অদৃশ্য মানুষ (উপন্যাস)

প্রথম। অপরিচিত আগন্তুকের আগমন

একটি ছোটখাটো শহর। তার আসল নামটি বলব না। ধরে নাও তার নাম হচ্ছে শ্রীপুর। ছুটির সময়ে নানান দেশ থেকে সেখানে অনেক লোক বেড়াতে আসে। কারণ জায়গাটির জল হাওয়া নাকি ভালো।

পাহাড়ে-শহর। পথে-ঘাটে বেরুলেই আশেপাশে ছোট-বড় পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়ে শহরে তখন পাহাড়ে-শীত। মাঝে মাঝে বরফও পড়ে।

বৈকাল। শ্রীপুর শহরে যখন রেলগাড়ি এসে থামল, চারিদিকে তখন কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। সে হাওয়া গায়ে যেন ছুরির ফলার মতন বিধে যায়। বোধ হয় বরফ পড়তে আর দেরি নেই।

একজন যাত্রী ইস্টিশানে এসে নামল। যাত্রীটি জাতে বাঙালি, সেটা তার পরনের কাপড় দেখলেই বোঝা যায়। তার পায়ে ঘোড়তোলা জুতো ও ফুল-মোজা। গায়ের জামা দেখবার জো নেই, কারণ একখানি আলোয়ানে সে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। কেবল তার ডান হাতের খানিকটা দেখা যাচ্ছিল, সেই হাতে ঝুলছিল একটা পোর্টম্যান্টো। তার হাতও ছিল দস্তানা-পরা। আলোয়ানের উপর জেগে আছে তার অদ্ভুত মুখখানা–সে-মুখের সবটাই ব্যান্ডেজে একেবারে ঢাকা। সাদা ব্যান্ডেজের ভিতর থেকে জেগে আছে কেবল তার গোঁফদাড়ি আর নাকের ডগাটা। তুলি-চশমা, অর্থাৎ গ দিয়ে সে তার চোখ দুটো পর্যন্ত সকলকার চোখের আড়াল করে রেখেছে। এই রহস্যময় লোকটি যে কে তা আমরা জানি না। এবং যতদিন না তার নাম জানতে পারি ততদিন। পর্যন্ত তাকে আমরা যাত্রী বলেই ডাকব।

শীতে কাঁপতে কাঁপতে ইস্টিশানের বাইরে এসে যাত্রী একটা পথ ধরে এগিয়ে চলল। খানিক দূর অগ্রসর হয়েই একখানা দোতলা বাড়ির সামনে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাড়িখানার দোতলার বারান্দায় একখানা সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে–শ্রীপুর স্বাস্থ্যনিবাস। অল্পক্ষণ সেইখানে দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলে।

এই স্বাস্থ্যনিবাসটির একটুখানি পরিচয় দরকার। শ্রীপুরে যারা বেড়াতে আসে তাদের অনেকেই এই স্বাস্থ্যনিবাসে আশ্রয় গ্রহণ করে। এর মালিক হচ্ছেন মিস্টার দাস ও মিসেস দাস। তারা বাঙালি খ্রিস্টান। স্বাস্থ্যের খোঁজে যাঁরা এখানে এসে ওঠেন তারা দুজনেই তাদের যত্ন, সেবা ও আদর-আপ্যায়নের ভার নেন–অবশ্য কয়েকটি রূপোর টাকার বিনিময়ে। তারাও এই বাড়ির অন্য এক মহলে বাস করেন।

বাড়ির ভিতরে ঢুকেই একটি বড় হলঘর। সেটি হচ্ছে এখানকার সাধারণ বৈঠকখানা। মিস্টার ও মিসেস দাস প্রত্যহ এইখানে বসেই তাদের অতিথিদের সঙ্গে গল্পগুজব ও আলাপ পরিচয় করেন।

আমাদের যাত্রীটি এই ঘরে ঢুকেই গম্ভীর স্বরে বললেন, আমার একখানা ভালো ঘর চাই!

মিসেস দাস তখন তার কয়েকজন অতিথির সঙ্গে একমনে গল্প করছিলেন। যাত্রীর আকস্মিক প্রবেশে ও গম্ভীর কণ্ঠস্বরে ঘরের সকলেই চমকে উঠল। যাত্রী তার দস্তানা-পরা হাত দিয়ে একখানা একশো টাকার নোট বার করে আবার গম্ভীর স্বরে বললে, এই নিন আগাম টাকা! আমার একখানা ভালো ঘর চাই।

না চাইতেই আগাম একশো টাকা! বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধায় মিসেস দাসের প্রাণটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠল! কপাল না খুললে এমন অতিথি মেলে না!

মিসেস দাস তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন, আসুন আমার সঙ্গে! আপনাকে বাড়ির সেরা ঘরই ছেড়ে দেব!

মিসেস দাস যাত্রীকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

বাড়ির দোতলায় রাস্তার ধারের বড় ঘরখানিই যাত্রীর জন্যে ছেড়ে দেওয়া হল। যাত্রী সেই ঘরের ভিতরে ঢুকে পোর্ট ম্যান্টোটি একটি টেবিলের উপরে রেখে দিলেন।

মিসেস দাস তার নতুন অতিথিটির সঙ্গে ভালো করে আলাপ জমাবার চেষ্টায় বললেন, আপনি বুঝি বৈকালের ট্রেনে এখানে এসেছেন?

যাত্রী জবাব না দিয়ে মিসেস দাসের দিকে পিছন ফিরে রাস্তার দিকে জানালার গরাদ ধরে দাঁড়াল। তারপর মুখ না ফিরিয়েই বললে, আমার খিদে পেয়েছে। এখুনি কিছু খাবার পাঠিয়ে দিন।

আলাপটি ভালো করে জমল না বলে কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হয়ে মিসেস দাস অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মিনিট পনেরো পরে চাকরের সঙ্গে মিসেস দাস আবার ভিতরে এসে ঢুকলেন। যাত্রীকে শুনিয়ে চাকরকে ডেকে বললেন, ভিখ, টেবিলের উপরে খাবারের থালা রাখ!

যাত্রী ঠিক আগেকার মতোই পাথরের মূর্তির মতন জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়েছিল। এবং এবারেও মুখ না ফিরিয়েই বললে, আচ্ছা, আপনি এখন যেতে পারেন!

মিসেস দাস নিজের মনে-মনেই বললেন, লোকটার টাকা আছে, কিন্তু ভদ্রতা-জ্ঞান মোটেই নেই! প্রকাশ্যে বললেন, আপনি চা খান কি?

যাত্রী বললে, মিনিট পনেরো পরে পাঠিয়ে দেবেন।

মিসেস দাস ঘরের ভিতরে আর দাঁড়ালেন না।

মিনিট পনেরো পরে ভিখুর সঙ্গে মিসেস দাস আবার ঘরের ভিতর ঢুকে দেখলেন, যাত্রী জানলাগুলো বন্ধ করে আধা-অন্ধকারে কোণের দিকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে গিয়ে বসে আছে। টেবিলের দিকে চেয়ে দেখলেন, তার জলখাবার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বললেন, আপনার চা নিয়ে এসেছি।

যাত্রী বললে, চা রেখে যান।

ভিখু চায়ের সরঞ্জাম রেখে টেবিল থেকে জলখাবারের থালাগুলো সরাতে লাগল; মিসেস দাস সেই ফাঁকে যাত্রীকে আর-একটু ভালো করে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভালো করে কিছুই আন্দাজ করতে পারলেন না। যাত্রী তখনও তার মুখের ব্যান্ডেজ তো খোলেইনি, উপরন্তু গায়ের আলোয়ান, হাতের দস্তানা ও পায়ের জুতো-মোজা পর্যন্ত ঠিক সেই ভাবেই পরে আছে। কেবল নিজের ঠোঁটের কাছ থেকে ব্যান্ডেজটি একটুখানি টেনে নামিয়ে রেখেছে–বোধহয় খাবার সুবিধার জন্যে। কিন্তু তার নাকের তলার দিকে চেয়ে মিসেস দাস ঠোঁটের কোনও চিহ্নই দেখতে পেলেন না! তিনি ভাবলেন, আধা-অন্ধকারে বোধ হয় তার চোখের ভ্রম হচ্ছে। তবু তার মনটা কেমন এক অস্বাভাবিক ভয়ে ছাঁৎ-ছাঁৎ করতে লাগল। এ কীরকম রহস্যময় লোক। এ যেন মানুষের চোখের সামনে আসতে চায় না–সর্বদাই নিজেকে সাবধানে লুকিয়ে রাখতে চায়। পৃথিবীর আলো-হাওয়াকে এ যেন পরম শত্রু বলে মনে করে! কে এ! ওর সারা মুখখানায় ও কীসের ব্যান্ডেজ? কোনও দৈবদুর্ঘটনায় ওর মুখখানা কি ভীষণ ভাবে জখম হয়েছে? না, কোনও সাংঘাতিক অস্ত্র-চিকিৎসায় ওর মুখের অবস্থা অমনধারা হয়েছে?

মিসেস দাস মনে মনে এমনই সব কথা নিয়ে ভোলা-পাড়া করছেন, এমন সময় যাত্রী হঠাৎ বললে, ইস্টিশানে আমার কতকগুলো লগেজ পড়ে আছে। সেগুলো আবার কি উপায় করা যায় বলুন দেখি?

যাত্রীর গলার আওয়াজ আর তেমন কর্কশ নয়। মিসেস দাস ভাবলেন, তার স্বাস্থ্যনিবাসের সুখাদ্য খেয়ে তার মেজাজ নরম হয়ে গিয়েছে! যাহোক, কথা-কইতে-নারাজ যাত্রীর সঙ্গে কথা কইবার সুযোগ পেয়ে মিসেস দাস খুব খুশি হয়ে, বললেন, সেজন্যে আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব অখন।

যাত্রী বললে, আজকেই সে ব্যবস্থা হতে পারে কি?

মিসেস দাস মাথা নেড়ে বললেন, আজ আর হয় না। মিস্টার দাস তার এক বন্ধুকে দেখতে গেছেন, কখন ফিরবেন বলা যায় না। বুঝলেন মশাই? তাঁর বন্ধুটি ট্রেন থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে বসে আছেন!–এই বলে যাত্রীর ব্যান্ডেজ-করা মুখের দিকে একবার কৌতূহলী। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার শুরু করলেন, আজকাল পথে-ঘাটে দৈব দুর্ঘটনা বড় বেশি বেড়ে গেছে, না মশাই?

মিসেস দাসের ইচ্ছা যে, যাত্রী নিজের মুখেই প্রকাশ করে তার মুখে ও মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা কেন? কিন্তু যাত্রী সে ধারও মাড়ালে না, হঠাৎ গলার আওয়াজ বদলে বলে উঠল, আচ্ছা, আমার লগেজ কাল এলেই চলবে। এখন আমি একটু একা থাকতে চাই।

আমার সঙ্গে গল্প করতে রাজি নয়, এ কীরকম অসভ্য লোক?

সবিস্ময়ে এই কথা ভাবতে ভাবতে অত্যন্ত অভিমান-ভরে মিসেস দাস সে-ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মিসেস দাস একেবারে নীচের বৈঠকখানায় গিয়ে ধপাস করে একখানা চেয়ারের উপরে বসে পড়লেন। ঠিক বৈঠকখানার উপরেই ছিল যাত্রীর ঘর। সে যে নিজের মনে ঘরের ভিতরে পায়চারি করছে, তারই আওয়াজ মিসেস দাসের কানের ভিতর এসে ঢুকল।

.

দ্বিতীয়। রতনবাবুর সন্দেহ

খানিক পরে মিস্টার দাসের এক বন্ধু সেই বৈঠকখানার এসে হাজির হলেন। তার নাম রামরতন–কিন্তু সবাই তাকে ডাকে রতনবাবু বলে। তিনি মাঝে মাঝে এখানে তার বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সঙ্গে গল্প করতে আসেন এবং সেই সময়ে দু-একখানা টোস্ট ও এক পেয়ালা চা পেলেই খুব খুশি হয়ে সদ্ব্যবহার করে যান। স্বামীর বন্ধুদের জন্যে এরকম বাজে-খরচ হওয়া মিসেস দাস মোটেই পছন্দ করেন না। বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যনিবাস ব্যবসার জায়গা দাঁতব্য ভোজনালয় নয়, তুমি তোমার বন্ধুদের সাবধান করে দিও। মিস্টার দাস তার স্ত্রীর এই হুকুম পালন করেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু রতনবাবুর স্বাস্থ্যনিবাসে আনাগোনা বন্ধ হয়নি এবং এখানকার টোস্ট ও চায়ের প্রতি তার কিছুমাত্র অরুচিও দেখা যায়নি।

রতনবাবুর একটি ঘড়ির দোকান ছিল। আজ তাঁকে দেখেই মিসেস দাসের সেই কথা মনে পড়ে গেল। যাত্রী যে-ঘরে আছে সেই ঘরের একটা বড় ঘড়ি আজ দুদিন বন্ধ হয়ে গেছে, কিছুতেই চলছে না। মিসেস দাস স্থির করলেন, রতনবাবুকে অনেক চা ও টোস্ট জোগান হয়েছে, তার বিনিময়ে তাকে দিয়ে বিনামুল্যে ঘড়িটাকে আজ আবার সচল করে নিতে পারলে বোকামি করা হবে না।

অতএব মিসেস দাস সহাস্যমুখে রতনবাবুকে অভ্যর্থনা করে বললেন, আসুন, আসুন! আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম!

মিসেস দাস তাঁকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করবেন ও তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন, রতনবাবুর এমন সৌভাগ্য আর কখনও হয়নি। কাজেই তিনি একেবারে আহ্বাদে-আটখানা হয়ে বললেন, বলেন কি মিসেস দাস! আমায় কি করতে হবে আজ্ঞা করুন।

মিসেস দাস কোনওরকম গৌরচন্দ্রিকা না করেই বললেন, ওপরের ঘরের একটা ঘড়ি খারাপ হয়ে গেছে, আপনি সেটা সারিয়ে দিতে পারবেন?

রতনবাবু মিসেস দাসের সাদর অভ্যর্থনা ও মিষ্ট হাসির অর্থ বুঝতে পারলেন। কিন্তু মুখের ভাবে কিছু প্রকাশ না করেই বললেন, বেশ তো, এ আর এমন শক্ত কি? ঘড়িটা কোথায় আছে?

ওপরের ঘরে। আসুন আমার সঙ্গে। এই বলে মিসেস দাস চেয়ার ছেড়ে উঠে রতনবাবুকে নিয়ে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মিসেস দাস উপরে উঠে দেখলেন, যাত্রীর ঘরের দরজা বন্ধ। বাইরে থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, ঘরের ঘড়িটা মেরামত করতে হবে। একবার ভেতরে যেতে পারি কি!

ভিতর থেকে আওয়াজ এল–আসুন।

রতনবাবুকে নিয়ে মিসেস দাস ঘরের ভিতরে ঢুকলেন।

ঘরের কোণের চেয়ারে দুই হাতের ভিতরে মাথা রেখে যাত্রী হেঁটমুখে বসেছিল। সন্ধ্যা তখন আসন্ন। মিসেস দাস আলো জ্বালবার চেষ্টা করতেই যাত্রী বলে উঠল, থাক। এখনি আলো জ্বালতে হবে না।..হ্যাঁ, ভালো কথা! আমার লগেজগুলো কাল সকালে পাব কি?

মিসেস দাস বললেন, হ্যাঁ, তা বোধহয় পাবেন। আপনার লগেজগুলো কীসের?

তার ভেতরে রাসায়নিক যন্ত্র আর অনেক রকম ওষুধের শিশি-বোতল আছে। শ্রীপুর নির্জন বলেই আমি এখানে এসেছি। নির্জনে আমি রাসায়নিক পরীক্ষা করতে চাই। কোনওরকম গোলমালই আমি সহ্য করব না।

মিসেস দাসের কৌতূহল আবার জেগে উঠল। তিনি তাড়াতাড়ি বলে ফেললেন, আপনি কি ডাক্তারি করেন?

যাত্রী সে কথার জবাব না দিয়ে আপন মনেই বললে আমি নির্জনে থাকতে ভালোবাসি। আমার চোখ এত খারাপ যে মোটেই আলো সইতে পারি না। সময়ে সময়ে আমাকে ঘরের দরজা-জানলা সব বন্ধ করে রাখতে হয়। অনেক সময় আমি আবার অন্ধকারেই থাকি। এ কথাগুলি দয়া করে মনে রাখবেন।

মিসেস দাস বললেন,  নিশ্চয়, নিশ্চয়! আচ্ছা, আমার একটা কথার জবাব দেবেন কি–

যাত্রী বাধা দিলে বললে, এখন আপনারা এ-ঘরে যা করতে এসেছেন, করুন বলেই সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে।

মিসেস দাস আর সেখানে দাঁড়ালেন না রাগে গগস করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

রতনবাবু একখানা টুলের উপর উঠে দাঁড়িয়ে, দেয়াল-ঘড়ির ডালা খুলে তার ভিতরটা পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ একবার মুখ তুলে দেখলেন, যাত্রী তার নীল-রঙা ঠুলি-চশমার ভিতর দিয়ে একদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটো দেখা যাচ্ছিল না বটে, কিন্তু রতনবাবুর মনে হল যেন দু-দুটো অন্ধকারের গর্ত কটমট করে তাকে নিরীক্ষণ করছে! তার বুকটা ছাঁৎ করে উঠল! সে ভাবটা সামলে নেওয়ার জন্যে রতনবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, দেখছেন মশাই, আজকে আকাশের অবস্থাটা মোটেই ভালো নয়!

যাত্রীর মূর্তি একটুও নড়ল না। কিন্তু সে কর্কশ স্বরে বলে উঠল, একটা ঘড়ি ঠিক করতে কতক্ষণ লাগে? তাড়াতাড়ি কাজ সেরে সরে পড়ন না!

রতনবাবু অপ্রস্তুত স্বরে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, আজ্ঞে হ্যাঁ! এই, আর এক মিনিটেই হয়ে যাবে! তারপর মুখ বুজে চটপট মেরামতি কাজ সেরে তিনি সে-ঘর থেকে অপরাধীর মতো সুড় সুড় করে বেরিয়ে গেলেন।

স্বাস্থ্যনিবাস থেকে বাইরে বেরিয়ে রতনবাবু নিজের বাসার দিকে অগ্রসর হলেন। খানিক পরেই মিস্টার দাসের সঙ্গে দেখা।

তাকে দেখেই মিস্টার দাস বলে উঠলেন, আরে, আরে, রতন যে! খবর কি?

রতনবাবু মুখ ভার করে বললেন, দাস, খবর বড় ভালো নয়!

কেন?

তোমার বাড়িতে একটা খুনে কি ডাকাত এসে আড্ডা জমিয়েছে!

মিস্টার দাস চমকে উঠে বললেন, কি বলচ হে?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ফেরার আসামি! দেখছি স্বাস্থ্যনিবাস এবার পুলিশের জিম্মায় যাবে।

মিস্টার দাস বললেন, বটে, বটে, তাই নাকি? আচ্ছা, এখনি গিয়ে আমি সব ব্যবস্থা করছি। এই বলেই দ্রুতপদে বাড়িমুখো হলেন।

কিন্তু স্বাস্থ্যনিবাসে ফিরে তিনি একটি টু শব্দ করবার আগেই মিসেস দাসই তাকে সচিৎকারে আক্রমণ করলেন। বললেন, তোমার মতন মানুষের হাতে পড়ে হাড় আমার ভাজা ভাজা হয়ে গেল! আমি মরছি নিজের জ্বালায়, আর উনি বেড়াচ্ছেন ফুর্তি করে। বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিলে বলো দিকি?

মিস্টার দাস আমতা আমতা করে বললেন, একেবারে রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করে আমাকে আর ভয় দেখিও না গো! আমি তো তোমার কাজেই বাইরে গিয়েছিলুম!

মিসেস দাস একটু নরম হয়ে বললেন, এখানে একজন নতুন লোক এসেছে, আর তুমি রইলে বাইরে। ফরমাজ কে খাটে বলো দিকি?

মিস্টার দাস বললেন, নতুন লোক? কে নতুন লোক? শুনলুম তাকে নাকি চোর-ডাকাত খুনের মতন দেখতে?

মিসেস দাস তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, সে তো আমাদের জামাই নয়! সে ভালো কি মন্দ দেখতে, তা নিয়ে আমাদের দরকার কি?

মিস্টার দাস বললেন, না, তা নিয়ে আমাদের দরকার নেই বটে, কিন্তু তাকে পুলিশের দরকার হতে পারে।

মিসেস দাস রাশভারী চালে বললেন, থামো, থামো! তোমাকে আর বেশি বাজে বকতে হবে না, নিজের চরকায় তেল দাওগে যাও!

মিস্টার দাসের আর কিছু বলবার সাহস হল না। তিনি মনে মনে এই ভাবতে ভাবতে অন্যদিকে চলে গেলেন, মেয়েরা চিরকালই এমন বোকা হয়! বিপদে না পড়লে তারা বিপদকে বিপদ বলে বুঝতেই পারে না!

.

তৃতীয় । পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ওঁচা জীব

পরের দিন সকালবেলায় যাত্রীর লগেজগুলো এসে হাজির হল।

গাড়ি থেকে লগেজগুলো যখন নীচে নামানো হচ্ছিল, যাত্রীও তখন সেখানে এসে ব্যস্ত হয়ে তদ্বির করতে লাগল। লগেজের মধ্যে ছিল গোটা-দুয়েক বড় বড় পোর্টম্যান্টো, দু-বাক্স ভর্তি মোটা মোটা বই, আর অনেকগুলো শিশি-বোতল–তাদের ভিতরে টলটল করছে নানান রঙের ওষুধের মতন তরল জিনিস।

মিস্টার দাসের একটা কুকুর ছিল, তার নাম হচ্ছে ডগি। যাত্রী তাকে দেখতে পায়নি, কিন্তু সে যাত্রীকে দেখতে পেলে। দেখে সে আর বেশি কিছু করলে না, দৌড়ে এসে কেবল যাত্রীর পায়ের উপরে দিলে দাঁত খিঁচিয়ে এক কামড়! মিস্টার দাস তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ডগিকে এক লাথি মেরে নিজের বীরত্বের পরিচয় দিলেন। ডগি কেঁউ কেঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে সরে পড়ল। যাত্রীর কাপড়ের খানিকটা ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গিয়েছিল, সেও তাড়াতাড়ি বাড়ির উপরে উঠে গেল।

মিসেস দাস বললেন, যেমন মনিব তার তেমনি কুকুর! তোমার কুকুর যদি অতিথিদের সঙ্গে এইরকম ব্যবহার করে তাহলে শিগগিরিই আমাদের স্বাস্থ্যনিবাস তুলে দিতে হবে!

মিস্টার দাস বললেন, সত্যি, ডগির অপরাধ আমি স্বীকার করছি! ভদ্রলোকের কি হল আমি এখুনি গিয়ে দেখে আসছি।

তিনি সিধে উপরে গিয়ে উঠলেন। যাত্রীর ঘরের দরজা খোলাই ছিল, চৌকাঠ পার হয়ে তিনি ঘরের ভিতর গিয়ে দাঁড়ালেন।

ঘরের জানলাগুলো আগেকার মতোই বন্ধ ছিল। ভিতরের আধা-অন্ধকারে স্পষ্ট করে কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু মিস্টার দাস যেন কি একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেলেন। যেন ছায়া ছায়া কি একটা নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে, যেন একখানা বাহুহীন হস্ত শূন্যে ভাসতে ভাসতে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তারপর কী যে হল স্পষ্ট বোঝা গেল না, কিন্তু কে যেন এক ধাক্কা মেরে তাঁকে ঘরের বাইরে তাড়িয়ে দিলে! সঙ্গে সঙ্গে দুম করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল ও খিল দেওয়ার শব্দ হল! ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে মিস্টার দাস কিছুই আন্দাজ করতে পারলেন না। ছায়াময় ঘর, অস্পষ্ট একটা আকারের আভাস ও বিষম৷ এক ধাক্কা! অত্যন্ত অবাক হয়ে মিস্টার দাস ভাবতে লাগলেন, তিনি স্বচক্ষে যা দেখলেন সেটা হচ্ছে কী?

হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ সেইখানে দাঁড়িয়ে থেকে, মিস্টার দাস চিন্তিত মুখে নীচে নেমে বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকলেন। সেখানে তখন স্বাস্থ্যনিবাসের ভাড়াটে বাসিন্দাদের জটলা শুরু হয়ে গেছে। এবং মিসেস দাস সকলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত-মুখ নেড়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন–পৃথিবীতে যতরকমের জীব আছে তার মধ্যে সবচেয়ে উঁচা জীব হচ্ছে, কুকুর। আর পৃথিবীতে যতরকমের কুকুর আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উঁচা কুকুর হচ্ছে, ডগি। স্বাস্থ্যনিবাসের অতিথিদের ওপরে ডগির কোনওই দরদ নেই। ভদ্রলোককে সে আজ কামড়ে দিয়েছে! না জানি এখন তার কতই কষ্ট হচ্ছে!

মিস্টার দাস বললেন, তোমার অতিথির জন্যে তোমাকে কিছুই ভাবতে হবে না! বোধ। হয় তাঁর বিশেষ কিছুই হয়নি। তার চেয়ে লগেজগুলো ঘরের ভেতরে আনাবার ব্যবস্থা করো।

পিছন থেকে গলার আওয়াজ এল, না, না–আমার কিছুই হয়নি! লগেজগুলো তাড়াতাড়ি আমার ঘরে পাঠাবার বন্দোবস্ত করুন।

সকলে ফিরে দেখলে জামা কাপড় বদলে যাত্রী আবার নীচে নেমে এসেছে। লগেজগুলো যেই ঘরের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হল অমনি যাত্রীর আর তর সইল না। তখনি ব্যস্তভাবে সে পোর্টম্যান্টো ও বাক্সগুলো খুলে ফেললে। তাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল মোটা বোতল, বেঁটে বোতল, ঢ্যাঙা বোতল; কোনওটার রং নীল, কোনওটার লাল, কোনওটার বা সবুজ; অনেকগুলোর গায়ে বড় বড় হরফে বিষ বলে লেখা রয়েছে। পাতলা পুরু লম্বা ছোট কত রকমের বই! টেবিলের উপরে ওইসব শিশি-বোতল সাজিয়ে নিয়ে, সামনের চেয়ারে বসে যাত্রী এক মনে কি কাজ করতে লাগল।

দুপুরবেলায় মিসেস দাস যখন উপরে এলেন, তখন ঘরের চেহারা দেখেই তার চক্ষু স্থির! প্যাকিংয়ের চটে, খড়ের টুকরোয় ও দড়িদড়ায় তার ঘরের মেঝে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। তিনি তখনি সেই জঞ্জালগুলোকে নিজের হাতে ঘরের ভিতর থেকে বিদায় করে দিতে লাগলেন। যাত্রী তখন এমন এক মনে কাজ করছিল যে মিসেস দাসের অস্তিত্ব টেরই পেলে না!

মিসেস দাস ঘর পরিষ্কার করে বললেন, আপনি চারদিক এমন নোংরা করে রাখবেন না। তাহলে স্বাস্থ্যনিবাসের বদনাম হবে।

যাত্রী চমকে ফিরে তাকালে। তখন সে চোখ থেকে চশমা খুলে রেখেছিল। মিসেস দাসের মনে হল তার চোখের কোটরে যেন চোখদুটো নেই, খালি দুটো গর্ত! মিসেস দাস ভাবলেন তারই দেখবার ভুল। যাত্রী তখনি চশমাখানা আবার পরে নিলে।

তারপর বললে, আপনি সাড়া না দিয়ে ঘরের ভেতরে এলেন কেন?

মিসেস দাস বললেন, আমি সাড়া দিয়েছিলুম, আপনি শুনতে পাননি–

যাত্রী বাধা দিয়ে বললে, হতে পারে কিন্তু সামান্য একটু শব্দেই আমার কাজের বড় ক্ষতি হয়।

মিসেস দাস বললেন, তাহলে আপনি তো এক কাজ করতে পারেন! এবার থেকে আপনি যখন কাজ করবেন, ঘরের দরজায় ভেতর থেকে খিল দিয়ে রাখবেন।

এ খুব সঙ্গত কথা।

কিন্তু মশাই, এই খড়গুলো–

যাত্রী আবার বাধা দিয়ে বললে, ঘরের ভেতরে খড়কুটো পড়লে তা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। যদি কিছু লোকসান হয় আপনি আমার কাছ থেকে টাকা আদায় করে নেবেন।

মিসেস দাস কেবল বুদ্ধিমান স্ত্রীলোক নন, তাঁকে নাছোড়বান্দাও বলা যেতে পারে। তিনি বললেন, কিন্তু আজ এই যে আপনি আমার ঘর-দোর নোংরা করেছেন–

যাত্রী বললে, তার জন্যে আমার পাঁচ টাকা জরিমানা হল। ব্যস, এখন আর কোনও কথা নয়।

মিসেস দাস খুব খুশিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাত্রীর কর্কশ কথা ও ব্যবহারের জন্যে এখন আর তার মনের উপরে কোনও দাগই পড়ল না, কারণ এমন পাঁচ টাকা জরিমানা পেলে মনের সব ময়লাই ধুয়ে যায়!

এরই খানিকক্ষণ পরে মিসেস দাস যখন আবার যাত্রীর ঘরের সুমুখ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন বন্ধ দ্বারের ওপার থেকে হঠাৎ একটা ঝনঝনানির আওয়াজ তাঁর কানে গিয়ে ঢুকল। কে যেন শিশি বোতল সাজানো টেবিলের উপরে সজোরে এক ঘুসি বসিয়ে দিলে! তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং তারপরেই যাত্রীর গলার আওয়াজে শুনলেন–আমি আর পারছি না, আমি আর পারছি না!–এর জন্যে আমার সারা জীবনই কেটে যাবে! অস্থির হব না?

অস্থির না হয়ে আর উপায় কি? হারে নির্বোধ!

.

চতুর্থ । হাত নেই–হাতা

শ্রীপুরের স্বাস্থ্যনিবাসে যাত্রীর দিন একভাবেই কাটতে লাগল।

শ্রীপুরের ঘরে-ঘরে কিন্তু গুজবের অন্ত নেই। যাত্রীর সেই আপাদমস্তক ঢাকা ব্যান্ডেজ করা কিম্ভুতকিমাকার মূর্তি দেখলেই শ্রীপুরের পথ থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভূত! ভূত! বলে চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে যায়! পথের উপরে রাত্রিকালে যাত্রীর মূর্তি দেখলে ছেলেমেয়েদের বাপেদের গা ছমছম করে ওঠে! যাত্রী কারুর সঙ্গে মেশে না, তার পরিচয়ও কেউ জানে না, এত ঠাঁই থাকতে কেন যে সে শ্রীপুরে এসে আবির্ভূত হয়েছে, সে রহস্যও কেউ বুঝতে পারে না! শ্রীপুরের পাড়ায় পাড়ায় যাত্রীর কথা নিয়ে উত্তেজনার অন্ত নেই!

রতনবাবুর আগেকার মত তো আমরা আগেই জানতে পেরেছি। আগে তিনি যাত্রীকে খুনি ও ডাকাত বলেই প্রচার করতেন। এখন তাঁর মতে, যাত্রী হচ্ছে সর্বনেশে স্বদেশি বোমাওয়ালা!

যাত্রী সারাদিন বন্ধ দরজার আড়ালে বসে তার শিশি বোতল আর বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে, মাঝে মাঝে ঘরের ভিতরে পায়চারি করতে করতে নিজের মনেই নিজের সঙ্গে কথাবার্তা কয় এবং যখন সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে আসে, তখন আগাপাশতলা জামাকাপড়ে মুড়ে শ্রীপুরের নির্জন পথে একটি বেড়াতে বেরোয়!

কেউ কেউ মিসেস দাসকে জিজ্ঞাসা করে, যাত্রীর নাম কী?

মিসেস দাস জবাব দেন, তিনি নাম আমাকে বলেছিলেন কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছি। কিন্তু কথাটা সত্য নয়। নিজের মুখ ও যাত্রীর সুনাম রক্ষা করবার জন্যেই মিসেস দাস ওরকম বাজে কথা বলতে বাধ্য হন। যাত্রীর ব্যবহার খুব ভদ্র ও গলার আওয়াজ খুব মিষ্ট না হলেও স্বাস্থ্যনিবাসের বিলের টাকা কোনওদিনই সে বাকি রাখেনি এবং মিসেস দাসকে মাঝেমাঝে জরিমানার টাকা দিতেও কোনওদিন সে আপত্তি করেনি। মিসেস দাসের মতে এমন প্রথম শ্রেণির অতিথি জীবনে একবার মাত্রই পাওয়া যায়।

মিস্টার দাস একথা মানতেন না। যাত্রীকে তার মনে ধরেনি। রতনবাবুর মতন তিনিও যাত্রীকে মনে মনে সন্দেহ করতেন।

কিন্তু মিসেস দাসের সামনে এ সন্দেহ প্রকাশ করলেই ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে উঠত। তিনি ঘন ঘন হাত-মুখ নেড়ে বলতেন, আহা, কোনও দৈব-দুর্ঘটনায় বেচারির মুখে চোট লেগেছে তাই সে ব্যান্ডেজ বেঁধে থাকে! স্বাস্থ্যনিবাসে সে সারতে এসেছে। চোর-ডাকাত হলে সে কখনও বিলের টাকা এমন করে শোধ করত?

শান্তিভঙ্গের ভয়ে মিস্টার দাস আর কিছুই বলতেন না।

শ্রীপুরে এক সরকারি ডাক্তার ছিলেন, তাঁর নাম মানিকবাবু। নানান লোকের মুখে নানান কথা শুনে একটা বাজে ওজর নিয়ে মানিকবাবু একদিন যাত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

মানিকবাবু ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখলেন, ইজিচেয়ারের উপরে একখানা বই নিয়ে ব্যান্ডেজ করা মুখে এক ব্যক্তি শুয়ে আছে।

তাঁকে দেখেই লোকটা উঠে বসে গম্ভীর স্বরে বললে, এখানে আপনার কি দরকার?

মানিকবাবু বললেন, মশাই, আমি সরকারি হাসপাতালের জন্যে চাঁদা আদায় করতে এসেছি।

যাত্রী ফ্যাঁচ করে হেঁচে ফেলে বললে, বটে!

মানিকবাবু শুধোলেন, কিছু দেবেন কি?

যাত্রী আবার হেঁচে বললে, সে কথা পরে ভাবা যাবে। তারপর আবার হাঁচলে।

মানিকবাবু বললেন, অত হাঁচছেন কেন? সর্দি হয়েছে নাকি?

যাত্রী বললে, হ্যাঁ।

মানিকবাবু বললেন, আমি ডাক্তার। সর্দির একটা ওষুধ লিখে দেব?

যাত্রী আবার নিজের কেতাবের দিকে তাকিয়ে বললে, সেটা আপনার ইচ্ছে!

মানিকবাবু নিজের পকেট থেকে একটু টুকরো কাগজ আর পেনসিল বার করে কি একটা ওষুধের নাম লিখলেন। তারপর সেই কাগজের টুকরোটা যাত্রীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই নিন।

আলোয়ানের ভিতর থেকে জামার একটা হাত বেরুল! কেবল জামার হাতা–মানুষের হাতের কোনওই চিহ্ন নেই! অথচ সেই হস্তহীন জামার হাতা ঠিক স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে এসে মানিকবাবুর হাত থেকে কাগজের টুকরোটা গ্রহণ করলে! ভয়ঙ্কর বিস্ময়ে তার দুই চক্ষু ছানাবড়ার মতন হয়ে উঠল। এবং মানিকবাবুর মুখ-চোখের ভাব দেখেই যাত্রী জামার হাতটা সাঁৎ করে আবার আলোয়ানের ভিতরে ঢুকিয়ে ফেললে।

সেই কনকনে শীতেও মানিকবাবুর কপালে ঘামের ফোঁটা ফুটে উঠল। অস্ফুট স্বরে তিনি বললেন, আপনার কি হাত কাটা গেছে? কিন্তু কাটা হাতে আপনি আমার হাত থেকে কাগজের টুকরোটা নিলেন কেমন করে?

তাই নাকি? বলেই যাত্রী সিধে হয়ে উঠে দাঁড়াল।

মানিকবাবু দু-পা পিছিয়ে এসে বললেন, হ্যাঁ। আপনার হাত নেই, খালি জামার হাতা আছে!

যাত্রী দু-পা এগিয়ে এসে ব্যঙ্গের স্বরে বললে, আমার হাত নেই খালি জামার হাতা আছে! বটে? আলোয়ানের ভিতর থেকে আবার হস্তহীন জামার হাতা বেরুল হাতাটা একেবারে মানিকবাবুর মুখের সামনে এসে হাজির হল–তারপর কে যেন দুটো অদৃশ্য আঙুল দিয়ে তার নাকটা খুব জোরে মলে দিলে!

এর পরেও কোনও ভদ্রলোকেরই সে-ঘরে থাকা উচিত নয়। মানিকবাবু তিন লাফে দরজা পেরিয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে পড়লেন। তারপর দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলেন, ঘরের ভিতর থেকে যাত্রী অট্টহাস্য করে উঠল।

স্বাস্থ্যনিবাসের বৈঠকখানার বসে মিস্টার দাস তখন মিসেস দাসের সঙ্গে তর্ক করছিলেন। হঠাৎ মড়ার মতন সাদা মুখ নিয়ে মানিকবাবুকে সেখানে আসতে দেখে তিনি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কি হয়েছে মানিকবাবু, অত ছুটে আসছেন কেন? ডগি তাড়া করেছে বুঝি?

মানিকবাবু ছুটে গিয়ে একখানা চেয়ারের উপরে ধপাস করে বসে পড়ে বিষম হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, মিস্টার দাস! ওঃ, হাত নেই খালি জামার হাতা!

মিস্টার দাস সবিস্ময়ে বললেন, কি বলছেন ডাক্তারবাবু? হাত নেই জামার হাতা?

মানিকবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ! হাত নেই–জামার হাতা! ওপরের ঘরের সেই ভূতুড়ে লোকটার হাত নেই খালি জামার হাতা আছে। জামার হাতা দিয়ে সে আমার নাক মলে দিলে! বলেই তিনি দুই চোখ কপালে তুলে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

.

পঞ্চম । ডাক্তারের বাড়িতে চুরি

সরকারি হাসপাতালের এক অংশে সরকারি ডাক্তার মানিকবাবু স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাস করতেন।

হস্তহীন জামার হাতা দেখে মানিকবাবুর, শরীরটা আজ বেজায় কাহিল হয়ে পড়েছিল। মিস্টার ও মিসেস দাস ও নিজের স্ত্রী বিমলার কাছে বারবার তিনি এই গল্প বলেছেন কিন্তু তাঁর কথায় ওঁরা কেউই বিশ্বাস করতে রাজি হননি। তাঁদের সকলেরই মত হচ্ছে, জামার হাতাটা হয়তো বেশি লম্বা ছিল বলেই হাতখানা তিনি দেখতে পাননি। শেষটা মানিকবাবু নিজেও মনে করলেন, হয়তো সেই কথাই ঠিক হবে, তারই চোখের ভুল!

অনেক রাতে মানিকবাবুর ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই তিনি শুনলেন তাঁর স্ত্রীর বিমলা তাঁকে ধাক্কা মারতে মারতে বলছেন, ওগো ওঠো! শিগগির ওঠো!

মানিকবাবু ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বললেন, কিগো, কি হয়েছে?

চোর, চোর! বাড়িতে চোর এসেছে!

চোর নামে কি জাদু আছে! এক পলকে মানিকবাবুর সব জড়তা কেটে গেল, এক লাফে ঘরের কোণে গিয়ে একগাছা মোটা লাঠি তুলে নিয়ে, মাথার উপরে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি বললেন, কোথায় সেই বদমাইশ? দেখিয়ে দাও আমাকে!

স্বামীর বীরত্ব দেখে বিমলা আশ্বস্ত হলেন না, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আপাতত তোমার লাঠি ঘোরানো থামাও। চোর এ-ঘরে নেই।

মানিকবাবু স্ত্রীর কথামতো কাজ করে বললেন, তবে সে হতভাগা কোথায়?

বিমলা বললেন, পাশের ঘরে। চুপিচুপি আমার সঙ্গে এসো, নইলে তাকে ধরতে পারবে না।

দুজনে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই শুনলেন, অন্ধকারে ফ্যাচ করে কে হেঁচে ফেললে। তারপরেই সুইচ টিপে কে আলো জ্বাললে। তারপরেই শোনা গেল কে যেন দেরাজের দরজাটা টেনে খুলে ফেললে।

মানিকবাবু একেই তো চোর-টোর পছন্দ করতেন না, তার উপরে যখন তার মনে পড়ল, দেরাজের ভিতরে আজ সকালেই তিনি পঁয়ত্রিশখানা দশ টাকার নোট রেখে দিয়েছেন, তখন আর কিছুতেই তিনি শান্ত হয়ে থাকতে পারলেন না। কে রে, কে রে বলে বিকট স্বরে চাঁচাতে চাঁচাতে এবং লাঠি ঘোরাতে-ঘোরাতে মহাবেগে তিনি ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন!

