সে দেহ এক ভুটিয়ার। তার সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত, মাথাটাও ভীষণভাবেও ফেটে গিয়েছে আর তার চারিপাশে রক্তের স্রোত জমাট হয়ে রয়েছে।
বিনয়বাবু স্তম্ভিতভাবে কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কী আশ্চর্য! জঙ্গলের এখানটাও তো আমরা খুঁজেছি, কিন্তু তখন তো এ দেহটা এখানে ছিল না!
কুমার বললে, হয়তো এ ঘটনা ঘটেছে তারপরে! দেখছেন না, ওর দেহ থেকে এখনও রক্ত ঝরছে!
হঠাৎ দেহটা একটু নড়ে উঠল।
বিমল তাড়াতাড়ি তার পাশে গিয়ে বসে পড়ে বললে, এ যে এখনও বেঁচে আছে।
আহত ব্যক্তি ভুটিয়া ভাষায় যন্ত্রণা-ভরা খুব মৃদু স্বরে বললে, একটু জল।
বিমলের ফ্লাস্কে জল ছিল। ফ্লাস্কের ছিপি খুলতে খুলতে সে শুধোলে, কে তোমার এমন দশা করলে?
দারুণ আতঙ্কে শিউরে উঠে সে খালি বললে, ভূত ভূত!..জল!
বিমল তার মুখে জল ঢেলে দিতে গেল, কিন্তু সে জল হতভাগ্যের গলা দিয়ে গলল না, তার আগেই তার মৃত্যু হল।
কুমার হঠাৎ ভীত ভাবে সবিস্ময়ে বলে উঠল, বিমল! দেখ, দেখ!
জমাট রক্তের উপরে একটা প্রকাণ্ড পায়ের দাগ! সে দাগ অবিকল মানুষের পায়ের দাগের মতো কিন্তু লম্বায় তা প্রায় আড়াই ফুট এবং চওড়াতেও এক ফুটেরও বেশি! মানুষের পায়ের দাগ এত বড় হওয়া কি সম্ভব? যার পা এমন, তার দেহ কেমনধারা?
সকলে বিস্ফারিত নেত্রে সেই বিষম পদচিহ্নের দিকে তাকিয়ে কাঠের মতন আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
.
দুই। বাবা মহাদেবের চ্যালা
সকলের আগে কথা কইলেন বিনয়বাবু। ভয়ার্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, বিমল! কুমার! একি অসম্ভব ব্যাপার। আমরা দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো?
রামহরি আড়ষ্টভাবে মত প্রকাশ করলে, এ মস্তবড় একটা বিদকুটে ভূতের পায়ের দাগ না হয়ে যায় না!
কুমার বললে, বিমল, আমরা কি আবার কোনও ঘটোৎকচের (আবার যকের ধন দ্রষ্টব্য) পাল্লায় পড়লুম, মানুষের পায়ের দাগ তো এতবড় হতেই পারে না!
.
পায়ের দাগটা ভালো করে পরীক্ষা করতে করতে বিমল বললে, মানুষের পায়ের দাগ এতবড় হওয়া সম্ভব নয় বটে কিন্তু এ দাগ যে অমানুষের পায়েরও নয়, এটা আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি।
বিনয়বাবু বললেন, কি প্রমাণ দেখে তুমি একথা বলছ?
বিমল মৃত ভুটিয়ার একখানা মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে নিয়ে বললে, এর হাতের মুঠোর দিকে তাকিয়ে দেখুন।
সকলে দেখলে, তার মুষ্টিবদ্ধ হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে একগোছা চুল বেরিয়ে পড়েছে।
বিনয়বাবু চুলগুলো লক্ষ করে দেখে বললেন, এ কার মাথার চুল? এত লম্বা, আর এত মোটা?
বিমল বললে, এ চুল যে ওই ভুটিয়ার মাথার চুল নয়, সেটা তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। তবে কেমন করে চুলগুলো ওর হাতের মুঠোর মধ্যে এল?
