কিন্তু হওয়া ক্রিয়াটির তাৎপর্য ঠিকমতো বোঝা দরকার; প্রতারণার উদ্দেশ্যেই একে দেয়া হয় অনড় মূল্য, যদিও এটি নির্দেশ করে এক জিনিশ থেকে আরেক জিনিশ হওয়ার গতিশীল হেগেলীয় অর্থ। হ্যা, সব কিছু মিলিয়ে নারী আজ পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট; এর অর্থ হচ্ছে এ ছাড়া নারীর অন্য কিছু হওয়ার উপায় ছিলো না। প্রশ্ন হচ্ছে : এ-অবস্থা কি চলতে থাকবে?
অনেক পুরুষই আশা করে যে এটা চলবে; সবাই যুদ্ধে ক্ষান্ত হয় নি। রক্ষণশীল বুর্জোয়ারা নারীর মুক্তির মধ্যে আজো দেখতে পায় তাদের নৈতিকতা ও স্বার্থের প্রতি হুমকি। কিছু পুরুষ ভয় পায় নারীর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে। সম্প্রতি এক ছাত্র হেবদোলাতিন-এ লিখেছে : প্রতিটি ছাত্রী, যে চিকিৎসাবিদ্যা বা আইন পড়ে, হরণ করে আমাদের একটি করে চাকুরি।’ পৃথিবীতে নিজের অধিকার সম্পর্কে তার মনে কখনো কোনো প্রশ্ন জাগে নি। আর আর্থিক স্বার্থই সব নয়। উৎপীড়ন উৎপীড়নকারীদের যেসব সুফল দেয়, তার একটি হচ্ছে তাদের মধ্যে অধমটিও নিজেকে গণ্য করে শ্রেষ্ঠতর বলে; এভাবে দক্ষিণের একটি ‘গরিব শাদা’ও নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে একথা ভেবে যে সে ‘নোংরা কালা আদমি’ নয়–আর ধনশালী শাদারা এ-গর্বটিকে সুচতুরভাবে লাগায় নানা কাজে।
একইভাবে, পুরুষের মধ্যে চরম অধমটিও নারীদের তুলনায় নিজেকে মনে করে একটি নরদেবতা। এম দ্য মঁতেরলঁর পক্ষে নারীদের সামনে নিজেকে নায়ক মনে করা ছিলো খুবই সহজ, পুরুষদের মধ্যে পুরুষ হিসাবে অভিনয় করে সে তা মনে করতে পারে নি, যদিও বহু নারী ওই কাজ করেছে তার থেকে অনেক বেশি ভালোভাবে। ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বরে ফিগারো লিতেরের-এর একটি রচনায় ক্লদ মারিয়াক, যাঁর মহৎ মৌলিকত্বের সবাই অনুরাগীনালী সম্বন্ধে লিখতে পেরেছিলেন : ‘আমরা শুনতে থাকি বিস্র উদাসীনতার স্বউদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবীর মধ্যে, এটা ভালোভাবে জেনেই যে তার বোধশক্তি কমবেশি উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত করে এমন চিন্তাভাবনা, যা আসে আমাদের থেকেই।’ এটা সুস্পষ্ট যে-বক্তাটির কথা বলা হয়েছে, তিনি মারিয়াকের নিজের চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত করেন না, কেননা তার যে নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে এটা কারো জানা নেই। এমন হতে পারে যে ওই নারীটি পুরুষের মধ্যে উৎসারিত চিন্তাভাবনাই প্রতিফলিত করেন, তবে পুরুষের মধ্যেও এমন অনেক আছে যারা অন্যদের চিন্তাভাবনা আত্মসাৎ করেছে; প্রশ্ন করতে পারি যে ক্লদ। মারিয়াকের পক্ষে কি পাওয়া সম্ভব ছিলো না এরচেয়ে আকর্ষণীয় কথোপকথন, যা তাঁকে প্রতিফলিত না করে প্রতিফলিত করে দেকার্ত, মার্ক্স, বা জিদকে। যা সত্যিই অসামান্য এখানে, তা হচ্ছে যে আমরা ব্যবহার করে তিনি নিজেকে করে তুলেছেন সেইন্ট পল, হেগেল, লেনিন, ও নিটশের সমতুল্য, এবং তাদের মহিমার উচ্চতা থেকে অবজ্ঞার সাথে তিনি তাকান সে-নারীর ঝাকের দিকে, যারা একই সমতলে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথোপকথনের সাহস করেন। আমি একাধিক নারীকে জানি, যারা অস্বীকার করতেন মারিয়াকের ‘বিনম্র উদাসীনতার স্বর’-এর পীড়ন সহ্য করতে।