বিমলাও ঘরে ঢুকে বললেন, ওগো থামো–থামো!

কিন্তু মানিকবাবু থামলেন না, দ্বিগুণ উৎসাহেই লাঠি ঘোরাতে লাগলেন।

বিমলা আবার বললেন, ওগো মহাবীর, আর লাঠি ঘুরিয়ে কাজ নেই! চোর পালিয়েছে!

লাঠি ঘোরানো থামিয়ে মানিকবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, পালিয়েছে। কোন দিক দিয়ে পালাল?

বিমলা বললেন, জানি না।

মানিকবাবু অবাক হয়ে চারিদিকে চেয়ে দেখলেন, সত্যই ঘরের মধ্যে কেউ নেই! এ ঘরের দরজা তো মোটে একটি, আর তার সামনে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন তারা দুজনে। তবে চোর পালাল কোনদিক দিয়ে?

মানিকবাবু বললেন, কিন্তু তখন ঘরের ভেতরে হাঁচলে কে?

বিমলা বললেন, আর ঘরের ভেতরে সুইচ টিপে আলো জ্বাললে কে?

মানিকবাবু বললেন, আর দেরাজটাই বা খুললে কে?

বিমলা দেরাজের কাছে গিয়ে উঁকি মেরে বললেন, আর তোমার দেরাজের ভেতর। থেকে সাড়ে তিনশো টাকাই বা গেল কোথায়?

এসব কথার উত্তর কেউ দিল না বটে, কিন্তু ঘরের ভিতরেই কে আবার ফাঁচ করে হেঁচে ফেললে।

মানিকবাবু ও বিমলা ভয়ানক চমকে উঠলেন।

তারপরেই তারা হতভম্ব হয়ে দেখলেন, ঘরের দরজাটা আপনা-আপনি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল–ও সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল বাহির থেকে দরজায় কে শিকল তুলে দিলে।

বিমলা দৌড়ে গিয়ে দরজাটা টেনে বললেন, দরজা কে বন্ধ করে দিয়ে গেছে!

মানিকবাবুর হাত থেকে প্রথমে লাঠি খসে পড়ল, তারপর তিনি নিজেও কাঁপতে কাঁপতে মাটির উপরে বসে পড়লেন এবং তারপর কপালে দুই চোখ তুলে তিনি বললেন, গিন্নি! হাত নেই–খালি জামার হাতা! মানুষ নেই–তবু হাঁচি! চোর নেই–তবু টাকা লোপাট! গিন্নি, আমাকে তুমি ধরো আমার ঘাড়ে আজ ভূতে ভর করেছে! বলেই তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

বিমলা স্বামীর কাছে গিয়ে বসে পড়তে পড়তে শুনতে পেলেন ঘরের বাইরে কে খিলখিল করে হেসে উঠল।

.

ষষ্ঠ । টেবিল-চেয়ারের নাচ

যে-সময়ে মানিকবাবু চোখ কপালে তুলে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, ঠিক সেই সময়ে স্বাস্থ্যনিবাসের আর এক দৃশ্যের অবতারণা হল।

মিসেস দাসের শরীর অনেক রাত্রে হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়াতে, মিস্টার দাস একটা ওষুধের খোঁজে বৈঠকখানায় দিকে গেলেন।

যাত্রীর ঘরের সুমুখ দিয়ে যাওয়ার সময় মিস্টার দাস অবাক হয়ে দেখলেন, সে-ঘরের দরজা খোলা রয়েছে।

তাঁর কেমন সন্দেহ হল। দরজায় পাশেই আলোর সুইচটা ছিল, আলো জ্বেলে দেখলেন ঘরের ভিতরে যাত্রী নেই! ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলেন, রাত তখন তিনটে। এত রাত্রে যাত্রী কোথায় গেল? ভাবতে ভাবতে তিনি নেমে গিয়ে বৈঠকখানার ভিতরে ঢুকলেন। তারপর ওষুধের শিশিটা নিয়ে ফিরে আসবার সময় তার চোখ পড়ল সদর দরজায় উপরে। সদর দরজায় ভিতর দিকের খিল খোলা! মিস্টার দাসের বেশ মনে পড়ল, তিনি নিজের হাতে খিল লাগিয়ে দিয়ে গেছেন।

কিছুই আর বুঝতে বাকি রইল না। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে মিসেস দাসকে ডেকে তিনি বললেন, ওগো, শুনচ? ব্যাপার গুরুতর!

মিসেস দাস তাড়াতাড়ি উঠে বসে বললেন, তার মানে?

রতনবাবুর কথাই ঠিক। আমাদের এই নতুন ভাড়াটেটা হয় খুনি, নয় ডাকাত, নয় স্বদেশি বোমাওয়ালা।

মিসেস দাস এবারে দাঁড়িয়ে উঠে আবার বললেন, তার মানে?

সে লোকটা ঘরে নেই। সদর দরজা খোলা। এই নিশুত রাতে বাড়ির বাইরে সে কি করতে গেছে?

মিসেস দাস হাত-মুখ নেড়ে বললেন, তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না।

তাহলে নিজের চোখে দেখবে এসো।

দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে সঙ্গেই শুনলেন, সদর-দরজা খোলার ও বন্ধ করার শব্দ! দুজনেই বিস্মিত হয়ে দুজনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন–কেউ কিছু বললেন না।

দুজনে যখন সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, হঠাৎ ফাঁচ করে হাঁচির শব্দ হল!

মিস্টার দাস ভাবলেন, তার স্ত্রী বোধহয় হেঁচে ফেললেন। মিসেস দাসের ধারণা হল ঠিক উলটো–এ হাঁচি নিশ্চয়ই তাঁর স্বামীর!

মিসেস দাস যখন যাত্রীর ঘরের কাছে এসেছেন, তখন ঠিক তার কাঁধের উপরে আবার কে হেঁচে দিলে। এবারে চমকে মুখ ফিরিয়ে তিনি দেখলেন, মিস্টার দাস তাঁর কাছ থেকে প্রায় দশ-বারো হাত তফাতে আছেন! অথচ হাঁচির শব্দ হল ঠিক তার কানের কাছেই! মিসেস দাস অত্যন্ত বিস্মিত হলেন, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না।

দুজনে ঘরের ভিতরে ঢুকলেন। যাত্রীর জুতো, জামা, কাপড়, আলোয়ান ও সেই বিশি ব্যান্ডেজগুলো ঘরের মেঝেয়, টেবিলের ও বিছানার উপরে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে!

আচম্বিতে তাঁরা স্তম্ভিত চক্ষে দেখলেন, জুতোজোড়া প্রথমে সজীব হয়ে নড়ে উঠল, তারপর গটগট করে বিছানার কাছে গিয়ে থেমে পড়ল!

মিসেস দাস হতভম্বের মতন দুই চোখ দু-হাতে রগড়ে আবার ভালো করে চাইতেই দেখলেন, যাত্রীর ঠুলি চশমাখানা শুন্যে স্থির হয়ে তার দিকেই যেন কটমট করে চেয়ে আছে!

তারপরেই ঘরের টেবিলটা হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে হড়াৎ করে এগিয়ে এসে মিস্টার দাসকে মারলে এক বিষমধাক্কা!

তারপরেই চেয়ারখানা হঠাৎ শূন্যে লাফিয়ে উঠল এবং বেগে মিসেস দাসের দিকে তেড়ে এল! কিন্তু মিসেস দাস চেয়ারের মনোবাসনা পূর্ণ করলেন না, তিরের মতন ছুটে ঘরের ভিতর থেকে পালিয়ে গেলেন। তার স্ত্রী যে এমন বেগে ছুটতে পারেন, মিস্টার দাস এতদিনেও তা জানতে পারেননি। বলা বাহুল্য তিনিও আর সে-ঘরে রইলেন না।

মিসেস দাস নিজের ঘরের সুমুখে গিয়ে মাটির উপরে ধড়াস করে আছাড় খেয়ে পড়লেন এবং সে অবস্থায় যেমন করে চাচানো উচিত, ঠিক তেমনি করেই চাচাতে কিছুমাত্র কসুর করলেন না।

সে-রাত্রে সমস্ত স্বাস্থ্যনিবাসের ঘুম ভেঙে গেল। সকলেই ঘটনাস্থলে ছুটে এল। জিজ্ঞাসা করতে লাগল–কি হয়েছে? আগুন লেগেছে? ডাকাত পড়েছে নাকি? প্রভৃতি।

মিসেস দাস হাপুস চোখে কাঁদতে কাঁদতে হাত নেড়ে নেড়ে বিনিয়ে বিনিয়ে বললেন, হায়, হায়, হায়,! ও চেয়ার যে আমার বাবার দেওয়া গো! অমন পুরোনো আর বিশ্বাসী। চেয়ার কিনা আজ আমাকেই তেড়ে এল? ওগো, আমাদের ওই ব্যান্ডেজ বাঁধা নতুন ভাড়াটেটা ভুতের সর্দার! তার মন্ত্রে আমার পুরোনো টেবিল-চেয়ারের ঘাড়ে ভূত চেপেছে! সারা ঘর জুড়ে টেবিল আর চেয়ার নাচ আরম্ভ করেছে। আমি কেতাবে পড়েছি, ভূতে পেলেই টেবিল চেয়ার জ্যান্ত হয়ে নাচতে থাকে।

মিস্টার দাস বললেন, হ্যাঁ, কেতাবে আমিও টেবিল-চেয়ার জ্যান্ত হওয়ার কথা পড়েছি বটে! কিন্তু খালি জুতো যে জ্যান্ত হয়ে নিজেই হাঁটাহাঁটি শুরু করে, কেতাবে এমন কথা তো কখনও পড়িনি!

মিসেস দাস বললেন, আর সেই চশমাখানা? সেখানাও তো ঘরময় পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছিল! মা-গো মা, এমন অনাসৃষ্টি কেউ কখনও দেখেছে না শুনেছে?

সকলে মিলে দাঁড়িয়ে গোলমাল করছে, এমন সময় যাত্রী উপর থেকে নেমে সেইখানে এসে দাঁড়াল। কর্কশ স্বরে বললে, এত গোলযোগ কীসের শুনি? রাতটা সৃষ্টি হয়েছে ঘুমোবার জন্যে, চিৎকার করবার জন্যে নয়। এসব আমি সহ্য করব না। এই বলে সে আবার সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।

সকলে সভয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইল–এমনকী মিসেস দাস পর্যন্ত আর উচ্চৈস্বরে নিজের মতামত প্রকাশ করতে সাহস করলেন না।

.

সপ্তম । যাত্রীর ছদ্মবেশ ত্যাগ

পরদিন শ্রীপুর শহরে ছিল চড়কের উৎসব। রাজপথে আশেপাশে খোলা জমির উপরে মেলা বসেছে নানা জায়গা থেকে নানা দোকানি-পসারি নানানরকম রংচঙে লোভনীয় জিনিস এনে সাজিয়ে রেখেছে। নাগরদোলায় চড়ে কোথাও ছেলেমেয়ের দল হাসিখুশির গোলমাল করছে, কোথাও বায়োস্কোপের তাঁবু খাটানো হয়েছে এবং কোথাও বা ম্যাজিক দেখানো হচ্ছে। রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য।

এদিকে স্বাস্থ্যনিবাসের বৈঠকখানায় তখনও সবাই মিলে ঘোঁট পাকিয়ে তুলছে। মিস্টার দাস এসব আজেবাজে কথায় সময় নষ্ট না করে থানায় খবর দিতে বেরিয়ে গেলেন।

খানিক পরে উপর তলা থেকে কর্কশ কণ্ঠের আওয়াজ এলমিসেস দাস, মিসেস দাস!

সে-ডাক বৈঠকখানায় মিসেস দাসের কানে গেল বটে, কিন্তু তার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হল না যে, তিনি কিছু শুনতে পেয়েছেন!

খানিক পরে যাত্রী আবার ক্রুদ্ধ স্বরে হাঁকলে–মিসেস দাস! শীগগির আমার খাবার পাঠিয়ে দিন!

মিসেস দাস তবু কোনওরকম ব্যস্ততা প্রকাশ করলেন না,–এক মনে তার ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে চেয়ার-টেবিলের অদ্ভুত নৃত্য কাহিনি নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।

খানিক পরে যাত্রী নিজেই নীচে নেমে এল। মিসেস দাসের সামনে এসে একটা গোল টেবিলের উপরে সজোরে করাঘাত করে বললে, মিসেস দাস! আপনি কি মনে করেন, আমি হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকবার জন্যে স্বাস্থ্যনিবাসে এসেছি?

এইবার মিসেস দাসের মুখ ফুটল। তিনিও টেবিলের উপরে সমান জোরে চড় মেরে বলে উঠলেন, আপনি কি মনে করেন, ভূত নামাবার জন্য আপনাকে আমি ঘর ছেড়ে দিয়েছি?

যাত্রী বললে, আপনার কথার অর্থ কি?

মিসেস দাস বললেন, আপনার জন্যে আমার বিশ্বাসী টেবিল-চেয়ার পর্যন্ত আমাকে আর গিন্নি বলে মানে না! নাচবার জন্যে টেবিল-চেয়ার তৈরি করা হয়নি! কে ওদের এমন নাচতে শেখালে? কে আপনি? আপনার নাম কী? আমার ঘরে বসে আপনি কী করেন? কাল অত রাত্রে বাইরে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? আর ফিরে এলেনই বা কেমন করে?

বিষম রাগে যাত্রীর দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগল! হঠাৎ ভীষণ চিৎকার করে সে বলে উঠল, চুপ করো! কে আমি? তোমরা জানতে চাও? তোমরা দেখতে চাও? দেখো তবে!বলেই সে তার মুখের ব্যান্ডেজে মারলে এক টান! ব্যান্ডেজ, ঠুলি-চশমা, নকল গোঁফ দাড়ি আর তার নকল নাকটা সকলের চোখের সামনে খসে পড়ল! সবাই দারুণ আতঙ্কে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলে–একটা জামা-কাপড়-পরা মূর্তি পায়ে পায়ে ক্রমেই এগিয়ে আসছে কিন্তু সে মূর্তির স্কন্ধের উপরে মুখমণ্ডলের কোনও চিহ্নই নেই।

বৈঠকখানায় মহা হুড়োহুড়ি লেগে গেল–চিৎকার, কান্না, আর্তনাদ! মিসেস দাস আঁ বলে চেঁচিয়ে উঠে প্রচণ্ড গতর নিয়ে পালাতে গিয়ে দড়াম করে এক আছাড় খেলেন কিন্তু সেই অবস্থাতেই আশ্চর্য কৌশলে ফুটবলের মতো গড়াতে গড়াতে চোখের নিমেষে তিনি কোথায়। অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বাকি লোকেরাও কে যে কেমন করে কোন দিকে সরে পড়ল, কিছুই বোঝা গেল না। আধ মিনিটেই ঘর একেবারে খালি।

স্কন্ধকাটা মূর্তিটা মিনিটখানেক সেখানে পায়চারি করে আবার বাড়ির ভিতরে চলে গেল। ধীরে ধীরে।

এ-খবর শ্রীপুরের পাড়ায় পাড়ায় রটে যেতে বেশি দেরি লাগল না! চড়কের মেলার কথা সবাই ভুলে গেল–আধঘণ্টার ভিতরে শহরের সমস্ত জনতা স্বাস্থ্যনিবাসের সামনে এসে হাজির। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মুখে কেবল একই কথা–জুজু! জুজু! জুজু! স্বাস্থ্যনিবাসে জুজুবুড়ো এসেছে!

এমন সময়ে দুজন চৌকিদার ও দারোগাকে সঙ্গে করে মিস্টার দাস, রতনবাবু আর মানিকবাবু বিজয়ী বীরের মতন সদর্পে স্বাস্থ্যনিবাসে এসে ঢুকলেন।

দারোগা শুধোলেন, কোথায় সে লোক?

এই যে, এই দিকে আসুন।বলে মিস্টার দাস সবাইকে নিয়ে যাত্রীর ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন।

সেই স্কন্ধকাটা মূর্তি ঘরের মাঝখানে একখানা চেয়ারের উপরে স্থির হয়ে বসেছিল।

বলা বাহুল্য, প্রথমে সকলেই ভড়কে গেল মিস্টার দাস, রতনবাবু ও মানিকবাবু তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এসে, দরকার হলেই পালাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে রইলেন।

দারোগা বললেন, ওসব ম্যাজিক আমি ঢের দেখেছি। আমার হাতে যখন ওয়ারেন্ট আছে, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব সবাইকে আমি গ্রেপ্তার করতে পারি! –এই বলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন।

স্কন্ধকাটা যাত্রী বললে, কে তোমরা? কী চাও?

দারোগা বললেন, তোমাকে গ্রেপ্তার করব!

যাত্রী উঠে দাঁড়াল। দারোগা এক লাফে যাত্রীর কাছে গিয়ে তার দস্তানাপরা একখানা হাত চেপে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে দস্তানাটা দারোগার হাতে খুলে এল এবং যাত্রীর হাতখানা একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু তখন আর কারুর এসব দেখে আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ ছিল নাদারোগা ও চৌকিদারেরা সেই হস্তহীন স্কন্ধকাটা মূর্তিটাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরলে।

মুখহীন মুখ থেকে আওয়াজ–ওঃ বড় লাগছে! তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, আমি আত্মসমর্পণ করছি।

দারোগা ও চৌকিদারেরা যাত্রীকে ছেড়ে দিয়ে তাকে আগলে দাঁড়িয়ে রইল।

দারোগা বললে, নাও, এখন হাতকড়ি পরো।

যাত্রী বললে, কেন, আমি কি দোষ করেছি? আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য হওয়া কি অপরাধ?

দারোগা টিটকিরি দিয়ে বললে, কি বললে? অদৃশ্য মানুষ? ম্যাজিকে আমি অমন ঢের ঢের অদৃশ্য মানুষ দেখেছি! আমার সঙ্গে ওসব চালাকি চলবে না!

যাত্রী বললে, আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করছেন না? এই দেখুন!বলেই সে নিজের গায়ের আলোয়ান চটপট খুলে ছিঁড়ে ফেলে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের উপর দিকটা অদৃশ্য হয়ে গেল! তারপরেই সে পরনের কাপড়খানা খুলতে লাগল!

দারোগা এতক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অবাক হয়ে এই সব দেখছিলেন। এখন যাত্রীকে কাপড় খোলবার চেষ্টা করতে দেখেই তিনি তার আসল মতলব খানা বুঝতে পেরে বলে উঠলেন, এই চৌকিদার! ওকে ভালো করে চেপে ধরে থাক-নইলে কাপড় খুললেই ও একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে!

কিন্তু তার আগেই যাত্রী কাপড়খানা খুলে ফেলে এক লাফে তাদের নাগালের বাইরে গিয়ে পড়ল! তখন দেখা গেল, কেবল জুতো মোজা পরা দুখানা হাঁটু পর্যন্ত পা ঘরময় লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে। পরমুহূর্তে অদৃশ্য মানুষ তার জুতো মোজাও খুলে ফেললে এবং জুতোর একপাটি মিস্টার দাসের দিকে ও আর একপাটি দারোগার দিকে সজোরে ছুঁড়ে মারলে।

তারপর সে-এক অপূর্ব দৃশ্য! ঘরের ভিতরে মহা শোরগোল পড়ে গেল! –ওই– ওইদিকে সে গিয়েছে!–বাপরে বাপ, আমায় লাথি মারলে!–ব্যাটা আমাকে ঘুষি মেরেছে! এইবারে তাকে ধরেছি! ওই যাঃ! আবার পালিয়ে গেল! ওরে বাপরে, গেছি রে!

অদৃশ্য মানুষ কখন যে কোন দিকে যাচ্ছে, কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না, মাঝখান থেকে কিল-চড়-ঘুষি-লাথি খেয়ে প্রত্যেকেরই প্রাণ যায় যায় হয়ে উঠল! বেদম প্রহার খেয়ে দারোগাবাবু তো মেঝের উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন, রতনবাবুর গোঁফের একপাশ একদম উড়ে গেল এবং মিস্টার দাসের উপর-পাটির তিন-তিনটে দাঁতের আর কোনও সন্ধানই পাওয়া গেল না!

তারপরেই প্রথমে ঘরের দরজার কাছে এবং তারপরেই সিঁড়ির উপরে দুমদুম শব্দ শুনে সকলেই বুঝতে পারলে অদৃশ্য মানুষ সে ঘরথেকে সকলের অগোচরে চলে গেল।

তখন স্বাস্থ্যনিবাসের সামনে যে জনতা এসে জমা হয়েছিল, তার ভিতরে এক বিষম বিভীষিকার সাড়া উঠল!–অদৃশ্য মানুষ রাস্তায় এসেছে! অদৃশ্য মানুষ রাস্তায় এসেছে প্রত্যেকেই এই কথা বলতে বলতে মহাভয়ে পালিয়ে যেতে লাগল।

শহরের বাইরেই ছোট একটি নদী পাহাড়ের কোল দিয়ে ঝিরঝির করে বয়ে যাচ্ছে। সেই নদীর ধারে আতাগাছের ছায়ায় একখানা পাথর-আসনে বসে শ্রীপুরের মহাকবি অবলাকান্ত একমনে কবিতা রচনা করছিলেন।

অবলাকান্ত হঠাৎ চমকে উঠলেন–ঠিক তার পাশেই ফাঁচ করে কে হেঁচে ফেললে! অবলাকান্ত একবার সামনে, একবার পিছনে, একবার ডাইনে ও একবার বামে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলেন কিন্তু হাঁচির মালিকের একগাছা টিকিও দেখা গেল না।

অবলাকান্ত ক্যাবলাকান্তের মতন তাকিয়ে আছেন, এমন সময়ে ঠিক তার কাছ থেকে হাত চারেক তফাতেই আবার কে ফাঁচ-ফাঁচ-ফাঁচ করে তিন-তিনবার হেঁচে উঠল।

অবলাকান্তের মুখ সাদা হয়ে গেল। বিড়বিড় করে তিনি বললেন, এ কে হচে? আকাশ, না বাতাস, না পাহাড়? না যক্ষ রক্ষ দেবতা দানব? এরকম হাঁচি তো ভালো নয়? এই বলে তিনি তাড়াতাড়ি কবিতার খাতা মুড়ে ফেলে শ্রীপুরের দিকে দ্রুত পদ-চালনা করলেন।

.

অষ্টম। বাবু বংশীবদন বসু

কেউ তাকে নাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, আমার নাম বাবু বংশীবদন বসু। পাছে তিনি আমাদের উপরে রাগ করেন, সেইজন্যে আমরাও তাকে বংশীবাবু বলেই ডাকব।

বংশীবাবুর ভোজন হয় যত্র-তত্র, আর শয়ন হয় হট্টমন্দিরে, তারপরে যে-সময়টুকু হাতে থাকে হাটে-ঘাটে-মাঠে টো-টো করে ঘুরে, বংশীবাবু সে-সময়টুকু কাটিয়ে দিতে পারেন অনায়াসেই।

মস্ত মাঠ। একটা বটগাছের ছায়ায় নরম ঘাসের উপরে বংশীবাবু দুপা ছড়িয়ে বসেছিলেন। তাঁর সামনে সাজানো ছিল সারি সারি চার জোড়া ছেঁড়া জুতোর পাটি।

বংশীবাবুর সম্প্রতি পায়ের জুতোর অভাব হয়েছে। কিন্তু সে অভাব পূরণ করতে তাঁর বেশিক্ষণ লাগেনি। শহরের বাড়ি বাড়ি ঘুরে এই চার জোড়া ছেঁড়া জুতো তিনি আজ সংগ্রহ করে এনেছেন। আর এখন বসে বসে পরীক্ষা করছেন, এই চার জোড়া জুতোর মধ্যে কোন জোড়া সবচেয়ে ছেঁড়া!

হঠাৎ কে পিছন থেকে বললে, ওগুলো, জুতো বুঝি? বংশীবাবু পিছনে না তাকিয়েই বললেন, হ্যাঁ এ বিষয়ে কোনওই সন্দেই নেই। এগুলি হচ্ছে দাঁতব্য জুতো। এর চেয়ে খারাপ চার জোড়া জুতো দুনিয়াতে কেউ আবিষ্কার করতে পারবে না।

পিছনের লোকটি বললে, হুঁ।

বংশীবাবু বললেন, অবশ্য এর চেয়েও খারাপ জুতো যে আমি পরিনি তা নয়, কিন্তু তবু, সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এ-শহরে যারা জুতো দান করে তারা খুব দয়ালু লোক নয়!

পিছনের লোকটি বললে, দুনিয়ায় যারা সবচেয়ে পাজি লোক, এ-শহরে বাস করে তারাই।

কে এতটা স্পষ্ট কথা কইছে দেখবার জন্যে বংশীবাবু ডান কাঁধের উপরে মুখ ফিরিয়ে পিছন-পানে তাকালেন। সেদিকে, কেউ নেই। তারপর তিনি বাঁ কাঁধের উপরে মুখ ফিরিয়ে পিছন পানে তাকালেন। সেদিকেও কেউ নেই। তারপর তিনি একেবারে ঘুরে বসলেন। কোথাও কেউ নেই।

বংশীবাবু নিজের মনে বললেন, আমি কি জেগে-জেগেই স্বপ্ন দেখছি?

সেই কণ্ঠস্বর বললে, ভয় পেও না।

বংশীবাবু আঁতকে উঠে বললেন, কে তুমি বাবা? কোথায় তুমি? কেউ কি তোমাকে মাটির ভেতরে পুঁতে রেখে গিয়েছে?

কণ্ঠস্বর আবার বললে, ভয় পেও না।

হতভম্ব বংশীবাবু বললেন, বল কি বাবা, ভয় পাব না কীরকম? উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব পশ্চিম সব খাঁ-খাঁ করছে। এই তেপান্তরে আমি আছি একলা। অথচ এখানে এসে তুমি কথা কইছ কোনখান থেকে?…না, তুমি বোধ হয় নেই! কাল রাতে সিদ্ধি খেয়েছিলুম, এখনও নেশা কাটেনি। ভুল শুনছি।

কণ্ঠস্বর বললে, না, এ নেশা নয়।

বাপ রে। বলেই এক লাফে বংশীবাবু দাঁড়িয়ে উঠলেন। একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পিছু হটতে হটতে বললেন, না নিশ্চয়ই আমার নেশা কাটেনি! দিব্যি গেলে বলতে পারি, আমি এখুনি কার গলা শুনলুম!

কণ্ঠস্বর বললে, হ্যাঁ, তুমি আমারই গলার আওয়াজ শুনেছ।

ভয়ে দুই চোখ মুদে ফেলে বংশীবাবু বললেন, আর কখনও আমি সিদ্ধি খাব না।

হঠাৎ কে তার দুই কঁধ ধরে খুব খানিকটা আঁকুনি দিয়ে বললে, তুমি একটা মস্ত গাধা।

বংশীবাবু চোখ না খুলেই বললেন, আমি গাধা হতেও রাজি আছি বাবা, তুমি যদি দয়া করে চুপ করো। এখন যদি রাত হত তাহলে এসব ভূতেরই খেলা বলে মনে করতুম।

কণ্ঠস্বর বললে, ওহে বোকারাম, আমি ভূত-টুত কিছু নই,আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ।

বংশীবাবু চোখ খুলে বললেন, অদৃশ্য মানুষ? না নেশার খেয়াল?

কণ্ঠস্বর বললে, নেশার খেয়াল নয়, আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ!

তুমি যে অদৃশ্য সেটা আমি বুঝতেই পারছি বাবা! কিন্তু তুমি কোন মন্ত্রে অদৃশ্য হয়েছ সেটা আমাকে শিখিয়ে দিতে পারো?

পারি। যদি তুমি আমার কথা শোনো।

ও-মন্ত্র পেলে তোমার জন্যে আমি সব করতে পারি।

দেখ, আমিও তোমার মতন ভবঘুরে। আমি অসহায়। আমার মাথা গোঁজবার ঠাই নেই। সারাদিন আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে রাগে আমার সর্বশরীর জ্বলছে। মানুষ পেলেই এখুনি আমি খুন করতে পারি!

বাবা! বলেই বংশীবাবু পালিয়ে যাওয়ার উপক্রম করলেন!

খপ করে বংশীবাবুর একখানা হাত ধরে অদৃশ্য মানুষ বললে, তোমার কোনও অনিষ্টই আমি করব না! আমি জামা-কাপড় চাই, আশ্রয় চাই, খোরাক চাই। এই-সব বিষয়ে তুমি আমাকে সাহায্য করবে!

বংশীবাবু ভাবতে লাগলেন, যার নিজের পরনের কাপড়, পেটের অন্ন আর মাথা গোঁজবার ঠাই জোটে না, এইসব বিষয়ে সে কিনা সাহায্য করবে অপরকে! কিন্তু ভয়ে মনের কথা তিনি মুখ ফুটে বলতে পারলেন না!

কণ্ঠস্বর বললে, আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ–সমস্ত পৃথিবীকে আমি শাসন করতে পারি। আমাকে সাহায্য করলে তোমার কোনও অভাবই থাকবে না! কিন্তু সাবধান, আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে পৃথিবীতে কেউ তোমাকে রক্ষে করতে পারবে না! বলতে বলতে সে। তার অদৃশ্য দুই হাত দিয়ে বংশীবাবুর দুখানা হাত সজোরে চেপে ধরলে।

বংশীবাবু যাতনায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন, ছেড়ে দাও বাবা! আমি তোমার গোলাম থাকব!

.

নবম । নোট প্রজাপতি

শ্রীপুরের স্বাস্থ্যনিবাসে সকালে-বিকালে চা, টোস্ট, কেক, বিস্কুট ও ডিম প্রভৃতির ব্যবস্থা ছিল। শ্রীপুরের যে-কোনও ভদ্রলোকই কিঞ্চিৎ অর্থব্যয় করলে সেখানে গিয়ে চায়ের তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারতেন। এবং প্রতিদিন সকালে-বিকালেই সেখানে চায়ের তেষ্টা মেটাবার জন্যে অনেক তৃষিত লোকের আবির্ভাব হত।

যাত্রীর অন্তর্ধানের পরের দিন সকালেও স্বাস্থ্যনিবাসের চা-বিভাগে চা-ভক্তদের অভাব হল না।

একটা মস্ত গোল টেবিলের চারিধারে বসে খরিদ্দাররা মাঝে মাঝে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন এবং মাঝে মাঝে গতকল্যকার ঘটনা নিয়ে উত্তেজিত ভাবে আলোচনা করছেন। বলা বাহুল্য চা-সভার সভাপতি ছিলেন স্বাস্থ্যনিবাসের মালিক মিস্টার দাস স্বয়ং এবং তাঁর ডাইনে ও বাঁয়ে বিরাজ করছিলেন রতনবাবু ও মানিকবাবু। আসল বক্তা হচ্ছেন তারা তিন জনই, বাকি সবাই শ্রোতা ও উৎসাহদাতা।

বক্তৃতা যখন রীতিমতো জমে উঠেছে, তখন ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন একটি নতুন লোক। তার জামা কাপড় যে হপ্তাকয়েকের মধ্যে রজকের দেখা পায়নি, এ সত্য খুব সহজেই বোঝা যায়। তাঁর ধুলোয় ধূসর তালিমারা জুতো-দুখানির অবস্থাও সন্দেহজনক; কারণ তাদের ভিতরে ভদ্রলোকের পা-দুখানি ঢুকেও আরও খানিকটা বেওয়ারিস জায়গা খালি পড়ে আছে। ভদ্রলোক আসতে আসতে ক্রমাগত পিছনপানে চেয়ে চমকে উঠছেন–যেন তার পিছনে পিছনে আসছে কোনও অদৃশ্য বিপদ!

স্বাস্থ্যনিবাসের খরিদ্দারের এমনধারা হতচ্ছাড়া চেহারা মিস্টার দাস পছন্দ করলেন না। একটু বিরক্ত ভাবে বললেন, এখানে আপনার কী দরকার?

আগন্তুক বললেন, এক পেয়ালা চা আর দু-টুকরো রুটি চাই। গোটাদুয়েক ডিম হলে আরও ভালো হয়।

আগন্তুকের ছেঁড়া পকেটের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে মিস্টার দাস বললেন, দাম চার আনা। আপনাকে, খাবার আগে দাম দিতে হবে।

মিস্টার দাসের ভয়ের কারণ বুঝে আগন্তুক হেসে বললেন আমার পকেট ছেঁড়া বটে, কিন্তু আমার টাকা থাকে ট্যাকে। এই নিন। বলে তিনি ট্র্যাক থেকে একটা টাকা বার করে ঠং করে টেবিলের উপরে ফেলে দিলেন।

মিস্টার দাস অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আসুন, আসুন, ওই টেবিলের ধারে বসুন। আপনার খাবার এখুনি আসবে। বলেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন, ডাক্তারবাবু, এইবারে সেই ভূতুড়ে লোকটার ঘরে যাওয়া যাক।

মিস্টার দাসের সঙ্গে মানিকবাবু স্বাস্থ্যনিবাসের ভিতরদিকে চলে গেলেন। আগন্তুক টেবিলের ধারে গিয়ে বসলেন। কারুকে বোধহয় বলে দিতে হবে না যে এই আগন্তুকই হচ্ছেন, আমাদের সেই বংশীবাবু।

মিস্টার দাস ও মানিকবাবু যাত্রীর ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখলেন, কালকের সেই তুমুল কাণ্ডের পর ঘরের সমস্ত আসবাব ঠিক সেইভাবেই এলোমেলো হয়ে ছড়ানো রয়েছে। ওলটানো চেয়ার-টেবিল, ভাঙা-চোরা শিশিবোতল ও লণ্ডভণ্ড বিছানা! কেবল যাত্রীর জামা-কাপড়, ব্যান্ডেজ, চশমা ও নকল নাকটা দারোগাবাবু যাওয়ার সময় নিজের সঙ্গে নিয়ে গেছেন।

ঘরের কোণে একখানা পকেটবুক পড়েছিল, সেইখানা তুলে নিয়ে মিস্টার দাস বললেন, এই পকেট বইখানার পাতা ওলটালে লোকটার অনেক কথাই হয়তো জানা যাবে!

মানিকবাবু কি জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ঘরের দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল।

মিস্টার দাস চমকে উঠে বললেন, ওকি, দরজা খুললে কে?

মানিকবাবু দরজার দিকে চেয়ে খুব সহজ ভাবেই বললেন, বোধ হয় হাওয়ায় দরজাটা খুলে গেল। এতে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।

মিস্টার দাস বললেন, কালকের ব্যাপারের পর থেকে অমন ভাবে দরজা খুলে গেলেই আমার বুকটা ধড়াস করে ওঠে!

ঘরের ভিতরে একটা চাপা হাঁচির শব্দ শোনা গেল।

মিস্টার দাস বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি কি এখনি হাঁচলেন?

ঘরের মধ্যে গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল–না, আমি হেঁচেছি। আমাকে আপনারা চেনেন।

মিস্টার দাস ও মানিকবাবু হতাশ ভাবে ও মড়ার মতন সাদা মুখে দুদিকে সরে গিয়ে দেয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়ালেন।

কণ্ঠস্বর বললে, মিস্টার দাস, আমার পকেটবুক আপনার হাতে কেন? দিন, ফিরিয়ে দিন।

মিস্টার দাস কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এসে পকেটবুকখানা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

পকেটবুক খানা মিস্টার দাসের হাত থেকে বেরিয়ে শুন্যে উড়ে একখানা চেয়ারের উপর গিয়ে পড়ল।

কণ্ঠস্বর বললে, মিস্টার দাস, আমার জামাকাপড়গুলো কোথায় গেল?

মিস্টার দাস বললেন, পুলিশ নিয়ে গেছে।

কণ্ঠস্বর বললে, আমার আর জামা-কাপড় নেই। তবে আপাতত আপনার জামা-কাপড় পেলেই আমার চলে যাবে। আপনার গায়ের আলোয়ানখানা খুলে মেঝের ওপরে রাখুন। তারপর আপনার জামা, কাপড় আর জুতো সব খুলে ওই আলোয়ানের ভেতরে রেখে দিন। তারপর একটা পোটলা বেঁধে জিনিসগুলো আমার হাতে দিন।

মিস্টার দাস আঁতকে উঠে বললেন, আঁ, সে কি কথা!

কণ্ঠস্বর খুব কর্কশ ভাবে বললে, যা বলছি তাই করুন। দেখতে পাচ্ছেন, আমি অদৃশ্য? আমি যদি ইচ্ছা করি, তা হলে এখনি আপনাদের দুজনকে গলা টিপে, মেরে ফেলতে পারি!

মিস্টার দাস বাধো বাধো গলায় অত্যন্ত লজ্জিত ভাবে বললেন, কিন্তু এ-ঘরে ডাক্তারবাবুর সামনে আমি জামাকাপড় খুলব কেমন করে?

কণ্ঠস্বর বললে, আমি অদৃশ্য বটে, কিন্তু আপনাদের চেয়ে বোকা নই। একবার চোখের আড়ালে যেতে পারলেই আপনি যে এখুনি পুলিশে খবর দিতে ছুটবেন, সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। ওসব চালাকি চলবে না। যা বলছি তাই করুন।.আর মানিকবাবু, ওই বইগুলো গুছিয়ে তুলে আপনিও এই পোঁটলার ভেতরে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করুন।

.

বাইরে তখন বংশীবাবুর চা, রুটি ও ডবল ডিম শেষ হয়ে গেছে।

এমন সময় রতনবাবু শুনতে পেলেন, যাত্রীর ঘর থেকে যেন একটা গোলমালের আভাস আসছে। দিনকাল ভালো নয় বলে তিনিও তাড়াতাড়ি উঠে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হলেন।

সিঁড়ির সামনে এসেই তিনি শুনলেন, তার খুব কাছেই একটা হাঁচির শব্দ হল। এ হাঁচি তিনি ভোলেননি। শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি এক পাশে সরে দাঁড়ালেন।

তার পরেই দেখলেন, সিঁড়ির উপর থেকে একটা পোটলা শূন্যে দুলতে দুলতে নেমে আসছে!

পোঁটলাটা ঠিক যেন হাওয়ায় সাঁতার কাটতে কাটতে বৈঠকখানা-ঘরের দিকে চলে গেল।

ঠিক সেই সময় মিসেস দাস কি-একটা কাজের জন্যে বৈঠকখানা-ঘরের দিকে আসছিলেন। কিন্তু দূর থেকেই উড্ডীয়মান পোঁটলা দেখে তার চক্ষু স্থির ও পা দুটো অচল হয়ে গেল। তার পরেই বাইরের ঘরে একটা অত্যন্ত গোলযোগ উঠল!

সঙ্গে সঙ্গে মানিকবাবু যাত্রীর ঘর থেকে বেগে বেরিয়ে এসে বলে উঠলেন, অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য মানুষ! ধরো যতক্ষণ ওর হাতে পোটলা থাকবে সবাই মিলে অনায়াসেই ওকে ধরতে পারবে!

রতনবাবু বেগে বৈঠকখানায় প্রবেশ করে দেখলেন, বংশীবাবু পোঁটলাটা কাঁধে করে দ্রুতপদে স্বাস্থ্যনিবাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন! অদৃশ্য মানুষ নির্বোধ নয়, নিজে পোঁটলা নিয়ে যেতে গেলে যে বিপদের সম্ভাবনা আছে, সেটা সে বিলক্ষণই জানে! তাই বংশীবাবুকেই সে পোটলার বাহন করেছে!

রতনবাবুও বংশীবাবুর পিছনে ছুটতে ছুটতে চাঁচাতে লাগলেন, চোর! চোর! পোটলা নিয়ে পালায়! পাকড়াও পাকড়াও!