কুমার বললে, যার আক্রমণে ও-বেচারির ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে, এগুলো নিশ্চয়ই তার মাথার চুল!
বিমল বললে, আমারও সেই মত। শত্রুর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করবার সময়ে ভুটিয়াটা নিশ্চয়ই তার চুল মুঠো করে ধরেছিল।…দেখুন বিনয়বাবু, চুলগুলো ঠিক মানুষেরই মাথার চুলের মতো, কিন্তু মানুষের মাথার চুল এত মোটা হয় না। এই পায়ের দাগ আর এই মাথার চুল দেখে আমার সন্দেহ হচ্ছে, এই ভুটিয়াকে যে আক্রমণ করেছিল, লম্বায় সে হয়তো পনেরো-ষোলো ফুট উঁচু!
কুমার হতভম্বের মতো বললে, বায়োস্কোপের কিংকং কি শেষটা হিমালয়ে এসে দেখা দিল?
বিমল বললে, আরে কিংকং তো গাঁজাখুরি গল্পের একটা দানব গরিলা। আর আমরা এখানে সত্যিকারের যে পায়ের দাগ দেখছি, এটা তো গরিলার নয়–কোনও দানব বা দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড মানুষের পায়ের দাগ!..এখন কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে এমন মানুষ কি থাকতে পারে?
কুমার বললে, হিমালয়ের ভিতরে যদি এমন কোনও অজানা জন্তু থাকে,যার পায়ের দাগ আর মাথা বা গায়ের চুল মানুষের মতো?
বিনয়বাবু বললেন, হয়তো ও মাথার চুল আর পায়ের দাগ জাল করে কেউ আমাদের ধাঁধায় ফেলবার বা ভয় দেখাবার ফিকিরে আছে।
বিমল বললে, আচ্ছা, এই চুলগুলো আপাতত আমি তো নিয়ে যাই, পরে কোনও অভিজ্ঞ লোকের সাহায্যে পরীক্ষা করলেই সব বোঝা যাবে।
রামহরি বারবার ঘাড় নেড়ে বলতে লাগল, এসব কোনও কথার মতো কথাই নয়, ওই ভুটিয়াটা মরবার সময়ে যা বলেছিল তাই হচ্ছে আসল কথা! এসব হচ্ছে ভূতের কাণ্ডকারানা!
বিনয়বাবু করুণ স্বরে বললে, আমার মৃণু কি আর বেঁচে আছে?
বিমল তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরে বললে, চুপ!
তখন পাহাড়ের বুকের ভিতরে সন্ধ্যা নেমে আসছে,–দূরের দৃশ্য ঝাপসা হয়ে গেছে। পাখিরা যে যার বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, চারিদিক স্তব্ধ।
সেই স্তব্ধতার মধ্যে অজানা শব্দ হচ্ছেধুপ ধুপ ধুপ ধুপ। কারা যেন খুব ভারী পা ফেলে এগিয়ে আসছে।
বাঘা কান খাড়া করে সব শুনে রেগে ধমক দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু কুমারের এক থাবড়া খেয়ে একেবারে চুপ মেরে গেল!
বিমল ব্যস্ত হয়ে বললে, শিগগির, লুকিয়ে পড়ুন–কিন্তু এখানে নয়, অন্য কোথাও।
বিমলেরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে ছুটতে সবাই জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। আরও একটু এগিয়েই দেখা গেল, ছোট গুহার মতন একটা অন্ধকার গর্ত, হামাগুড়ি না দিলে তার মধ্যে ঢোকা যায় না এবং তার মধ্যে অন্য কোনও হিংস্র জানোয়ার থাকাও অসম্ভব নয়। কিন্তু উপস্থিত বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে সে সব কথা কেউ মনেও আনলে না, কোনও রকমে গুঁড়ি মেরে একে একে সকলেই সেই গর্তের ভিতরে ঢুকে পড়ল।