কতোটা আছে সত্যিকার মূল্য তা আরো অস্পষ্ট। অন্যের সুখ পরিমাপের কোনো সম্ভাবনা নেই, এবং আমরা যে পরিস্থিতিকে সুখী বলতে চাই, তাকে সুখী বলে বর্ণনা করা সব সময়ই সহজ।