- বইয়ের নামঃ দ্বিতীয় লিঙ্গ – সিমোন দ্য বোভোয়ার
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
সিমোন দ্য বোভোয়ার ও নারীবাদ
লন্ডন থেকে একটু দূরে এপিং বনভূমির কাছের এক পল্লীর গরিব কৃষকপরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন এক তরুণী, ফরাশি বিপ্লবের থেকেও বিপ্লবাত্মক, ১৭৯১-এ মাত্র ৩২ বছর বয়সে, মাত্র ৬ সপ্তাহে লিখেছিলেন ১৩ পরিচ্ছেদের একটি পারমাণবিক, এখন অমর বই : দি ভিন্ডিকেশন অফ দি ব্লাইট্স্ অফ ওম্যান, বেরিয়েছিলো। ১৭৯২-এ। সেদিন বিশ্বের একটি বড়ো পরিবর্তন ঘটেছিলো। লেখক মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্, এক সময় নিন্দিত, এখন বন্দিত নারীবাদের জননীরূপে। জননী? শব্দটি ঠিক হলো? নারীবাদ কি জরায়ু থেকে উৎপন্ন? এ-প্রথাগত অভিধাটি আজো ব্যবহৃত হয়, তাঁর ক্ষেত্রেও হয়। মননশীল কিন্তু আবেগাতুর, বিয়েবিরোধী কিন্তু প্রেম ও পুরুষের জন্য কাতর, একই সঙ্গে অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু, মেরি নারীবাদের জোয়ান অফ আর্ক, যিনি দেখা দিয়ে, জয় ক’রে, হয়েছিলেন ট্র্যাজেডি। ১৫৭ বছর পর দেখা দেন আরেক নারী, এবার ইংল্যান্ডে নয়, ফ্রান্সে, ১৯৮৯-এ দু-খন্ডে বেরোয় তাঁর ১০০০-এরও বেশি পৃষ্ঠার বইঃ ল্য দ্যকিয়েম সেক্সঃ দি সেকেন্ড সেক্সঃ দ্বিতীয় লিঙ্গ। তিনি সিমোন দ্য বোভোয়ার। তিনিও বন্দিত বিশশতকের নারীবাদের জননীরুপে; তাঁর বইয়ের পংক্তির পর পংক্তি থেকে জন্মেছে আধুনিক নারীবাদের বিচিত্র ধারা, অনুপ্রাণিত হয়েছেন পঞ্চাশ – ষাট ও পরের দশকগুলোর নারীবাদীরা! অ্যালিস শোয়ার্জার, দ্য বোন্ডোয়ারের এক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী লিখেছেন, ‘পঞ্চাশ ও ষাটের তমসায়, যখন নব নারী আন্দোলন দেখা দেয় নি, তখন দ্বিতীয় লিঙ্গ ছিলো এক গুপ্ত সংকেতবিধির মতো, যার সাহায্যে আমরা নতুন নারীরা পরস্পরের কাছে বার্তা পাঠাতাম। আর সিমোন দ্য বোভোয়ার নিজে, তাঁর জীবন এবং তাঁর কর্ম, ছিলেন এবং আছেন এক প্রতীক হয়ে।’ জননী হওয়ার কোনো ইচ্ছে তার ছিলো না; মেরি তবু দুটি কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন, দ্বিতীয়টি জন্ম দিতে গিয়ে চ’লে গিয়েছিলেন পৃথিবী থেকে, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে। দ্য বোভোয়ার সন্তানে ও বিয়েতে বিশ্বাস করেন নি; মননশীলতায় তিনি মেরির থেকে প্রায়-বিপরীত মেরুর, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মননশীলতার প্রতিমূর্তি; কিন্তু ভেতরে ভেতরে মিল আছে তাদের; দ্য বোভোয়ার জাঁ-পল সাত্রের সাথে ৫১ বছর কাটিয়েছেন প্ৰেমবন্ধুত্বের সম্পর্কে, অন্য প্রেমেও পড়েছেন, মননশীল বই লেখার ফাঁকে অন্য প্রেমিককে লিখেছেন কাতর পত্র, গর্ভপাত করেছেন। দুজনেই তিরস্কৃত ও নন্দিত হয়েছেন বই প্রকাশের পর; বিরোধীরা মেরিকে বলেছে ‘পেটিকোটপরা হয়েনা’,‘দার্শনিকতাপরায়ণ সৰ্পিণী’; আর দ্য বোভোয়ারের বইয়ের একটি অংশ পত্রিকায় বেরোলে এক ফরাশি লেখক চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে তিনি লেখিকার যৌনাঙ্গের বিস্তৃত বিবরণ পেয়েছেন, এবং বই বেরোনোর পর ক্যাথলিকদের ধর্মীয় দুর্গ ভ্যাটিকান তার বই অনৈতিক’ বলে নিষিদ্ধ করে, এক মার্কিন সাংবাদিক অপভাষায় লেখেন লেখিকার যা