বিধানকর্তারা, পুরোহিতেরা, দার্শনিকেরা, লেখকের এবং বিজ্ঞানীরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে নারীর অধীন অবস্থান স্থির হয়েছে স্বর্গে এবং মর্ত্যে এটা সুবিধাজনক। পুরুষের উদ্ভাবিত ধর্মগুলোতে প্রতিফলিত হয় আধিপত্যের এ বাসনা। হাওয়া ও প্যান্ডোরার উপকথায় পুরুষ নারীর বিরুদ্ধে নেমেছে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। তারা ব্যবহার করেছে দর্শন ও ধর্মতত্ত্বকে, যা দেখা যায় আরিস্ততল ও সেইন্ট টমাস থেকে উদ্ধৃতিতে। প্রাচীন কাল থেকেই ব্যঙ্গাকারেরা ও নীতিবাগীশেরা প্রচুর আনন্দ উপভোগ করে এসেছে নারীর দুর্বলতা দেখিয়ে দেখিয়ে। ফরাশি সাহিত্য ভরে নারীর বিরুদ্ধে যে-বর্বর অভিযোগ করা হয়েছে, তার সাথে আমরা পরিচিত। এ-বৈরিতা কখনো কখনো হয়তো সত্য, এবং অধিকাংশ সময়ই ভিত্তিহীন; তবে এগুলো কমবেশি সফলভাবে গোপন করে রাখার চেষ্টা করে নিজেকে ঠিক বলে প্রতিপন্ন করার বাসনা। যেমন মঁতেইন বলেছেন, অপর লিঙ্গটিকে ক্ষমা করার থেকে একটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ভোলা সহজ। অনেক সময় কী ঘটছে, তা বেশ স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, রোমান আইন নারীর অধিকার খর্ব করতে গিয়ে বলেছে নারীর মূঢ়তা, স্থিতিহীনতার কথা; এ-সময় দুর্বল হয়ে পড়ছিলো পারিবারিক বন্ধন, আর এতে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো পুরুষ উত্তরাধিকারীদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার। নারীকে অভিভাবকের অধীনে রাখার জন্যে ষোড়শ শতকে আবেদন করা হয়েছিলো সেইন্ট অগাস্টিনের কর্তৃত্বের প্রতি, যিনি ঘোষণা করেছিলেন নারী এমন জীব, যে সিদ্ধান্তগ্রহণসক্ষম নয় স্থিরও নয়; এটা ঘটেছিলো এমন সময়ে যখন মনে করা হয়েছিলো যে একলা নারী নিজের সম্পত্তি দেখাশোনা করতে সমর্থ। নারীর নির্ধারিত ভাগ্য কতোটা খামখেয়ালিপূর্ণ ও অন্যায্য, তা স্পষ্ট বুঝেছিলেন মতেইন : নারী যখন তার জন্যে প্রণীত বিধিবিধান মানতে অস্বীকার করে, তখন সে একটুও ভুল করে না, কেননা নারীর সাথে আলোচনা করেই পুরুষেরাই প্রণয়ন করে এসব বিধিবিধান। ষড়যন্ত্র আর কলহের যে এতো ছড়াছড়ি, এটা কোনো বিস্ময় নয়। কিন্তু তিনি নারীর পক্ষে যোদ্ধা হয়ে ওঠেন নি।
বেশ পরে, আঠারে শতকে, সত্যিকারভাবে গণতান্ত্রিক পুরুষেরা ব্যাপারটিকে বস্তুগতভাবে দেখতে শুরু করেন। আরো অনেকের মতো দিদেরো দেখাতে চেয়েছেন যে পুরুষের মতো নারীও মানুষ। পরে জন স্টুয়ার্ট মিল ঐকান্তিকভাবে দাঁড়িয়েছেন নারীর পক্ষে। এ-দার্শনিকেরা দেখিয়েছেন অসাধারণ নিরপেক্ষতা। উনিশ শতকে। নারীবাদী কলহ আবার হয়ে ওঠে দলভুক্তদের কলহ। শিল্পবিপ্লবের একটি পরিণতি ছিলো যে নারী প্রবেশ করে উৎপাদনমূলক শ্রমে, এবং এখানেই নারীবাদীদের দাবি তাত্ত্বিক এলাকা পেরিয়ে লাভ করে আর্থনীতিক ভিত্তি, আর তাদের বিরোধীরা হয়ে ওঠে আরো বেশি আক্রমণাত্মক। যদিও তখন ভূম্যধিকার বেশ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, তবু বুর্জোয়ারা আঁকড়ে থাকে পুরোনো