বেচারী বংশীবাবু! খানিক পরেই তিনি দেখলেন, সারা শ্রীপুর শহরটাই যেন তার পিছনে ভেঙে পড়েছে। সকলেরই মুখে এক কথা–চোর! চোর! পোটলা চোর! ধরো ওকে-মারো ওকে! এসব আপত্তিকর কথা শুনে বংশীবাবু আরও জোরে পা চালিয়ে দিলেন। ছোটবার অসুবিধা হবে বলে তার দাঁতব্য জুতো-জোড়াকেও তিনি পা থেকে খুলে নির্দয় ভাবে বিসর্জন দিতে বাধ্য হলেন।

সকলের আগে আসছিলেন রতনবাবু ও মানিকবাবু। হঠাৎ রতনবাবুর মনে হল, কে যেন তাকে বিশ্রী একটা ল্যাং মারলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে দু-হাতে মাটি জড়িয়ে ধরলেন।

তারপরেই বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতন মানিকবাবুর টিকলো নাকের উপরে প্রচণ্ড একটা ঘুষি এসে পড়ল। মানিকবাবু দুই চক্ষে অনেকগুলো সর্ষের ফুল দেখলেন–এবং তারপর কি যে হল তা আর তিনি বলতে পারেন না।

আর যারা ছুটে আসছিল, তাদেরও কেউ খেলে কিল, কেউ খেলে চড় এবং কেউ বা খেলে লাথি বা গলাধাক্কা! বেগে ছুটতে ছুটতে আছাড় খেয়ে অনেকেরই হাত-পা-মাথা ভেঙে গেল! বাকি লোকেরা তখন বুদ্ধিমানের মতো যে যেদিকে পারল পলায়ন করলে– এই কথা বলে চাঁচাতে চাঁচাতে–অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য মানুষ আবার ফিরে এসেছে! সকলে সাবধান হও! এই ভয়ানক খবর শুনেই অনেকে নিজের নিজের বাড়ির সদর দরজায় ভিতর থেকে খিল লাগিয়ে দিলে।

শ্রীপুরের সবাই যখন রাজপথে, মিস্টার দাস তখন যাত্রীর ঘরের ভিতরে বন্দি হয়ে আছেন। রাজপথের ও স্বাস্থ্যনিবাসের সমস্ত হট্টগোল ও আর্তনাদ তার কানে এসে ঢুকছে, কিন্তু মিস্টার দাসের ঘর থেকে বেরুবার উপায় নেই কারণ তখন তিনি সদ্যপ্রসূত শিশুর মতোই বস্ত্রহীন! অবশেষে অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি যখন খানকয়েক খবরের কাগজ তুলে নিয়ে কোমরে জড়িয়ে নিজের বস্ত্রের অভাব দূর করবার চেষ্টা করছেন, তখন রতনবাবু আবার হাপরের মতন হাঁপাতে-হাঁপাতে ফিরে এলেন।

ঘরে ঢুকেই রতনবাবু বলে উঠলেন, অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য ঘুষি! অদৃশ্য লাথি! সমস্ত শ্রীপুরের গতর চূর্ণ হয়ে গেছে!

মিস্টার দাস ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, সে এখন কোথায়?

এতক্ষণ আমরা তার পিছনে পিছনে ছুটছিলুম, কিন্তু এখন আমাদেরই পিছনে পিছনে সে ছুটে আসছে! হাতের কাছে যাকেই পাচ্ছে মেরে তার হাড় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সবাই এখন পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছে–অদৃশ্য মানুষ বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে!

ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মিস্টার দাস বললেন, সে আর এখানে ফিরে আসবে না তো?

আসবে না কি, ওই এল বুঝি! এই বলেই সাঁতারুরা গঙ্গায় যেমন করে ঝাঁপ খায়, রতনবাবু তেমন করেই মাটির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে একেবারে খাটের তলায় ঢুকে অদৃশ্য মানুষের চেয়েও অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

মিস্টার দাসও কোমরের খবরের কাগজগুলোকে দুই হাতে প্রাণপণে চেপে ধরে দরজার বাইরের দিকে সুদীর্ঘ একটি লম্ফত্যাগ করলেন;–এবং লাফিয়ে তিনি যে কোথায় গিয়ে পড়লেন তা আমরা জানি না, তবে তাকেও আর দেখা গেল না।

.

সারাদিন ধরে শ্রীপুর শহরে যে সব অঘটন ঘটল, চতুর্মুখ ব্রহ্মা চারমুখেও তা বলে শেষ করতে পারবেন না।

রাজপথে কেউ হাঁচলেই চারিদিকে অমনি সাড়া ওঠে ওই অদৃশ্য মানুষ এসেছে! সঙ্গে সঙ্গে সেখানটা মরুভূমির মতন জনশূন্য হয়ে যায়!

বাড়ির ভিতরে লুকিয়ে থেকেও শান্তি নেই! হাওয়ার দাপটে ঘরের দরজা-জানলা যদি হঠাৎ খুলে বা বন্ধ হয়ে যায়, অমনি সবাই হাউ-মাউ করে চেঁচিয়ে ওঠে!

শ্রীপুর ব্যাঙ্কের কাউন্টারের উপরে হাজার কয়েক টাকার নোট নিয়ে একজন কেরানি হিসাব করছিল। আশপাশে আরও অনেক লোক আপন আপন কাজে নিযুক্ত ছিল। এমন সময় দেখা গেল, সকলের চোখের সুমুখ দিয়েই নোটের তাড়া শূন্যপথে উড়ে গেল–ঠিক প্রজাপতির মতন। সবাই রাজপথে ছুটে এল কিন্তু সেই নোট-প্রজাপতিদের আর কোনও সন্ধান পেলে না, কেবল দেখা গেল, একজন ময়লা জামা-কাপড়-পরা লোক খালি পায়ে হন হন করে এগিয়ে যাচ্ছে!

স্বাস্থ্যনিবাসের উপরে অদৃশ্য মানুষের আক্রোশ অত্যন্ত বেশি। কারণ, সারাদিনে সে বার চারেক স্বাস্থ্যনিবাসকে আক্রমণ করেছে, সেখানকার একখানা সার্সির কাচও অটুট নেই, এবং কাচের সমস্ত বাসনও চুরমার হয়ে গেছে! স্বাস্থ্যনিবাসের ভাড়াটিয়ারা প্রত্যেকেই পলায়ন করেছে।

খবরের কাগজে এই সব ঘটনার উজ্জ্বল বর্ণনা পাঠ করে শ্রীপুরের বাসিন্দাদের উত্তেজনা, দুর্ভাবনা ও বিভীষিকার আর সীমা রইল না।

কখন কোথায় এই ভীষণ অদৃশ্য মানুষের অদৃশ্য আবির্ভাব ঘটবে, সেই দুশ্চিন্তায় সকলেই তটস্থ হয়ে রইল।

যে-মাঠে বংশীবাবুর সঙ্গে প্রথমে আমাদের চেনাশুনো হয়, সেই ধূ-ধূ মাঠেরই এক নির্জন কোণে একটা ঝোপের ভিতরে তিনি এখন আবার হতাশ ভাবে দুপা ছড়িয়ে বসে ঘন ঘন হাঁপ ছাড়ছেন। এবং মাঝে মাঝে এদিকে-ওদিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে কেন যে তিনি শিউরে উঠছেন অন্য কেউ তার রহস্য বুঝতে পারবে না।

হঠাৎ শূন্যপথে দৈববাণীর মতো এক কণ্ঠস্বর জেগে উঠল,–বংশীবদন, তোমার হাঁপ ছাড়া শেষ হল কি? সন্ধে হতে যে আর দেরি নেই!

বংশীবাবুর বদলে কিছুমাত্র উৎসাহের লক্ষণ দেখা গেল না। অত্যন্ত কাহিল ভাবে তিনি বললেন, আমাকে দয়া করে ছেড়ে দিন আপনার দুটি পায়ে পড়ি!

কণ্ঠস্বর বললে, সে কি হে বংশীবদন! ব্যাঙ্কের কাউন্টার থেকে, রাস্তার লোকের পকেট থেকে আজ কত নোট আর টাকা তোমার পকেটে এসে জুটেছে সেটা হিসেব করে দেখেছ কি? আমার সঙ্গে থাকলে রোজই এমনি আশ্চর্য রোজগার হবে। অর্ধেক তোমার অর্ধেক আমার।

বংশীবাবু দুই হাত জোড় করে কঁচুমাচু মুখে বললেন, আমার আশ্চর্য রোজগারে আর কাজ নেই বাবা! এত রোজগার আমার ধাতে সইবে না! এর চেয়ে গড়ের মাঠের মতন ট্যাক নিয়ে নিশ্চিন্ত প্রাণে ঘুরে বেড়ানো ঢের ভালো। রোজগার করে করব কি, সারা শহর যে আমাকে চিনে ফেলেছে। পথে-পথে পাহারাওয়ালা ঘুরছে আমার গলা টিপে ধরবার জন্যে। আপনি তো অদৃশ্য হয়ে দিব্যি মজায় আছেন কিন্তু আমার? আমার কি হবে?

লোকটা বললে, কেমন করে তাকে দেখিয়ে দেব? সে যে অদৃশ্য মানুষ! সে আমার পিছনে পিছনে তেড়ে আসছে। আমাকে বাঁচাও।

হঠাৎ পাহারাওয়ালার দাড়ি-ভরা গালে চটাৎ করে এক নিরেট চড় এসে পড়ল। গালে হাত বুলোতে বুলোতে হতভম্ব পাহারাওয়ালা দু-পা পিছিয়ে এল। তারপরেই বিস্ময়ে দেখলে, তার সামনের লোকটাকে কে যেন হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কে যে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখবার জো নেই!

পাহারাওয়ালা এক লাফ মেরে এগিয়ে গিয়ে দুহাতে লোকটার দুই-পা খুব জোরে চেপে ধরলে, তারপর একদিকে পাহারাওয়ালা ও আর-একদিকে অদৃশ্য মানুষ, এই দুয়ে মিলে টাগ অফ ওয়ার লেগে গেল সেই হতভাগ্য লোকটার দেহ নিয়ে।

গোলমাল শুনে ফাঁড়ির দারোগা বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, এসব কী কাণ্ড!

পাহারাওয়ালা টানাটানি করতে করতে প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বলে উঠল, অদৃশ্য মানুষ।

যার দেহ নিয়ে টানাটানি করা হচ্ছে সেই লোকটি অর্থাৎ আমাদের বংশীবাবু যাতনায় বিকৃত স্বরে বলে উঠলেন, আমাকে বাঁচাও। আমার দেহ এইভাবে ছিঁড়ে দুখানা হয়ে যাবে!

দারোগা রিভলভার বার করে কয়েকবার গুলিবৃষ্টি করলেন। গুলি অদৃশ্য মানুষের গায়ে লাগল কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু বংশীবাবুর দুই হাত থেকে অদৃশ্য মানুষের হাতের বাঁধন ফস করে খুলে গেল!

.

দশম । পূর্ণ-বিধু সংবাদ

রসায়নশাস্ত্রে বিখ্যাত পণ্ডিত শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় শ্রীপুর শহরে বাস করতেন। আজ সারাদিন তাঁর অশান্তির অবধি নেই।

আজ সারাদিন শ্রীপুরের পথে হট্টগোল ও হুড়োহুড়ি চলেছে, তার জন্যে পূর্ণবাবুর সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। সারাদিনই তার কানের ভিতরে এই চিৎকারই বারবার ছুটে এসেছে অদৃশ্য মানুষ। অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য মানুষ! ওই আসছে! ওই ধরলে!

পূর্ণর্বাবুও বারবার বিরক্তিভাবে নিজের মনেই বলছেন, পৃথিবীতে আবার কি রূপকথার রাজ্য ফিরে এল? অদৃশ্য মানুষ! সারা দুনিয়াটা কি হঠাৎ পাগলা হয়ে গেল?

সন্ধ্যার পরে শহর যখন ঠান্ডা হল ও রাজপথের জনতা কমে গেল, পূর্ণবাবু তখন নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কাজে বসলেন। রাত যখন দুপুর তখনও তিনি কাজ করছেন একমনে।

আচমকা কি কতকগুলো ভাসা-ভাসা চিৎকার ও রিভলভারের শব্দ তার কানে এসে ঢুকল। কাজ করতে করতে মুখ তুলে পূর্ণবাবু বললেন, আবার কি গাঁজাখোরদের উপদ্রব শুরু হল? কিন্তু রিভলভার ছুঁড়েছে কে? তারপর, আবার তিনি নিজের কাজে মন দিলেন।

অল্পক্ষণ পরেই খুব জোরে তার সদর-দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। তারপর দরজা খোলার ও বন্ধ হওয়ার আওয়াজ এল তার কানে।

চাকরকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে কড়া নাড়ছিল!

চাকর বললে, জানি না হুজুর! দরজা খুলে কারুকে তো দেখতে পেলুম না।

চাকর চলে গেল। পূর্ণবাবু আবার কাজ করতে লাগলেন।

রাত দুটোর সময় তাঁর কাজ শেষ হল। ধীরে ধীরে টেবিলের ধার থেকে উঠে তিনি তার শয়ন-ঘরে প্রবেশ করলেন।

কিন্তু ঘরে ঢুকেই একখানা চেয়ারের তলায় কি-একটা দাগ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, খানিকটা রক্ত! আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, এখানে রক্তের দাগ এল কেমন করে? কিন্তু একটানা পরিশ্রমের পর তার চোখ তখন ঘুমে জড়িয়ে আসছিল, এসব বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তিনি শয্যার দিকে আবার অগ্রসর হলেন। ঘুমের ঘোরে সে রাত্রে তিনি ক্ষুধার কথাও ভুলে গেলেন।

কিন্তু খাটের কাছে গিয়ে তিনি যা দেখলেন, তাতে তার বিস্ময় আরও বেড়ে উঠল। তাঁর সমস্ত শয্যা লণ্ডভণ্ড ও বিছানার চাদর ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে এবং তাতেও রক্তের দাগ রয়েছে! এ কী রহস্য!

অবাক হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছেন, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল কী আশ্চর্য! এ যে পূর্ণ!–পূর্ণবাবু একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, ঘরে তিনি ছাড়া আর জনপ্রাণী নেই! কণ্ঠহীন কণ্ঠস্বর? শ্রীপুরের পাগলামি তাকেও আক্রমণ করল নাকি! ধেৎ!

হঠাৎ একখানা চেয়ারের দিকে তাঁর নজর পড়ল। চেয়ার থেকে ঠিক আধ হাত উপরে শুন্যে একটা ব্যান্ডেজ স্থির হয়ে আছে–আর তাতেও রক্তের দাগ। গোল ব্যান্ডেজ কিন্তু তার ভিতরে কোনও বস্তু বা দেহের কোনও অংশ নেই! এও কি সম্ভব! পূর্ণবাবুর কিছুমাত্র কুসংস্কার ছিল না, কিন্তু এ-দৃশ্য দেখবার পর তারও বুকের কাছটা ছমছম করতে লাগল!

ঘরের ভিতর আবার কে তাকে ডেকে বললে, পূর্ণ! তুমি এখানে!

বিপুল বিস্ময়ে পূর্ণবাবু হাঁ করে রইলেন!

কণ্ঠস্বর বললে, পূর্ণ, ভয় পেও না! আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ!

শ্রীপুরের পাগলামি তার শয়ন-ঘরেও ঢুকেছে? না, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখছেন? স্বপ্নের ঘোরেই তিনি যেন বললেন, আঁ?

কণ্ঠস্বর আবার বললে, আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ!

নিজের কানকে অবিশ্বাস করেও পূর্ণবাবু বললেন, অদৃশ্য মানুষ? অদৃশ্য মানুষকে দেখতে কি ওই ব্যান্ডেজের মতো?

কণ্ঠস্বর বললে, না। ব্যান্ডেজটা আমার কোমরে বাঁধা আছে। তোমার বিছানার চাদর ছিঁড়ে এই ব্যান্ডেজ তৈরি হয়েছে।

পূর্ণবাবু ভাবলেন, অদৃশ্য মানুষ যদি সত্যিকার মানুষই হয়, তাহলে অত্যন্ত অভদ্র তো! সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়েও তাকে তুমি তুমি বলে কথা কইছে!

কিন্তু এ সবই বাজে ধাপ্পা! ম্যাজিকের ফকিকারিতে তাকে ভোলানো এত সহজ নয়! সামনে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে তিনি ব্যান্ডেজটা ধরবার চেষ্টা করলেন। হঠাৎ দু-খানা তপ্ত রক্তমাংসের হাত তার হাত সজোরে চেপে ধরলে সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর বললে, পূর্ণ, বিশ্বাস। করো। সত্যিই আমি অদৃশ্য মানুষ!

এইবারে পূর্ণবাবুর গায়ে কাঁটা দিলে তিনি চেঁচিয়ে লোকজন ডাকবার উপক্রম করলেন এবং তৎক্ষণাৎ দু-খানা অদৃশ্য হাত সজোরে তার মুখ চেপে ধরলে!

পূর্ণ, বোকামি কোরো না। চাঁচামেচি করলে তোমার ভালো হবে না। আমার গলা শুনেও তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি হচ্ছি বিধু!

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পূর্ণবাবু বললেন, বিধু?

হ্যাঁ, হ্যাঁ–বিধু, অর্থাৎ বিধুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সিটি কলেজে তোমার সঙ্গে পড়তুম– মনে নেই, দিনে তিরিশ কাপ করে চা খেতুম বলে তুমি আমাকে কেবলই ধমক দিতে? আশ্চর্য, এত শীঘ্র তুমি বন্ধুদের ভুলে যাও!

পূর্ণবাবু আমতা আমতা করে বললেন, বিধু? হ্যাঁ, এখন মনে পড়ছে বটে! কিন্তু অদৃশ্য মানুষের সঙ্গে আমাদের সেই বিধুর কি সম্পর্ক? সে তো অদৃশ্য ছিল না!

না, তখন আমি অদৃশ্য ছিলুম না। এখন হয়েছি।

এও কি সম্ভব? মানুষ অদৃশ্য হতে পারে?

সে আলোচনা পরে করব। আপাতত আমায় কিছু খেতে দাও–আজ তিন দিন আমার পেটে অন্ন যায়নি।

পূর্ণবাবু বললেন, আজ আমার খিদে নেই বলে আমি কিছু খাইনি। আমার খাবার তোমার পাশের টেবিলেই চাপা দেওয়া আছে। ইচ্ছে করলেই খেতে পারো।

নিরাকার বিধুর আর তর সইল না–পূর্ণবাবু অবাক হয়ে দেখলেন তার টেবিলের উপরে রক্ষিত খাবারের থালার ঢাকনিটা হঠাৎ যেন জ্যান্ত হয়ে এক লাফ মেরে টেবিলের আর-এক পাশে গিয়ে পড়ল এবং তারপর খাবারগুলোও জ্যান্ত হয়ে শূন্যে টপাটপ লাফ মারতে শুরু করলে!

খেতে খেতে নিরাকার বিধু বললে, আঃ, এতক্ষণে যেন বাঁচলুম! আমি ঈশ্বরের মতো নিরাকার হয়েছি বটে, কিন্তু ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে এখনও জয় করতে পারিনি। ভাগ্যিস দৈবগতিকে তোমার বাড়িতেই এসে পড়েছি!

তোমার দেহ নিরাকার হয়েছে বটে, কিন্তু তোমার দেহের রক্ত তো চর্মচক্ষুকে ফাঁকি দিতে পারে না! ব্যাপার কী? তুমি আহত হয়েছ কেন?

সে অনেক কথা, পরে বলব। আপাতত এইটুকু শুনে রাখো, একটা পাজি লোক আমার টাকা নিয়ে পালাচ্ছিল, তাকে ধরতে গিয়েই, আমার এই বিপদ হয়েছে।…ভাই পূর্ণ, আজ আর আমি কথা কইতে পারছি না–তিন দিন আমি ঘুমোই নি, আমাকে ঘুমোবার একটু ঠাই দাও।

তুমি এই ঘরেই ঘুমোতে পারো, আমি অন্য ঘরে যাচ্ছি।

আর তোমার দু-একটা বাড়তি জামাকাপড় আমাকে দিয়ে যাও।

আচ্ছা।

.

একাদশ । নিরাকারের আত্মকথা

পূর্ণবাবু একখানা আলোয়ান, একটা গরম কোট, একটা ফ্লানেলের শার্ট, একখানা কাপড় ও একজোড়া জুতো এনে দিলেন।

বিধু যখন সেইগুলো পরলে, তখন তার দেহের একটা নির্দিষ্ট গঠন পূর্ণবাবুর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল–যদিও জামার উপরে তার মুণ্ড, জামার হাতার তলায় তার হাত দুটো এবং হাঁটুর কাপড় ও জুতোর মাঝখানে তার পা-দুটো দৃশ্যমান হল না বলে সে দেহটাকে অত্যন্ত কিম্ভুতকিমাকার দেখাতে লাগল।

বিধু বললে, ভাই পূর্ণ, এইবারে আমি একটু ঘুমিয়ে নেব। বাকি কথা সব কাল সকালে হবে।…হ্যাঁ, ভালো কথা। আমি এখানে আছি একথা তুমি কারুকে বলবে না তো?

কেন?

লোকে আমার কথা টের পায়, এটা আমি পছন্দ করি না! সাবধান, আমার একথা ভ্রমেও ভুলো না!

পূর্ণবাবু সে-ঘর ছেড়ে বেরিয়ে অন্য একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। তার চোখে সে রাত্রে আর ঘুম এল না। একখানা ইজিচেয়ারের উপরে বসে পড়ে তিনি নানা কথা ভাবতে লাগলেন।

অদৃশ্য মানুষ! শ্রীপুরের আর সকলের মতো আমারও মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? এও কি সম্ভব? হ্যাঁ, সমুদ্রের জলে যারা বাস করে, আমাদের চোখে তারা অদৃশ্য বটে! পুকুরের জলে যে-সব জীব বাস করে, তারাও অদৃশ্য! কিন্তু পৃথিবীর হাওয়ার জগতে যারা বাস করে, তারা কখনও অদৃশ্য হতে পারে না!

ভেবে-চিন্তেও তিনি কুলকিনারা পেলেন না।..রাত পুইয়ে গেল। সকালবেলায় খবরের কাগজ এল। খবরের কাগজে পূর্ণবাবু অত্যন্ত আগ্রহের সহিত অদৃশ্য মানুষের সমস্ত কীর্তিকলাপ পড়ে ফেললেন। যে-কথাগুলি তিনি জানতে পারলেন, সেগুলি হচ্ছে এই :

(১) অদৃশ্য মানুষ স্বাস্থ্যনিবাসের উপরে বিষম অত্যাচার করেছে। (২) অদৃশ্য মানুষ ডাক্তার মানিকবাবুর বাড়ি থেকে টাকা চুরি করেছে। (৩) অদৃশ্য মানুষ শ্রীপুরের অসংখ্য স্ত্রী-পুরুষকে আহত করেছে। (৪) অদৃশ্য মানুষ শ্রীপুরের ব্যাঙ্ক থেকে কয়েক হাজার টাকার নোট নিয়ে পালিয়েছে এবং রাজপথের পথিকদের পকেট কেটে অনেক টাকা সরিয়েছে! প্রভৃতি।

পূর্ণবাবু নিজের মনেই বললেন, সর্বনাশ। বিধু কেবল অদৃশ্য নয়, উন্মত্তও বটে! ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে সে সাংঘাতিক কাণ্ডও করতে পারে। মানুষের সমাজের সমস্ত নিয়ম বদলে দিতে পারে! আর আমি কিনা তাকে স্বাধীনভাবে আমারই ঘরে ছেড়ে রেখে এসেছি! তাকে কি স্বাধীনতা দেওয়া উচিত? কখনওই নয়।

পূর্ণবাবু একখানা কাগজে তাড়াতাড়ি কি লিখলেন। তারপর কাগজখানা একখানা খামের ভিতরে পুরে চাকরকে ডেকে বললেন, এই চিঠিখানা চুপিচুপি থানায় দিয়ে এসো।

ঠিক সেই সময়েই তার শয়ন-ঘরের ভিতরে ঝনঝন করে একটা বেজায় আওয়াজ হল– যেন কাচের কি কতগুলো ভেঙে পড়ল! পূর্ণবাবু তাড়াতাড়ি শয়ন ঘরের দিকে ছুটলেন।

ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখলেন, একটা জানলার সামনে বিধুর স্কন্ধকাটা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং জানলার সার্সির ভাঙা কাচগুলো ঘরের মেঝের উপর ছড়িয়ে রয়েছে!

পূর্ণবাবু বললেন, এ কী ব্যাপার?

বিধু বিরক্তমুখে বললে, আমার মেজাজ বেজায় তিক্ত হয়ে আছে! কিছুই ভালো লাগছে না। ভয়ানক রাগ হচ্ছে। রাগের ঝেকে তোমার সার্সির কাচগুলো ভেঙে ফেলেছি!

পূর্ণবাবু মনে মনে বললেন, উন্মাদ রোগের পূর্বলক্ষণ! প্রকাশ্যে বললেন, তুমি আজকাল মাঝে মাঝে এইরকম করো নাকি?

করি।

পূর্ণবাবু ঘরের ভিতর নীরবে খানিকক্ষণ পায়চারি করলেন। তারপর বিধুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বললেন, বিধু, শান্ত হয়ে বসো। কেমন করে তুমি অদৃশ্য হলে, সে কথা আমাকে বলোনি। আমার শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।

অদৃশ্য হওয়া খুবই সহজ কথা!

তোমার কাছে সহজ হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে এটা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার!

কলেজ ছাড়বার পর আমি যে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে খুব মেতে উঠেছিলুম, সে কথা বোধহয় তুমি জানো না। মোহনপুরে আমার বাসা ছিল। সেখানে প্রায় দিন-রাত একটা ঘরে বন্দি হয়ে আমি কেবল পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে হরেকরকম পরীক্ষা করতুম। সেই পরীক্ষার ফলেই অদৃশ্য হবার এই অদ্ভুত উপায় আবিষ্কার করেছি।

সে উপায়টা কি শুনি?

সে কথা ভালো করে বোঝাতে গেলে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক কঠিন বিষয় নিয়ে এখন ব্যাখ্যা করতে হয়। সে সময় আমার নেই। তবে খুব সংক্ষেপে দু-একটা কথা বলছি, শোনো। ধরো, কাচের কথা। পাথরের চেয়ে কাচ স্বচ্ছ, তাই পাথরের ভিতর দিয়ে দেখা যায় না, কিন্তু কাচের ভিতর দিয়ে যায়। অস্পষ্ট আলোতে খুব পাতলা কাচ সহজে চোখে পড়ে না– কারণ, সে আলো শোষণ ও প্রতিফলিত করতে পারে খুবই অল্প। সাধারণ সাদা কাচ তুমি যদি জলের ভিতরে ফেলে দাও, তাহলে সে বিশেষরূপে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আবার জলের চেয়ে ঘন কোনও তরল পদার্থের ভিতরে কাচকে ফেলে দিলে সে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়– কারণ, সেই তরল পদার্থ ভেদ করে খুব অল্প আলোই তার কাছে গিয়ে পৌঁছোতে পারে। ঠিক এই কারণেই বাতাসের ভিতরে হাইড্রোজেন গ্যাস অদৃশ্য হয়ে থাকে। কাচকে যদি ভেঙে গুঁড়ো করা হয় তাহলে বায়ু-চলাচলের স্থানে তাকে রাখলে সকলেই দেখতে পায়! কিন্তু সেই দৃশ্যমান কাচের গুঁড়ো জলের মধ্যে ফেলে দিলে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। সাদা কাগজ স্বচ্ছ নয়–তার ভিতর দিয়ে দৃষ্টি চলে । কিন্তু ভালো করে তেল মাখিয়ে সাদা কাগজকেও স্বচ্ছ করা যায়।.এইরকম সব ব্যাপারের উপরেই নির্ভর করে আমি এই অপূর্ব আবিষ্কার করেছি।

পূর্ণবাবু বললেন, তারপর কি হল বলো!

বিধু বলতে লাগলঃ

কয়েক বৎসর চেষ্টার পরে যখন আমার মনে হল যে আমি পরীক্ষার সফল হয়েছি, তখন একদিন একটা বিড়ালকে ধরে আনলুম। তারপর সেই বিড়ালের উপরে আমি আমার আবিষ্কৃত ওষুধ প্রয়োগ করলুম। বিড়ালটা ওষুধ খেয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তারপর আমার চোখের সামনেই ধীরে ধীরে তার দেহ শূন্যে মিলিয়ে গেল। তার দেহ মিলিয়ে গেল বটে, কিন্তু তার মিউ মিউ করে কান্নার জ্বালায় আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠল। শেষটা অনেক কষ্ট করে ও তাড়াহুড়ো দিয়ে বিড়ালটাকে ঘর থেকে বিদায় করলুম। কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে পথে গিয়ে আবার সে হইচই বাধিয়ে তুললে। বিড়াল মিউ মিউ করছে, অথচ তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! রাজপথে বেশ ভিড় জমে গেল। যখন বিড়ালটাকে কিছুতেই আবিষ্কার করা গেল না, তখন তাকে ভূতুড়ে বিড়াল মনে করে সবাই সেখান থেকে পলায়ন করলে।

এ ওষুধটা হয়তো এত শীঘ্র আমি নিজের উপরে প্রয়োগ করতুম না, কিন্তু বাধ্য হয়ে শেষটা করতে হল। পূর্ণ, আমি যে ধনীর ছেলে নই এ কথা তুমি জানো। সামান্য যা কিছু পুঁজি-পাটা ছিল, এই পরীক্ষা শেষ করতেই তা ফুরিয়ে গেল। কয়েক মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি, বাড়িওয়ালা বিষম তাগাদা শুরু করলে। তাগাদায় যখন ফল হল না, তখন সে নালিশ করে আমার বিরুদ্ধে বডি-ওয়ারেন্ট বার করলে। বাড়িওয়ালা ও ওয়ারেন্টকে ফাঁকি দেবার জন্যে শেষটা আমি মরিয়া হয়ে ওষুধ খেয়ে অদৃশ্য হয়ে পড়লুম।

বাড়িওয়ালার চোখের সুমুখ দিয়েই আমি সরে পড়লুম, কিন্তু সে আমাকে মোটেই দেখতে পেলে না। রাজপথে জনতার ভিতর দিয়ে লক্ষ্যহীনের মতন এগিয়ে চললুম। কিন্তু খানিক দূর এগুতে না এগুতেই নানান রকম মুশকিল হতে লাগল। মোটরগাড়িগুলো হর্ণ না দিয়েই আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে চলে যেতে চায়। একটা মুটে একরাশ জিনিস ভরা ঝাঁকা মাথায় করে আমার গায়ের উপরে এসে পড়ল। আমি সাৎ করে একপাশে সরে গেলুম বটে, কিন্তু আমার অদৃশ্য গায়ে ধাক্কা খেয়ে মুটেটা আশ্চর্য হয়ে এমনি চমকে উঠল যে তার সমস্ত মোট মাট পথের উপরে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তার আঁকার ভিতরে কাচের কি–একটা জিনিস ছিল, তারই এক টুকরো ভেঙে আমার পায়ের তলায় ফুটে গেল ও ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল। আমি কাচের টুকরোটা পা থেকে বার করে ফেলবার চেষ্টা করছি, ইতিমধ্যে

সেখানে অনেক লোকজন জমে গেল। তারা মুটেটাকে বললে, তুই কানা হয়ে পথ চলছিস। নাকি? মুটেটা বললে, না বাবু, ভূতে আমায় ধাক্কা মেরেছে! সব লোক হেসে উঠল। মুটে বললে, ওই দেখুন, রক্তমাখা পায়ের দাগ। বেগতিক দেখে আমি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে। পালাতে লাগলুম। কিন্তু কি আপদ, যতই অগ্রসর হই রক্তমাখা পায়ের রেখা আমার পিছনে পিছনেই চলে। রাস্তার ভিড় ক্রমেই বেড়ে উঠল, সকলেই ভীত, বিস্মিত, স্তম্ভিত! সেই মস্ত ভিড় রক্তাক্ত পায়ের দাগ ধরে আমায় অনুসরণ করতে লাগল! তার উপরে পথের লেড়ে কুকুরগুলোর ব্যাপার আরও সঙিন করে তুলল। তারা আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না বটে, কিন্তু তাদের তীব্র ঘ্রাণশক্তি আমাকে আবিষ্কার করে ফেললে অনায়াসেই! হতভাগারা আমাকে ঘেউ ঘেউ করে কামড়ে দিতে এল! ব্যতিব্যস্ত হয়ে কি করব ভাবছি এমন সময় দেখি একখানা ফিটনগাড়ি সেইখান দিয়ে যাচ্ছে। একলাফে তার উপরে উঠে পড়লুম, গাড়িখানা দুলে উঠল, গাড়োয়ান সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে পিছন ফিরে একবার দেখলে; কিন্তু কিছুই না দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হয়ে আবার গাড়ি চালাতে লাগল।

খানিক পরেই এক নতুন বিপদ! একটা ভীষণ মোটা মেম হঠাৎ সেই গাড়িখানার উপরে চড়ে বসল। আমি তাড়াতাড়ি অন্য দরজা দিয়ে আবার পথের উপরে লাফিয়ে পড়লুম। এবারে খুব সাবধানে সকলকে এড়িয়ে পথ চলতে লাগলুম। সন্ধে পর্যন্ত এইরকম ঘুরে ঘুরে রীতিমতো ক্ষুধার উদ্রেক হল। একখানা খাবারের দোকানের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালুম। দোকানি যেই একটু অন্যমনস্ক হয়, অমনি খান-দুই-তিন লুচি বা দু-একখানা কচুরি বা দু-একটা আলুর দম প্রভৃতি টপাটপ সরিয়ে ফেলি! কিন্তু দু-একটা খাবার মুখে ফেলেই নতুন এক বিপদের সম্ভাবনায় মুষড়ে পড়লুম! আমার দেহের রক্ত যেমন বাইরের আলো-হাওয়ার সংস্পর্শে এলে আর অদৃশ্য থাকে না, তেমনি বাইরের কোনও খাবার জিনিসও হজম না হওয়া পর্যন্ত উদরের মধ্যে দৃশ্যমান হয়েই থাকে। এই সত্যটা ধরতে পেরেই পেটের ক্ষুধা পেটে নিয়ে পালিয়ে এলুম।

সারাদিন ঘুরে ঘুরে ও অনাহারে শরীর এলিয়ে পড়ল। এখন উপায়? বাসায় ফেরবার পথ নেই, রাস্তায় রাস্তায় কতক্ষণ আর এমন করে ঘুরে বেড়াব? সারাদেহে এক-টুকরো কাপড় নেই, তার উপরে পৌষমাসের প্রখর শীত! কাঁপতে কাঁপতে ভাবতে লাগলুম, কোনওরকমে যদি জামাকাপড় ও জুতো জোগাড় করতে পারি, আর চশমা ব্যান্ডেজ ও পরচুল প্রভৃতির সাহায্যে। মুখের অদৃশ্য অংশগুলো ঢাকা দিতে পারি, তাহলে আমার চেহারা খুব চমৎকার দেখতে না হলেও এক রকম চলনসই হতে পারে। কেউ শুধোলে বললেই হবে যে, দৈব-দুর্ঘটনায় চোট। খেয়েছি বলে মুখে ব্যান্ডেজ বাঁধতে হয়েছে!..আরও মিনিট পনেরো পথ চলবার পরই যা। খুঁজছিলুম সেই সুযোগই পেলুম!–একটা বাড়ির সামনে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে–এককড়ি বিশ্বাস এন্ড কোং। এইখানে যাত্রা ও থিয়েটারের সকল রকম সাজপোশাক ও সরঞ্জাম সুলভে ভাড়া দেওয়া হয়।

কোনওরকম ইতস্তত না করে একেবারে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলুম। ঘরের ভিতরে একটা টাকমাথা বুড়ো একটা বাক্সের সামনে মাদুরের উপর বসে একখানা খাতায় কি লিখছিল! আমার পায়ের শব্দে চমকে মুখ তুলে দেখলে, কিন্তু সামনে কিছুই দেখতে না পেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। চারিদিকে সিন্দুক, বাক্স ও তোরঙ্গ সাজানো রয়েছে, দেয়ালে হরেকরকম সাজপোশাক এবং পরচুল ও গোঁফ-দাড়ি ঝোলানো রয়েছে, নানা আকারের মুখোশ ও অস্ত্রশস্ত্র টাঙানো রয়েছে। আমি পা টিপে টিপে একটা কোণের দিকে যাবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু এমনি আমার কপাল যে হঠাৎ আমার ধাক্কা লেগে একটা তোরঙ্গ গেল হুড়মুড় করে পড়ে! বুড়ো এবারে কাজকর্ম ফেলে একেবারে উঠে দাঁড়াল! যে-তোরঙ্গটা পড়ে গিয়েছিল তার কাছে এসে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু কিছুই আবিষ্কার করতে না পেরে আরও বেশি হতভম্ব হয়ে গেল।

এ সুযোগ আমি ছাড়লুম না। হঠাৎ বুকের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জোরে তার গলা টিপে ধরলুম! দু-চারবার গোঁ-গোঁ করেই সে অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর

পূর্ণবাবু বিস্মিত স্বরে বলে উঠলেন, বল কি হে, তুমি অনায়াসেই বুড়োটার গলা টিপে ধরলে?

বিধু বললে, তখন তা ছাড়া আর কি উপায় ছিল বলো? যে অবস্থায় আমি পড়েছিলুম, আমাকে বাঁচতে হবে তো?

পূর্ণবাবু বিরক্ত ভাবে বললেন, তাহলে নিজেকে বাঁচাবার জন্যে অনায়াসেই তুমি অন্য কারুকে খুন করতে পারো? কি অন্যায়?

বিধু উত্তেজিত ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললে, তা পারি। আত্মরক্ষা হচ্ছে জীবনের ধর্ম। নিজেকে বাঁচাবার জন্যে নরহত্যা করা আমি অপরাধ বলে মনে করি না। এর ভেতরে তুমি অন্যায়টা দেখলে কোথায়?

পূর্ণবাবু খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বিধু, তোমার স্বভাব ঢের বদলে গেছে দেখছি। কিন্তু সে-কথা থাক। তুমি যা বলছিলে বলো।

বিধু আবার আরম্ভ করলে–

খানিকটা দড়ি নিয়ে বুড়োর হাত-পা আমি বেঁধে ফেললুম। তার মুখে কতকগুলো ন্যাকড়া গুঁজে দিলুম, যেন হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেয়ে চেঁচিয়ে না ওঠে! তারপর নিজের মনের মতন পোশাক বেছে নিয়ে পরে ফেললুম। পরচুল, দাড়ি-গোঁফ, একখানা ঠুলি চশমা নিয়ে মুখের অদৃশ্য অংশ ঢাকা দিলুম! একটা মুখোশের নাক কেটে নিয়ে নিজের মুখের যথাস্থানে বসিয়ে দিলুম। তারপর মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করে একখানা আরসির সামনে পরীক্ষা করে দেখলুম, আমার মুখখানা দেখতে অদ্ভুত হলেও অমানুষিক হয়নি! বুড়োর বাক্স হাতড়ে দুশো পঁচিশ টাকা পেলুম। নোট ও টাকাগুলো পকেটে পুরে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম।

পূর্ণবাবু আবার বললেন, পরের টাকা নিতে তোমার সংকোচ হল না?

বিধু বললে, কিছুমাত্র না! টাকা যার কাছে থাকে তারই হয়! লোকে তা বুঝলে এতদিনে পৃথিবীতে আর গরিব থাকত না! সেখান থেকে এক হোটেলে ঢুকে আগে পেটের ক্ষুধাকে শান্ত করলুম। তারপর কেমন করে আবার নিজের বাসায় ফিরে গিয়ে আমার পুঁথিপত্র ও ওষুধের শিশি-বোতলগুলো শ্রীপুরে পাঠাবার ব্যবস্থা করে নিজেও এখানে এসে হাজির হলুম, সে-সব কথা আর না বললেও চলবে।

শোনো পূর্ণ! আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ! কিন্তু নিরাকার হবার আগে অদৃশ্য হওয়ার যে সব আনন্দ মনে-মনে কল্পনা করেছিলুম, আজ সে-সব আকাশ কুসুমের মতো মিলিয়ে গিয়েছে! এখন আমার মতো অসহায় আর কেউ নেই! আমাকে সবাই ভয় করে, ভীষণ শত্রু বলে মনে করে! কোনও সাধারণ মানুষের সাহায্য না পেলে পৃথিবীতে আমার পক্ষে বেঁচে থাকাই অসম্ভব। সেই জন্যেই বংশীবদনকে আমার সঙ্গী করেছিলুম, কিন্তু সে হতভাগাও আমার পুঁথিপত্র ও টাকা চুরি করে আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে!

পূর্ণবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এখন কী করতে চাও?

বিধু বললে, মনে করছি এখন তোমার এখানেই কিছুদিন থাকব। ভগবান তোমার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিয়েছেন। মনে করলেই আমরা দুজনেই দুজনের অনেক উপকার করতে পারি। তুমি আমাকে আশ্রয় দেবে, আমাকে লুকিয়ে রাখবে, আর আমি দুনিয়ার ঐশ্বর্য লুটে নিয়ে এসে তোমার কাছে সঁপে দেব! তুমি আমাকে সাহায্য করবে পূর্ণ?

পূর্ণবাবু চুপ করে বসে রইলেন।

চুপ করে রইলে যে? পূর্ণ, তুমি কি আমার কথায় রাজি নও?

পূর্ণবাবু নীরবে যেন কি শুনতে লাগলেন।

পুর্ণ, নীচে যেন দরজা খোলার শব্দ হল না?

কই, আমি তো শুনতে পাইনি!

বিধু খানিকক্ষণ কান পেতে শুনলে? তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললে, উঁহু, সিঁড়ির উপরে নিশ্চয়ই কাদের পায়ের শব্দ হচ্ছে, কারা ওপরে আসছে?

পূর্ণবাবুও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কে আবার আসবে?