দরকার, তা হচ্ছে একটা উৎকৃষ্ট সঙ্গম। মেরি প্রচণ্ড বিদ্রোহী, তিনি ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন পুরুষের সভ্যতাকে, মুক্তি দিতে চেয়েছেন বন্দী নারীকে; দ্য বোভোয়ার প্রাজ্ঞ, সুধীর, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কাব্যিক, ব্যাখ্যা ও উদ্ঘাটন করেছেন, অদৃশ্য জীবাণুর মতো পুরুষতন্ত্রের কাঠামোর ভেতরে ঢুকে তাকে জীৰ্ণ করেছেন। মেরি নারীবাদের জোয়ান অফ আর্ক হ’লে সিমোন দ্য বোভোয়ার নারীবাদের আইনস্টাইন। পুরুষের সাথেই তুলনা করতে হলো; তা-ই করতে হচ্ছে, কেননা দ্য বোভোয়ার, এবং সব নারীবাদীই, চান পুরুষের সাথে সাম্য; কেননা পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় সার্বভৌম পুরুষই প্রকাশ করে মানবপ্রজাতির সে-বৈশিষ্ট্য, যাকে দ্য বোভোয়ার বারবার বলেন- ‘ট্র্যান্সেন্ডেন্স’ : সীমাতিক্ৰমণতা, আর নারীকে আটকে রাখা হয়েছে ‘ইমানেন্স’-এ : সীমাবদ্ধতায়।
পুরোনাম সিমোন লুসি-এর্নেস্তিন-মারি-বেরত্রা দ্য বোভোয়ার, বিশ্ববিখ্যাত তিনি সিমোন দ্য বোভোয়ার (১৯০৮-১৯৮৬) নামে; তিনি দিয়ে গেছেন চিরকালের শ্রেষ্ঠ নামগুলোর একটি। দ্য বোভোয়ার জন্মেছিলেন প্যারিসে, ১৯০৮-এর ৯ জানুয়ারি মঁৎপারনাসের কাফে দ ল রঁতঁদের ওপরে। বাবা জর্জে বেরত্রা দ্যা বেরঁত্রা দ্য বোভোয়ার ছিলেন আইনজীবী, মা ফ্রাঁসোয়া ব্রাসেয়ো; দুজন ছিলেন দু-রক্ম। দ্য বোভোয়ার ছিলেন পিতাতামার জ্যেষ্ঠ সন্তান, আরেকটি বোন ছিলো তাঁর, তাঁকে অনেকটা পুত্ররূপেই পালম করেন পিতা। তিনি লিখেছেন, “বাবা গর্বের সাথেই বলতো : সিমোনের মগজ পুরুষের; সে পুরুষের মত চিন্তা করে; সে পুরুষ।’’ তিনি বেড়ে উঠেন প্যারিসের চতুর্দশ ‘আঁরোদিসঁমা’বা এলাকায়, যেখানে থেকেছেন প্রায় সারা জীবন। মা ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক, বাৰা সন্দেহবাদী, প্যারিসীয়; এবং অল্প বয়সেই বোভোয়ার বুঝতে পেরেছিলেন চারপাশের পৱিস্থিতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে উঠলে দ্য বোভোয়ার দেখতে পান কী দুঃসহ ক্লাস্তিকার গৃহস্থালির কাজ করতে হয় তাঁর মাকে- যে-ক্লান্তির মর্মস্পশী বর্ণনা দিয়েছেন তিনি দ্বিতীয় লিংগ-এ; তখনই স্থির করেন কখনো গৃহিণী বা মা হবেন না। দ্বিতীয় লিংগ-এ এক তরুনীর কথা বলেছেন তিনি, যে মায়ের ক্লান্তিকর একঘেয়ে গৃহস্থালির কাজ দেখে ভয় পায় যে সেও বাঁধা পড়বে ওই নির্মম নিরর্থক নিয়তিতে, তখনি সে ঠিক করেন ফেলে সে কখনো মা আর গৃহিণী হবে না; ওই তরুণী দ্য বোভোয়ার নিজেই। ১৯২৯-এ ২১ বছর বয়সে সরবনে দর্শনে এগ্রিগেশন পরীক্ষায় পাশ করেন। তিনি; ফ্রান্সে এ-পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে লাভ করেন। এ-ডিগ্রি। পরীক্ষায় জা-পল সার্ত্র হন প্রথম, তিনি দ্বিতীয়, এবং জড়িয়ে পড়েন প্রেমে, বন্ধুত্ত্বে, এক ব্যতিক্রমী সম্পর্কে, যারা কখনো পরস্পরকে ছেড়ে যান নি, কিন্তু অন্য কারো সাথে না জড়ানোর, শুদ্ধ একনিষ্ঠ দেহ ও মনের সতীত্বের বাধ্যবাধকতায়ও থাকেন নি। সার্ত্রের সাথে দেখা হওয়ার পর বোভোয়ারের জীবন বদলে যায় চিরকালের মতো, এ-সাক্ষাৎ বিশশতকের এক শ্রেষ্ঠ ঘটনা, হয়তো বদলে গিয়েছিলো সার্ত্রের জীবনও, কেননা দ্য বোভোয়ার অস্তিত্ববাদী দর্শনের ‘অপর’ বা আদার’ হয়ে থাকার মতো নারী ছিলেন না।