নৈতিকতা, যা পারিবারিক সংহতির মধ্যেই দেখতে পায় ব্যক্তিমালিকানার নিশ্চয়তা। নারীর মুক্তি এক সত্যিকার হুমকি হয়ে দেখা দেয় বলে নারীকে আবার আদেশ দেয়া হয় ঘরে ফেরার। এমনকি শ্রমজীবীদের মধ্যেও পুরুষেরা নারীর মুক্তি ঠেকাতে চেষ্টা করে, কেননা তারা নারীকে দেখতে শুরু করে বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে–বিশেষ করে এজন্যে যে নারীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলো কম মজুরিতে কাজ করতে।
এরপর নারীর নিকৃষ্টতা প্রমাণের জন্যে নারীবাদবিরোধীরা আগের মতো শুধু ধর্ম, দর্শন, ও ধর্মতত্ত্বের নয়, তারা সাহায্য নিতে শুরু করে বিজ্ঞানের–জীববিদ্যা, নিরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞান প্রভৃতির। নারীকে তারা সর্বোচ্চ যা দিতে সম্মত হয়, তা হচ্ছে ‘ভিন্নতার মধ্যে সাম্য’। ওই লাভজনক সূত্রটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ; এটা উত্তর। আমেরিকার নিগ্রোদের জন্যে প্রণীত জিম ক্রো আইনের ‘সমান, তবে পৃথক’ সূত্রের মতোই। সবাই জানে এ-তথাকথিত সাম্যপরায়ণ বিচ্ছিন্নকরণের ফল হচ্ছে চরমতম বৈষম্য। যে-সাদৃশ্য এখানে দেখানো হলো, এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়, কেননা যখনই কোনো জাতি, বর্ণ, শ্রেণী বা লিঙ্গকে নিকৃষ্ট অবস্থানে ঠেলে দেয়া হয়, তখন তার যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করা হয় একই পদ্ধতিতে। ‘চিরন্তনী নারী’ কথাটি ‘কৃষ্ণ আত্মা’ এবং ‘ইহুদি চরিত্র’ ধারণারই সমতুল্য। এটা সত্য যে ইহুদিদের সমস্যাটি অন্য দুটি থেকে ভিন্ন–ইহুদিবিরোধীদের কাছে ইহুদিরা নিকৃষ্ট নয়, তারা শত্রু, যাদের পৃথিবীতে টিকে থাকতে দেয়া যাবে না, নিশ্চিহ্নীকরণই তাদের জন্যে। নির্ধারিত নিয়তি। কিন্তু নারী ও নিগ্রোর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে গভীর সাদৃশ্য। এরা উভয়ই আজকাল মুক্তি পাচ্ছে একই ধরনের অভিভাবকত্ব থেকে এবং আগের প্রভুশ্রেণীটি চাচ্ছে তাদের নিজের জায়গায় রাখতে’–অর্থাৎ তাদের জন্যে নির্ধারিত স্থানটিতে রাখতে। উভয় ক্ষেত্রেই আগের প্রভুরা মুখর হয়ে ওঠে কমবেশি আন্তরিক স্তুতিতে, তারা প্রশংসায় মুখর হয় ভালো নিগ্রোর গুণাবলির, তার সুপ্ত, শিশুসুলভ, প্রফুল্ল আত্মার, অর্থাৎ অনুগত নিগ্রোর; অথবা সে-নারীর গুণাবলির, যার রয়েছে প্রকৃত নারীত্ব’, অর্থাৎ লঘু, বালখিল্য, দায়িত্বহীন–অনুগত নারীর। উভয় ক্ষেত্রেই আধিপত্যশীল শ্ৰেণীটি নিজের যুক্তিকে দাঁড় করায় এমন সব ব্যাপারের ওপর, যেগুলো সৃষ্টি করেছে তারা নিজেরাই। জর্জ বার্নার্ড শ এর সারকথা বলেছেন এভাবে, মার্কিন শাদারা কালোদের ঠেলে নামিয়ে দেয় জুতোপালিশকারী বালকদের স্তরে, এবং এ থেকে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে কালোরা জুতো পালিশ করা ছাড়া আর কিছুর উপযুক্ত নয়।’ এ-দুষ্টচক্রের দেখা পাওয়া যায় সদৃশ সমস্ত পরিস্থিতিতে; যখন কোনো ব্যক্তিকে (বা একদল ব্যক্তিকে) রাখা হয় নিকৃষ্ট পরিস্থিতিতে, তখন তাকে নিকৃষ্টই মনে হয়।