কিন্তু বিধুর সন্দেহ দূর হল না! সে তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু পূর্ণবাবুও তাড়াতাড়ি এগিয়ে তার আগেই দরজার কাছে গিয়ে হাজির হলেন।

বিধু গর্জন করে বললেন, বিশ্বাসঘাতক!–এবং তার পরেই সে পূর্ণবাবুর উপরে লাফিয়ে পড়ল ও দুই হাতে সবলে তার গলা টিপে ধরে তাকে একটানে মেঝের উপরে আছড়ে ফেললে। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে পূর্ণবাবু তখনি উঠে বসলেন এবং সেই অবস্থায় দেখলেন, তার চোখের সামনে জামাকাপড়গুলো টান মেরে খুলে ফেলে বিধু আবার নিরাকার হয়ে গেল!

থানার দারোগা পাহারাওয়ালাদের সঙ্গে সিঁড়ি বয়ে তাড়াতাড়ি উপরে আসছিলেন এমন সময় আচমকা তার দেহের উপরে হুড়মুড় করে একটা অদৃশ্য ভার এসে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনিও হলেন একেবারে কুপোকাত!

দারোগা-মশাই যখন আবার দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠতে পারলেন, তখন দেখলেন পূর্ণবাবু রক্তাক্ত মুখে বেগে ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছেন।

তিনি দারোগাবাবুর সামনে এসে বললেন, অদৃশ্য মানুষ আবার আমাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে!

.

দ্বাদশ । অদৃশ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

পূর্ণবাবু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, আপনারা বুঝি ঢাক-ঢোল বাজিয়ে চোর ধরতে যান?

দারোগাবাবু থতমতো খেয়ে বললেন, কেন বলুন দিকি?

পূর্ণবাবু আরও রেগে বললেন, কেন, এখনও তা বুঝতে পারছেন না? আপনারা এমন গোলমাল করে বাড়ির ভেতর ঢুকেছেন যে, সে আগে থাকতেই সাবধান হয়ে পালিয়ে গেল!

দারোগাবাবু অপ্রতিভভাবে বললেন, তাই তো, বড় ভুল হয়ে গেছে!

হ্যাঁ, এ-ভুল আর শোধরাবার উপায় নেই! অদৃশ্য মানুষকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দিলেন। তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, সে বদ্ধ পাগল! সে মানুষের টাকা কেড়ে নেবে, নরহত্যা করবে, পৃথিবী তার অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে উঠবে! আমি তার সমস্ত মনের কথা শুনেছি, সে সমস্ত মানুষকে ঘৃণা করে, আজকের ব্যাপারের পর সে আর কারুকেই ক্ষমা করবে না! ছি, ছি, কি সর্বনাশটাই করলেন বলুন দেখি!

দারোগাবাবু স্রিয়মান মুখে বললেন, তাকে কি ধরবার আর কোনওই উপায় নেই?

পূর্ণবাবু বললেন, উপায় থাক আর না থাক, আমাদের চেষ্টা করতে হবে তো!…দাঁড়ান, হয়েছে! শুনুন, শ্রীপুরের চারিদিকে চৌকিদার রাখুন–তারা সব পথ-ঘাট আগলে থাক। পথে ঘাটে কুকুরেরা ঘেউ ঘেউ করলেই খোঁজ নিন! তার মুখেই আমি শুনেছি, সে অদৃশ্য হলেও কুকুররা তার অস্তিত্ব টের পায়! শ্রীপুরের সমস্ত লোককে সশস্ত্র আর সাবধান হয়ে থাকতে বলুন! কেউ যেন তার বাড়ির ভিতরে ঢোকবার পথ খোলা না রাখে! সর্বদাই খাবার-দাবার যেন লুকিয়ে রাখা হয়,–যেন সে খাবার চুরি করতে না পারে, যেন সে অনাহারে থাকে!

দারোগাবাবু বললেন, তাহলে আপনিও আসুন, এ-বিষয়ে চটপট একটা ব্যবস্থা করে ফেলা যাক!

পূর্ণবাবু বললেন, যাচ্ছি। কিন্তু আর একটা কথা জেনে রাখুন। তার অদৃশ্য দেহের ভিতরে হজম না হওয়া পর্যন্ত খাবার দেখা যায়। খাবার হজম করবার জন্যে তাকে লুকিয়ে থাকতে হবে। এখানকার প্রত্যেক বনেজঙ্গলে আর ঝোপে-ঝাপে পাহারা দেবার জন্যে লোক রাখতে হবে। যদি দরকার হয়, পথে-ঘাটে কাচের টুকরোও ছড়িয়ে রাখতে হবে। তার পা আহত হলে রক্ত পড়ে, আর সে রক্ত অদৃশ্য নয়! জানি, এ-ব্যবস্থা নিষ্ঠুর। কিন্তু উপায় কি? সে একে অদৃশ্য, তার ওপরে পাগল আর হিংস্র জন্তুর মতো ভয়ংকর!

দারোগা বললেন, এত তো আটঘাট বেঁধে কাজ করতে বলছেন, কিন্তু তার আগেই সে যদি এ-মুল্লুক ছেড়ে লম্বা দেয়?

পূর্ণবাবু বললেন, সে এখনি এখান থেকে নড়বে বলে মনে হয় না। বংশী বলে কে একটা লোক তার দরকারি পুঁথিপত্র নিয়ে পালিয়েছে। আমার বোধহয় সেগুলো সে আগে ফিরে পাবার চেষ্টা করবে।

দারোগা বললেন, তাহলে আর দেরি নয়। আসুন, বেরিয়ে পড়া যাক।

দুজনে দ্রুতপদে নীচে নেমে গেলেন।

ত্রয়োদশ। দৃশ্যে ও অদৃশ্যে

অদৃশ্য মানুষ নিশ্চয় দুর্জয় ক্রোধে অন্ধের মতো হয়ে পূর্ণবাবুর বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। কারণ সেই বাড়ির দরজার সামনে তখন একটি ছোট শিশু নিজের মনে খেলা করছিল, আচম্বিতে কোনও অদৃশ্য শক্তি তাকে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে দূরে ফেলে দেয় এবং বেচারির একখানা পা ভেঙে যায়।

তারপর ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে আর তার কোনওই সন্ধান পাওয়া গেল না। হয়তো পূর্ণবাবুর বিশ্বাসঘাতকতায় ও নিজের আশায় নিরাশ হয়ে খানিকক্ষণের জন্যে সে অত্যন্ত দমে গিয়েছিল এবং কোনও নির্জন স্থানে নিশ্চেষ্ট ভাবে বসে ভবিষ্যতের কর্তব্য স্থির করে নিয়েছিল।…

কিন্তু সে জানতে পারলে না, ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে সমস্ত পৃথিবী কীরকম জাগ্রত হয়ে উঠেছে। শ্রীপুরের ঘরে-ঘরে প্রত্যেক সদর-দরজা আজ বন্ধ। কোনও স্কুল, কলেজ ও আপিসও আজ খোলা নেই। খাবারওয়ালারা পর্যন্ত তাদের দোকানে ঝপ তুলে দিয়েছে। এবং পথে পথে সেপাইরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে।

শ্রীপুর শহরের প্রান্তে নদীর ঘাটে খেয়া পারাপার আজ বন্ধ। এবং শ্রীপুর স্টেশনে সমস্ত রেলগাড়িরই কামরার দরজা আর জানলা আজ বন্ধ! শ্রীপুর থেকে মালগাড়ি যাওয়াও আজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কি জানি, ভোলা মালগাড়ি পেয়ে অদৃশ্য মানুষ পাছে তার উপরে চড়ে সকলের অজান্তে পলায়ন করে!

মাঠে মাঠে বনে-জঙ্গলে আনাচ-কানাচে মোটা মোটা লাঠি-সোটা, রামদা, তরোয়াল ও সড়কি নিয়ে দলে দলে লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং হাওয়ায় কোথাও একটা পাতা নড়লেই হাঁ হাঁ করে সেই দিকে ছুটে যাচ্ছে।

অদৃশ্য মানুষ যে শ্রীপুরের মায়া এখনও ত্যাগ করেনি, শীঘ্রই সে প্রমাণ পাওয়া গেল।

শ্রীপুরের এক পাটকলের ম্যানেজার ছিলেন চন্দ্রভূষণবাবু। সন্ধ্যার কিছু আগে নদীর ধারের মাঠের ভিতরে হঠাৎ তার মৃতদেহ পাওয়া গেল। চন্দ্রবাবুর সর্বাঙ্গে ভয়ানক প্রহারের দাগ এবং তার মাথাটাও কে ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়ে গেছে। চন্দ্রবাবুর মৃতদেহের পাশে তার নিজের মোটা বেতের লাঠিটা দু-টুকরো হয়ে পড়েছিল এবং তারই খানিক তফাতে ছিল একটা মোটা লোহার রক্তমাখা গরাদ! বেশ বোঝা গেল, ওই গরাদের সাহায্যেই চন্দ্রবাবুকে কেউ হত্যা করে গিয়েছে।

এই ব্যাপারে শহরময় অত্যন্ত হইচই পড়ে গেল। চন্দ্রবাবু ছিলেন নির্বিরোধী ভালোমানুষ লোক–শ্রীপুরে কেউ তার শত্রু ছিল না। সুতরাং সকলেরই ধারণা হল, অদৃশ্য মানুষ ছাড়া এ-কাজ আর কেউ করেনি। কিন্তু চন্দ্রবাবুকে খামোকা সে খুন করতে যাবে কেন? এ খুন। যে টাকার জন্যে নয় তার প্রমাণ, চন্দ্রবাবুর পকেট থেকে মানিব্যাগটা হারায়নি! তবে?

অনেক খোঁজাখুঁজির পর সঠিক ব্যাপারটা জানা না গেলেও, একটা হদিস পাওয়া গেল। মাঠের ধারের একখানা বাড়ি থেকে একটি ছোট মেয়ে যা দেখেছিল, তাই নিয়ে সকলে। অনেকরকম জল্পনা-কল্পনা করতে লাগল। মেয়েটি বলে, মাঠের উপর দিয়ে একটা লোহার গরাদ ঠিক পাখির মতোই নাকি উড়ে যাচ্ছিল, আর তার পিছনে লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটছিলেন চন্দ্রবাবু। মেয়েটি তার পরের কথা আর কিছু বলতে পারলে না।

সবাই যা আন্দাজ করলে তা হচ্ছে এই অদৃশ্য মানুষ বোধ হয় সশস্ত্র হবার জন্যে কোনও বাড়ির জানলা থেকে এই লোহার গরাদটা খুলে নিয়েছিল। সে যখন মাঠের উপর দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তাকে দেখা না গেলেও তার হাতের লোহার গরাদটা অদৃশ্য হয়নি। আর সেই উড়ন্ত গরাদ দেখে চন্দ্রবাবু বোধ হয় আশ্চর্য হয়ে তাকে নিজের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করবার চেষ্টা করেছিলেন। অদৃশ্য মানুষ তাঁর হাত ছাড়াবার চেষ্টা করেও যখন মুক্তি পায়নি, তখন তাঁকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছে।

চন্দ্রবাবুকে হত্যা করে অদৃশ্য মানুষ যে-কোন দিকে গেল তাও ঠিক বোঝা গেল না। তবে ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে যে মস্ত একটা চক্রান্তের সৃষ্টি হয়েছে, এটা বোধহয় সে বুঝে নিয়েছিল! কারণ, চারিদিকে এমন সতর্ক পাহারা সত্ত্বেও কেউ তাকে আর আবিষ্কার করতে পারলে না।

তবে সন্ধ্যার পরে একদল কুলি যখন মাঠ পার হয়ে শ্রীপুরের দিকে আসছিল, তখন তারা নাকি শুনতে পেয়েছিল যে, মাঠের ভিতরে কোনও অদৃশ্য কণ্ঠ থেকে কখনও কান্নার, কখনও হাসির ও কখনও গর্জনের রোমাঞ্চকর শব্দ হচ্ছে! ভূত মনে করে কুলিরা প্রাণপণে ছুটে পালিয়ে এসেছিল!

.

চতুর্দশ । পূর্ণবাবুর বাড়ি আক্রমণ

সকালবেলায় পূর্ণবাবু একখানা অদ্ভুত পত্র পেলেন। চিঠিখানা বেয়ারিং। পত্ৰলেখক লিখছেঃ

পূর্ণ, তুমি খুবই চালাক আর সাধু লোক নয়? আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলুম। আর তুমি বন্ধু হয়েও আমাকে ধরিয়ে দিলে। আমার সঙ্গে এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করে তোমার কি স্বার্থসিদ্ধি হবে, তা তুমিই জানো। তোমারই চক্রান্তে একটা দিন আমাকে হাটে-মাঠে-বাটে ঘেয়ো কুকুরের মতো পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। যাতে আমি খেতে ও ঘুমোতে না পাই সেজন্যে তুমি কোনও সুব্যবস্থা করতেই বাকি রাখোনি। তবু আমি পেট ভরে খেয়েছি ও সারারাত প্রাণ ভরে ঘুমিয়েছি। এ খবর শুনে তুমি বোধহয় খুব খুশি হবে?

এইবারে আসল নাটক শুরু হবে–হাসির নাটক নয়, বিয়োগান্ত নাটক, অর্থাৎ তার মধ্যে পতন ও মৃত্যুর কোনওই অভাব হবে না।

এ চিঠি যখন তুমি হাতে পাবে, তখন থেকেই বিভীষিকা শুরু হবে। আজ থেকে শ্রীপুরের রাজা আর কেউ নয়–এখানে এখন কেবল আমারই একচ্ছত্র অধিকার! শ্রীপুরের সর্বশক্তিমান মহারাজা হচ্ছি আমি–অদৃশ্য মানব! কাকে রাখব আর কাকে মারব সে-কথা কেবল আমিই জানি।

তবে, প্রথম দিনে আমি কী করব, সে কথাটা তোমার কানে কানে চুপিচুপি আমি জানিয়ে রাখছি। আমার সঙ্গে শত্রুতা করলে কী হবে, তার একটা দৃষ্টান্ত দেখাবার জন্যে প্রথম দিনেই একজনের জন্যে আমি প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করব। আসামির নাম হচ্ছে, বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুর দূত এখনি তার দিকে অগ্রসর হয়েছে। সে ঘরের দরজায় চাবি বন্ধ করে বসে থাকতে পারে, বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, নিজের চারিদিকে অগুন্তি সেপাই রাখতে পারে–সে যা খুশি করতে পারে, কিন্তু তবু মৃত্যু, অদৃশ্য মৃত্যু তাকে। গ্রহণ করবার জন্যে এগিয়ে আসছে। তাকে আমি খুব সাবধান হতে বলি, কারণ লোকে তাহলেই বুঝতে পারবে যে, সাবধান হলেও আমার হাত থেকে রক্ষা নেই। যে তাকে সাহায্য করবে তাকেই মরতে হবে। তুমি শুনে রাখো বন্ধু, আজকে পূর্ণের মৃত্যু-দিবস!

পূর্ণবাবু চিঠিখানা হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে বললেন, বিধু ঠাট্টা করে এ চিঠিখানা লেখেনি। সে তার মনের কথাই খুলে লিখেছে। তিনি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর সামনে যে গরম চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, সেদিকেও তার কোনও খেয়াল রইল না। আগে চাকরকে ডেকে তিনি বাড়ির ভিতরে ঢোকবার সব পথ বন্ধ করে দিতে বললেন। তারপর দেরাজের ভিতর থেকে একটা রিভলভার বার করে নিজের পকেটে পুরলেন। তারপর ঘরের ভিতরে পায়চারি করতে করতে নিজের মনেই বললেন, বিধু! তাহলে কাল আহার আর নিদ্রা থেকে তুমি বঞ্চিত হও নি? বেশ, বেশ! তাই মনের আনন্দে তুমি আমার প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করেছ? এও মন্দ কথা নয়। কিন্তু বিধু, তুমি যতই অদৃশ্য হও, টেক্কা মারব কিন্তু আমিই! বলতে বলতে তিনি টেলিফোনের কাছে গিয়ে হাজির হলেন এবং থানার দারোগাকে সকল কথা জানালেন। দারোগা বললেন, আমি এখনি আপনার বাড়িতে যাচ্ছি। টেলিফোনের কাছ থেকে তিনি একটা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ রাজপথের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের মনেই আবার বললেন, কে জানে বিধু এতক্ষণে আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কি না! হয়তো সে এখন পথে দাঁড়িয়ে আমার পানেই তাকিয়ে আছে!–একটা কি জিনিস ঝপ করে জানলার সার্সির উপরে এসে পড়ল।–পূর্ণবাবু আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি পিছু হটে এলেন এবং তারপরে উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললেন, চড়ুই পাখি! আমার মনে নিশ্চয় ভয় ঢুকেছে। নইলে সামান্য একটা চড়ুই পাখি আমাকে এমন চমকে দিতে পারে?

সদর-দরজায় কড়া-নাড়ার শব্দ হল। তিনি নিজে নেমে গেলেন। দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–কে?

দরজার ওপাশ থেকে দারোগাবাবু সাড়া দিলেন।

পূর্ণবাবু খিল খুলে দরজাটা একটুখানি ফঁক করে আগে উঁকি মেরে দেখে নিলেন, সত্যই দারোগাবাবু কি না! তারপর নিঃসন্দেহ হয়ে দরজার এক পাটি খুব কম করে খুলে দারোগাবাবুকে ভিতরে এনে আবার খিল তুলে দিলেন।

দুজনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে ওঠবার আগেই শুনলেন, একটা ঘরের ভিতর থেকে ঝনঝন করে সার্সি-ভাঙার আওয়াজ এল!

দুজনে সে ঘরে গিয়ে ঢুকতে-না-ঢুকতেই আরও দুখানা সার্সির কাচ ভেঙে পড়ল!

পূর্ণবাবু বিবর্ণ মুখে বললেন, বিধু তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছে। আমার বাড়ি অবরোধ শুরু হল!

দারোগা বললেন, বাড়ির বাইরে থেকে কোনও কিছু ধরে কেউ উপরে উঠতে পারবে না তো?

টিকটিকি আর পাখি ছাড়া আর কেউ পারবে না।

দুমদাম, ঝনঝনাঝন, ঠকঠকাঠক! বড় বড় ঢিল বৃষ্টি হচ্ছে, কতকগুলো সার্সি ভাঙল, গুণে বলা দায়! অদৃশ্য মানুষকে দেখা যাচ্ছে না, বাড়ির ভিতরে ঢুকতে না পেরে সে ঢিল ছুঁড়েই মনের আক্রোশ মিটিয়ে নিচ্ছে!

পূর্ণবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, এখন কি করা যায় বলুন দেখি?

দারোগা বললেন, একটা উপায় আমার মনে হচ্ছে। আপনি কাল বললেন না যে, কুকুররা অদৃশ্য মানুষের গন্ধ পায়?

হ্যাঁ।

আমার তিনটে ডালকুত্তা আছে। বলেন তো নিয়ে আসি। তারা চোখে দেখতে না পেলেও ঠিক ওই দুরাত্মাকে ধরে ফেলবে!

কিন্তু বাইরে যাবেন কেমন করে? বিধু যে পথ আগলে আছে!

আপনার রিভলভারটা যদি দেন, তাহলে ঠিক আমি যেতে পারব। রিভলভারটা দেখলে ও বদমাইশ নিশ্চয়ই আমার কাছে আসবে না।

পূর্ণবাবু অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও রিভলভারটা দারোগার হাতে সমর্পণ করলেন। তারপর নীচে নেমে আচমকা সদর-দরজাটা খুলে দারোগাকে বার করে দিয়েই তখনি আবার দরজা বন্ধ করে দিলেন।

দারোগা পূর্ণবাবু বাড়ির ডানদিকের মাঠ দিয়ে সাবধানে চারিদিকে চোখ রেখে অগ্রসর হলেন।

হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর বললে, তুমি দাঁড়াও!

দারোগা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে রিভলভারটা মুঠোর ভিতরে চেপে ধরলেন।

কণ্ঠস্বর বললে, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

বুকের ধুকপুকুনি সামলে নিয়ে দারোগা মুখসাবাসি দেখিয়ে বললেন, সে খবরে তোমার দরকার কী?

পরমুহূর্তেই দারোগার নাকের উপরে যেন একটা পাঁচ সের ওজনের ঘুষি এসে পড়ল। ধপাস করে মাটির উপরে বসে পড়ে যখন তিনি চোখের সামনে রাশি রাশি সর্ষেফুল ফোঁটা দেখতে লাগলেন, তখন হঠাৎ কার অদৃশ্য হস্ত এসে তার হাত থেকে রিভলভারটা ছিনিয়ে নিলে!

কণ্ঠস্বর বললে, যাও, বাড়ির ভেতরে ফিরে যাও! নইলে–

দারোগা হতাশ ভাবে মুখ তুলে দেখলেন, যেন কোনও জাদুবিদ্যার বলেই শূন্যে একটা রিভলভার স্থির হয়ে আছে–তার নলচেটা তাঁরই দিকে ফেরানো!

কণ্ঠস্বর বললে, উঠে দাঁড়াও! আমার সঙ্গে কোনওরকম চালাকি খেলতে এসো না! মনে রেখো, তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ না, কিন্তু আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। সুড়সুড় করে ভালোমানুষটির মতন বাড়ির ভেতরে ফিরে যাও!

দারোগা বললেন, পূর্ণবাবু আর আমাকে দরজা খুলে দেবেন না।

কণ্ঠস্বর বললে, কিন্তু তোমাকে ফিরে যেতেই হবে! নইলে তুমি লোকজন ডেকে নিয়ে আসবে! তোমার সঙ্গে আমার কোনও ঝগড়া নেই, কিন্তু আমার কথা না শুনলে তোমাকে আমি বধ করতে বাধ্য হব।

দারোগা আচমকা এক লাফ মেরে রিভলভারটা অদৃশ্য হাত থেকে কেড়ে নিতে গেলেন– সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারের মুখ থেকে দপ করে বিদ্যুৎশিখা জ্বলে উঠল এবং পর মুহূর্তে দারোগার দেহ ঘুরে মাটির উপরে আছাড় খেয়ে পড়ে আড়ষ্ট হয়ে রইল।

দোতালার একটা জানলার পাল্লা ফাঁক করে পূর্ণবাবু সমস্ত দৃশ্যই দেখছিলেন। এবং ইতিমধ্যেই টেলিফোনে সাহায্যের জন্যে তিনি থানায় খবর দিয়েছিলেন। দারোগার পতনের পর রিভলভারটা সেখানেই শূন্যে দুলতে লাগল, এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে পূর্ণবাবু তাড়াতাড়ি নীচে নেমে গিয়ে দেখলেন, থানা থেকে চারজন পাহারাওয়ালা এসে হাজির হয়েছে। তিনি চট করে তাদের ভিতরে এনে আবার দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, তোমাদের দারোগা আর বেঁচে নেই। অদৃশ্য মানুষের হাতে রিভলভার আছে। খুব সাবধান!

বাড়ির পিছন দিকের একটা দরজার উপরে দুমদুম করে পদাঘাতের শব্দ হতে লাগল। খিড়কির সে দরজাটা তেমন মজবুত ছিল না–অদৃশ্য মানুষ বোধ হয় সেটা আবিষ্কার করে ফেলেছে।

পাহারাওয়ালাদের নিয়ে পূর্ণবাবু সেই দিকে ছুটলেন কিন্তু তার আগেই খিড়কির দরজার পলকা খিলটা সশব্দে ভেঙে গেল!

পূর্ণবাবু চিৎকার করে বললেন, অদৃশ্য মানুষ বাড়ির ভেতরে ঢুকল! মনে রেখো, তার হাতে রিভলভার আছে!

পাহারাওয়ালারা দুহাতে লাঠি ধরে এদিকে-ওদিকে লুকিয়ে একেবারে প্রস্তুত হয়ে রইল। উপর উপরি দু-বার রিভলভারের গর্জন শোনা গেল! কিন্তু তার আগেই পূর্ণবাবু তড়াক করে মস্ত লাফ মেরে একটা ঘরে ঢুকে পড়ে সে-যাত্রা প্রাণ রক্ষা করলেন।

অদৃশ্য মানুষকে দেখা গেল না বটে কিন্তু এটা দেখা গেল যে একটা চকচকে রিভলভার শূন্যপথে থেকে থেকে ক্রমেই এগিয়ে আসছে!

হঠাৎ একটা পাহারাওয়ালা গুপ্ত স্থান থেকে বেরিয়ে রিভলভারের পিছনদিকে প্রচণ্ড এক লগুড়াঘাত করলে। একটা যন্ত্রণাময় চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারটা ছিটকে তফাতে গিয়ে পড়ল! অদৃশ্য মানুষের হাতে আর রিভলভার নেই দেখে পূর্ণবাবু ও অন্য তিনজন পাহারাওয়ালাও আবার বাইরে বেরিয়ে এল।

যতক্ষণ অদৃশ্য মানুষের হাতে রিভলভারটা ছিল ততক্ষণ তবু তার একটা ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু এখন সে যে কোথায় আছে সে-রহস্য কিছুই বোঝা গেল না।

কিন্তু যে পাহারাওয়ালা তার হাতে লাঠি মেরেছিল, তাকে সে ক্ষমা করলে না। উঠানে এক কোণে একটা টুল ছিল, হঠাৎ সেখানা শূন্যে উঠে ঘুরতে ঘুরতে প্রথম পাহারাওয়ালার মাথার উপরে এসে পড়ল! বিকট চিৎকার করে সে প্রপাত ধরণীতলে হল!

তার পরেই পূর্ণবাবু সভয়ে দেখলেন, রিভলভারটা মাটির উপর থেকে আবার শূন্যে লাফিয়ে উঠল। চোখের নিমেষে বাকি পাহারাওয়ালারা আবার অদৃশ্য হল এবং পূর্ণবাবু এবারে খিড়কির দরজা দিয়ে একেবারে বাড়ির বাইরের দিকে দৌড় দিলেন! দুম করে রিভলভারের একটা শব্দ হল–কিন্তু সে গুলিও তাকে স্পর্শ করতে পারলে না!

পঞ্চদশ । অদৃশ্য মানুষ দৃশ্যমান হল

পূর্ণবাবু মাঠের উপর দিয়ে ছুটছেন ঝড়ের মতন বেগে! রিভলভারের লক্ষ্যকে ব্যর্থ করবার জন্যে তিনি সাপের মতন এঁকেবেঁকে ছুটতে লাগলেন। খানিক দূর গিয়ে মুখ ফিরিয়েই তিনি দেখতে পেলেন, সেই নাছোড়বান্দা রিভলভারটা তখনও বেগে তার অনুসরণ করছে।

সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! ছুটন্ত মানুষ ও তার পিছনে শূন্যপথে উড়ন্ত রিভলভার! বাজারের একখানা ছবিতে দেখা যায়, ভীত পরশুরামের পিছনে বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র শূন্য-পথে তেড়ে আসছে। এ-দৃশ্যও অনেকটা সেইরকম!

রিভলভার আরও দুবার অগ্নিময় ধমক দিলে, কিন্তু তাও ব্যর্থ হল! অদৃশ্য মানুষ নিশ্চয়ই রিভলভার ছোঁড়ায় অভ্যস্ত ছিল না, তাই এবারের মতো পূর্ণবাবু কোনও গতিকে প্রাণে বেঁচে গেলেন! কিন্তু তবু সে পূর্ণবাবুর পিছু ছাড়লে, খালি-রিভলভারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাঁকে ধরবার জন্যে আরও জোরে অদৃশ্য পা দুটো চালিয়ে দিলে।

.

আমাদের ডাক্তার মানিকবাবু সেদিন পথের ধারে একটা পুকুর-ঘাটে বসে নিজের মনে মাছ ধরছিলেন। মানিকবাবুর জীবনে এই একটি মাত্র শখ আছে। আর তার এশখ এমন দুর্দান্ত যে, তিনি শীত গ্রীষ্ম মানতেন না, যে-কোনও পুকুর-ঘাটে গিয়ে ছিপ নিয়ে বসে পড়তেন। কিন্তু এমন একজন অকৃত্রিম মাছ-শিকারির উপরে মাছের দল মোটেই সদয় ছিল না–ঘাটের উপরে তাকে দেখলেই তারা যেন তার ছিপকে বয়কট করত। কিন্তু সেজন্যে মানিকবাবুর উৎসাহ কিছুমাত্র কমে না! কেউ ঠাট্টা করলে উলটে বলেন, ওহে, মাছ ধরতে গেলেই যে মাছ ধরতে হবে, এর কিছু মনে আছে? তোমরা তো রোজ কতরকম মন্ত্র পড়ে ভগবানকে ডাকো, কিন্তু ভগবান তোমাদের দেখা দেন কি? এমন অকাট্য যুক্তির উপরে কারুর আর কোনও কথা বলবার থাকত না।

মানিকবাবু একমনে মাছ ধরছেন–অর্থাৎ ধরবার চেষ্টা করছেন, এমন সময়ে দ্রুত পদশব্দ শুনে মানিকবাবু মুখ তুলে দেখলেন, ভয়-ব্যাকুল পূর্ণবাবু পথের উপর দিয়ে তিরবেগে ছুটে চলেছেন এবং ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলছেন, অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য মানুষ!

পুকুর-ঘাটে বসে মানিকবাবুর আর বেশি কিছু শোনবার দরকার হল না। তখন জলের মাছ ডাঙায় না তুলে, অদ্ভুত একটা ডিগবাজি খেয়ে ডাঙার মানুষ মানিকবাবু ঝপ করে একেবারে জলের ভিতরে প্রবেশ করলেন।

মাছেরা সেদিন কি ভাবলে জানি না। হয়তো তারা ভাবলে, ডাঙায় বসে রোজ বিফল হয়ে মানিকবাবু রাগ করে আজ তাদের ধরবার জন্যেই জলের ভিতরে ঝাঁপ দিয়েছেন!

মাছেরা কি ভাবলে আর না ভাবলে সেটা ভাববার অবসর মানিকবাবুর মোটেই রইল না। কারণ তিনি সাঁতার জানতেন না। জলের ভিতরে প্রবেশ করেই সে কথাটা তার মনে পড়ল। ভুড়ি ভরে জল খেতে খেতে একখানা নিরেট জগদ্দল পাথরের মতো ক্রমেই তিনি নীচের দিকে নামতে লাগলেন। তারপরেই হঠাৎ তার মনে হল, জলের ভিতরে এত নীচে নামা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পাগলের মতন দুবার হাত-পা ছুঁড়তেই তার দেহটা আবার উপর দিকে উঠতে লাগল।

পুকুরের ধারে একটা মস্ত বটগাছ জলের ভিতরে অনেকগুলো ঝুরি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েছিল– জলে ঝুরি ঝুলিয়ে সেও যেন মাছ ধরবার চেষ্টা করছে! ভাগ্যে মানিকবাবুর দেহটা ঠিক সেইখানেই ভস করে ভেসে উঠল, তাই বটের ঝুরি ধরে সে-যাত্রা মানে মানে তিনি তার পৈতৃক প্রাণটি রক্ষা করলেন।

মানিকবাবু নিজের মনে বললেন, বাপ! যে জলটা, আজ খেয়েছি, এ জীবনে বোধ হয় আর জল-তেষ্টা পাবে না! অদৃশ্য মানুষের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে শেষটা আজ আত্মহত্যা করেছিলুম আর কি!…কিন্তু পূর্ণবাবুর কি হল?

মানিকবাবু ভয়েভয়ে চারিদিক তাকিয়ে দেখলেন, কিন্তু পূর্ণবাবুর কোনও পাত্তাই পাওয়া গেল না!

কিন্তু ওদিকে ইতিমধ্যেই পাশা উলটে গেছে!

পূর্ণবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাহারাওয়ালারা থানায় গিয়ে খবর দিয়েছে এবং সেখান থেকে দলে-দলে সেপাই পূর্ণর্বাবুকে রক্ষা করবার জন্যে ছুটে এসেছে।

এখন পালাবার পালা হচ্ছে অদৃশ্য মানুষের।

কিন্তু পাছে সে আবার ফাঁকি দেয় সেই ভয়ে পূর্ণবাবু সেপাইদের ডেকে চেঁচিয়ে বললেন, শিগগির! হাতধরাধরি করে সবাই গোল হয়ে দাঁড়াও! অদৃশ্য মানুষ এর মধ্যেই আছে!

সকলে তাড়াতাড়ি পূর্ণবাবুর কথামতো কাজ করলে।

পূর্ণবাবু আবার বললেন, সবাই ধীরে-ধীরে এগিয়ে এসে চক্রটাকে ছোট করে আনন। তাহলে অদৃশ্য মানুষ আর পালাতে পারবে না! তার কথা শেষ হতে না হতেই বিপুল বিক্রমে অদৃশ্য মানুষ আগে তাকেই আক্রমণ করলে! এবারে পূর্ণর্বাবুও তাকে ছাড়লেন না, তার অদৃশ্য দেহটাকে তিনি দুই হাতে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরলেন! তার পর দুজনে জড়াজড়ি করে পথের উপরে গিয়ে পড়লেন।

সেপাইরা সবাই ছুটে এল হাত দিয়ে অনুভব করে সকলে মিলে অদৃশ্য মানুষের মাথা, গলা, বুক, বাহু, কোমর, জানু ও পা সজোরে চেপে ধরলে!

অদৃশ্য মানুষ একবার যন্ত্রণা-বিকৃত বদ্ধ স্বরে চিৎকার করে উঠল, উঃ! গেলুম!– তারপরে তার সমস্ত দেহ একেবারে স্থির হয়ে গেল।

পূর্ণবাবু বলে উঠলেন, ওকে ছেড়ে সরে দাঁড়াও! ও আহত হয়েছে–আর পালাতে পারবে না!

সেপাইরা কেউ কেউ বললে, বদমাইশটা দুষ্টুমি করে চুপ করে আছে, ছেড়ে দিলেই পালাবে!

পূর্ণবাবুর ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছিল, তার শরীরেও নানা জায়গায় কাটাকুটির দাগ! সেই অবস্থাতে তিনি উঠে অদৃশ্য মানুষের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আন্দাজে তার বুকের উপরে হাত দিয়ে বললেন, না, বিধু আর পালাতে পারবে না! এর হৃৎপিণ্ড স্থির হয়ে গেছে! এ আর বেঁচে নেই!

তখন শ্রীপুর শহরের সমস্ত লোক সেইখানে এসে জড়ো হয়েছিল। সকলেরই মুখে বিস্ময় ও আতঙ্ক! সকলেই নানারকম কথা বলে চ্যাঁচামেচি করছে!

একটা বুড়ি ভিড়ের ভিতর হুমড়ি খেয়ে পড়ে অদৃশ্য মানুষকে দেখবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ সে ভীত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, আমি ওকে দেখতে পেয়েছি, আমি ওকে দেখতে পেয়েছি!

বুড়ির কথা শুনে পূর্ণর্বাবুও সচকিত দৃষ্টিতে দেখলেন, পথের ধুলোর উপরে কাচের মতন স্বচ্ছ একখানা মানুষের হাত ক্রমেই বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দেখতে দেখতে তার স্বচ্ছতা দূর হয়ে গেল, তখন তাকে দেখাতে লাগল ঠিক যেন ঘষা কাচের একখানা হাতের মতো।

একটা সেপাই বলে উঠল, আরে, আরে ওর পা-দুটোও যে দেখা যাচ্ছে!

দেখতে-দেখতে সকলের স্তম্ভিত চক্ষের সামনে অদৃশ্য মানুষের সমস্ত দেহটাই মায়াময় ছায়ার মতন ফুটে উঠল! তারপর ধীরে ধীরে সেই ছায়াটা ক্রমেই ঘন ও নিরেট হয়ে উঠল। তারপর অদৃশ্য মানুষ যখন স্পষ্ট রূপে দৃশ্যমান হল, তখন সে রক্তমাংসের সম্পূর্ণ গঠন ফিরে পেয়েছে।

যে ওষধির প্রক্রিয়ায় তার জীবন্ত দেহ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, মরণ সেই ওষধির গুণ নষ্ট করে তার রক্ত-মাংসে গড়া দেহকে পৃথিবীর ধূলায় আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেল!

পথের উপরে শুয়ে আছে একটি তিরিশ বছর বয়সের যুবা পুরুষ–তার সমস্ত দেহে আঘাতের দাগ এবং তার মুখে-চোখে নিরাশা ও ক্রোধের চিহ্ন!

পূর্ণবাবু দুই হাতে মুখ ঢাকা দিয়ে বলে উঠলেন, ওর মুখে কাপড় ঢাকা দাও–দোহাই তোমাদের! ওর মুখে কাপড় ঢাকা দাও!

পৃথিবীতে প্রথম যে মানুষ অপূর্ব বুদ্ধি ও জ্ঞানের প্রসাদে রক্ত-মাংসে গড়া নিরেট দেহকে অদৃশ্য করবার অদ্ভুত উপায় আবিষ্কার করেছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে এমনি শোচনীয় ভাবে সে তার ভারবহ, ভীষণ জীবন সমাপ্ত করলে।

ষোড়শ । উপসংহার

বাবু বংশীবদন বসুকে তোমরা নিশ্চয়ই কেউ ভোলেনি।

তোমাদের কারুর যদি তার সঙ্গে দেখা করবার সাধ হয়, তাহলে চুপিচুপি পা টিপে টিপে আমার সঙ্গে এসো। গোলমাল করলে তার দেখা পাবে না, কারণ তোমরা যে তাকে আগে থাকতে চেনেনা একথা টের পেলেই তিনি তাড়াতাড়ি পালিয়ে যেতে পারেন।

শ্রীপুরের পান্থনিবাস হোটেলে আমার সঙ্গে এসো। ওই দেখো, হোটেলের হল-ঘরের মাঝখানে, একখানা ইজিচেয়ারের উপরে পরম আয়েসে বসে বংশীবাবু কেমন মিষ্টি মিষ্টি হাসি হাসছেন! বংশীবাবু এখন দাঁতব্য জুতো ও ময়লা জামা-কাপড়কে অত্যন্ত ঘৃণা করেন। তাঁর মাথায় এখন চমৎকার টেরি কাটা গায়ে ইস্ত্রি করা সিল্কের পাঞ্জাবি পরনে কেঁচানো শান্তিপুরি ধুতি ও পায়ে বার্নিশ করা চকচকে জুতো! আর, তোমরা শুনলে বোধ হয় অবাক হয়ে যাবে যে, এতবড় পান্থনিবাস হোটেলটির একমাত্র মালিক হচ্ছেন, এখন কেবল তিনিই! পান্থনিবাসের এখন এমন পসার যে, শ্রীপুরের কোনও লোক স্বাস্থ্যনিবাসের নাম আর মুখেও আনে না।

এজন্যে বংশীবাবু বড়ই খুশি। যখন-তখন একগাল হেসে মাথা নেড়ে বলেন, হুঁ হুঁ বাবা, ঘুঘু দেখেছ ফঁদ তো দেখোনি! আমার ময়লা জামাকাপড় আর ছেঁড়া জুতো দেখে মিস্টার দাস ভারি তাচ্ছিল্য করেছিলেন। এখন বোধ হয় তিনি বংশীবদনের মহিমা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন!

তার হোটেলে বসে কেউ অদৃশ্য মানুষের নিন্দা করলে তিনি মুখভার করে বলেন, ওগো, তোমরা সবাই থামো! আমি গুরু-নিন্দা শুনব না! তোমরা যাঁকে অদৃশ্য মানুষ বলছ, তিনি ছিলেন আমার গুরুদেব! তার আশীর্বাদেই আজ আমার এত বাড়-বাড়ন্ত! বংশীবাবুর গুরুভক্তি দেখে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নাই। অদৃশ্য মানুষের হুকুমে শ্রীপুর ব্যাঙ্ক থেকে নোটপ্রজাপতিগুলো ফরফর করে উড়ে গিয়ে বংশীবাবুর পকেটে যে বাসা বেঁধেছিল, একথা কেউ না জানুক, তোমরা সকলে নিশ্চয় জানেনা। অতএব এসো, আমরাও সবাই মিলে বংশীবাবুর গুরুজির জয় দিয়ে পালা সাঙ্গ করি!