এ-উদাহরণটি নিয়ে আমি একটু বেশি সময় কাটিয়েছি, কেননা পুরুষালি প্রবণতা এটিতে দেখানো হয়েছে প্রতিপক্ষকে শক্তিহীন করে তোলার মতো অকপটভাবে। কিন্তু পুরুষ আরো অনেক সূক্ষ্ম উপায়ে লাভবান হয় নারীর অপরত্ব থেকে। যারা ভুগছে হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষায়, এখানে তাদের জন্যে রয়েছে এক অলৌকিক মলম, আর একথা সত্য যারা নিজেদের পৌরুষ নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাদের থেকে আর কেউ নারীর প্রতি বেশি আক্রমণাত্মক, বা বিদ্বেষপরায়ণ নয়। আজকাল অধিকাংশ পুরুষ আর নারীকে নিকৃষ্ট বলে গণ্য করে না; তাদের মধ্যে এখন গণতন্ত্রের আদর্শ কাজ করে, তাই সব মানুষকে সমান মনে না করে কোনো উপায় নেই।
পরিবারের মধ্যে থেকে শিশু ও যুবকের চোখে নারী ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের একই সামাজিক মর্যাদা আছে বলে মনে হয়। পরে কামনা ও প্রেমময় ওই যুবক উপলব্ধি করে তার কাম্য ও প্রেমাস্পদ নারীটির প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা; বিয়ের মধ্যে নারীকে সে শ্রদ্ধা করে স্ত্রী ও মা হিশেবে, এবং দাম্পত্য জীবনের বাস্তব ঘটনাবলিতে নারীটি পুরুষটির কাছে দেখা দেয় এক স্বাধীন মানুষরূপে। তাই পুরুষটি মনে করতে পারে লিঙ্গ দুটির মধ্যে আর কোনো অধীনতা নেই এবং সব মিলিয়ে পার্থক্য সত্ত্বেও নারী তার সমান। তবে সে গুটিকয় নিকৃষ্টতা লক্ষ্য করে–তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হচ্ছে কোনো পেশার জন্যে নারীর অযোগ্যতা; সে মনে করে এর মূলে রয়েছে প্রাকৃতিক কারণ। যখন সে নারীর সঙ্গে থাকে সহযোগিতামূলক ও সদাশয় সম্পর্কে, তখন তার বিষয়বস্তু হচ্ছে বিমূর্ত সাম্যের নীতি এবং যে-সব অসাম্য রয়েছে, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে সে তার মনোভঙ্গি গঠন করে না। কিন্তু যখন সে বিরোধে লিপ্ত হয় নারীর সাথে, তখন পরিস্থিতি উল্টে যায় : তখন তার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে বিরাজমান অসাম্য, এবং এমনকি এর মধ্যেই সে পায় বিমূর্ত সাম্যকে অস্বীকার করার যৌক্তিকতা।
অনেক পুরুষ যেনো সরল বিশ্বাসে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে থাকে যে নারী পুরুষের সমান এবং তাদের শোরগোল করার কিছু নেই, এবং একই সময়ে তারা বলে নারীরা কখনোই পুরুষের সমান হয়ে উঠতে পারবে না; তাদের দাবি নিষ্ফল। পুরুষের পক্ষে সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণের গুরুত্ব বোঝা বেশ কঠিন, কেননা এটাকে নগণ্য মনে হয় বাহ্যিকভাবে, কিন্তু এটা নারীর মধ্যে সৃষ্টি করে এমন গভীর নৈতিক ও মননগত প্রভাব যে মনে হয় ওগুলো উদ্ভূত হয়েছে তার মৌল স্বভাব থেকে। সবচেয়ে সহানুভূতিশীল পুরুষেরাও নারীর বাস্তব পরিস্থিতি পুরোপুরি বুঝতে পারে না। আর যে-পুরুষেরা নিজেদের সুবিধাগুলো রক্ষা করার জন্যে ব্যর্থ, তাদের বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই; তারা ওগুলোর পরিমাণ নিজেরাও পরিমাপ করতে পারে না। নারীর ওপর যতো আক্রমণ চালানো হয়, সেগুলোর সংখ্যা ও ভয়াবহতা দেখে ভয় পেলে চলবে না, আর ‘খাঁটি নারী’র বন্দনার ফাঁদে পড়লেও আমাদের চলবে না।