 

অমানুষিক মানুষ (উপন্যাস)

প্রথম। শিকারির স্বর্গে

কলের গাড়ি, কলের জাহাজ, উড়োজাহাজ আর হাওয়াগাড়ির দৌলতে দুনিয়ার কোনও দেশই আজ আর অজানা নয়। ভূগোল সারা পৃথিবীর কোনও দেশের কথাই বলতে বাকি রাখেনি। পৃথিবীর বাইরে মঙ্গল প্রভৃতি গ্রহেরও মানুষ জীব আবিষ্কার করেছে। পণ্ডিতদের বিশ্বাস, ত্রিভুবন আজ তাদের নখদর্পণে।

পণ্ডিতদের বিশ্বাসকে অবহেলা করছি না। কিন্তু তবু আমি বিশ্বাস করি যে, পণ্ডিতদের জ্ঞানরাজ্যের বাইরে এমনও এমন সব অজানা, অচেনা দেশ আছে, ভূগোলে যার কথা লেখা হয়নি। এ কথার উত্তরে ইস্কুলের মাস্টারমশাইরা হয়তো আমাকে রুখে বকতে আসবেন কিন্তু তার আগেই তারা যদি দয়া করে আমার এই আশ্চর্য ইতিহাস শোনেন, তাহলে অত্যন্ত বাধিত হব। মুখের কথায় সত্যকে অস্বীকার করলেও, উড়িয়ে দেওয়া চলে না।

লোকে বাঙালিকে কুনো বলে। আমার মতে, বাঙালি সাধ করে কুনো হয়নি, কুনো হয়েছে বাধ্য হয়ে। ভারতবর্ষের আর সব জাতি পেটের ধান্দায় যত সহজে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, বাঙালিরা তা পারে না কেন? বাঙালির আত্মসম্মান জ্ঞান বেশি বলে। উড়িয়ারা বিদেশে গিয়ে পালকি বইতে বা মালি কি বেয়ারা হতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। মাড়োয়ারিরা কলকাতায় এসে মাথায় ঘিয়ের মটকা, খাবারের থালা বা কাপড়ের মোট নিয়ে পথে-পথে ফিরি করতে লজ্জা পায় না। ভারতের আরও অনেক বড় জাতির লোকেরা ফিজি দ্বীপে, আফ্রিকায় বা দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়ে অম্লানবদলে কুলিগিরি করে। এইখানে বাঙালির বাধে। ছোট কাজে সে নারাজ। অন্য জাতের লোকেরা পরে বড় হবার জন্যে আগে ছোট হতে অস্বীকার করে না, কিন্তু বাঙালি বড় হবার লোভেও বিদেশিদের কাছে সহজে মাথা নীচু করতে চায় না। ফিরিওয়ালা হব? কুলিগিরি করব? রামচন্দ্র! এই হল বাঙালিজাতের মনের ভাব। মান বাঁচিয়ে বাঙালি কুনো অপবাদও সইতে রাজি।

তাই আফ্রিকার অনেক জায়গায় গিয়ে ভারতের নানাদেশি লোকদের মধ্যে যখন বাঙালির সংখ্যা দেখলুম খুবই কম, বিশেষ বিস্মিত হলুম না। ভারত থেকে এখানে যারা এসেছে, তাদের অধিকাংশই ভদ্রলোকের কাজ করে না। বাঙালিরা তাদের দলে ভিড়তে চাইবে কেন?

আমিও বাঙালি হয়ে আফ্রিকার কেন গিয়েছি, একথা তোমরা জিজ্ঞাসা করতে পারো। কিন্তু আমার জবাব শুনলে বোধকরি একটু আশ্চর্য হবে। কারণ, আফ্রিকায় চাকরি, কুলিগিরি বা দোকানদারি করতে যাইনি,–আমি গিয়েছিলুম শিকার করতে।

ভারি আমার শিকারের শখ! অর্থও আছে, অবসরও আছে, কাজেই ভালো করেই শখ মিটিয়ে নিচ্ছি। ভারতের বনেজঙ্গলে যতরকম পশু আছে, তাদের কোনও নমুনাই সংগ্রহ করতে বাকি রাখিনি। এবারে হিপোপটেমাস, গরিলা আর সিংহেরা আমার বন্দুকের সামনে আত্মদান করে ধন্য হতে চায় কি না, তাই জানবার আগ্রহেই আফ্রিকায় আমার শুভাগমন হয়েছে।

বাংলাদেশ তার বাঘ, হাতি, গোখরো সাপ ও অন্যান্য হিংস্র জন্তুর জন্যে কম বিখ্যাত নয়। পৃথিবীর সব দেশের শিকারির কাছেই আমাদের সুন্দরবন হচ্ছে স্বর্গের মতো। সুন্দরবনের ভিতরে আমিও আমার জীবনের অনেকগুলো দিন কাটিয়ে দিয়েছি সুন্দর ভাবেই। তার অগণ্য জলাভূমি, অসংখ্য নদ-নদী, স্নিগ্ধশ্যাম বনভূমি, নির্জন বালুদ্বীপ, বিজনতার মাধুর্য ও সোঁদা মাটির সুগন্ধ এ জীবনে কোনওকালে ভুলতে পারব না। সেখানে জলের কুমির গাছের অজগরকে দেখতে পেয়ে বিফল আক্রোশে ল্যাজ আছড়ায়, সেখানে নলখাগড়ার বনে-বনে হলদে কালো ডোরা কাটা বিদ্যুতের মতো রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছুটোছুটি করে, সেখানে সঁতসেঁতে মাটি থেকে বিষাক্ত বাষ্প বা কুয়াশা পুঁদরি গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠে আকাশকে আচ্ছন্ন করে দেয়! সুন্দরবনের ভিতরে আসতে না পারলে যে-কোনও শিকারিই তার জীবন ব্যর্থ হল বলে মনে করে।

কিন্তু আফ্রিকার বিপুল অরণ্যও হচ্ছে শিকারির পক্ষে আর-এক বিরাট স্বর্গ। সুন্দরবন তার কাছে কত ক্ষুদ্র! পশুরাজ সিংহ, হস্তি, গন্ডার, হিপো, জিরাফ, জেব্রা, চিতা, লেপার্ড, প্যান্থার, গরিলা, বেবুন, শিম্পাঞ্জি, ম্যানড্রিল, বরাহ, নু, উট, উটপাখি, ওকাপি, বনমহিষ, নানাজাতের হরিণ, বানর ও কুমির-আফ্রিকাকে বিশেষ করে মস্ত এক পশুশালা বললেই হয়, এত পশু পৃথিবীর আর কোথাও একত্রে পাওয়া যাবে না।

আফ্রিকার যে তিনটি জীবের সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে আমার সবচেয়ে বেশি ঝোঁক, তারা হচ্ছে–গরিলা, সিংহ ও হিপোপটেমাস।

সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আজকাল আফ্রিকার অত্যন্ত গভীর অরণ্যও মানুষের পক্ষে সুগম হয়েছে। বনের ভিতর দিয়ে ভালো ভালো পথ ও তাদের ওপর দিয়ে ছুটছে বড় বড় মোটরগাড়ি। আগে তিন বছরেও আফ্রিকায় যতটা দেখা যেত না, এখন তার চেয়ে বেশি দেখতে গেলেও তিন মাসেই কুলিয়ে যায়। পদে-পদে যে অজানা বিপদের আনন্দে আগেকার শিকারিদের জীবন হয়ে উঠত বিচিত্র, স্থলে মোটরের ও জলে কলের নৌকোর আবির্ভাবে সে। আনন্দ আজ অনেকটা কমে গেছে। আজকাল কেউ কেউ আবার উড়োজাহাজে চড়েও আফ্রিকায় যান শিকারি বলে নাম কেনবার জন্যে। এতে যে শিকারের কী আমোদ আছে, সেটা তাঁরাই জানেন! তার চেয়ে তারা তো পশুশালায় গিয়েও বাঘ, সিংহ, গন্ডার মেরে আসতে পারেন। বিপদহীন শিকার, শিকার নামেরই যোগ্য নয়!

কিন্তু কঙ্গো-প্রদেশের কাবেল নামক জায়গায় এসে এ যুগেও আর মোটরগাড়ির যাত্রী হওয়া যায় না। এখান থেকে আমি কাফ্রি কুলিদের মাথায় চাপিয়ে, পায়ে হেঁটে কঙ্গোর ভিতর দিকে প্রবেশ করলুম-বেশ কিছুকালের জন্যে সভ্যতার কাছে বিদায় নিয়ে। গরিলা বা হিপো বা সিংহের কবলে পড়ে এ বিদায়–চিরবিদায় হবারও সম্ভাবনা আছে।

যাত্রাপথে পড়ল বুনিয়নি হ্রদ। এ যে কী সুন্দর হ্রদ, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। টলটলে নীল জল, ধারে-ধারে জলের ভিতর জেগে উঠছে শরবন। নীল জলের পটে জীবন্ত আঁকা-ছবির মতো বড় বড় পদ্ম, তাদের গায়ে মাখানো লালাভ ল্যাভেন্ডারের রং। তেমন বড় পদ্ম ভারতে ফোটে না–আকারে তাদের প্রত্যেক মৃণাল দশ ফুটের কম হবে না এবং তা নারকেল দড়ির মতো শক্ত! হ্রদের তীর থেকে উঠেছে তৃণশ্যামল উচ্চভূমি, ইউফোর্বিয়ায় খচিত।

বাংলাদেশের অরণ্য সুন্দর বটে, কিন্তু এমন বিচিত্র নয়। এখানে বনের সঙ্গে সঙ্গে আছে পাহাড়, উপত্যকা, ঝরনা ও হ্রদ, সুন্দরবনে যা নেই। প্রতি পদেই নতুন-নতুন দৃশ্য এবং নতুন-নতুন বিস্ময়। দিনের পর দিন বনের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি, কিন্তু নতুনত্বের পর নতুনত্বের আবির্ভাবে মনের মধ্যে এতটুকু শ্রান্তি আসছে না।

কিন্তু এখানকার সমস্ত সৌন্দর্যের সঙ্গে মেশানো আছে যেন কোনও অভাবিত বিপদের অপচ্ছায়া! মধুর রূপ দেখলেও এখানে কবিত্ব উপভোগ করতে হয় পরম সাবধানে, কবিত্বে বিহ্বল বা একটু অন্যমনস্ক হলেই সর্বনাশের সম্ভাবনা!

একদিন সন্ধ্যার সময়ে একটা নদীর ধারে আমরা তাঁবু ফেললুম। একে সারাদিনের পরিশ্রমে অত্যন্ত শ্রান্ত হয়েছি, তায় সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, তাই কোন জায়গায় তবু ফেলা হল সেটা আর লক্ষ করবার অবসর ও উৎসাহ হল না। কিন্তু এইটুকু অসাবধানতার জন্যেই সেদিন যে অঘটন ঘটল, তা ভাবতে আজও আমার গা শিউরে ওঠে।

রাত্রে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়ে ক্যাম্পখাটে শুয়ে পড়লুম এবং ঘুম আসতে বিলম্ব হল না। জীবনের অধিকাংশই আমার কেটে গিয়েছে পথে-বিপথে, তাই যেখানে সেখানে খুশি আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারতুম।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম জানি না, কিন্তু এতটুকু মনে আছে, কী যেন একটা সুখস্বপ্ন দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল!

ঘুমের ঘোর ভালো করে কাটতে না কাটতে শুনলুম, তাবুর বাইরে বিষম একটা হট্টগোল ও হুটোপুটির শব্দ!

ঘুমের ঘোর যখন একেবারে কাটল, সমস্ত গোলমাল তখন থেমে গেছে। তাঁবুর ভিতর ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। বসে-বসে ভাবতে লাগলুম, গোলমালটা শুনলুম কি স্বপ্নে?

কিন্তু তারপর যা হল সেটা স্বপ্ন নয় নিশ্চয়ই! আমার ডানদিক থেকে খুব জোরে ভেঁস করে একটা আওয়াজ হল!

তাড়াতাড়ি টর্চটা তুলে নিয়ে জ্বেলেই দেখি, তাবুর কাপড়ের দেওয়াল দুলছে!

ঠিক সেই সময়ে আমার বাঁ-দিক থেকেও তেমনি ভেঁস করে একটা বেজায় শব্দ উঠল– সঙ্গে সঙ্গে সেদিকেও তাবুর গা দুলতে লাগল।

ব্যাপার কী? এ কীসের শব্দ? তবু এমন দোলে কেন?

হতভম্ব হয়ে ভাবছি, এমন সময়ে দুই দিক থেকেই আবার দুই-তিন বার তেমনি শব্দ হল ও তাঁবু ঘন ঘন কাঁপতে লাগল।

তখনই রাইফেলটা তুলে নিলুম। বাইরে ও কারা এসেছে? এমন শব্দ করে কেন? কী চায় ওরা?

পরমুহূর্তে কী যে হল কিছুই বুঝতে পারলুম না–আচম্বিতে যেন ভূমিকম্প উপস্থিত, মাথার ওপরে যেন পাহাড় ভেঙে পড়ল! প্রচণ্ড এক ধাক্কায় আমি হাতকয় দূরে মাটির ওপরে ছিটকে পড়ে গেলুম।

অন্য কেউ হলে তখনই হয়তো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেত। কিন্তু বহুকাল আগে থেকেই বিপদের সঙ্গে আমার চেনাশোনা, বহুবারই সামনে দেখেছি সাক্ষাৎ মৃত্যুকে, তাই আহত ও আচ্ছন্ন অবস্থাতেই মাটির ওপরে পড়েই আবার সিধে হয়ে উঠে বসলুম।

অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় অবাক হয়ে দেখলুম, দুরে সাদা মতো প্রকাণ্ড কী একটা দুম দুম করে চলে যাচ্ছে অনেকগুলো পায়ের ভারে পৃথিবী কাঁপয়ে এবং কোথাও আমার তাঁবুর চিহ্নমাত্র নেই!

ফ্যালফ্যাল করে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চারদিকে তাকাতে লাগলুম, কিন্তু এপাশে-ওপাশে, সামনে-পিছনে–আমার তাঁবু নেই কোথাও!

অনেক কষ্টে উঠে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে কয়েক পা এগিয়ে দেখি, এক জায়গায় কতকগুলো ভাঙা কাঠ ও ছেঁড়া ন্যাকড়া পড়ে রয়েছে এবং পরীক্ষা করে বোঝা গেল, সেগুলো হচ্ছে আমারই ক্যাম্প খাটের ধ্বংসাবশেষ!

আমার সঙ্গে ছিল ত্রিশজন কুলি ও চাকরবাকর, কিন্তু তারাও যেন কোনও যাদুমন্ত্রে হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে মিলে গিয়েছে!

দূরে আবার অনেকগুলো ভারী-ভারী পায়ের শব্দ শুনলাম। ফিরে দেখি একদল বড় বড় জীব আমার দিকেই এগিয়ে আসছে!

ভাগ্যে কাছেই একটা প্রকাণ্ড গাছ ছিল, চটপট তার ওপরে উঠে বসলুম।

জীবগুলো আর কিছু নয়–একদল হিপো। তারা গদাইলশকরি চালে চলতে-চলতে যেখানে আমার তবু ছিল সেইখানে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপরে প্রত্যেকেই দুই একবার সেই ক্যাম্প খাটের ভগ্নাবশেষকে ভেঁস ভেঁস শব্দে শুঁকে পরীক্ষা করে, এদিকে ওদিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় এবং তারপর নদীর দিকে চলে যায়।

এতক্ষণে ব্যাপারটা স্পষ্ট হল।

বন্য পশুদের জলপান করতে যাবার জন্য এক একটা নির্দিষ্ট রাস্তা থাকে–প্রত্যহই তারা সেই চেনাপথ ব্যবহার করে। এটা হচ্ছে হিপোদের জলপান করতে যাবার রাস্তা।

অন্ধকারে ও তাড়াতাড়িতে না দেখে আমরা আস্তানা গেড়েছিলুম হিপোদের এই নিজস্ব রাস্তার উপরেই!

হিপোদের গায়ের জোর ও গোঁয়ারতুমি যেমন বেশি, বুদ্ধিশুদ্ধি তেমনি কম। দুটো হিপো আগে এই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পথের ওপরে তাঁবু দেখে বিস্মিত হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের দেখে পালায় আমার লোকজনরা। তখন তারা দুজনে দুদিক থেকে ভেঁস ভোঁস শব্দে আমার তবু শুঁকে হিপো-বুদ্ধিতে স্থির করে–এটা নিশ্চয়ই কোনও বিপজ্জনক বস্তু বা জন্তু, নইলে কাল এখানে ছিল না, আর আজ কোথা থেকে উড়ে এসে নদীর পথ জুড়ে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? অতএব মারো ওটাকে জোরসে এক টু!

কিন্তু ঢুঁ মারার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত তাঁবুটা যেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে তাদের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ধরলে, অমনি সমস্ত বীরত্ব ভুলে নাদাপেটা হাঁদারামরা তাঁবু ঘাড়ে করেই অন্ধের মতো দৌড়ে পলায়ন করেছে।

বনের ভিতরে আনাচেকানাচে এমনিধারা কত যে ধারণাতীত বিপদ সর্বদাই অপেক্ষা করে, তা বলবার কথা নয়! একবারমাত্র অসাবধান হলেই জীবনে আর কখনও সাবধান হবার সময় পাওয়া যাবে না।

পল গ্রেটেজ নামে একজন জার্মান সৈনিক আফ্রিকার মহিষ শিকার করতে গিয়ে কী ভয়াবহ বিপদে পড়েছিলেন, এখানে সে গল্প বললে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। মহিষ শিকারের কথা শুনে কেউ যেন অগ্রাহ্যের হাসি না হাসেন। কারণ বন্যমহিষ বড় সহজ জীব নয়, অনেক শিকারির মতে সিংহ ব্যাঘ্রের চেয়েও তারা হচ্ছে বেশি সাংঘাতিক! ঘটনাটি মেজর ডবলিউ রবার্ট ফোরানের Kill : Or Be Killed নামে শিকারের প্রসিদ্ধ পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে। এই সত্য গল্পটি গ্রেটেজ সাহেবের মুখেই শ্রবণ করুন, শিকারের এমন ভয়ানক কাহিনি দুর্লভঃ

আমি তখন রোডেশিয়ার বাংউয়েলো হ্রদে স্টিমারে করে যাচ্ছিলুম। আমার দলে ছিল ফরাসি আলোকশিল্পী অক্টেভ ফিয়ের, কাফ্রি পাঁচক জেমস ও আর চারজন দেশি চাকর।

সেদিন সকালে ডাঙায় নেমে আমরা প্রাতরাশ আহার করছি, হঠাৎ মুখ তুলে দেখেই বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলুম!

আমাদের কাছ থেকে হাত ত্রিশ তফাতেই তিনটে বন্যমহিষ স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তারা যে সে জীব নয়, এমন বিরাটদেহ মহিষ আমি জীবনে কখনও দেখিনি। তারা যে ছায়ার মতো নিঃশব্দে কখন সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা কেউই তা টের পাইনি!

দুই এক মুহূর্তের জন্যে আমরা সকলেই নীরব হয়ে রইলুম। এ নীরবতা যেন মৃত্যুরই অগ্রদূতজীবন ও পৃথিবী যখন শ্বাস রোধ করে থাকে!

পরমুহূর্তেই আমি আমার মসার রাইফেলটা তুলে নিলুম। এবং আমার দেখাদেখি ফিয়েরও তাই করলে। কারণ এই মহিষ তিনটে যদি আগে থাকতে হঠাৎ আক্রমণ করে তাহলে

আমাদের কারুরই আর রক্ষা নেই!

আমি বন্দুক ছুড়লুম–গাছের পাখিদের শশব্যস্ত করে আওয়াজ হল ধ্রুম! সবচেয়ে বড় মহিষটা ধপাস করে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় মাথা নাড়া দিলে, তারপর উঠেই ঝোপের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল, অন্য দুটোও ছুটল তার পিছনে-পিছনে।

খানিক পরে দেখা গেল, অন্য মহিষদুটো অনেক দূরে নদীর ধার দিয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছে। কিন্তু আহত বড় মহিষটার আর দেখা নেই।

কোথায় গেল সে? মারাত্মকরূপে জখম হয়ে সে কি ঝোপের ভিতরে কাত হয়ে পড়ে আছে?

মাটির ওপরে রক্তের দাগ ধরে আমরা খুব সহজেই তার অনুসরণে চললুম, কিন্তু তখন জানতুম না আমরা চলেছি স্বেচ্ছায় মরণের সন্ধানে।

তাকে ধরা সহজ হল না। আমরা চলেছি তো চলেছিই–সে সুদীর্ঘ রক্তের দাগের যেন শেষ নেই!

ছয় ঘণ্টা কেটে গেল, আমাদের শরীর একেবার কাবু হয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ আর বিশ্রাম না করলেই নয়। একটা গাছের ছায়ায় বসে জিরুতে লাগলুম।

সূর্য অস্ত যাবার কিছু আগে হঠাৎ একজন কুলি এসে খবর দিলে যে, খানিক তফাতেই একটা ঝোপের ভিতরে সেই আহত মহিষটা পড়ে পড়ে ধুকছে।

আমরা দুজনে তখনই সোৎসাহে উঠে সেইদিকে ছুটলুম।

কিন্তু সেই ঝোপের কাছে যাওয়া মাত্রই মহিষটা উঠে আগেই আমাদের আক্রমণ করলে। আমরা দুজনেই একসঙ্গে বন্দুক ছুড়লুম-মহিষটা আবার চোট খেলে। কিন্তু তবু থামল না!

তার পথ থেকে আমি সরে দাঁড়াতে গেলুম, কিন্তু দৈবগতিকে একটা গাছের শিকড়ে পা আটকে একেবারে ভূতলশায়ী হলুম।

মূর্তিমান যমদূতের মতো মহিষটা আমার ওপরে এসে পড়ল এবং আমাকে শিঙে করে টেনে তোলবার চেষ্টা করলে।

আমি কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে তার শিংদুটো দু-হাতে চেপে ধরলুম! আমার হাত ছাড়াবার জন্যে মহিষটা বিষম এক মাথা নাড়া দিলে এবং তার একটা শিং প্রবল বেগে আমার গালের ভিতরে ঢুকে গেল! ভীষণ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে আমি তার শিংদুটো ছেড়ে দিলুম এবং পরমুহূর্তে অনুভব করলুম সে আমাকে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে দূরে ফেলে দিলে! তারপরে কী হল আর আমি জানি না।

অনেকক্ষণ পরে জ্ঞানলাভ করে দেখলুম, কুলিরা আমাকে নদীর ধারে এনে শুইয়ে দিয়েছে। আমার সর্বাঙ্গে রক্তপ্রবাহ ও অসহ যাতনা। একজন ঠান্ডা জল ঢেলে আমার ক্ষত ধুইয়ে দিচ্ছে।

কোনওরকমে অস্ফুট স্বরে আমি বললুম, আমার বন্ধু কোথায়?

তাকে ধরাধরি করে এখানে নিয়ে আসা হচ্ছে। তিনি বাঁচবেন না।

মহিষটা?

মরে গেছে।

কাছেই নদীতে আমাদের মোটরবোট ভাসছিল।

আমি বললুম, শিগগির! ওষুধের বাক্সটা নিয়ে এসো! আমার মুখের ভিতর থেকে তখন হু হু করে রক্ত বেরিয়ে আসছে! আর–আর, সে কী ভয়ানক যাতনা।

ওষুধের বাক্স এল। একজন কুলি আমার মুখের সামনে আরশি ধরলে। নিজের মুখ নিজে দেখেই আতঙ্কে আমি শিউরে উঠলুম।

আমার ডান গালে এত বড় একটা ছাদা হয়েছে যে তার ভিতরে অনায়াসেই হাতের মুঠো ঢুকে যায়! নীচেকার ঠোঁটখানা ছিঁড়ে কাঁপতে কাঁপতে ঝুলছে। তলাকার চোয়াল দুই জায়গায় ফেটে ও ভেঙে গেছে কান আর ঠোঁটের কাছে। একখানা লম্বা ভাঙা হাড়ও বেরিয়ে ঝুলে আছে, তার ওপরে রয়েছে তিনটে দাঁত! তলাকার চোয়ালের সমস্ত মাংস একেবারে হাড় থেকে খুলে এসেছে। আমার জিভখানাও টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। যতবার থুতু ফেলেছি, ছোট বড় হাড়ের আর ভাঙা দাঁতের টুকরো ঝরে ঝরে পড়ছে!

সেই অবস্থায় যতটা সম্ভব, নিজের হাতে সুচ দিয়ে গাল ও হাড়ের মাংস সেলাই করতে লাগলুম। আজও আমি ভেবে উঠতে পারি না যে, কী করে আমি সেই অসাধ্য সাধন করেছিলুম। যন্ত্রণার ওপরে তেমন যন্ত্রণা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।

কোনও রকমে ব্যান্ডেজ বেঁধে ফিয়েরের কাছে গেলুম। তার অবস্থা একেবারেই মারাত্মক। তার দেহের তিন জায়গা শিঙের গুঁতোয় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বাঁ-দিকের বুকের সমস্ত মাংসপেশি ছিঁড়ে ঝলঝল করে ঝুলছে! তাকে নিয়েও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করলুম, কিন্তু সে বাঁচল না।

চার-পাঁচ দিন পরে অনেক দূর থেকে ডাক্তার আনা হল–এবং তারপরে আবার অস্ত্র চিকিৎসা–আবার নতুন নরকযন্ত্রণা! অনেকদিন ভুগে আমি বেঁচেছি বটে, কিন্তু আমার মুখ হয়েছে চিরকালের জন্যে ভীষণদর্শন!

আগেই যে মেজর ডবলিউ রবার্ট ফোরানের নাম করা হয়েছে, বন্যমহিষের ভীষণ বিক্রম সম্বন্ধে চিত্তোত্তেজক কাহিনি বলেছেন, এখানে সেটিও তুলে দিলুম। বলা বাহুল্য এটিও সত্য গল্প এবং এরও ঘটনাস্থল আফ্রিকা।

একদিন আমার কাফ্রি ভৃত্য হামিসির সঙ্গে আমি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ খানিক তফাত থেকে উত্তেজিত সিংহ ও মহিষের প্রচণ্ড গর্জন ও চিৎকার শুনতে পেলুম! সঙ্গে সঙ্গে ঘন ঘন লম্ফঝম্পের আওয়াজ!

বুঝলুম নেপথ্যে বিষম এক পশুনাট্যের অভিনয় চলছে, যা স্বচক্ষে দেখবার সুযোগ জীবনে একবারের বেশি আসে না! পা টিপে টিপে অগ্রসর হলুম, পিছনে-পিছনে এল হামিসি।

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে একটা ভোলা জমির ওপর এসে পড়লুম এবং তারপর যে দৃশ্য দেখলুম তা আমার নিজের অস্তিত্ব ভুলিয়ে দিলে–এমনকী আমার বন্দুকের কথাও আর মনে রইল না!

আমার চোখের সামনেই মস্ত একটা কেশরওয়ালা সিংহ এবং বিরাট একটা মহিষ মৃত্যু পণ করে বিষম এক যুদ্ধে নিযুক্ত হয়ে আছে! এ যুদ্ধ একজন না মরলে থামবে না। হায়রে, আমার সঙ্গে একটা ক্যামেরা যদি থাকত।

আমার এ পথে আসবার কত আগে থেকে এই মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে তা বুঝতে পারলুম না। তবে যুদ্ধ যে এখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে যোদ্ধাদের রক্তাক্ত দেহ দুটো দেখলেই সে প্রমাণ পাওয়া যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্থির নেত্রে তাকিয়ে রইলুম-কিন্তু কতক্ষণ তা জানি না, স্থান ও কালের কথা আমার মন থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

সিংহটা মহিষের কাঁধের ওপর রীতিমতো জাঁকিয়ে বসে আছে এবং মহিষ তার কাঁধ থেকে শত্রুকে ঝেড়ে ফেলবার যতরকম কৌশল জানে কিছুই অবলম্বন করতে ছাড়ছে না। সেই অবস্থাতেই সিংহ তার মাথার গোটাকয়েক প্রচণ্ড ঠু ও নিষ্ঠুর শিঙের গুঁতো খেলে, কিন্তু। তবু সে অটল।

অবশেষে মহিষটা এক ঝটকান মেরে সিংহটাকে মাটির ওপরে পেড়ে ফেললে এবং সে সামনে সরে যাবার আগেই তীক্ষ্ণ শিঙের এক গুঁতোয় শত্রুর দেহটা এ-ফেঁড় ও-ফেঁড় করে দিলে! তারপর সে কী ঝটপটি, কী গর্জন, চিৎকার! আকাশ বাতাস অরণ্য যেন থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমার মন স্তম্ভিত, আমার মেরুদণ্ড দিয়ে ছুটছে বিদ্যুৎপ্রবাহ!

কোনওরকমে পশুরাজ নিজেকে আবার শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করে নিয়ে সরে গিয়ে দাঁড়াল এবং সরে যাবার আগেই দাঁত ও থাবা দিয়ে মহিষের দেহের অবস্থা এমন শোচনীয় করে তুললে যে সে আর বলবার নয়! মহিষের দেহের মাংস ফালা ফালা হয়ে ঝুলতে লাগল। চতুর্দিকে রক্ত ঝরছে ও ধুলোর মেঘ উড়ছে! দুজনেই পরস্পরের দিকে মুখ ও তীক্ষ্ণদৃষ্টি রেখে মণ্ডলাকারে ঘুরছে আর ঘুরছে! প্রত্যেকেই পরস্পরের ওপরে আবার লাফিয়ে পড়বার জন্যে সুযোগ খুঁজছে! তাদের ঘোরা আর শেষ হয় না! তারা নিজেদের ক্ষত আর যন্ত্রণার কথা ভুলে গেল, নিশ্বাসে তাদের নাসারন্ধ্র স্ফীত, এবং মুখ করছে ক্রমাগত শোণিতবৃষ্টি!

আমি ভাবলুম, বিখ্যাত সিংহ বিক্ৰম এইবারে ঠান্ডা হয়েছে, পশুরাজ এখন ভালোয়। ভালোয় সরে পড়বার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমার ধারণা ভ্রান্ত! আচম্বিতে ঠিক বিদ্যুতের মতোই আশ্চর্য তীব্র গতিতে সিংহ আবার লাফ মেরে মহিষের স্কন্ধের ওপরে উঠে বসল।

আমি স্থির করলুম, আর রক্ষা নেই–এবারে মহিষেরই শেষ মুহূর্ত উপস্থিত! পশুরাজ অতঃপর তার ঘাড় কামড়ে ধরবে এবং থাবা দিয়ে তার মাথাটা চেপে ধরে ঘুরিয়ে মুচড়ে দেবে; তারপর ঘাড় ভাঙা মহিষের মৃতদেহ মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়বে! সিংহরা এই উপায়েই শিকারের পশুদের বধ করে।

মহিষ দুই হাঁটু গেড়ে ভূমিতলে বসে পড়ল এবং সেই অবস্থাতেই শত্রুকে আবার পিঠের ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। তারপর চমৎকার বুদ্ধি খাঁটিয়ে সে টপ করে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল এবং তার বিষম ভারী দেহ নিয়ে সিংহের গায়ের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল! তার দেহের চাপে জব্দ হয়ে সিংহ তাকে ছেড়ে দিতে পথ পেলে না! বুঝি তার ঘাড়টাই মটকে গেল।

কিন্তু সিংহ তখনও কাবু হয়নি! মহিষ দু-পায়ে ভর দিয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে সিংহ চড়ে বসল পুনর্বার তার কাঁধের উপরে! এবার সে একপাশ থেকে ঝুলে পড়ে শত্রুর দেহ চার থাবা দিয়ে জড়িয়ে ধরে ভীমবিক্রমে বারংবার দংশন করতে লাগল এবং মহিষটা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল কাতর স্বরে।

কিন্তু মহিষ তবু হার মানলে না! বারংবার গা-ঝাড়া দিয়েও যখন সে ছাড়ান পেলে, তখন সে শেষ উপায় অবলম্বন করলে। হঠাৎ শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে মহিষ উলটে চিত হয়ে মাটির ওপরে আছাড় খেয়ে পড়ল এবং তার বিপুল ও গুরুভার দেহের তলায় পশুরাজের দেহ গেল অদৃশ্য হয়ে!

মাটি তখন রক্তে রাঙা এবং সমস্ত জায়গাটার ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে! সিংহ ও মহিষ–কেউ আর নড়ছে না, যেন তারা কেউ আর বেঁচে নেই! আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম, পরিণামে কী হবে? একবার পিছন ফিরে হামিসির দিকে তাকালুম–তার মুখ দিয়ে বইছে দর-দর ধারে ঘামের ধারা, দুই স্থির চক্ষু বিস্ময়ে বিস্ফারিত, দুই ঠোঁট ফাঁক করা, যেন সে মায়ামন্ত্রে সম্মোহিত! আবার ঘটনাস্থলের দিকে দৃষ্টি ফেরালুম।

ধীরে ধীরে টলতে টলতে মহিষ আবার উঠে দাঁড়াল, এবং হেঁটমুখে শত্রুর দিকে দৃষ্টিপাত করলে!

সিংহের সর্বাঙ্গ তখন থেঁতলে তালগোল পাকিয়ে গেছে, কিন্তু তখনও সে মরেনি। মহিষ শিং নেড়ে আবার তাকে দুই-তিন বার গুতো মারলে, সঙ্গে-সঙ্গে পশুরাজের প্রাণ বেরিয়ে গেল!

যুদ্ধক্ষেত্র একেবারে স্তব্ধ; কাছের কোনও গাছে একটা পাখি পর্যন্ত ডাকছে না। আমি কেবল আমার দ্রুতচালিত হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পেলুম!

মহিষ তখন খুব জোরে জোরে নিশ্বাস টানছে এবং তার দেহ টলমল করে টলছে! সেই অবস্থায় বিজয়ী বীর মৃত্যুকে বরণ করলে! তার দেহ সশব্দে পরাজিত শত্রুর মৃতদেহের ওপরে লুটিয়ে পড়ল!

আমাদের তখন আর কথা বলবার শক্তিও ছিল না। অভিভূত প্রাণে বিজেতা ও বিজিতের দেহ সেই নির্জন অরণ্যের মধ্যে ফেলে রেখে আমরা দুজনে পায়ে পায়ে চলে এলুম।

পশুদেহ হলেও সম্মুখ যুদ্ধে মৃত সেই দেহ দুটিতে হাত দেওয়া অধর্ম!

.

দ্বিতীয়। রাতের অতিথি

সিংহের চেয়ে গরিলা বধ করবার জন্যেই আমার ঝোঁক ছিল বেশি! আফ্রিকার বনে-বনে সিংহের অভাব নেই, তাদের দলে দলে বধ করেছে এমন লোকও অসংখ্য। কিন্তু গরিলা হচ্ছে দুর্লভ জীব। পৃথিবীর খুব কম চিড়িয়াখানায় গরিলা দেখতে পাওয়া যায়। আফ্রিকাতেও গরিলার সংখ্যা খুব কম। তার ওপরে দৈহিক শক্তিতে ও মানসিক বুদ্ধিতে তারা পশুরাজ্যে অতুলনীয় বলে অধিকাংশ শিকারি তাদের কাছে ঘেঁষতেও ভরসা পায় না।

কিভুর অরণ্য হচ্ছে গরিলাদের রাজত্ব। আমি এখন সদলবলে এইখানেই এসে হাজির হয়েছি।

একটি ছোট খাত দিয়ে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে, স্থানীয় ভাষায় তাকে কানিয়ানামা গুফা বা মৃত্যু-খাত বলে ডাকা হয়। এর এমন ভয়ানক নাম কেন তা পরীক্ষা করবার সুযোগ পাইনি। এরই আশেপাশে রয়েছে প্রকাণ্ড বাঁশবন–এখানকার ভাষায় যাকে বলে রুগানো। এইখানেই সর্বপ্রথমে আমি গরিলার পদচিহ্ন দেখতে পেলুম।

কচি বাঁশের রসালো অঙ্কুর হচ্ছে গরিলার শখের খাবার। এখানে বন বলতে বুঝায় প্রধানত বাঁশের বন। মাইলের পর মাইল চলে গেছে কেবল বাঁশবনের পর বাঁশবন এবং তাদের ভিতর থেকে মেঘ-ছোঁয়া মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মিকেনো, কারিসিম্বি ও বাইশোক নামে তিনটি আগ্নেয়গিরি। ওই সব পাহাড়ের দুর্গম স্থানগুলিও বাঁশবনের অধিকারভুক্ত হয়েছে। সেখানে বাঁশের ঝাড় এত ঘন যে, গাছ না কেটে কিংবা হামাগুড়ি না দিয়ে তার ভিতরে ঢোকা বা নড়াচড়া করা যায় না। বাঁশবনের কাছে কাছে নীচে রয়েছে জলবিছুটি গাছ, লালাভ সাদা ফুসিয়া জাতীয় পুষ্পগুল্ম, অজস্র ফুলে ভরা দোপাটি গাছ, শ্বেতবর্ণ ভেরোনিকা গুল্ম এবং বেগুনি, হলদে ও আলতা রঙা রাশি রাশি অর্কিড!

এইসব বনে বেড়িয়ে বেড়ায় দলে দলে গরিলা, মহিষ ও হস্তি। চিতাবাঘ ও অন্যান্য হিংস্র জন্তুর অভাবও এখানে নেই। এক বনের কচি বাঁশ সাবাড় হয়ে গেলেই গরিলারা অন্য বনে গিয়ে আশ্রয় নেয়। মানুষের মতন অনেকটা দেখতে হলেও তারা মানুষের মতো সভ্য নয়, তাই উদর চিন্তায় তাদের ব্যতিব্যস্ত হতেও হয় না, খাবার কেনবার জন্যে পয়সা রোজগার করতেও হয় না! বনে গাছ আছে, ভেঙে খাও, নদীতে জল আছে, চুমুক দাও! তারপর গাছের ডাল পাতা ভেঙে নরম বিছানা তৈরি করো, এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিব্যি আরামে জোরসে নাক ডাকাও! গরিলারা কী সুখেই আছে!

কিভু-অরণ্যে দুরকম গাছ বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একরকম গাছের নাম দেশি ভাষায় মুসুঙ্গুরা। তার পাতাগুলি খুব ছোট এবং তাতে গোলাপের মতন দেখতে হলদে হলদে ফুল ফোটে। লম্বায় পঞ্চাশ-ষাট ফুট উঁচু হয়! আর একরকম গাছের নাম মুগেসী। তার পাতা আখরোট পাতার মতন এবং তার উচ্চতা একশো ফুট পর্যন্ত হয়। মার্চ ও এপ্রিল মাসে তাতে ম্যাজেন্টার আভা মাখানো বেগুনি রঙের থোলো থোলো ফুল ফোটে। পূর্বোক্ত দুই গাছের উপরেই সবুজ ও সোনালি রঙের শৈবালের বিছানা পেতে জেগে থাকে সব রঙিন ও বিচিত্র অর্কিডরা! এখানে আরও যে কতরকম বাহারি ফুল দেখলুম তা আর বলা যায় না! এ যেন ফুলের দেশ!

কিন্তু এই ফুলের দেশেই আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি কবিতার খাতা নিয়ে নয়, হত্যাকারী বন্দুক ঘাড়ে করে!

গরিলা শিকারের একটা মস্ত সুবিধা আছে। অনেক খুঁজে কষ্ট পেয়ে তবে সিংহ বা বাঘের পাত্তা মেলে। কিন্তু একবার গরিলাদের দেশে আসতে পারলে তাদের দর্শন পেতে বেশি দেরি হয় না, তার কারণ, তারা থাকে দলবদ্ধ হয়ে। একে তো তাদের প্রত্যেকের গায়ে অসুরের মতন জোর, সিংহও জোরে তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে কি না সন্দেহ, তার ওপরে তারা যখন দল বেঁধে থাকে, তখন হাতি পর্যন্ত গরিলাদের কাছে তুচ্ছ বলে গণ্য হয়। তারা নিজেদের এই প্রতাপ ভালো করেই জানে, তাই কোনও শত্রু বোকার মতন কাছে এসে উঁকিঝুঁকি মারলে সেটার দিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র করে না! সিংহ বা মানুষ দেখলে প্রথমে তারা অবহেলা প্রকাশ করে, কাছে এগিয়ে এলে মুখ খিঁচিয়ে দু-চার বার ধমক দেয়, কিন্তু যে শত্রু তাতেও সাবধান না হয়, তার কপাল বড় মন্দ! গরিলা চলে-ফেরে গদাইলশকরি চালে ধীরে ধীরে, এমনকী খুব বেশি বিপদে না পড়লে দৌড়োদৌড়ি করে শরীরকে সে ব্যস্ত করতে চায় না। এইসব কারণে গরিলার পিছু নেওয়া অনেকটা সহজ।

গরিলাদের সন্ধানে কিভু অরণ্যে এসে এক জাতের মানুষ দেখে অবাক হয়েছি। ইংরেজিতে এদের নাম পিগমি, আমি বালখিল্য বলতে চাই। পৃথিবীতে এই বালখিল্যদের চেয়ে ছোট আকারের মানুষ আর চোখে পড়ে না, মাথায় এরা আমার কোমরের চেয়ে উঁচু নয়। দূর থেকে এই বালখিল্যদের দেখলে মনে হয়, যেন একদল নয়-দশ বছরের ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে!

বাল্যখিল্যদের রং কুচকুচে কালো, চুল কোঁকড়া, নাক থ্যাবড়া, কোমরে খালি তেলেচোবানো একটুকরো ন্যাকড়া ঝোলে। ছোট চেহারা হলেও এদের দেহ খুব বলিষ্ঠ, সুদৃঢ় মাংসপেশিগুলো দেহের ওপরে ফুলে ফুলে ওঠে! এবং এরা পরম সাহসী। নিজেদের দেহের মতনই ছোট ছোট বর্শা নিয়ে এরা গভীর জঙ্গলে শিকার করতে ঢোকে ও বড় বড় বড় হাতি আর বন্যমহিষ বধ করে! শিকারই এদের একমাত্র জীবিকা। শাকসবজি, শিকড় খেয়েই এরা দিন কাটাতে পারে, যখন মাংস খাবার সাধ হয় তখন তিরধনুক বা বর্শা নিয়ে বনে গিয়ে শূকর বা হরিণ মেরে আনে। বালখিল্যরা আফ্রিকার অন্য কোনও বাসিন্দাদের সঙ্গে মেলামেশা করে না। সবুজ বনের ভিতরে নৃত্যশীল নদীর তীরে ছোট ছোট পাতার কুঁড়ে বানিয়ে পরম শান্তিতে তারা সরল জীবন কাটিয়ে দেয় এবং সভ্যতার কোনও ধারই ধারে না।

একদিন পথ চলতে-চলতে হঠাৎ দেখলুম, এক জায়গায় বড় বড় গাছের তলায় মাটির ওপরে পর পর অনেকগুলো বাসা সাজানো রয়েছে। গুনে দেখলুম, ত্রিশটা বাসা। লতা, ডাল ও শুকনো পাতা দিয়ে প্রত্যেকটি বাসা তৈরি।

জিজ্ঞাসা করাতে আমার কুলিদের সর্দার জানালে, এগুলো গরিলাদের বাসা।

আমি বললুম, শুনেছি গরিলারা এক বাসায় দুদিন শোয় না?

সে জানালে,–না, তবে তারা নিশ্চয়ই খুব কাছে আছে। কারণ ও বাসাগুলো টাটকা।

চারিদিকে তাকিয়ে দেখলুম। বাঁশবন ও অন্যান্য নানা জাতের গাছের স্নিগ্ধ ছায়া নরম ঘাসের বিছানার উপরে ঝিলমিল করছে। গাছের ডালে ডালে দাঁড়কাক, কাঠঠোকরা, ঘুঘু, মধুপায়ী সূর্যপাখি ও একরকম গীতকারী চড়াইপাখি বন-মর্মরের সঙ্গে নিজেদের কণ্ঠ মিশিয়ে দিয়ে মিশ্রসংগীত সৃষ্টি করেছে। উঁচু গাছের ঘন পাতার পর্দা সরিয়ে মাঝে-মাঝে মুখ বাড়িয়েই পালিয়ে যাচ্ছে সোনালি বানররা! একপাশ দিয়ে ছোট্ট একটি নদী রুপোর লহর দুলিয়ে এঁকেবেঁকে চোখের আড়ালে চলে গেছে।

সূর্য অস্ত যেতে দেরি নেই। দূর থেকে একটা শব্দ কানে এল কারা যেন মড়মড় করে গাছ ভাঙছে।

কুলির সর্দারের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলুম, কারা গাছ ভাঙছে?

গরিলারা।

আমি বললুম, তাহলে এইখানেই ছাউনি ফ্যালো। জায়গাটি আমার ভালো লাগছে। কাল আমরা গরিলা শিকারে যাব।

কিন্তু সেই রাত্রেই আমার জ্বর এল–পরদিন আর শিকারে যাওয়া হল না। পাঁচ দিন জ্বরে ভুগে উপোস করে এমন দুর্বল হয়ে পড়লুম যে, আরও দিন তিনেক সেইখানেই বিশ্রাম করতে হল।

ইতিমধ্যে এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল।

সেদিন সকালে সবে আমি পথ্য করেছি, শরীর বড় দুর্বল। সঙ্গে করে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থাবলি নিয়ে গিয়েছিলুম, মাঝে-মাঝে তার পাতা ওলটাই এবং মাঝে-মাঝে তাঁবুর বাইরে গিয়ে একখানা ক্যাম্পচেয়ার পেতে বসি। নদীর নাচ দেখি আর পাখিদের গান শুনি। এমনি ভাবে সারাদিন কাটল। সন্ধ্যার কিছু আগে একদল হাতি বনের ভিতরে মহা শোরগোল তুলে মড়মড়িয়ে গাছ ভাঙতে-ভাঙতে খানিক তফাত দিয়ে চলে গেল–তারা আমাদের দিকে চেয়েও দেখলে না। এসব দৃশ্য এখন আমার চোখেও সহজ হয়ে এসেছে। হাতির পাল কেন, বনের ভিতর দিয়ে যেতে-যেতে মাঝে-মাঝে দুরে সিংহদেরও খেলা করতে দেখেছি এবং তারাও আমাদের দিকে বিশেষ দৃষ্টিও দেয়নি বা আক্রমণ করতেও আসেনি।

সন্ধ্যার অন্ধকার যখন ঘনিয়ে এল, পাখিদের কনসার্ট ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে থেমে গেল। স্তব্ধ অরণ্যের অন্তঃপুর থেকে একটা চিতাবাঘের গলা জেগে উঠল। আমিও আস্তে আস্তে তাবুর ভিতরে এসে ঢুকলুম।

সেদিন গুরুপাক খাবার সইবে না বলে দু-টুকরো রুটি জেলি মাখিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়লুম।

আফ্রিকার বনের পাখিরা ভালো করে আলো ফোটবার আগেই এত বেশি চ্যাঁচামেচি শুরু করে যে, ভোর হতে না হতেই ঘুম ভেঙে গেল।

অত্যন্ত ক্ষুধাবোধ করলুম। চাকরবাকররা তখনও জাগেনি, কাজেই নিজেই উঠে কিঞ্চিৎ খাদ্যসংগ্রহের চেষ্টা করলুম।

প্রথমেই আবিষ্কার করলুম, আমার জেলির টিনটা টেবিলের ওপর থেকে অদৃশ্য হয়েছে। তারপর দেখলুম, কাল যে চারখানা রুটি আমি না খেয়েই শুয়ে পড়েছিলুম, টেবিলের ওপরে সেগুলোও নেই!

অত্যন্ত রাগ হল। নিশ্চয়ই কোনও চোর ও পেটুক কুলি কাল রাত্রে লুকিয়ে আমার তাবুর ভিতরে ঢুকেছিল ভেবে সর্দারকে ডাকলুম।

সব কথা শুনে সর্দার অন্যান্য কুলিদের আহ্বান করলে।

কিন্তু তাদের কেউ দোষ স্বীকার করলে না।

আমি ক্রুদ্ধ স্বরে বললুম, আচ্ছা, ভবিষ্যতে আমার তাঁবুর ভিতরে যদি কোনও চোরকে ধরতে পারি, তাহলে গুলি করে তাকে মেরে ফেলব!

সেদিন রাত্রে হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। ঘুমোবার সময়ে আমার বৃষ্টি ভারি মিষ্টি লাগে। পৃথিবী যখন ধারাজলে স্নান করছে, মাটি যখন কাদায় প্যাঁচ প্যাঁচ করছে এবং পথিকদের কাপড়চোপড় যখন ভিজে সঁাৎ সঁাৎ করছে, আমি যে তখন দিব্যি শুকনো ও উত্তপ্ত দেহে পরম আরামে বিছানায় শুয়ে আছি, এই পরিতৃপ্তির ভাবটুকু মনকে খুশি করে তোলে এবং চোখে তন্দ্রাসুখের আবেশ মাখিয়ে দেয়। গাছের পাতায় পাতায় বৃষ্টিবিন্দুর টুপুর টুপুর শব্দ শুনতে-শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়লুম।

পরদিন সকালে উঠে দেখা গেল, বিস্কুটের যে নতুন টিনটা সবে কাল সন্ধ্যায় ভোলা হয়েছিল, সেটা আর টেবিলের ওপরে নেই!

মন যে কীরকম খেপে গেল তা আর বলা যায় না। শহরে এমন খাবার চুরি হলে বিশেষ ভাবনা হয় না। কিন্তু সভ্যতা ও হাটবাজার থেকে এত দুরে এই গহন বনে যেখানে একটা মোহর দিলেও একখানা বিস্কুট কেনা যায় না, সেখানে নিত্য যদি এইভাবে খাবার চুরি যেতে থাকে তাহলে দু-দিন পরেই আমাকে যে পাততাড়ি গুটিয়ে মানে এখান থেকে সরে পড়তে হবে।

তাঁবুর বাইরে গিয়ে দাঁড়ালুম। সঙ্গে সঙ্গে চোখ পড়ল মাটির উপরে। কাল রাত্রে বৃষ্টি পড়ে তাবুর দরজার সামনেকার মাটি নরম করে দিয়েছে এবং সেইখানে কতকগুলো স্পষ্ট পায়ের দাগ। সে পদচিহ্ন মানুষের।

সেদিনও আগে সর্দারকে ডেকে চুরির কথা বললুম ও পায়ের দাগগুলো দেখালুম।

সর্দার খানিকক্ষণ ধরে দাগগুলো পরীক্ষা করলে। আফ্রিকায় বনে-বনে ঘোরা যাদের ব্যবসা, ভূমিতলে পদচিহ্ন দেখে ভালো ডিটেকটিভের মতন তারাও যে অনেক তথ্য আবিষ্কার করতে পারে, এ আমি জানতুম। সুতরাং এই পদচিহ্নগুলো দেখে সর্দার কী বলে তা শোনবার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলুম।

সর্দার হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে-ঘুরে দাগগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। লক্ষ করলুম, তার মুখে-চোখে বিস্ময়ের আভাস ফুটে উঠেছে! সর্দারের পরীক্ষা যখন শেষ হল তার মুখ তখন গম্ভীর।

কী সর্দার, ব্যাপার কী?

সর্দার হতাশভাবে কেবল দুবার মাথা নাড়লে।

কিছু বুঝতে পারলে না? কিন্তু আমি বলছি, এগুলো মানুষের পায়ের দাগ। আর এ দাগগুলো যার পায়ের, সে নিশ্চয়ই কুলিদের দলে আছে। আমরা শেষ গ্রাম থেকে বিশ মাইল দূরে এসে পড়েছি। রাত্রে এই বিপজ্জনক বন পার হয়ে সেখান থেকে কোনও চোর আসতে পারে না, এ কথা তুমি মানো তো?

হ্যাঁ হুজুর, মানি।

তাহলে আমাদেরই কোনও কুলি এই চুরি করেছে।

সর্দার আবার প্রবল ভাবে মাথা নাড়া দিয়ে বললে, না হুজুর, আমাদের কোনও কুলিই এ চুরি করেনি।

সর্দার, তাহলে তুমি কী বলতে চাও শুনি?

হুজুর, আমি যা বলতে চাই, তা শুনলে হয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন না!

কেন?

আপনি ভাববেন আমি অসম্ভব মিথ্যা কথা বলছি।

আচ্ছা, তোমার কী বিশ্বাস বলো। আমি বিশ্বাস করব।

হুজুর, কাল রাতে আপনার তাঁবুতে যে চুরি করতে ঢুকেছিল, সে পুরুষমানুষ নয়।

তার মানে?

অন্তত এই পায়ের দাগগুলো যে স্ত্রীলোকের, সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই!

সর্দার, সর্দার! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? যে বন গ্রাম থেকে বিশ মাইল দুরে, যে বনে গরিলা, হাতি, বুনোমোষ আর বাঘের বাস, সেখানে রাত্রে চুরি করতে আসবে স্ত্রীলোক?

সর্দার দৃঢ়ভাবে বললে, ওসব কথা আমিও ভেবে দেখেছি। কিন্তু এগুলো স্ত্রীলোকের পায়ের দাগ।

আমি স্তম্ভিত ও স্তব্ধ হয়ে রইলুম। তারপর সর্দার চলে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি তাকে ডেকে বললুম, শোনো। এসব কথা যেন কুলিদের কাছে জানিও না!

সর্দার অল্প হেসে বললে, আপনি মানা না করলেও আমি বলতুম না। এ গল্প শুনলে। তারা পেতনির ভয়ে এখনই আমাদের ছেড়ে পালিয়ে যাবে!

সর্দারের কথা নিয়ে যতই নাড়াচাড়া করি, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না। ভয়াবহ কিভু–অরণ্য, যার চতুঃসীমানায় লোকালয় নেই, যার ভিতর দিয়ে দিনের বেলায় পথিকরা দলবদ্ধ ও সশস্ত্র হয়েও সভয়ে পথ চলে, মানুষের জীবন যেখানে প্রতিমুহূর্তেই হিংস্র জন্তুর দুঃস্বপ্ন দেখে, সেখানে গভীর রাত্রে একাকিনী স্ত্রীলোক,–এ কল্পনা হাস্যকর। সর্দার নিশ্চয়ই ভুল করেছে।

দুপুরবেলায় একটা বন্দুক নিয়ে বাইরে গেলুম। কাছাকাছি যদি কোথাও দুই একটা শিকারের পাখি পাওয়া যায় তাহলে আজকের নৈশ আহারটা সুসম্পন্ন হবে, এই ভেবে নদীর ধার ধরে গাছে গাছে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রেখে অগ্রসর হলুম।

নদীর জলধারায় ঝরে ঝরে পড়ছে উজ্জ্বল রৌদ্রধারা এবং তার সঙ্গে বাতাসে বাতাসে বয়ে যাচ্ছে শত-শত পাখির গানের আনন্দ-ধারা! চারদিকের জীবন্ত স্নিগ্ধতাটুকু আমার এত ভালো লাগল যে, জীবহিংসা করতে আর সাধ হল না। বড় জাতের একরকম বনপায়রা আমায় দেখে কাছের গাছ থেকে দূরের গাছে উড়ে গিয়ে বসল, কিন্তু আমি তাকে অনুসরণ করলুম না। মন যেন আমাকে ডাক দিয়ে বললে,–আজকের এই উত্তপ্ত সূর্যালোকের আনন্দ সভায় তোমাদের যতটুকু বাঁচবার অধিকার, ওরও অধিকার তার চেয়ে একটুও কম নয়!

খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার তাঁবুর দিকে ফিরলুম।

হঠাৎ নদীর তীরে কী একটা চকচকে জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, সূর্যালোক তার ওপরে পড়ে জ্বলে-জ্বলে উঠছে!

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দেখি, আমার বিস্কুটের টিনটা সেখানে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে।

তাড়াতাড়ি সেটা তুলে নিলুম! টিন একেবারে খালি!

নদীতীরের বালির ওপরে মানুষের পায়ের অনেকগুলো দাগ!

যে আমার টিন চুরি করেছে, সে লোকালয়ে ফিরে যায়নি, বৃষ্টিসিক্ত গভীর রাত্রে, এই ভীতিসঙ্কুল বন্য নদীর তীরে বসে জমাট অন্ধকারে নির্ভয়ে নিশ্চিন্ত প্রাণে উদরের ক্ষুধানিবৃত্তি করেছে। কে সে? সে যে আমার কোনও কুলি নয় স্ত্রীলোক নয়, এটা ঠিক! কিন্তু পুরুষ হলেও সে কী রকম পুরুষ? তার কি কোনও মাথা গোঁজবার আশ্রয়ও নেই? তার মনে। কি মানুষের স্বাভাবিক ভয়ও নেই?

এমনি সব কথা ভাবতে-ভাবতে ছাউনিতে ফিরে এসে দেখি, সর্দার একটা গাছতলায় চুপ করে বসে আছে।

তাকে আমার নতুন আবিষ্কারের কথা জানালুম। শুনে তার মুখে নতুন কোনও বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল না। সে আবার খালি হতাশ ভাবে মাথা নাড়লে।

তার ব্যবহার রহস্যজনক। যেন সে কোনও গুপ্তকথা জানতে পেরেছে, কিন্তু আমার কাছে প্রকাশ করতে চায় না!

আমিও জানবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করলুম না। তার মনে একটা ভ্রমাত্মক বিশ্বাস জন্মেছে, হয়তো আবার একটা কোনও উদ্ভট কথা বলে বসবে।

কেবল বললুম, সর্দার, এই অদ্ভুত চোরকে ধরতে হবেই। আজ রাত্রে আমি ঘুমোব না, তুমি জেগে সতর্ক হয়ে থাকতে পারবে কি?

সর্দার বললে, আমি স্থির করেছি, আজ রাত্রে এই গাছের ওপরে উঠে পাহারা দেব।

আমি তাকে ধন্যবাদ দিলুম।

সে রাত্রে আহারদির পর আলো নিবিয়ে আমি শুয়ে পড়লুম। কিন্তু ঘুমোলুম না। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলুম, আজ রাত্রে মেঘ ও বৃষ্টি নেই, চাঁদের আলো আছে,–আর বাইরের গাছের টঙে জেগে আছে সতর্ক সর্দার। চোরকে সে অনায়াসেই দেখতে পাবে! আর বিছানায় শুয়ে জেগে আছি আমি–চোরকে অনায়াসেই ধরতে পারব!

বাইরে নিশুত রাতের বুকে দুলছে আর দুলছে একতালে ঝিল্লির ঝঙ্কার! মাঝে মাঝে দূর বন থেকে ভেসে-ভেসে আসছে হস্তির চিৎকার! আমার তাঁবুর ওপর থেকেও দু-তিন বার একটা পঁাচা ডাক দিয়ে যেন বলে বলে গেল হুঁশিয়ার, হুশিয়ার!

আমি হুঁশিয়ার হয়েই রইলুম। বাইরের চোখ বুজে শুয়ে আছি বটে, কিন্তু মনের চোখ খোলা আছে! তন্দ্রা অনেকবারই সোহাগ করে আমাকে ঘুম পাড়াতে এসেছিল, কিন্তু আজ আর তার কোনও জারিজুরিই খাটল না! আমি জোর করে সারারাত জেগে রইলুম!

তাঁবুর ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো এল, কিন্তু রাত্রের চোর এল না! পাখিদের সমবেত চিৎকার শুনে মনে হল, আমার ব্যর্থতা দেখে তারা যেন আমাকে টিটকারি দিচ্ছে!

বিরক্ত মনে তাঁবুর পর্দা ঠেলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালুম।

সর্দার কাছের একটা বাঁশঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে সেলাম করলে।

আমি তিক্ত স্বরে বললুম, সারা রাত জেগে থাকাই সার হল। বদমাইশ চোরটা কাল আসেনি।

সর্দার বললে, সে এসেছিল।

এসেছিল!

হ্যাঁ হুজুর, ওই বাঁশঝাড়ের মধ্যে।

ওর ভিতর দিয়ে রাত্রে বা দিনে কোনও মানুষ আসতে পারে না।

হুজুর, তাকে মানুষ মনে করছেন কেন?

কী সর্দার, তুমিও কি তাকে পেতনি বলে ভাবো?

আমি তাকে কী মনে করি, আল্লাই তা জানেন। কিন্তু সে ওই বাঁশঝাড়ের মধ্যে এসেছিল, আমি কাল রাতে ওইখানে শুকনো পাতায় পায়ের শব্দ শুনেছি। আজ এখনই ওই জায়গাটা আমি পরীক্ষা করে আসছি। বাঁশঝাড়ের তলাকার জমি এখনও পরশু রাতের বৃষ্টিতে নরম হয়ে আছে। ওই জমিতে আমি হাঁটু আর হাতের ছাপ দেখেছি। সে হামাগুড়ি দিয়ে বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে আসছিল। কিন্তু তার চোখ আমাদের চেয়ে ঢের বেশি তীক্ষ্ণ, সে চোখ তো এখন আর মানুষের চোখ নয়! গাছের ওপরে আমাকে সে নিশ্চয় দেখে ফেলেছে। তারপর আর কী সে বাঁশঝাড় ছেড়ে বাইরে বেরোয়?

রুদ্ধ আক্রোশে আমি স্তব্ধ হয়ে রইলুম।

সর্দার আবার শুধোলে, হুজুর, আমাদের তাঁবু তুলে এখান থেকে আজ রওনা হবার কথা। কখন যাবেন?

আমি দৃঢ়স্বরে বললুম, আগে ওই চোরকে ধরব, তবে এখান থেকে এক পা নড়ব। যদি এক মাস এখানে থাকতে হয়, তাও থামব! সর্দার, আজ তোমার বুটা আমার বুর পাশে এনে খাঁটিয়ে ফ্যালো। আজ রাত্রে তুমি আর গাছে চোড়ো না, নিজের তাঁবুর ভিতরে জেগে বসে থেকো। আমার তাঁবুতে আমিও জেগে থাকব। আমার ডাক শুনলেই তুমি বেরিয়ে এসো।

সর্দার ঘাড় নেড়ে জানালে, আচ্ছা।

সে রাতেও আবার জাগবার পালা। আকাশে চাঁদ জাগছে, বনে রক্তপিপাসা জাগছে, তাঁবুতে আমার চোখ জাগছে, বাঁশঝাড়ে চোর জাগছে! আর জাগছে নদী–যেন ঘুমপাড়ানি গান শোনাতে-শোনাতে!

সর্দার বলে কী?–তাকে মানুষ মনে করছেন কেন? সে মানুষ নয়! সর্দারের মনে কুসংস্কারের উদয় হয়েছে? আশ্চর্য কী, সে-ও তো আফ্রিকারই লোক! এই আফ্রিকা হচ্ছে বিশ্বের সমস্ত কুসংস্কারের স্বদেশ! এখানে আকাশে বাতাসে জলে স্থলে ঘুরে বেড়ায় শুধু ভুত আর পেতনি! যে নরখাদক জন্তু বেশি মানুষ মারে, সে আর এখানে সাধারণ জন্তু থাকে না, লোকে বলে–দুষ্ট মানুষই নাকি ঝাড়ফুঁক তুকতাকের গুণে জন্তুর দেহ ধরে নরনারীর ঘাড় ভাঙছে! তাই এদেশে ভূতের চেয়ে রোজার দল ভারী!

কাল সারারাত কেটেছে অনিদ্রায়, আজও রাতদুপুর হয়ে গেছে। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে তার আমেজ এসেছে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ তাঁবুর ভিতরে খটমট করে জিনিস নড়ার আওয়াজ হল এবং সঙ্গে সঙ্গে চট করে আমার তন্দ্রার ঘোর কেটে গেল!

ঘরের ভিতরে কেউ এসেছে! ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে তাকে দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু বিষম একটা পূতিগন্ধে চারিদিক বিষাক্ত হয়ে উঠেছে! মানুষের গা দিয়ে এরকম দুর্গন্ধ বেরোয় না!

আমি শ্বাস রোধ করে পাথরের মতন স্থির ভাবে শুয়ে রইলুম। যে ঘরের ভিতরে এসে ঢুকেছে সেও নিসাড়,–তন্দ্রা ছুটে যাবার সময়ে হয়তো আমি সামান্য চমকে উঠেছিলুম, হয়তো সে দাঁড়িয়ে আমাকে তীক্ষ্ণনেত্রে পরীক্ষা করছে, হয়তো সে অন্ধকারেও দেখতে পায়!

এইভাবে মিনিট পাঁচেক কাটল। নীরবতার ভিতরে কেমন একটা বন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ আমার কানকে আঘাত করতে লাগল বারংবার। আর সেই পূতিগন্ধ! উঃ, অসহনীয়!

আবার খট খট করে শব্দ হল! কেউ আমার টেবিলের ওপরে জিনিসপত্তর নাড়াচাড়া করছে! আমি ঘুমোচ্ছি ভেবে নিশ্চয় সে নিশ্চিত হয়েছে!

আগে আন্দাজ করে নিলুম, চোর আমার টেবিলের কোনওদিকে আছে। তারপর কোনওরকম জানান না দিয়ে আচম্বিতে একলাফ মেরে টেবিলের সেইদিকে লাফিয়ে পড়লুম এবং চোরকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরতে গেলুম–

সঙ্গে সঙ্গে দু-খানা অত্যন্ত সবল বাহু আমাকে এমন প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারলে যে, আমি আবার ছিটকে বিছানার ওপরে এসে পড়লুম!

দৈবগতিতে আমার হাত পড়ল ইলেকট্রিক টর্চের ওপরে,বন্দুকের সঙ্গে এটাকেও আমি প্রতিরাত্রে পাশে নিয়ে শয়ন করি।

টর্চটা তুলে নিয়েই টিপলুম চাবি এবং পর-পলকেই বৈদ্যুতিক আলোপ্রবাহের মধ্যে আমার চোখের সুমুখে যে-মুখখানা জেগে উঠল, তার স্মৃতি আমি জীবনে ভুলতে পারব না!

রাশিকৃত উজ্জ্বল কিলবিলে কালো সাপের মতন কেশগুচ্ছের মধ্যে একখানা ভয়ানক কালো মুখ! সে মুখ স্ত্রীলোকের এবং সে মুখ মানুষের–এবং সে মুখ মানুষের নয়! ওই অগ্নিবর্ষী দুটো ভাটার মতন ক্ষুধিত চক্ষু–তা মানুষের চোখ নয় কখনও! ওই দংশনোদ্যত ক্রুদ্ধ নিষ্ঠুর দন্তগুলো–ওগুলো কি মানুষের দাঁত?

হঠাৎ তীব্র আলোকছটায় মূর্তির চোখদুটো নিশ্চয় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল!

আমি চিৎকার করে ডাকলুম–সর্দার, সর্দার, সর্দার!

কান ফাটানো ভয়াবহ এক গর্জনে আমার তাঁবুর ভিতরটা পরিপূর্ণ হয়ে গেল–কোনও মানুষেরই কণ্ঠ সে রকম অমানুষী গর্জন করতে পারে না!

শিউরে উঠে বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি বন্দুকটা তুলে নিলুম এবং সেই মুহূর্তেই মূর্তিটা সাঁৎ করে তাঁবুর ভিতর থেকে বেরিয়ে গেল!

এবং তার পরেই বাহির থেকে শুনলুম, ঘন ঘন হিংস্র গর্জন ও সর্দারের গলায় আর্তনাদের পর আর্তনাদ।

ঝড়ের বেগে বন্দুক নিয়ে বাইরে ছুটে গেলুম!

চাঁদের আলোয় সভয়ে দেখলুম, তাঁবুর দরজার সামনেই সর্দার মাটির ওপরে পড়ে গোঁ গোঁ ও ছটফট করছে এবং একটা ঘোর কালো বিভীষণা নগ্ন মূর্তি সর্দারের দেহ বৃহৎ সর্পের মতন দুই কৃষ্ণ বাহু দিয়ে চেপে রেখে তার টুটি কামড়ে ধরেছে প্রাণপণে! মূর্তিমতী হিংসা!

বন্দুক ছোড়বার উপায় নেই সর্দারের গায়ে গুলি লাগবার ভয়ে। বন্দুক তুলে আমি সেই ভীষণ মূর্তির মাথায় কুঁদো দিয়ে করলুম প্রচণ্ড এক আঘাত!

মূর্তিটা তীব্র–তীক্ষ স্বরে পশুর মতন একটা বিশ্রী আর্তনাদ করে ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মতন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল–তার মাথার এলানো আঁকড়া চুলগুলো চারিদিকে ঠিকরে পড়ল–তারপর সে আমাকে লক্ষ করে আহত কেউটের মতন এক লাফ মারলে–আমি দুই পা পিছিয়ে এলুম এবং সে আবার ঘুরে মাটির ওপরে আছাড় খেয়ে পড়ে মড়ার মতন স্থির হয়ে রইল।

সর্দারের কাছে দৌড়ে গেলুম, কিন্তু সে নিজেই উঠে বসল।

সর্দার, সর্দার, তোমার গলা দিয়ে রক্ত ঝরছে!

সর্দার কাপড় দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে বললে, বেশি কামড়াতে পারেনি, কিন্তু আপনি আর একটু দেরি করলেই আমি মারা পড়তুম! কিন্তু কিন্তু–ও কীসের আওয়াজ? সে অত্যন্ত ভীত ভাবে চারিদিকে তাকাতে লাগল।

সত্য! নিঝুম রাত্রে আচম্বিতে অরণ্য যেন সজাগ হয়ে উঠেছে। মাটি থরথর করে কাঁপছে, বনের গাছ মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে, বাঁশঝাড় টলমল করে টলছে! সঙ্গে-সঙ্গে একটা একটানা অব্যক্ত, অদ্ভুত ও ভীতিময় সমবেত কণ্ঠধ্বনি ধীরে-ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

ততক্ষণে আমাদের সমস্ত কুলি ঘটনাস্থলে এসে হাজির হয়েছে। প্রায় পরিপূর্ণ চন্দ্র তখন মাঝ আকাশে সমুজ্জ্বল মহিমায় বিরাজ করছে, আলো আঁধারিমাখা অপূর্ব বনভূমির ধার দিয়ে। চকচকে রুপোলি পাড়ের মতন নদীটি আপন মনে বয়ে যাচ্ছে কলসংগীতে মুখর হয়ে, এবং তৃণশ্যামল ভূমির ওপরে আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে স্বপ্নময় জ্যোৎস্না!

কিন্তু এই সমস্ত সৌন্দর্যকেই ব্যর্থ করে দিলে সেই ক্রমবর্ধমান অজ্ঞাত সম্মিলিত কণ্ঠের ভয় জাগানো কোলাহল! আমরা সকলে মিলে কী একটা আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় অভিভূত হয়ে আড়ষ্ট নেত্রে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম,–সর্দারও তাড়াতাড়ি উঠে আমার পাশে এসে দাঁড়াল তার চোখদুটো তখন ভয়ে যেন ঠিকরে পড়ছে।

পূর্বদিকের অরণ্যের ভিতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ভীত পাখিরা ব্যাকুল স্বরে চিৎকার করে বাস ছেড়ে উড়ে পালাল, গোটাকয়েক সোনালি বানর ও একটা চিতাবাঘ সামনের জমি পার হয়ে পশ্চিম দিকে বেগে দৌড় দিলে!

সর্দার অস্ফুট স্বরে কাঁপতে কাঁপতে বললে, হুজুর, ওইদিকে! ওইদিকে থেকেই ওরা আসছে!

অভাবিত কোনও বিভীষিকায় আমার গলা শুকিয়ে এসেছিল, কোনওরকমে জিজ্ঞাসা করলুম, ওরা? ওরা মানে কারা?

কিন্তু সর্দারের গলা দিয়ে আর কোনও কথা বেরুল না,–তার মুখ মড়ার মতন সাদা।

সেই বিপুল–অথচ অব্যক্ত কোলাহল তখন খুব কাছে এসে পড়েছে এবং মাটিতে তখন লেগেছে যেন ভূমিকম্পের ধাক্কা! আমি এমন অপার্থিব কোলাহল আর কখনও শুনিনি–এ মানুষের কোলাহল নয়, কিন্তু এরকম কোলাহল তুলতে পারে এমন কোনও জন্তুও পৃথিবীতে আছে বলে জানি না।

হঠাৎ পূর্ব দিকের বাঁশঝাড়ে যে ঝড়ের মতন লাগলকতকগুলো খুব বড় বাঁশ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গেল!

তার পরেই–ও কী ও? ওরা কারা? জ্যোত্সাময় রাত্রে অরণ্যের স্বচ্ছ ছায়ায় দেখা যাচ্ছে এক জমাট অন্ধকারের জীবন্ত প্রাচীর!

স্তম্ভিত নেত্রে ভালো করে তাকিয়ে দেখলুম, সেই অন্ধকার প্রাচীরের যেন অসংখ্য বাহু আছে বাহুগুলো মানুষের বাহুর মতন!

এমন সময়ে আমার পাশ থেকে একটা কালো বীভৎস মূর্তি বিদ্যুতের মতন ছুটে বেরিয়ে গেল–সে ছুটছে ওই অগণ্য বাহুকণ্টকিত জীবন্ত অন্ধকার প্রাচীরের দিকেই!

এক পলকের জন্যে ফিরে দেখলুম, মাটির ওপরে সেই অচেতন দানবী মুর্তিটা আর নেই কখন তার জ্ঞান হয়েছে আমরা কেউ দেখতে পাইনি, দেখবার সময়ও ছিল না!

দেখতে-দেখতে মূর্তিটা সেই বিরাট অন্ধকার প্রাচীরের ভিতরে মিলিয়ে গেল!

আমি সেইদিকে লক্ষ করে বন্দুক তুলে গুলির পর গুলি ছুঁড়তে লাগলুম,–উত্তেজনায়, দুর্ভাবনায়, ভয়ে ও বিস্ময়ে আমি যেন পাগলের মতন হয়ে উঠলুম কাল রাত্রে টোটার মালা পরেই শুয়েছিলুম–বন্দুকে গুলি ভরি, আর ছুড়ি! নৈশ আকাশ আমার বন্দুকের ঘন ঘন গর্জনে বিদীর্ণ হয়ে যেতে লাগল, কতবার যে বন্দুক ছুড়লুম তা আমি জানি না!

হঠাৎ সর্দার আমার হাত চেপে ধরে বললে, হুজুর, মিথ্যে আর টোটা নষ্ট করছেন কেন?

তখন আমার হুঁশ হল! চক্ষের উদভ্রান্ত ভাব কেটে গেল, পূর্ব দিকে তাকিয়ে আর সেই জীবন্ত অন্ধকার প্রাচীরকে দেখতে পেলাম না! সেই অব্যক্ত ভীম কোলাহলের বিভীষিকাও আর নেই এবং বাঁশঝাড়ও আঁকা ছবির মতন একেবারে স্থির!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি মাটির ওপরে বসে পড়লুম।

শ্রান্ত স্বরে বললুম, ওরা কারা আসছিল?

গরিলারা।

গরিলারা? কেন?

টানাকে নিয়ে যাবার জন্যে।

টানা আবার কে?

যে চুরি করতে রোজ আপনার তাঁবুর ভিতরে ঢুকত!

সর্দার, তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ? তুমি কী বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না!

হুজুর, টানা হচ্ছে মানুষের মেয়ে। তার বয়স যখন এক বছর, গরিলারা তখন তাকে চুরি করে নিয়ে পালায়। সে আজ পনেরো বছর আগেকার কথা! সেইদিন থেকেই সে গরিলাদের সঙ্গে-সঙ্গে আছে, মানুষ হলেও তার ব্যবহার এখন গরিলারই মতন। অনেকদিন আগে আমি এই গল্প শুনেছিলুম, কিন্তু টানাকে আজ প্রথম দেখলুম। আল্লার কাছে প্রার্থনা তাকে যেন আর কখনও না দেখতে হয়!

চন্দ্রলেখায় সুদূর বনভূমিকে পরিপুরীর মতন দেখাচ্ছে। মানুষের মেয়ে টানা, কিন্তু মানুষ এখন তার কাছে শত্রুর জাতি! হয়তো বনের ভিতরে বসে টানার গরিলা অভিভাবকরা এখন তার মাথায় ব্যথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আচ্ছন্নের মতন বনের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে বসে রইলুম! কী বিস্ময়কর এই বিচিত্র জগৎ।

.

তৃতীয় । সিংহের গহ্বরে

আমি তখন আফ্রিকার উগান্ডা প্রদেশে।

একটা সিংহ আমার বন্দুকের গুলিতে জখম হয়ে পালিয়ে গিয়েছে,–মাটির ওপরে রক্তের দীর্ঘ রেখা রেখে। সেই রক্তের দাগ দেখে দেখে আমি সিংহের খোঁজে এগিয়ে চলেছি। আমার সঙ্গে আছে কাফ্রি জাতের কয়েকজন লোক।

সামনেই মস্ত এক পাহাড়। একটা পথ সমতল ক্ষেত্র থেকে পাহাড়ের ওপরে উঠে মিলিয়ে গেছে। সেই পথ দিয়েই যে সিংহটা পলায়ন করেছে, তার স্পষ্ট চিহ্ন দেখতে পেলুম।

আমি পাহাড়ের ওপরে ওঠবার উপক্রম করছি, এমন সময়ে কাফ্রিদের দলের সর্দার আমাকে বাধা দিয়ে বললে, হুজুর, ও পাহাড়ে উঠবেন না!

কেন?

ও হচ্ছে শয়তানেরে পাহাড়!

বিস্মিত হয়ে বললুম, শয়তানের পাহাড়! সে আবার কী?

সর্দার মুখখানা বেজায় গম্ভীর করে বললে, ও পাহাড়ের শেষ নেই। ওর ভেতরে কারা থাকে তা আমি দেখিনি, কিন্তু শুনেছি তারা মানুষ নয়।

তা আর আশ্চর্য কী? বনেজঙ্গলে তো মানুষের বাস না থাকবারই কথা। আর আমি তো এখানে মানুষ শিকার করতে আসিনি!

না, হুজুর! আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন না! ও পাহাড়ের ভেতরে আছে। জুজুদের রাজ্য। তাদের চেহারা দেখলেই মানুষের প্রাণ বেরিয়ে যায়!

কী বলছ সর্দার, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! জুজু-টুজু আমি মানি না,আমি ওখানে যাবই! এসো আমার সঙ্গে!

সর্দার ভয়ে আঁতকে উঠে দু-পা পিছিয়ে গিয়ে বললে, আমি? এত তাড়াতাড়ি মরতে রাজি নই! আমার দলের কেউই ওখানে যাবে না, হুজুর বরং নিজেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন!

আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও হল না দলের সবাই একবাক্যে বলে উঠল, আমরা কেউ যাব না!

ফাঁপরে পড়ে গেলুম। যে সিংহটার পিছু নিয়েছি, তেমন প্রকাণ্ড সিংহ বড় একটা চোখে পড়ে না। বন্দুকের গুলিতে সে এমন সাংঘাতিক ভাবে আহত হয়েছে যে, আর বেশিদূর পালাতে পারবে বলেও মনে হয় না। এমন একটা শিকারকে হাতছাড়া করব?

যা থাকে কপালে, এগিয়ে পড়ি! এই ভেবে বললুম, আচ্ছা সর্দার, তোমরা তবে আমার জন্যে এইখানেই অপেক্ষা করো,আমি সিংহটাকে শেষ করে ফিরে আসছি!

সর্দার বললে, হুজুর আমার কথা শুনুন, ওই জুজু পাহাড়ে গেলে কোনও মানুষ আর বাঁচে না!

অসভ্যদের কুসংস্কার দেখে আমার হাসি পেল। আমি আর কোনও জবাব না দিয়ে, রক্তের চিহ্ন ধরে ধীরে ধীরে পাহাড়ের পথ বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলুম।

আহত ব্যাঘ্র বা সিংহ যে কী বিপজ্জনক জীব প্রত্যেক শিকারিই তা জানে। কাজেই খুব হুশিয়ার হয়ে বন্দুক তৈরি রেখেই আমি এগিয়ে চলেছি।

প্রায় তিনশো ফুট ওপরে উঠে দেখলুম, রক্তের দাগ হঠাৎ পথ ছেড়ে ডান দিকের এক জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ঢুকেছে। সে এমন ঘন জঙ্গল যে, তার ভিতরে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই অসম্ভব।

আমাকে তখন শিকারের নেশায় পেয়ে বসেছে। একটুও ইতস্তত না করে আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লুম, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে জঙ্গল ভেদ করে অগ্রসর হলুম। জঙ্গলের নিবিড়তা দেখে বেশ বোঝা গেল, এ তল্লাটে কোনওদিন কোনও মানুষের পা পড়েনি। চারদিক ভয়ানক নির্জন। যেখান দিয়ে যাচ্ছি, দিনের বেলাতেও সেখানে আলো ঢোকে না।

হঠাৎ বাধা পেলুম। পাহাড়ের গায়ে সুমুখেই একটা গুহা রয়েছে এবং রক্তের দাগ গিয়ে ঢুকেছে সেই গুহার মধ্যেই।

আহত সিংহটা আছে তাহলে ওই গুহার ভিতরেই? হয়তো ওই গুহাটাই হচ্ছে তার বাসা!

গুহার ভিতরে কী অন্ধকার! অনেক উঁকিঝুঁকি মেরেও কিছুই দেখতে পেলুম না। সিংহটারও কোনও সাড়া নেই। হয়তো ভিতরে বসে সেও আমার গতিবিধি লক্ষ করছে! হয়তো আচম্বিতে মহা ক্রোধে আমার ওপরে সে লাফিয়ে পড়বে!

কাছে ইলেকট্রিক টর্চ ছিল। টর্চটা জ্বেলে গুহার ভিতরে আলো ফেললুম। সঙ্গে সঙ্গে দেখলুম, গুহার মুখ থেকে হাত-পাঁচেক তফাতেই প্রকাণ্ড একটা সিংহের দেহ মেঝের ওপরে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে!

টর্চের তীব্র আলোতেও সিংহটা একটুও নড়ল না! খানিকক্ষণ লক্ষ করতেই বুঝলুম, তার দেহ শ্বাসপ্রশ্বাসেরও লক্ষণ নেই! সিংহটা মরেছে!

কিন্তু সাবধানের মার নেই। আহত জন্তুরা অনেক সময়ে এমনি মরণের ভান করে। তারপর হঠাৎ শিকারির ঘাড়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরণকামড় বসিয়ে দেয়। কাজেই টর্চটা কৌশলে জ্বেলে রেখেই সিংহটার দেহের ওপরে আরও দু-দুটো গুলিবৃষ্টি করলুম। তার দেহ তবু একটুও নড়ল না। তখন নিশ্চিন্ত হয়ে আমি গুহার ভিতরে প্রবেশ করলুম। এত কষ্ট সার্থক হল বলে আমার প্রাণ তখন আমোদে মেতে উঠেছে।

গুহাটা ছোট। কিন্তু কী ভীষণ স্থান! মাথার ওপরে কালো পাথর, আশেপাশে কালো পাথর, পায়ের তলায় কালো পাথর–আর তাদের গায়ে মাখানো কালো অন্ধকার! সেই কালোর ঘরে চারিদিকে বিশ্রী ভয়াবহ ভাব সৃষ্টি করে মেঝের ওপরে সাদা ধবধবে যে জিনিসগুলো পড়ে রয়েছে, সেগুলো মাংসহীন হাড় ছাড়া আর কিছুই নয়! হয়তো তার ভিতরে মানুষেরও হাড়ের অভাব নেই!

মানুষের কথা মনে হতেই আর একটা জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে।

গুহার কোণে হাড়ের রাশির সঙ্গে কালো রঙের কী একটা পড়ে রয়েছে। বন্দুকের নল দিয়ে নেড়েচেড়ে বোঝা গেল সেটা একটা জামা ছাড়া আর কিছুই নয়।

জামা! কোট! তাহলে এ সিংহটার মানুষ খাওয়ার অভ্যাস ছিল।

বন্দুকের সাহায্যে কোটটাকে ওপরে তুলতেই কী একটা জিনিস তার ভিতর থেকে মাটিতে পড়ে গেল।

হেঁট হয়ে দেখি, একখানা পকেট বই! সিংহের আক্রমণে যার প্রাণের প্রদীপ নিবে গেছে, নিশ্চয়ই এটি সেই হতভাগ্যেরই সম্পত্তি!

খুব সম্ভব এটি কোনও শ্বেতাঙ্গ শিকারির জিনিস। ওর ভিতরে হয়তো তার পরিচয় লেখা আছে, এই ভেবে আমি পকেট বইখানা কৌতূহলী হয়ে কুড়িয়ে নিলুম।

পকেট বইখানা খুলে, তার ওপরে টর্চের আলো ফেলেই চমকে উঠলুম!

এর পাতায় পাতায় যে বাংলাতে অনেক কথা লেখা রয়েছে।

আমার মন বিপুল বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল! কোথায় বাংলাদেশ, আর কোথায় উগান্ডার সিংহ-বিবর! ঘরমুখো বাঙালি এতদূরে ছুটে এসেছে নিষ্ঠুর সিংহের ক্ষুধার খোরাক। জোগাবার জন্যে!

তার পরেই মনে হল,–এ ব্যাপারে আর যে কেহ অবাক হতে পারে, কিন্তু আমার আশ্চর্য হওয়া উচিত নয়। কারণ, আমিও তো বাঙালি–এবং আমিও তো আজকেই সিংহের খোরাক হলেও হতে পারতুম! তারপর ওই হতভাগ্যের মতন আমারও হাড়গুলো হয়তো এখানকার অস্থিস্তূপকে আরও কিছু উঁচু করে দিত। সে হাড়গুলো দেখে কেউ আমার কোনও পরিচয়ই জানতে পারত না!

সেই ভীষণ গুহার হিংসার ও হত্যার গুহার এবং তার সামনেকার জঙ্গলের ভিতর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাইরের খোলা হাওয়ায় এসে দাঁড়ালুম।

তার পরেই মনে পড়ল কাফ্রিদের ভয়ের কথা শিকারের উত্তেজনায় এতক্ষণ যে কথা ভুলে গিয়েছিলুম!

ওরা এই পাহাড়টাকে জুজু পাহাড় নাম দিয়েছে! কেন? ওরা বলে, এখানে যারা থাকে, তাদের দেখলেই মানুষ মরে যায়। কেন? এ মুল্লুকের কোনও মানুষই এ পাহাড়ের ত্রিসীমানায় আসে না। কেন?

তীক্ষ্ণ চোখে চারিদিকে তাকিয়ে এইসব কেনর জবাব খোঁজবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই আবিষ্কার করতে পারলুম না। নির্জন পথ, নির্জন পাহাড়, নির্জন অরণ্য! নিস্তব্ধতা ও নির্জনতার ওপরে ধীরে ধীরে গোধুলির ম্লান আলো নেমে আসছে! এই নিস্তব্ধতা ও নির্জনতা কেমন অস্বাভাবিক বলে মনে হল। তা ছাড়া আমার মনে কোনওরকম ভয়ের ভাবই জাগল না।

সন্ধ্যা আসছে,এখানে আর অপেক্ষা করা যুক্তিসঙ্গত নয়। তাড়াতাড়ি পাহাড় থেকে নেমে এলুম।

কাফ্রিদের সর্দারের মুখের ভাব দেখেই বুঝলুম, আমি যে আবার ফিরে আসব, এ আশা সে করেনি!

আমি হেসে বললুম, সর্দার, আমার মুখের পানে অমন হাঁ করে তাকিয়ে আছ কেন? ভয় নেই, এখনও আমি ভূত হয়নি!

সর্দার খুব ভীত কণ্ঠে খুব মৃদুস্বরে বললে, আপনি তাদের দেখেছেন?

কাদের?

যারা মানুষ নয়?

হ্যাঁ, মানুষ নয় এমন জীবকে আমি দেখেছি বটে!

সর্দার ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল, তার মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না!

তার ভাব দেখে আমি হো-হো করে হেসে উঠে বললুম, হ্যাঁ সর্দার! মানুষ নয় এমন একটা জীবকে আমি সত্যিই দেখেছি–আর সে জীবটা হচ্ছে আমাদেরই সেই আহত সিংহটা। একটা গুহার ভেতরে সে মরে কাঠ হয়ে আছে।

সর্দারের যেন বিশ্বাস হল না। থেমে থেমে বললে, আর কিছুই দেখেননি হুজুর?

কিছু না কিছু না–একটা নেংটি ইঁদুর পর্যন্ত না!

সর্দার তখন আশ্বস্ত হয়ে বললে, তাহলে আপনি ভাগ্যবান পুরুষ। ও পাহাড়ে যারা যায়, তারা আর ফেরে না।

আমি বললুম, আচ্ছা সর্দার, বলতে পারো, আমার আগে ও পাহাড়ে আর কোনও বাঙালি কখনও গিয়েছিল?

হ্যাঁ হুজুর, গিয়েছিল। ঠিক এক বছর আগে! আমিই তাকে পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসেছিলুম। আপনার মতন সেও আমার কথা শোনেনি। আমার মানা না মেনেই সেই বাবু ওই পাহাড়ের ভেতরে যায়। কিন্তু সে বাবু আর ফিরে আসেনি।

আমি বললুম, কেমন করে সে ফিরবে? তার হাড় সে সিংহের গর্তের ভিতরে পড়ে রয়েছে!

কিন্তু সেই বাঙালিবাবুর প্রাণ গেছে যে সিংহের কবলে, সর্দার একথা বিশ্বাস করতে চাইলে না। সে শয়তান, জুজু ও আরও কত কী নাম করে নানান কথা বলতে লাগল– কিন্তু সেসব কথায় আমি আর কান পাতলুম না।

পকেটবুকখানা এখন আমার পকেটেই আছে। ঠিক করলুম ক্যাম্পে ফিরেই সেখানা ভালো করে পড়ে মৃত বাঙালিটির পরিচয় জানবার চেষ্টা করব।

আহা, বেচারি! হয়তো তার মৃত্যু সংবাদ এখনও তার আত্মীয়স্বজনরা জানতেও পারেনি।

.

চতুর্থ । পিপের চোখ

খাওয়াদাওয়ার পর রাত্রে ক্যাম্প খাটে শুয়ে সেই পকেটবুক বা ডায়ারিখানা পড়তে শুরু করলুম।

যতই পড়ি, অবাক হয়ে যাই! এ এক অদ্ভুত, বিচিত্র, অমানুষিক ইতিহাস বা আত্মকাহিনি, গোড়ার পাতা পড়তে আরম্ভ করলে শেষ পাতায় না গিয়ে থামা যায় না। এমন আশ্চর্য কাহিনি জীবনে আর কখনও আমি শুনিনি–শুনব বলে কল্পনাও করিনি!

শহরে বসে কারুর মুখে এ কাহিনি শুনলে কখনও বিশ্বাস করতুম না। কেউ একে সত্য বলে চালাবার চেষ্টা করলে তাকে নিশ্চয়ই আমি পাগলাগারদে পাঠাতে বলতুম।

কিন্তু এইখানে,আফ্রিকার এই বনে! এখানে বসে আজ সবই সম্ভব বলে মনে হচ্ছে! তাবুর পরদার তুলে একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলুম।

কী পরিষ্কার রাত! আকাশে যেন জ্যোৎস্নার সমুদ্র এবং বাতাসে যেন জ্যোৎস্নার ঝরনা! ওই তো জুজু পাহাড়,–তার মেঘ-ছোঁয়া শিখরের ওপরে পূর্ণচাঁদের রৌপ্যমুকুট। পাহাড়ের নীচের দিক গভীর জঙ্গলে ঢাকা–মানুষ যার মধ্যে ভরসা করে ঢোকে না। কিন্তু ফুটফুটে চাঁদের আলোয় এই ভয়াল গহন বনকেও দেখাচ্ছে আজ চমৎকার!

এই আনন্দময় সুন্দর চন্দ্রালোকের মধ্যেও যে অরণ্যের চিরন্তন নাট্যলীলা বন্ধ হয়ে নেই, তার সাড়াও কানের কাছে বেজে উঠছে অনবরত। কাছে, দুরে আরও দুরে বনের মাটি কাঁপয়ে ঘনঘন বজ্রধ্বনির মতন সিংহদের ক্ষুধার্ত গর্জন শোনা যাচ্ছে, সভয়ে দুদুড়িয়ে জেব্রার দল পলায়ন করছে তাদের অসংখ্য ক্ষুরের শব্দ! হায়েনারা থেকে থেকে রাক্ষুসে অট্টহাসি হাসছে! গাছের ওপরে বানরদের পাড়ায় কিচিরমিচির আওয়াজ এবং হয়তো সাপের মুখে পড়ে কোনও পাখি মৃত্যুযাতনায় আর্তনাদ করে উঠল ও তাই শুনে আশপাশের পাখিরা সচকিত হয়ে ডানা ঝাঁপটা দিলে! মাঝে-মাঝে তক্ষকের মতন কী-একটা জীব ডেকে উঠে যেন জানিয়ে দিচ্ছে, এই জীবনযুদ্ধক্ষেত্রে সেও একজন যোদ্ধা! পাচারা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে উড়ে যাচ্ছে রাত্রিকে যে বিষাক্ত করে! এইসব শব্দ রেখার মতন এসে পড়ছে যেন শব্দময় আর একখানা বিরাট পটের ওপরে এবং তা হচ্ছে অনন্ত অরণ্যের অশ্রান্ত, অব্যক্ত ধ্বনি! শব্দ-পটের ওপরে শব্দ রেখা পড়ে এঁকে যাচ্ছে এক বিচিত্র শব্দচিত্র!

তাঁবুর দরজা থেকে অল্প তফাতে হিংস্র পশুদের ভয় দেখাবার জন্যে আগুন জ্বেলে, বসে বসে গল্প করছে কাফ্রি বেয়ারা ও কুলিরা। তাদের কালো কালো মুখগুলোর খানিক খানিক অংশ আগুনের আভায় লাল দেখাচ্ছে। তাদের ভাষা জানি না, তারা কী গল্প করছে তাও জানি না, তবে একটা বিশেষ কথা বারবার আমার কানের কাছে বাজতে লাগল। তারা বারংবার উত্তেজিত স্বরে বলে বলে উঠছে, জুজু! জুজু! জুজু!

বুঝলুম, এখনও তাদের ভিতরে ওই জুজু-পাহাড় নিয়েই আলোচনা চলছে। এরা হচ্ছে সরল অসভ্য মানুষ,শহুরে সভ্য মানুষের মনের মতন এদের মন নানা চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে নেই, তাই এদের মাথার ভিতরে একটা কোনও বিশেষ নতুন চিন্তা ঢুকলে এরা সহজে আর সেটা ভুলতে পারে না।

কিন্তু জুজু-পাহাড়ের যে বিভীষিকা এদের মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে, সত্য-সত্যই সেটা কি কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়?

এই অজানা বাঙালির লেখা ডায়েরিখানা পড়বার পর সে কথা তো আর জোর করে বলতে পারি না! এ ডায়ারি যিনি লিখেছেন তিনি ওদের মতন অসভ্য নন। লেখার ভাষা দেখেই বুঝেছি, তিনি সুশিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি যে-কোনও ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের বর্ণনা দেননি, লেখা পড়লে তাও জানা যায়। কিন্তু যেসব কথা তিনি লিখেছেন–

হঠাৎ তাঁবুর পরদা ঠেলে কাফ্রিদের সর্দার ভিতরে প্রবেশ করল। তার মুখে ভয় ও উদ্বেগের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কী ব্যাপার, সর্দার?

সে বললে, আপনি কি এখানে শিকারের জন্যে আরও কিছুদিন থাকবেন?

হ্যাঁ। এখানে দেখছি খুব সহজেই শিকার পাওয়া যায়। দিন পনেরো এখানেই থেকে যাব মনে করছি।

সর্দার বললে, তাহলে আমাদের বিদায় দিন। আমরা কাল সকালেই এখান থেকে পালাতে চাই!

আশ্চর্য হয়ে বললুম, সে কী! কেন?

সর্দার বললে, এ জায়গায় জ্যান্ত মানুষের থাকা উচিত নয়! এখানকার ইট-কাঠ-পাথরের ওপরেও জুজুর অভিশাপ আছে!

আমি হেসে উঠে বললুম, সর্দার! আবার তুমি পাগলামি শুরু করলে?

সর্দার মাথা নেড়ে বললে, না হুজুর, না! পাগলামির কথা নয়। আজ এইমাত্র স্বচক্ষে যা দেখলুম!

কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, স্বচক্ষে কী তুমি দেখেছ? ভূত? জুজু? পেতনি? না রাক্ষস?

সর্দার অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললে, না হুজুর, না! এসব ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা করা ভালো নয়। আজ আমি স্বচক্ষে যা দেখেছি, আর একবার তা দেখলে আমি আর বাঁচব না।

অধীর ভাবে বললুম, কিন্তু তুমি কী দেখেছ, আগে সেই কথাটাই বলো না।

আমরা জানতুম হুজুর, জুজুরা ওই পাহাড়ের বাইরে আসে না। তাই আমরা নির্ভয়ে এদিকে-ওদিকে চলাফেরা করে বেড়াচ্ছিলুম। কিন্তু আজ দেখছি, জুজুরা পাহাড় ছেড়ে নীচেও নামে। বোধহয় এটা আপনার দোষেই। আপনি আমাদের বারণ শুনলেন না। মানুষ হয়েও পাহাড়ে উঠে জুজু-পাহাড়ের পবিত্রতা নষ্ট করলেন। তাই আপনাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে তারা পাহাড় ছেড়ে নেমে এসেছে।

আমি শুয়েছিলুম। এইবারে উঠে বসে বিরক্ত স্বরে বললুম, সর্দার! হয় তুমি কি দেখেছ বলো, নয় এখান থেকে চলে যাও! তোমার বাজে বকুনি শোনবার সময় আমার নেই।

সর্দার বললে, একটু আগে আমি নদী থেকে এক বালতি জল আনতে গিয়েছিলুম। ফেরবার সময়ে ঠিক আমার সুমুখ দিয়েই একটা জিনিস গড়াতে গড়াতে তিরবেগে এধার থেকে পথ পার হয়ে ও-ধারের জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেল। ধবধবে চাঁদের আলোয় সে জিনিসটাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলুম।

সে জিনিসটা কী? কোনও জন্তু-টন্তু?

না।

মানুষও নয়? না। একটা ছোট পিপে। আমি বাধো বাধো স্বরে বললুম, একটা ছোট পিপে?

হ্যাঁ হুজুর। একটা ছোট পিপে। কে কবে দেখেছে, পিপে আবার জ্যান্ত হয়ে গড়িয়ে বেড়ায়?

হয়তো কেউ তোমাকে ভয় দেখাবার জন্যে পিপেটাকে ধাক্কা মেরে গড়িয়ে দিয়েছিল।

না হুজুর! আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি, সেখানে আমি ছাড়া আর জনপ্রাণী ছিল । তারপর, আরও শুনুন। আমি বেশ ভালো করেই দেখেছি, সেই চলন্ত পিপেটার ভেতর থেকে দু-দুটো জ্বলন্ত রাক্ষুসে চোখ ভয়ানক ভাবে কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। জলের বালতিটা সেখানেই ফেলে চো-চা দৌড় মেরে আমি পালিয়ে এসেছি। পিপে যেখানে হেঁটে বেড়ায় আর চোখ কটমটিয়ে তাকায়, সেখানে আর আমাদের থাকা চলে না। আমরা কাল সকালেই এ মুলুক ছেড়ে সরে পড়ব।–এই বলে সর্দার চলে গেল।

এবার আর সর্দারের কথা আমি হেসে উড়িয়ে দিতে পারতুম না। কারণ এই ডায়ারিখানা আমি পড়েছি। সর্দারের কথা মিথ্যা বললে, যিনি ডায়ারি লিখেছেন, তাঁকেও মিথ্যাবাদী বলতে হয়!

অবশ্য ডায়ারির অনেক জায়গায় চোখ বুলিয়ে আমার সন্দেহ হয়েছে বটে যে, আমি যেন কোনও ছেলে ভুলানো হাসির গল্প বা মজার রূপকথা পড়ছি, কিন্তু তবু লেখককে একেবারে অবিশ্বাস করতে পারছি না। হয়তো মাঝে-মাঝে বর্ণনার অত্যুক্তি বা অতিরঞ্জন আছে,সত্যিকার জীবনের কথা লিখতে বসেও অধিকাংশ লেখক যে লোভ সংবরণ করতে পারেন না! কিন্তু… কিন্তু, বিংশ শতাব্দীর কলেজে পড়া মোটরে চড়া বিজ্ঞান জানা সভ্য মানুষ আমি, একটা অসভ্য কাফ্রির কথা শুনে এবং একজন অচেনা মৃত ব্যক্তির ডায়ারির পাতা উলটে এমনধারা অদ্ভুত কাণ্ডকে ধ্রুবসত্য বলে একেবারে বিনা দ্বিধায় মেনে নেব?

কে জানে, ডায়ারি যিনি লিখেছিলেন, তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল কি না কে জানে? তিনি গালিভারের ভ্রমণ কাহিনির মতন একখানা কাল্পনিক উপন্যাস রচনা করে গেছেন কি না? হয়তো আজ তিনি এ-প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারতেন। কিন্তু মৃত্যু যাঁর মুখ বন্ধ করে দিয়েছে, তার কাছ থেকে আর কোনও উত্তর পাবারই আশা নেই।

তার পরেই মনে হল, তবু সর্দার আজ এখনই যে গল্প বলে গেল, তার সত্য-মিথ্যা তো আমি পরীক্ষা করে দেখতে পারি? ডায়ারির গল্পের সঙ্গে সর্দারের গল্পের কিছু কিছু মিল আছে। কেমন করে এমন মিল সম্ভবপর? সর্দারের গল্প যদি সত্য হয়, তাহলে ডায়ারির গল্প সত্য বলে মানা যেতে পারে। এমন একটা অসম্ভব বিস্ময়কর সত্যের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয়ের এই সুযোগ ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়!

তখনই ক্যাম্প-খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালুম এবং শিকারের পূর্ণ পোশাক পরতে লাগলুম। পোশাক পরতে-পরতে মনের ভিতরে কেমন একটা বিপদের সাড়া জেগে উঠল। কিন্তু সে ভাবটাকে আমি মনের ভিতরে স্থায়ী হতে দিলুম না।

বাংলার সবুজ কোলের শাস্তি ছেড়ে যে-লোক সুদূর আফ্রিকার নিবিড় জঙ্গলে কালো অন্ধকারের ভিতরে সিংহ, হাতি, গন্ডারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছে নির্ভয়ে এবং যার হাতে আছে বুলেট-ভরা বন্দুক ও কোমরে আছে ছ-নলা রিভলভার আর শিকারের ছোরা, বিপদের সামনে যেতে সে কেন ইতস্তত করবে? এই বিপদের গভীর আনন্দকে সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় উপভোগ করতে পারে বলেই পৃথিবীতে মানুষ আজ শ্রেষ্ঠ জীব হতে পেরেছে! উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু, আমেরিকা, উড়োজাহাজ ও ডুবোজাহাজ প্রভৃতি আজ আবিষ্কৃত হয়েছে কেন? বিপদের দৌলতে! এইসব আবিষ্কারের জন্যে কত মানুষ হাসতে-হাসতে প্রাণ দিয়েছে এবং কত মানুষ হাসতে হাসতে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে। অধিকাংশ আবিষ্কারের মূলেই আছে এই বিপদের আনন্দ! যে জাতি এই বিপদের সাধনা শিখতে পারে, সে জাতির উন্নতির পথে কোনও বাধাই টেকে না।

এমনি সব ভাবতে-ভাবতে পোশাক পরা শেষ হল। কোমরের বেল্টে একটা টর্চ তো গুঁজে নিলুমই, তার ওপরে পেট্রল-জুলা একটা স্থির বিদ্যুতের মতন অতি উজ্জ্বল আলোের লণ্ঠনও নিতে ভুললুম না! আধা অন্ধকারে অনেক সময়ে একটা বৃক্ষশাখার আবছায়া নড়লেও অন্য কিছু বলে ভ্রম হয়। স্পষ্ট আলো সন্দেহ দূর করে।

তাঁবুর বাইরে এসেই দেখি, কাফ্রি কুলিরা তাদের মোটমাট বাঁধতে বসেছে। সর্দারকে ডেকে শুধোলুম, এসব কী হচ্ছে?

সর্দার বললে, ওরা সবাই ভয় পেয়েছে। অনেকে আজ রাতেই পালাবে। কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

আমি বললুম, নদীর ধারে।

নদীর ধারে! কেন হুজুর?

তুমি আমার কাছে যা বলে এলে, তা সত্যি কী না দেখবার জন্যে!

সর্দারের মুখ দেখে মনে হল, সে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সে বললে, হুজুর অমন কাজ করবেন না। নদীর ধারে আজ জুজুর অভিশাপ জেগে উঠেছে, জ্যান্ত মানুষ সেখানে গেলে আর ফিরবে না। আজ সেখানে একলা গেলে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত!

কেন, একলা কেন, তুমিই আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো–কোনও ভয় নেই।

সর্দার আঁতকে উঠে বললে, আমি যাব আপনার সঙ্গে? বলেন কী হুজুর। আমি তো পাগল হইনি! ঘরে আমার বউ-ছেলে আছে, আমি কি শখ করে আত্মহত্যা করতে পারি?

বেশ, তুমি যেয়ো না। কিন্তু নদীর কোন পথে তুমি সেই ব্যাপারটা দেখেছিলে?

সর্দার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে, এই সামনের পথ দিয়েই চলে যান। নদী খুব কাছেই। কিন্তু হুজুর, এখনও আমার কথা শুনুন, মানুষ হয়ে জুজুর সামনে যাবেন না।

আমি তার কথার জবাব না দিয়ে অগ্রসর হলুম।

আজ যে পৃথিবীময় চাঁদের আলোয় ছড়াছড়ি, একথা আগেই বলেছি। চারিদিক ধবধব করছে। নদীর ধারে যাবার পথের রেখা একটা ঘুমন্ত ও অতিকায় অজগরের মতন এঁকেবেঁকে স্থির হয়ে আছে। পথের দু-ধারে ঘন জঙ্গল চাঁদের আলোয় যেন স্বপ্ন মাখানো! সেই জঙ্গ লের মাঝখানে জুজু-পাহাড়ের মাথা উঁচু হয়ে উঠে যেন নীল আকাশকে ঢু মারতে চাইছে।

চারিদিক নির্জন হলেও নিস্তব্ধ নয়। অরণ্যের রহস্যময় বিচিত্র শব্দগুলো এখনও অবিরাম জেগে আছে–হায়েনার রাক্ষুসে হাসি, বানরদের ভীত স্বর, পাচার চিৎকার–এবং আরও কত কী, হিসাব করে বলা অসম্ভব! কেবল আফ্রিকার এ-অঞ্চলের জঙ্গলের যা প্রধান বিশেষত্ব, সিংহদের সেই মাটি কাঁপানো ঘনঘন মেঘের মতন গর্জন এখন আর একেবারেই শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা ভরসার কথা নয়, ভয়ের কথা! কারণ আফ্রিকার অভিজ্ঞ শিকারি মাত্রই জানেন, সিংহরা স্তব্ধ হলেই অত্যন্ত সাবধান হওয়া উচিত। কেননা, সামনে বা কাছে শিকারের দেখা বা সাড়া পেলেই সিংহরা একেবারেই চুপ মেরে যায়। তারপর চোরের মতন চুপিচুপি এসে শিকারের ওপর লাফিয়ে পড়ে। কে জানে, কাছের কোনও জঙ্গলেই লুকিয়ে কোনও দুর্দান্ত পশুরাজ আমাকে দেখে আসন্ন ফলারের লোভে উন্মুখ হয়ে উঠেছে কী না?

লণ্ঠনটা সামনের দিকে বাড়িয়ে পথের দু-পাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে নদীর দিকে এগিয়ে চললুম। কিন্তু আমার মাথার ভিতরে তখন সিংহের জন্যে কোনও ভয়-ভাবনাই প্রবল হয়ে উঠতে পারলে না,আমি ভাবছিলুম কেবল ডায়ারির ও সর্দারের কথা! জুজু এবং জীবন্ত পিপে!

দূরে–পথের পাশ থেকে ওপাশে চিতাবাঘের মতন কী-একটা জন্তু তাড়াতাড়ি চলে গেল। একটা ঝুপসি গাছের ভিতর থেকে ডাল-পাতা সরিয়ে চার-পাঁচটা বেবুন সবিস্ময়ে মাথা বাড়িয়ে মুখ খিঁচিয়ে উঠল–এই বিজন ও ভীষণ অরণ্যপথে রাত্রিবেলায় আমার মতন একাকী মানুষকে দেখবার আশা তারা যেন করেনি!

একটু তফাতে আচম্বিতে গাছপালার আড়ালে অনেকগুলো পাখি ব্যস্তভাবে চেঁচিয়ে উঠল। প্রত্যেক শিকারিই পাখিদের এইরকম আকস্মিক চিৎকারের অর্থ বোঝে। নিশ্চয়ই তারা কোনও হিংস্র জীবজন্তুর সাড়া পেয়েছে। যেখানে পাখিদের গোলমাল উঠেছে সেইখানে লক্ষ করে দেখলুম, জঙ্গলটা দুলে দুলে উঠল,–যেন কোনও অদৃশ্য জন্তু তার ভিতরে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমিও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলুম। কিন্তু আর কোনও কিছু নজরে পড়ল না। আবার অগ্রসর হলুম। জঙ্গলের সেই জায়গাটা যখন পার হয়ে গেলুম, মনের ভিতরে কেমন অস্বস্তি হতে লাগল!

নির্জনতা, জ্যোত্সা-ধোয়া পাহাড়, বন, নদী এবং চাঁদের তিলকপরা নীলিমা! মাঝে-মাঝে বনফুলেরও অভাব নেই! মাসিকপত্রের কবিদের মুখে শুনি, তারা নাকি এইসব প্রাণের মতো ভালোবাসেন! কিন্তু তাদের দলের ভিতর থেকে কারুকে ধরে এনে আজ যদি এইখানে একলা ছেড়ে দি এবং বলি, কবি এইবারে একটি কবিতা লেখো তো! তুমি যা যা ভালোবাসো এখানে সেসবের কিছুরই অভাব নেই! এইবারে একটি চাঁদ ওঠার, ফুল ফোঁটার আর মলয় বাতাস ছোটার বর্ণনা লেখো তো বাপু! তাহলে কবি কবিতা লেখেন, না পিঠটান দেন, না ভিরমি যান, সেটা আমার দেখবার সাধ হয়।

নদীর ধারে এসে পড়লুম। কিন্তু এখনও পর্যন্ত অস্বাভাবিক কোনও ব্যাপারই চোখে পড়ল না। বনজঙ্গলে যেসব ভয় থাকা স্বাভাবিক এখানে তার অভাব নেই, কিন্তু এসব তো থাকবেই এবং এমন ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য তো শিকারির কাছে পরম লোভনীয়ই! কিন্তু আমি যা দেখবার জন্যে আজ প্রস্তুত হয়ে এসেছি, ডায়ারির পাতায় পাতায় যেসব অলৌকিক ঘটনা লেখা আছে এবং আজ সর্দারের মুখেও যার কিঞ্চিৎ বর্ণনা শুনেছি, তার ছিটেফোঁটাও তো এখনও পর্যন্ত দেখতে পেলুম না! মনে মনে হেসে মনে মনেই বললুম–পক্ষীরাজ ঘোড়া রূপকথায় আর শিশুর স্বপ্নেই দেখা যায়! আমি হচ্ছি একটি নিরেট বোকা, তাই সারাদিন পরিশ্রমের পর রাত্রের সুনিদ্রা নষ্ট করে বদ্ধপাগলের মতন এখানে ছুটে এসেছি!

নদীর তীরে নজর গেল। একটা মস্তবড়ো কুমির ডাঙার ওপরে দেহের খানিকটা তুলে স্থির ভাবে আমার পানে তাকিয়ে আছে। যেন সে বলতে চায়–বন্ধু কী আর বলব! আমার কাছে আর একটু সরে এসে দ্যাখো না, খিদে পেলে আমি কী করি?

মাঝনদীতে জীবন্ত বিয়ার মতন একদল হিপো ভাসছে। তিন-চারটে বাচ্চা হিপো জল খেলা খেলছে,–কেউ তার মায়ের কুপোর মতন পেটে গিয়ে ঢু মারছে, কেউ-বা জলের ভিতরেই উলটে পড়ে চমৎকার ডিগবাজি খাচ্ছে!

এমন সময়ে আচম্বিতে আমার মনে হল এখানে কেবল এই কুমির আর হিপোর পালই নেই,–যেন আরও সব অদৃশ্য জীব আনাচেকানাচে গা ঢাকা দিয়ে আমাকে লক্ষ করছে।

মনের মধ্যে এই সন্দেহ হতেই চারিদিকে তাকিয়ে দেখলুম, কিন্তু সারা পথটা জনশূন্য ও চন্দ্রালোক তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে এবং পথের দু-ধারের বনজঙ্গলের ভিতর থেকেও কোনও কিছুই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল না।

তবু বুকের কাছটা কেমনধারা করতে লাগল। এতক্ষণ এমন হয়নি, এখনই বা হচ্ছে কেন? এখানে আর কে থাকতে পারে? সিংহ? ব্যাঘ্র? গন্ডার?

আশ্চর্য নয়! নদীর ধারে হয়তো কোনও বড় জন্তু জলপান করতে এসে আমাকে দেখে আর বাইরে বেরুতে পারছে না। কিংবা হয়তো সুমুখেই তৈরি খাবার দেখে জঙ্গলের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে জলপানের আগেই আমার ঘাড়ের ওপরে একটি লম্ফত্যাগ করবে কি না!

তা এখানটা পড়তে তোমাদের যতই ভালো লাগুক না কেন, ব্যাপারটা তখন আমার মোটেই ভালো লাগছিল না। লণ্ঠনটা মাটির ওপরে রাখলুম। টর্চটা কোমরবন্ধ থেকে খুলে পথের দু-পাশের ঝোপঝাড়ের ওপরে আলো ফেলে পরীক্ষা করতে লাগলুম। হঠাৎ এক জায়গায় টর্চের আলো পড়তেই আমি চমকে উঠলুম!

কী ও-দুটো? একটা আঁকড়া ঝোপের ভিতর থেকে দুটো অগ্নিময় গোলা আমার পানেই তাকিয়ে আছে! দুটো হিংসা ও ক্ষুধা ভরা জুলন্ত ও ভয়ানক চক্ষু!

ও-দুটো সিংহের, না ব্যাঘ্রের চক্ষু? যার চক্ষুই হোক, আমি আর এক মুহূর্তও নষ্ট করলুম না, তাড়াতাড়ি বন্দুক এগিয়ে বাগিয়ে ধরে সেই দুটো অগ্নিগোলকের দিকে উপর-উপরি দুইবার গুলি বৃষ্টি করলুম!

তার পরেই ভয়ংকর এক আর্তনাদ–পৃথিবীর কোনও সিংহ ব্যাঘ্রই সেরকম আর্তনাদ করতে পারে না। এবং পরমুহূর্তেই একটা অদ্ভুত শব্দ হল–যেন পিপের মতন কী একটা বড় জিনিস গড়গড় করে ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছে!

এবং সঙ্গে-সঙ্গেই জঙ্গলের ভিতর থেকে কারা যেন অসংখ্য কণ্ঠে অমানুষিক স্বরে চিৎকার করতে লাগল–সেই সমস্বরের অপার্থিব চিৎকার শুনলে অতিবড় সাহসীরও বুকের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়, মানুষের কান তেমন চিৎকার কোনওদিন শোনেনি!

কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতন ভাবছি,কারা ওরা, অমন চিৎকার করতে পারে এমন কোনও জীব এই পৃথিবীতে আছে?–ঠিক সেই সময়ে আবার যে কাণ্ডটা হল, তাতে আমার সমস্ত বুদ্ধি শুদ্ধি যেন একেবারেই লোপ পেয়ে গেল!

আমি দাঁড়িয়েছিলুম পথের মাঝখানে। সেখান থেকে সামনের জঙ্গল ছিল প্রায় দশ বারো হাত তফাতে। জঙ্গলের ভিতর থেকে যদি কোনও জন্তু আমাকে আক্রমণ করতে আসে, তবে তাকে এই দশ-বারো হাত জমি আমার চোখের সামনে পার হয়ে আসতে হবে!

কিন্তু হঠাৎ জঙ্গলের ভিতর থেকে মোটা সাপের মতন কী-একটা বিদ্যুদবেগে শূন্যপথে উড়ে আমার বাঁ-হাতের ওপরে এসে পড়ল, আমার বন্দুকটা তখনই সশব্দে পথের ওপরে ঠিকরে পড়ে গেল এবং তার পরেই কে যেন বজ্রমুষ্টিতে আমরা হাত চেপে ধরে আমাকে জঙ্গলের দিকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে লাগল!

প্রথমটা আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম! তারপর কতকটা সামলে নিয়ে সেই বজ্রমুষ্টি থেকে ছাড়ান পাবার চেষ্টা করলুম কিন্তু পারলুম না! তারপর প্রায় যখন জঙ্গলের কাছে গিয়ে পড়েছি, তখন আমার মাথায় বুদ্ধি জাগল! আমার ডান হাত তখনও মুক্ত ছিল, ক্ষিপ্র হাতে কোমরবন্ধ থেকে রিভলভারটা বার করে নিয়ে আবার বার-তিনেক গুলিবৃষ্টি করলুম এবং অমনি আমার বাঁ-হাতের ওপর থেকে সেই বজ্রমুষ্টির বাঁধনটা খুলে গেল!

অমন দশ-বারো হাত জমি পেরিয়ে সেটা যে কী এসে আমার হাত ধরলে ও ছেড়ে দিলে, কিছুই আমি ভালো করে বুঝতে বা দেখতে পেলুম না, কারণ তখন আমি বিস্ময়ে হতভম্ব ও আতঙ্কে অন্ধের মতন হয়ে গিয়েছি!

ভালো করে কিছু বোঝবার বা দেখবার ভরসাও আর হল না,–যে পথে এসেছিলুম। আবার তিরের মতন সেই পথেই ছুটতে লাগলুম আমার তাবুর দিকে! পিছনে তখনও বহু কণ্ঠে সেই অমানুষিক চিৎকার বনজঙ্গল, আকাশ-বাতাস কাঁপয়ে তুলছে!

সে চিৎকার বোধ হয় আমার তাবুর লোকেদেরও কানে গিয়েছিল কারণ উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে তাবুর কাছে এসে দেখি, আমার কাফ্রিকুলিরা আগুনের চারিপাশে ভয়বিহ্বলের মতন দাঁড়িয়ে গোলমাল করছে!

আমাকে অমন ঝড়ের মতন বেগে ছুটে আসতে দেখে কুলিরা বোধহয় স্থির করলে যে, যাদের ভয়ে আমি পালিয়ে আসছি, তারাও হয়তো আমার পিছনে পিছনেই ছুটে আসছে! তারা কী ভাবলে ঠিক তা জানি না, তবে আমাকে দেখেই কুলিরা একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠে যে যেদিকে পারলে পলায়ন করলে! তারপর তাদের আর কারুরই দেখা পাইনি!

কুলিদের কাপুরুষ বলে দোষ দিতে পারি না। আমি আজ স্বচক্ষে যা দেখলুম হয়তো তারাও এর আগেই তার কিছু কিছু দেখেছে বা শুনেছে! সে রাতটা তাবুর ভিতরে বসে দুশ্চিন্তায়, আতঙ্কে ও অনিদ্রায় যেভাবে কেটে গেল, তা জানি খালি আমি এবং আমার ভগবানই! পরের দিন সকালেই এই অভিশপ্ত দেশ ত্যাগ করলুম। আমার দামি বন্দুক আর লণ্ঠনটা নদীর ধারে পথেই পড়ে রইল। দিনের আলোতেও এমন সাহস হল না যে, ঘটনাস্থলটা আর একবার পরীক্ষা করে নিজের জিনিস আবার কুড়িয়ে নিয়ে আসি! বিপদেই মানুষের চরিত্র বোঝা যায় বটে, কিন্তু বিপদেরও একটা সীমা আছে তো? বিপদকে ভালোবাসলেও সাঁতার না জেনে কে জলে ঝাঁপ দিতে যায়?

ডায়ারিতে যা লেখা আছে, আমি এইখানে উদ্ধার করে দিলুম। কাহিনিটি তোমরাও শোনো। যদি বিশ্বাস করতে ইচ্ছা না হয়, তবে অবিশ্বাস কোরো।

ডায়ারির লেখক তার গল্পটিকে বেশ গুছিয়ে বলেছেন। আমি তার কোনও কথাই বাদ দিইনি, কেবল সকলের সুবিধার জন্যে গল্পটিকে কয়েকটি পরিচ্ছেদে ভাগ করে দিলুম।

.

পঞ্চম। ডায়ারির গল্প শুরু হল

কুলিদের কথা যে সত্য, সে বিষয়ে আর কোনওই সন্দেহ নেই।

অসম্ভবও যে সম্ভব হয়, স্বচক্ষে আমি তা দেখেছি। আমার যদি যথেষ্ট মনের জোর থাকত না, তাহলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমি বদ্ধপাগল হয়ে যেতুম।

সময়ে-সময়ে নিজেরই সন্দেহ হয়েছে যে, আমি কোনও বিদঘুঁটে স্বপ্ন দেখছি না তো? কিন্তু সেই অদ্ভুত দেশে গিয়ে আমি যে সব ছবি এঁকেছিলুম, সেগুলো এখনও আমার কাছে রয়েছে। ছবিগুলো তো আর স্বপ্ন হতে পারে না!

এই গল্পের গোড়ার দিকটা যতই ভয়াবহ হোক, এর শেষদিকটা হয়তো অনেকেরই কাছে প্রহসনের মতন হাসির খোরাক জোগাবে। অনেকেই হয়তো একে প্রহসনের মতোই হালকা ভাবে নেবেন। কিন্তু মানুষের এই জীবনটাই হচ্ছে প্রহসনের মতন! একজনের হাসি আর একজনের কাছে মৃত্যুর মতন সাংঘাতিক! গল্পের শেষ ঘটনাগুলি পড়ে পাঠকরা যখন হাসবেন, তখন তারা হয়তো মনেও করতে পারবেন না যে, ঘটনার সময়ে আমার মনের মধ্যে হাস্যরসের একটা ফোঁটাও বর্তমান ছিল না!

আমার এই কাহিনির নাম দেওয়া যেতে পারে–দুঃস্বপ্নের ইতিহাস! মানুষ স্বপ্নে যেসব ভয়ঙ্কর ও অলৌকিক দৃশ্য দেখবার সময়ে অত্যন্ত ভয় পায়, জেগে উঠে তার কথা মনে করে হাসি আসে! আমারও অবস্থা এখন অনেকটা সেইরকম! কেবল দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, আমি যা দেখেছি তার কথা ভেবে অনেককাল ধরে হাসবার মতন পরমায়ু আমার নেই।

কোনওরকমে পাহাড়ের এই গুহার ভিতরে আশ্রয় নিয়ে আমার এই দুঃস্বপ্নের ইতিহাস লিখছি! আমি যে আর বেশিক্ষণ বাঁচব, এমন আশা রাখি না। তবু আমার ইতিহাস লিখে রেখে গেলুম এইজন্যে, কোনও না কোনও দিন হয়তো এটা অন্য মানুষের চোখে পড়বে।

কুলিরা কেউ আমার সঙ্গে আসতে রাজি হল না। সকলেরই মুখে এক কথা–জুজু পাহাড়ে মানুষ যায় না।

আমার রোখ বেড়ে উঠল। জুজু-পাহাড়ের ভিতরে কী রহস্য আছে, না জেনে এখান থেকে ফিরব না,–এই পণ করে কুলিদের পিছনে ফেলেই আমি একলা পাহাড়ের ওপরে উঠতে লাগলুম।

উঠছি, উঠছি, উঠছি! জুজু বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব দেখতে পেলুম না বটে, কিন্তু এই প্রকাণ্ড পাহাড়টা কী আশ্চর্যরকম নির্জন। কোথাও মানুষের একটা চিহ্নও নেই।

আরও খানিকটা ওপরে ওঠবার পর আমার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। এ পাহাড়ে মানুষের পদচিহ্ন পর্যন্ত নেই কেন এবং কোনও মানুষ এখানে আসে না কেন? সূর্যের সোনার আলোয় ঝলমলে এমন সুন্দর পাহাড়; এখানে ওখানে কৌতুকময়ী ঝরনা রুপোর ধারা কুলকুচো করতে করতে ও নীলাকাশকে নিজের গানের ভাষা শোনাতে-শোনাতে পাথর থেকে পাথরের ওপরে লাফিয়ে নাচতে নাচতে পৃথিবীর কোলের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্যে নীচে-আরও নীচে নেমে যাচ্ছে, ফলে-ফুলে রঙিন ও লতায় পাতায় সাজানো, নরম ঘাসের সবজে সাটিনে ঢাকা আনন্দময় উপত্যকা, এ তো কবির স্বর্গ, ভ্রমণকারীর তীর্থ! তবু মানুষ এই পাহাড়কে পরিত্যাগ করেছে কেন? এত বড় একটা চমৎকার পাহাড়, তবু কোথাও এর বর্ণনা শুনিনি কেন?

আর-একটা অদ্ভুত ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আমি ওপরে উঠছি। আশপাশ, আনাচকানাচ, বনজঙ্গলের আড়াল দিয়ে যেন আরও কারা সব নিঃশব্দ পদে আমার সঙ্গে সঙ্গেই ওপরে উঠছে! এখানে মানুষ নেই, অন্য কোনও জীবেরও সাড়া নেই, তবু যেন আমি একলা নই! কারা যেন অদৃশ্য হয়ে আমার সমস্ত গতিবিধি সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ করছে! এদিকে তাকাই ওদিকে তাকাই, সামনে ফিরি পিছনে ফিরি–এমনকী হঠাৎ ঝোপেঝাপে গিয়েও উঁকি মারি, তবু জনপ্রাণীকেও দেখতে পাই না! তবু আসছে, আসছে,–অদৃশ্য আত্মারা আমার সঙ্গে সঙ্গে আসছে আর আসছে আর আসছে! এই অদ্ভুত ভাবটাকে কোনওরকমেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারলুম না! কী অসোয়াস্তি!

ঘণ্টা চারেক এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ এক জায়গায় একটি ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

দু-ধারের পাহাড় কেটে কারা যেন একটা সরু রাস্তা তৈরি করেছে। রাস্তার মাঝে মাঝে শুকনো কাদা রয়েছে। তার ওপরে মানুষের পায়ের ছাপ আছে কি না দেখবার জন্যে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলুম। মানুষের পায়ের একটিমাত্র ছাপও সেখানে নেই। তার বদলে কাদার ওপরে অনেকগুলো টানা টানা বিচিত্র চিহ্ন দেখলুম। মাটি যখন ভিজে ছিল, তখন এই পথ দিয়ে যেন অনেকগুলো পিপের মতন জিনিস কারা গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে গেছে, তাদের পায়ের চিহ্নগুলো কোথায় গেল? অদ্ভুত রহস্য!

পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ আমার পা গেল ফসকে! যেখানে দাঁড়িয়েছিলুম, ঠিক তার পাশেই ছিল একটা গভীর খাদ। কোনওরকমেই নিজেকে সামলাতে না পেরে আমি সেই খাদের ভিতরে গিয়ে পড়লুম।

গড়াতে-গড়াতে পাতালের ভিতরে নেমে যাচ্ছি! দেহের ওপরে আঘাতের পর আঘাত! চারিদিক অন্ধকার যন্ত্রণায় চিৎকার করছি।

হঠাৎ পাথরের ওপরে মাথা ঠুকে অজ্ঞান হয়ে গেলুম!

.

ষষ্ঠ । ষোলো হাত লম্বা হাত

যখন আমার জ্ঞান হল, দেখলুম আমি একটা টেবিলের ওপরে শুয়ে আছি। পরে জেনেছিলুম সেটা হচ্ছে অপারেশন টেবিল–অর্থাৎ যাকে বলে রোগীকে অস্ত্র করবার টেবিল।

ভালো করে চেয়ে দেখি, আমি টেবিলের ওপরে শুয়ে নেই–টেবিলটাই আছে আমার পিঠের উপরে! কড়িকাঠ থেকে এক ঝোলানো টেবিলে পিঠ রেখে আমি ঘরের মেঝের দিকে মুখ করে আছি! আমার হাত-পা বাঁধা নেই, তবু আমি পড়ে যাচ্ছি না! যদিও পরে এই রহস্যেরও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনেছিলুম কিন্তু তখন আমি অত্যন্ত আশ্চর্য ও আড়ষ্ট হয়ে ভাবতে লাগলুম, বোধহয় আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি!

হঠাৎ চেয়ে দেখি, ঘরের মেঝেতে একটা পিপের ভিতর থেকে একখানা অদ্ভুত মুখ উঁকি মারছে! ছবিতে গোল চাঁদের ভিতরে চোখ নাক ঠোঁট এঁকে দিলে যে-রকম হয়, সেই মজার মুখখানা ঠিক সেইরকম দেখতে! তখন আমার দৃঢ় ধারণা হল যে, আমি স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই দেখছি না!

চাঁদমুখো লোকটা একটু হাসলে। বললে, এই যে, তোমার জ্ঞান হয়েছে দেখছি। অমল, তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তুমি ভাবছ এসব স্বপ্ন,না?

আমি হতভম্বের মতন বললুম, আপনি কী বলতে চান যে, আমি স্বপ্ন দেখছি না?

না।

এখন আমি কোথায়? এইটুকু আমার মনে আছে যে, আমি পাহাড়ের খাদে পড়ে গিয়েছিলুম!

ঠিক তাই। তোমাকে আমরা সেইখান থেকেই কুড়িয়ে এনেছি। তুমি নিশ্চয়ই বাঁচতে না। তোমার মেরুদণ্ড আর দু-খানা পা ভেঙে গিয়েছিল। আমি বৈজ্ঞানিক উপায়ে আবার তোমাকে বাঁচিয়ে তুলেছি।

লোকটা বলে কী? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো এ কী দেখছি? মানুষ কখনও ঝোলানো টেবিলে এমনভাবে পিঠ রেখে শুনে শুয়ে থাকতে পারে? আর নীচে ওই যে প্রকাণ্ড চাঁদের মতন মুখখানা আমার সঙ্গে কথা কইছে, ওরকম মুখ দুনিয়াতে কেউ কখনও দেখেছে? আমার মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল।

পিপের মুখ আবার বললে, অমল, এখন তুমি আরোগ্য লাভ করেছ।

আমি বললুম, আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?

তোমার পকেট-বই দেখে। রোসো তোমাকে নামিয়ে দিচ্ছি।–এই বলেই সেই চাঁদমুখো কেমন করে কী কল টিপলে জানি না, কিন্তু আমাকে সুদ্ধ নিয়ে টেবিলটা ধীরে ধীরে ঘুরে সোজা হয়ে মাটির ওপরে গিয়ে দাঁড়াল।

চাঁদমুখো বললে, এইবার তুমি নীচে নামতে পারো!

আমি আস্তে আস্তে উঠে বসে টেবিল ছেড়ে নেমে পড়লুম। পিপের ভিতর থেকে একখানা হাত বেরুল–সেই হাতে একটা কাচের গেলাস। চাঁদমুখো বললে, নাও, এইটুকু পান করো।

গেলাসে সবুজ রঙের কী একটা তরল পদার্থ ছিল। যেমনি তা পান করলুম, অমনি আমার দেহের ভিতর দিয়ে যেন একটা জ্বালাময় বিদ্যুৎপ্রবাহ ছুটে গেল!

আমি সভয়ে বলে উঠলুম, এ আমার কী খাওয়ালেন?

চাঁদমুখো হেসে বললে, ভয় নেই–ভয় নেই! ওতে তোমার উপকারই হবে!

আমি আবার জিজ্ঞাসা করলুম, আমি এখন কোথায় আছি?

আফ্রিকার এক গুপ্ত দেশে।

আপনি বাংলা শিখলেন কোথা থেকে?

এখানে সবাই বাংলা বলে। আমাদের ইতিহাস পরে বলব অখন, এখন যা বলি শোনো। আমি জানি তুমি বাঙালি। কিন্তু এ দেশে বিদেশিদের প্রবেশ নিষেধ। তবু যে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি, তার কারণ তোমাকে নিয়ে আমি একটা নতুন রকম পরীক্ষা করতে চাই। কিন্তু মহারাজ তোমাকে এখানে থাকতে দেবেন কি না জানি না। শীঘ্রই মহারাজার সভা বসবে। সেই সভায় স্থির হবে, তোমাকে এদেশে থাকতে দেওয়া হবে কি তোমাকে হত্যা করা হবে!

আমি চমকে উঠে বললুম, হত্যা?

চাঁদমুখো বেশ স্থির ভাবেই বললে, হ্যাঁ। এদেশে কোনও বিদেশি এলে তাকে হত্যা করাই হচ্ছে এখানকার আইন।

চমৎকার আইন! আমার বুক ভারি দমে গেল।

চাঁদমুখো বললে, কিন্তু অমল, একথা ভেবে এখন তুমি মাথা খারাপ কোরো না। তোমাকে যাতে হত্যা করা না হয়, আমি প্রাণপণে সে চেষ্টা করব।

আমি কৃতজ্ঞ স্বরে বললুম, ধন্যবাদ। কিন্তু আপনার নামটি জানতে পারি কি?

চাঁদমুখে বললেন, এ রাজ্যে কেউ আমার নাম ধরে ডাকে না। তুমি আমাকে পণ্ডিতমশাই বলে ডেকো। আমি মহারাজার প্রধান পণ্ডিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করাই আমার কাজ। বলেই পণ্ডিতমশাই ঘরের ভিতরে পায়চারি করতে লাগলেন।

এতক্ষণ পরে হঠাৎ একটা ব্যাপার দেখে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল! কী সর্বনাশ, পিপের ভিতর থেকে বেরিয়েছে তিনখানা মানুষের পা আর পিপের একদিকে আছে পণ্ডিতমশাইয়ের চাঁদ-মুখ–এবং এই মুখ-পা-ওয়ালা পিপেটা আমার চোখের সামনে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল।

একটা জাপানি রূপকথায় আশ্চর্য এক চায়ের কেটলির বর্ণনা পড়েছিলুম। সেই চায়ের কেটলিটার বিষম এক বদ অভ্যাস ছিল। মাঝে-মাঝে হাত-পা-মুখ বার করে সে নাচের নানারকম প্যাঁচ দেখাত! কিন্তু সেসব হচ্ছে তো ছেলেভুলানো বাজে গল্প! আজ আমার চোখের সুমুখে হাত-পা-মুখ-ওয়ালা যে জ্যান্ত পিপেটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, একে তো গাঁজাখোরের নেশার খেয়াল বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না কিছুতেই।

আমি হাঁ করে অবাক হয়ে চেয়ে আছি দেখে পণ্ডিতমশাই মুচকে হেসে বললেন, আমার দেহটা একটু নতুনরকম দেখাচ্ছে? আচ্ছা, এসব কথা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে অখন, আপাতত একটু কাজে আমি বাইরে যাচ্ছি। ততক্ষণ আমার মেয়ের সঙ্গে তুমি গল্প করো– আমি গেলেই সে আসবে!

কাগজের একরকম সাপ দেখেছ? যখন জড়ানো থাকে তখন খুব ছোট। তারপর ছেলেরা যেই ফুঁ দেয় অমনি ফুড়ুৎ করে হাত খানেক লম্বা হয়ে যায়! ঠিক সেই ভাবেই পিপে-পণ্ডিতের পাশ থেকে ফুড়ুৎ করে একখানা হাত বেরিয়ে পড়ল এবং একটানে ঘরের দরজাটা খুলে ফেলেই হাতখানা চোখের নিমিষে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। পণ্ডিতমশাই যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখান থেকে ঘরের দরজাটা ছিল ষোলো-সতেরো হাত তফাতে!

তার পরেই দেখি, পণ্ডিতমশাইয়ের ঠ্যাং তিনখানাও গুটিয়ে পিপের ভিতরে ঢুকে গেল এবং পিপেটা মাটির ওপরে গড়াতে-গড়াতে ঘরের দরজার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল!

নিজের চোখকেও আমি বিশ্বাস করতে পারলুম না–এও কখনও সম্ভব হয়?

বিস্ফারিত নেত্রে দরজার দিকে তাকিয়ে আকাশপাতাল ভাবছি আর ঘেমে উঠছি, এমন সময়ে হঠাৎ দেখি, সেখানেও এক অপূর্ব নতুন মূর্তির আবির্ভাব।

.

সপ্তম । মায়াময়ী কমলা

এবারে যার আবির্ভাব হল, তাকে দেখে ভয় পাবার কোনও কারণ ছিল না। কারণ তাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় আর প্রাণ মন খুশি হয়ে উঠে। পরমাসুন্দরী সে–যেন রূপকথার রাজকুমারী!

পরমাসুন্দরী মেয়ের কথা অনেক উপকথায়, অনেক কাব্যে এবং অনেক গল্প-উপন্যাসে পাঠ করেছি। কিন্তু এ-মেয়েটির রূপ সেসব বর্ণনার চেয়েও ঢের বড়! এর চেয়ে সুন্দর রং, গড়ন ও নাক-চোখ-মুখের কল্পনাও করা অসম্ভব! সৃষ্টিছাড়া পিপে-জগতে স্বপ্নলোকের এই মানসকন্যাকে দেখে যেন মোহিনী-মন্ত্রে আমার মন অভিভূত হয়ে গেল!

আমার কাছে এসে মধুর হাসি হেসে সে বললে, আপনিই বুঝি আমার বাবার অতিথি? আপনার নাম কী?

অমলকুমার সেন।

আপনি বুঝি খুব ভয় পেয়েছেন?

এখানে এসে ভয় পায় না, এমন মানুষ দুনিয়ায় আছে নাকি? যে জীবটি এখনই এখান থেকে চলে গেল, তাকে বোধহয় তুমি দ্যাখোনি?

মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠে বললে, বাঃ, কেন দেখব না?

তা দেখেও জিজ্ঞাসা করতে চাও, কেন আমি ভয় পেয়েছি! অমন আরও কতগুলো চাঁদমুখ তোমরা পিপেয় পুরে বন্ধ করে রেখেছ?

অনেক। তা আর গুনে বলা যায় না।

বলো কী! ওদের নিয়ে তোমরা কী করো?

কী আবার করব? ওদের কেউ আমার বন্ধু, কেউ আমার শত্ৰু, কেউ আমার খেলার সাথি, কেউ আমার বাবা

তোমার বাবা! চাঁদের মতন গোল মুখ, ষোলো হাত লম্বা হাত, পিপের মতন দেহ আর তিনখানা পা, উনিই কি তোমার বাবা?

হ্যাঁ গো হা, উনিই আমার বাবা!

কিন্তু তুমি তো দেখছি আমাদেরই মতন মানুষ!

যা দেখছেন এ চেহারা আমার আসল চেহারা নয়।

আমি হতভম্বের মতন বললুম, তার মানে?

আমি আমার পূর্বপুরুষদের চেহারা নকল করেছি। আমার নিজের চেহারা আমি পছন্দ করি না।

মেয়েটি পাগলি নাকি! চেহারার আবার আসল নকল কী? বললুম, তোমার আসল চেহারা কীরকম শুনি?

ওই বাবার মতনই আর কী! তবে বাবার গোঁফ আছে, আমার নেই! মাঝে-মাঝে আমাকেও সেই মূর্তি ধারণ করতে হয়, কারণ এই নকল দেহ নিয়ে বেশিক্ষণ থাকা চলে না। কষ্ট হয়।

মেয়েটি বলে কী? পূর্বপুরুষদের চেহারার নকল, বাবার মতন মূর্তি ধারণ,–এসব উদ্ভট কথা শুনলেও যে পেটের পিলে চমকে ওঠে! এ কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে? কিন্তু তার সরল নির্দোষ শিশু-মুখের পানে তাকালে তো সেকথা মনে হয় না। তবে আমি কি সত্য সত্যই কোনও প্রেতলোকে এসে পড়েছি? পৃথিবীর অনেক বড় বড় পণ্ডিত বলেন, ইহলোকের পর পরলোক বলে যে জগৎ আছে, সেখানে প্রেত আর প্রেতিনী বাস করে। এই কি সেই পরলোক? জুজু-পাহাড়ের খাদের মধ্যে পড়ে গিয়ে আমার কি অনেকক্ষণ আগেই মৃত্যু হয়েছে– এখন কি আমিও ইহলোকের মানুষ নই এবং এই ভয়ানক সত্য কথাটা এখনও বুঝতে পারিনি? না, গল্পের বিখ্যাত অ্যালিসের মতন আমিও এখন ওয়ান্ডারল্যান্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছি নিজের অজ্ঞাতসারে স্বপ্নের ঘোরেই?..কিন্তু মনের এই সব দুর্ভাবনা আমি মুখে না প্রকাশ করেই বললুম, তাহলে তুমিও পিপের ভেতরে থাকো?

হাঁ। কাছিমরা যেমন খোলের ভেতরে থাকে, আমরাও তেমনি পিপের ভেতরে থাকি। তবে তোমাদের মতন তো আমাদের দেহে হাড় নেই, তাই ইচ্ছে করলেই যে কোনওরকম মূর্তি ধারণ করতে পারি। আমাদের দেহ হচ্ছে রবারের মতন–খুশিমতন কমানো বাড়ানো যায়। এই দ্যাখো না–বলেই সে গলাটাকে ক্রমেই বেশি লম্বা করতে লাগল। দেখতে দেখতে তার গলাটা আমাদের রাস্তায় জল দেওয়ার নলের মতন এতটা লম্বা হয়ে উঠল যে, তার মাথাটা জানলার বাইরে গিয়ে হাজির হল!

আমি ভয়ানক ভড়কে গিয়ে খুব চেঁচিয়ে বললুম, থামো থামো–আর দেখতে পারি না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে!

এক মুহূর্তে তার গলা গেল আবার ছোট্ট হয়ে এবং তার মাথাটা হাসতে-হাসতে রবারের বলের মতন এক লাফে আবার যথাস্থানে এসে হাজির!

সে বললে, আবার ইচ্ছে করলে আমার চোখ দুটোকে নিয়ে এইভাবে খেলা করতে পারিকথা শেষ হবার আগেই তার চোখ দুটো কোটর থেকে প্রায় ছয় ইঞ্চি বেরিয়ে এসেই আবার সুড়সুড় করে নিজের কোটরে ফিরে গেল!

আতঙ্কে আমার প্রাণ ধড়ফড় করতে লাগল! রূপকথার রাক্ষস-রাক্ষসীরা খুশিমতন নানারকম মূর্তি ধারণ করতে পারে, তবে কি আমি কোনও রাক্ষস রাজ্যে এসে পড়েছি? আমার মাথার চুল ও গায়ের রোমগুলো পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠল! এখন যে আর স্বপ্ন দেখছি না, এটুকু আমি বেশ বুঝেছি, কিন্তু…কিন্তু…এসব কী অসম্ভব কাণ্ড!

মিনতি ভরা স্বরে বললুম, লক্ষ্মীমেয়েটি, তুমি অমন করে আর আমাকে ভয় দেখিয়ে, তার চেয়ে আমাকে একেবারে মেরে ফ্যালো!

সে আবার খিলখিল করে হেসে উঠে বললে, ও! বুঝেছি, এসব দেখলে তুমি ভয় পাও? আচ্ছা, এই ঘাট মানছি, আর এ কাজ করব না! কিন্তু সত্যি বলছি, এতে ভয় পাবার কিছু নেই, এখানে দুদিন থাকলেই সব তোমার অভ্যাস হয়ে যাবে! এখন তাহলে আসি। সে চলে গেল।

মেয়েটি দেখছি ভারি গায়েপড়া! এই একটু আগে আপনি বলছিল, আর এখনই তুমি বলতে শুরু করেছে। কাল থেকেই হয়তো আমাকে তুইতোকারি করবে!

হঠাৎ দরজার দিকে চেয়েই দেখি, চাঁদমুখো পণ্ডিতমশাই তিনপায়ে দাঁড়িয়ে পিপের ভিতর থেকে মুখ টিপে টিপে হাসছেন।

তিনি বললেন, কী, অমন করে জড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছ যে? কমলা বুঝি তোমার সঙ্গেও দুষ্টুমি করছিল? হ্যাঁ, ও দুষ্টুমি না করে থাকতে পারে না! তারপর? কমলার চেহারা বোধহয় তোমার খুব পছন্দ হয়েছে? তা তো হবেই! তোমার মতে ওইরকম চেহারাই খুব সুন্দর! কিন্তু আমরা তা বলি না। কেন বলি না জানো? আচ্ছা সংক্ষেপে আগে আমাদের ইতিহাস শোনো!

.

অষ্টম। জুজু রাজ্যের ইতিহাস

পণ্ডিতমশাই বলতে লাগলেনঃ

জানো তো, বাংলার বিজয়সিংহ সমুদ্রপথে সিংহলে এসে বাহুবলে সেখানকার রাজা হন? আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন সেই সিংহল জেতা বিজয়সিংহের সঙ্গে।

সমুদ্রে হঠাৎ ঝড় উঠে বিজয়সিংহের নৌবাহিনীর একখানা জাহাজকে বিপথে নিয়ে যায়। অনেকদিন সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে সেই জাহাজখানা শেষটা আফ্রিকায় এসে কুল পায়।

সেই জাহাজে যিনি ছিলেন প্রধান, তার নাম হচ্ছে চন্দ্রসেন। তিনি কেবল সাহসী যোদ্ধাই ছিলেন না। নানা শাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। বৈজ্ঞানিক রহস্য নিয়ে সর্বদাই আলোচনা করতেন। এমন সব ব্যাপার তিনি জানতেন, তোমাদের এখনকার বড় বড় পণ্ডিতও যার কোনওই খবর রাখেন না।

মানুষের দেহ আর মনকে উন্নত করে তাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলবার এক গুপ্ত পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। সে-পদ্ধতি এখানে ব্যাখ্যা করলেও তুমি বুঝতে পারবে না, তা বড়ই জটিল। সে-রহস্য জানবার জন্যে যদি তোমার কৌতূহল হয়, তাহলে এখানকার জাদুঘরে গিয়ে দ্যাখো।

জাহাজে যেসব সঙ্গীরা ছিল, চন্দ্রসেন তাদের নিয়েই নিজের পদ্ধতিটিকে পরীক্ষা করতে লাগলেন। সেই পরীক্ষার ফলেই আমাদের সৃষ্টি হয়েছে।

সুতরাং বুঝতেই পারছ, আমরা একসময়ে ছিলুম তোমাদেরই মতন বাঙালি এবং সেকেলে মানুষ। কিন্তু আমরা এখন তোমাদের মতন অক্ষম আর অসম্পূর্ণ মানুষ নই। আমাদের মন দেহের চাকর নয়, আমাদের মন দেহের প্রভু! আমাদের দেহে একখানাও হাড় নেই, কারণ তা অনাবশ্যক। এই দেহ নিয়ে আমরা যা খুশি করতে পারি,কমলা বোধহয় তার দু-একটা দৃষ্টান্ত তোমাকে না দেখিয়ে ছাড়েনি? তোমাদের মতন আমাদের brain অর্থাৎ মগজ, খুলির ভিতরে চেপটে বন্দি হয়ে থাকে না। সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাই দেহের ওপরে আমাদের অবাধ অধিকার। আমার এই একখানা মুখকে আমি কতরকম করতে পারি–দ্যাখো! (এই বলে পণ্ডিতমশাই কতগুলো এমন ভীষণ ভীষণ নমুনা দেখালেন যে, আমার সর্বাঙ্গ ছমছম করতে লাগল!) যখন যতগুলো দরকার, তখন ততগুলো হাত আর পা আমরা সৃষ্টি করতে পারি! (এই বলে পণ্ডিতমশাই আমার বিস্মিত চোখের সামনে দুকুড়ি হাত-পা বার করে নেড়েচেড়ে দেখালেন!) আমি তোমার মতন ধীরে ধীরে হাঁটতেও পারি, আবার দরকার হলে দৌড়ে মোটরগাড়িকেও হারাতে পারি। আমি কতকাল বাঁচব, সেটাও আমার নিজের ইচ্ছার ওপরে নির্ভর করে।

রাবণ রাজা থাকতেন লঙ্কাদ্বীপে–অর্থাৎ সিংহলে। তার দশ মুণ্ড আর বিশখানা হাত ছিল। আবার দরকার হলে তিনি সাধারণ মানুষের রূপ ধারণ করতে পারতেন। রাবণ রাজার ভাই কুম্ভকর্ণের দেহ ছিল তালগাছের চেয়েও উঁচু। এসব হচ্ছে দেহের ওপরে মনের প্রভুত্বের দৃষ্টান্ত। তোমরা হচ্ছ সাধারণ মানুষ। তাই এসব ব্যাপারকে গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দাও। কিন্তু এ হচ্ছে তোমাদেরই বোকামি। রামায়ণ ও মহাভারত যাঁদের লেখা, তারা কোনওকালে গাঁজা খেতেন বলে প্রমাণ নেই।

খুব সম্ভব রাবণ রাজার দেশে গিয়েছিলেন বলেই চন্দ্রসেন সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ মানুষ সৃষ্টি করবার গুপ্ত পদ্ধতিটা আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। তখনও সিংহলের কোনও কোনও পণ্ডিত হয়তো ওই গুপ্ত পদ্ধতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন। এ-পদ্ধতি এখন খালি আমরাই জানি। তুমি যদি আমাদের সঙ্গে কিছু কাল থাকো, তাহলে তুমিও হয়তো অনেক নতুন জ্ঞান অর্জন করতে পারবে!

অমল, আজ আর বেশি কিছু বলব না। একদিনে বেশি কথা শুনলে তোমার অসম্পূর্ণ ছোট মগজ হয়তো গুলিয়ে যাবে। আজ এই পর্যন্ত। এসো আমার সঙ্গে!

পণ্ডিতমশাইয়ের সঙ্গে আমি পাশের ঘরে গিয়ে হাজির হলুম। সেখানে দু-খানা জলচৌকির মতন ছোট ছোট টেবিলে রাশিকৃত ফলমূল সাজানো রয়েছে। পণ্ডিত তার পিপে দেহের একদিকটা। মাটির ওপরে বসিয়ে পা তিনখানা ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে বললেন, বোসো অমল, খেতে বোসো। আমরা খাওয়াদাওয়ায় বেশি সময় নষ্ট করি না। বলেই তিনি অজগর সাপের মতন মস্ত একটা হাঁ করে মিনিট দুয়েকের মধ্যে প্রায় একঝুড়ি ফল উদরস্থ করে ফেললেন। তারপর জলপান করে বললেন, ব্যাস, খাওয়া তো হল,–এইবারে ওঠো!

খাওয়া হল না ছাই হল! এঁরা খাওয়াদাওয়ায় বেশি সময় নষ্ট না করতে পারেন, কিন্তু দু-মিনিটে যারা দশজন লোকের খোরাক গপগপ করে গিলে ফেলতে পারে, তাদের আর বেশি সময়ের দরকার কী? এই চাঁদমুখো পণ্ডিতের সঙ্গে খেতে বসলে আমাকে উপোস করে মরতে হবে দেখছি! তাড়াতাড়ি করেও দু-মিনিটে আমি দুটো আপেল পার করতে পারলুম না। কী আর করি, পণ্ডিত যখন চোখ বুজে জলপান করেছিলেন, তখন আমি, গোটাকয়েক ফল টপটপ করে পকেটে পুরে ফেললুম!

পণ্ডিত মুখ মুছতে-মুছতে বললেন, বেশি খেলে মগজ ভোতা হয়ে যায়। তাই আমি নামমাত্র খাই। কিন্তু আমাদের দেশেও এমন অনেক নিরেট বোকা আছে, যারা মনে করে বেশি খেলে দেহের তেজও বেশি হয়। এদের বুদ্ধির গলায় দড়ি। ওই যে, নাম করতে করতেই ওই দলের একটি নির্বোধ আমাদের দিকেই আসছে!

ফিরে দেখি, প্রকাণ্ড একজন পিপে-মানুষ হেলেদুলে হাঁসফাস করতে করতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। তার পিপেটা এমন ভয়ানক মোটা যে ওর মধ্যে পণ্ডিতের মতন দু-দুজন লোকের ঠাঁই হতে পারে। তার মুখখানাও সবচেয়ে বড় বারকোসের মতন। কপালে গালে বড়ির মতন বড় বড় আঁচিল আর তার ঠোঁটে এমনি ন্যাকামি মাখানো হাসি যে দেখলেই গা যেন জ্বলে যায়! লোকটাকে মোটেই আমার পছন্দ হল না!

সে এসে একবার সবিস্ময়ে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললে, প্রিয় পণ্ডিতমশাই, এই বুঝি সেই জীবটা? বটে! আমি এটাকেই দেখতে এসেছি।

পণ্ডিত বললেন, এই ভদ্রলোকের নাম শ্রীঅমলকুমার সেন, নিবাস বাংলাদেশ! ভোম্বল, এঁর সম্বন্ধে তুমি ওরকম ভাষায় কথা কোয়ো না!

ভোম্বল অমনি সুর বদলে চোখ মটকে বললে,  নিশ্চয়, নিশ্চয়! আপনার বন্ধু তো আমারও বন্ধু! হ্যাঁ, ভালো কথা কমলা কোথায়?

পণ্ডিত বললেন, এতক্ষণে সে বোধহয় মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়িতে গিয়েছে। আপাতত তুমি এক কাজ করতে পারো ভোম্বল? অমলকে নিয়ে খানিকটা বেড়িয়ে আসবে?

ভোম্বল বললে, নিশ্চয়, নিশ্চয়! আপনার কথায় আমি প্রাণ দিতে পারি, এটা তো অতি তুচ্ছ ব্যাপার! আসুন অমলবাবু, আমার সঙ্গে আসুন! আপনাকে আমি জাদুঘরে নিয়ে যাব। সেখানে একটা ভালো হোটেল আছে, একটু-আধটু খাওয়া-দাওয়াও করা যাবে কী বলেন? বলেই সে মহা মুরুব্বির মতন আমার পিঠ চাপড়ে দিলে।

পণ্ডিত বললেন, সন্ধের আগেই ওকে আবার ফিরিয়ে আনা চাই। মনে রেখো, ওর ভার এখন তোমার উপরে, ওর জন্যে তুমি দায়ী হবে! বলেই তিনি হাত-পা ভিতরে গুটিয়ে নিয়ে গড়াতে-গড়াতে ঘর থেকে বেগে বেরিয়ে গেলেন।

.

বম । নরডিম্ব

ভোম্বল চোখ দুটো নাচাতে নাচাতে বললে, যখন পণ্ডিতের হুকুম, পালন করতেই হবে। অমলবাবু, তাহলে আপনি হচ্ছেন একটি মনুষ্য? আমাদের দেখে আপনার কী মনে হয়? বলেই সে দন্তবিকাশ করে হাসলে।

আমি জবাব দিলুম না।

সে আবার দন্তবিকাশ করে হেসে বললে, আপনি গড়িয়ে গড়িয়ে হাঁটতে পারেন?

আমি চটে গিয়ে বললুম, নিশ্চয়ই পারি না! দেখতেই পাচ্ছেন আমি পিপে নই!

তাহলে উপায় নেই–আমাকেও দেখছি আপনার সঙ্গে ছোটলোকের মতন পায়ে হেঁটে মরতে হবে। পায়ে হাঁটা এক ঝকমারি। হাঁপ ধরে।…আসুন, এই পথে।

ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে দেখি, একটা পথ ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে। সেটা হচ্ছে সিঁড়ি! এদের সিঁড়িতে ধাপ নেই–তাই গড়িয়ে নামবার সুবিধা হয়। আমার কিন্তু একটু মুশকিল হল। ঢালু পথ দিয়ে নামতে গিয়ে দু-চার বার হুমড়ি খেয়ে পড়বার মতন হলুম। এবং শেষ পর্যন্ত টাল সামলাতে পারলুমও না। খানিকটা সড় সড় করে নেমে গিয়ে মস্ত একটা ডিগবাজি খেয়ে দড়াম করে নীচের চাতালের ওপরে আছাড় খেয়ে পড়লুম।

ভোম্বলের কিন্তু কোনওই বালাই নেই। সে হাত-পা ভিতরে গুটিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চোখের নিমিষে নীচে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর দন্তবিকাশ করে ন্যাকামির হাসি হেসে বললে, দেখছেন, শ্রীখোলের ভেতরে থাকার কত সুবিধে!

আমি রাগে মুখ ভার করে বললুম, আমাদের দেশে গেলে আপনিও বুঝতেন কত ধানে কত চাল! আমাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে হলে আপনার ভোলা ফেটে চৌচির হয়ে যেত!

ভোম্বল বললে, আপনাদের দেশে যাচ্ছে কে? অসভ্য দেশ!

আমি আর কিছু বললুম না। তার সঙ্গে বাড়ির বাহির হয়ে রাজপথের ওপরে গিয়ে। দাঁড়ালুম।

সে এক নতুন দৃশ্য! রাজপথের দু-ধারে সারি সারি বাড়ি কিন্তু কোনও বাড়ির সঙ্গেই কোনও বাড়ির গড়ন মেলে না। প্রত্যেক বাড়ির ওপর দিকটা খিলানের আকারে গড়া– আঁকাবাঁকা, কিম্ভুতকিমাকার!

কলকাতার আপিস অঞ্চল যেমন আকাশমুখো মস্ত মস্ত বাড়ি আছে, এখানেও তার অভাব নেই। কিন্তু এদেশি ঢ্যাঙা বাড়িগুলোর আমাদের চিলের ছাদের মতন ঢালু সিঁড়ির কথা ভেবে আমার বুক কাঁপতে লাগল! ওসব সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময়ে এরা হয়তো যথেচ্ছভাবে বিশ-পঁচিশ খানা অসম্ভব ও ভূতুড়ে হাত-পা বার করে ওপরে উঠে যায়, কিন্তু ওসব সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে গেলে গতর চূর্ণ হয়ে আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত!

রাস্তায় আমাদের দেশের মতন গোলমালও নেই। পথ দিয়ে ধীরে ধীরে বা দ্রুতবেগে পিপের পর পিপে গড়িয়ে যাচ্ছে, খুব কম লোকই পায়ে হেঁটে চলছে! যারা পদব্রজে যাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকেরই তিনখানা করে পা দেখে বোঝা গেল যে, ইচ্ছামতো পদবৃদ্ধি করতে পারলেও সাধারণত এরা তিনখানা পদই ব্যবহার করে।

গরুর গাড়ির চাকার মতনই বড় অনেকগুলো চক্রও রাস্তার ওপর দিয়ে বনবন করে ছুটছে! এক-একখানা চাকা আবার এত বড় যে, মাপলে আট-দশ হাতের কম চওড়া হবে না! চাকাগুলো ছুটে যাচ্ছে ঠিক মোটরগাড়ির বেগে। এমন কায়দায় তারা এঁকেবেঁকে ছোট ছোট পিপের পাশ কাটিয়ে ছুটছে যে দেখলে তারিফ করতে হয়। কিন্তু পিপেদের সঙ্গে ধাক্কা লাগলেও কোনও পক্ষ থেকেই এখানে যে আপত্তি হয় না, সে প্রমাণ পাওয়া গেল। কারণ একবার একখানা চাকা বিপরীত দিক থেকে ধাবমান একটা পিপের ওপরে উঠে আবার গড়িয়ে নেমে চলে গেল, তবু কোনও পক্ষ থেকেই কোনও গোলমাল হল না–যেন এ ব্যাপারটা এত বেশি তুচ্ছ যে, লক্ষ করবার মতনই নয়!

আমার পাশের হৃষ্টপুষ্ট জীবটি অর্থাৎ ভোম্বলদাস লকলকে জিভ দিয়ে ঠোঁটটা একবার চেটে নিয়ে বললে, কী অমলা, আমাদের দেশ দেখে তুমি যে দেখছি থ হয়ে গেলে!

অমলা! আমি খাপ্পা হয়ে বললুম, আপনি আমাকে অমলা বলে ডাকছেন যে? আমার নাম অমল।

ভোম্বল দন্তবিকাশ করে বললে, ঠাট্টা করলে চটো কেন? ও অমল আর অমলা একই কথা!

আমি বললুম, না, অমল আর অমলা একই কথা নয়! ওরকম ঠাট্টা আমি পছন্দ করি না!

ভোম্বল বললে, বাপরে তুমি তো ভারি বেরসিক কাঠগোঁয়ার হে? একটুতেই এত বেশি চটো কেন? তোমার মুখখানা এখন কীরকম দেখতে হয়েছে জানো? এইরকম! বলেই ভোম্বল তার মুখখানা বিকৃত করতে লাগল। এবং আমার চোখের সামনেই দেখতে-দেখতে তার অদ্ভুত মুখখানা অবিকল আমার মুখেরই মতন হয়ে উঠল! সে যে কী প্রাণ চমকানো ব্যাপার, ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ তা বুঝবে না। আমার চোখের সুমুখেই আর একজন আমির আবির্ভাব! শেষটা আমি আর সইতে পারলুম না, বলে উঠলুম, ক্ষান্ত হন মশাই, ক্ষান্ত হন! আমি ঘাট মানছি!

ভোম্বলের মুখ আবার ভোম্বলেরই মতন কুৎসিত হয়ে গেল। দন্তবিকাশ করে হেসে বললে, দেবরাজ ইন্দ্র যে বিদ্যার জোরে মহর্ষি গৌতমের মূর্তি ধারণ করেছিলেন, আমিও সেই বিদ্যা জানি! হ্যাঁ, আর পণ্ডিতের মেয়ে কমলাও এ বিদ্যায় ভারি পাকা। এ রাজ্যে এই বহুরূপী বিদ্যায় আমাদের আর জুড়ি নেই–আমাদের মতন ভালো নকল আর কেউ করতে পারে না! না, মিছে কথায় সময় কাটানো হচ্ছে–আমার খিদে পেয়েছে! চলো জাদুঘরে যাই! চাকা! এই চাকা! বলেই সে এমন তীক্ষ্ণ শিস দিল যে আমার মনে হল কানের কাছে বুঝি কোনও কলের গাড়ির ইঞ্জিন বাঁশি বাজালে!

কোথা থেকে সোঁ-সোঁ করে দু-খানা মস্ত চাকা আমাদের সামনে এসে হাজির। তাদের চঞনাভির মধ্যে অর্থাৎ মাঝখানে দুজন পিপে-মানুষ কী কৌশলে নিজেদের সংলগ্ন করে রেখেছে এবং হাতে করে পাখির দাঁড়ের মতন বেয়াড়া এক বসবার আসন ধরে আছে।

লোকে যেমন করে ব্যাগ বা পোর্টম্যান্টো গাড়ির ওপরে উঠিয়ে দেয়, ভোম্বল ঠিক তেমনি ভাবেই ধরে আমাকে সেই দাঁড় আসনে তুলে বসিয়ে দিলে! তারপর নিজেও আমার পাশে এসে বসে হেঁকে বললে, এই! জাদুঘর শিগগির!

বোঁ করে চাকা ছুটল–কে যেন আমাকে এক হাচটা টান মেরে দাঁড় থেকে ফেলে দেয় আর কী! কী কষ্টে যে ঝোঁক সামলে নিলুম, তা আর বলবার নয়! চাকা দুখানা ছুটল ঠিক আমাদের পাঞ্জাব মেলের মতন, হু-হু হাওয়ার তোড়ে নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। দাঁড়ের ওপর বসে থাকে, কার সাধ্য!–ভোম্বলের কিন্তু কোনওই খেয়াল নেই– দন্তবিকাশ করে হাসতে হাসতে সে দিব্যি আরামেই যাচ্ছে! গাড়ির পায়ে নমস্কার!

আচমকা গাড়িখানা দাঁড়িয়ে পড়ল। এবং এবারে আমি কিছুতেই টাল সামলাতে পারলুম না–দাঁড় থেকে ঠিকরে দশ হাত দূরে খুব নরম কী একটা জিনিসের ওপর দিয়ে পড়লুম এবং পরমুহূর্তেই সে জিনিসটাও আমাকে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলে।

খনখনে গলায় কে বলে উঠল, কীরকম লোক মশাই আপনি?

আমি নিশ্চয় কারুর ঘাড়ের ওপরে গিয়ে পড়েছিলুম। তাড়াতাড়ি মাটি থেকে উঠে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললুম, আমাকে মাপ করবেন! আমি–

আপনি কি দেখতে পাননি যে, আমি এখন আমার শ্রীখোলের ভেতরে নেই? আপনি কি চোখের মাথা খেয়েছেন? আপনি কি–ও হরি, এটা যে সেই মানুষটা!

এতক্ষণ পরে আমি একটু দম পেলুম এবং আমার চোখের ধোঁয়া ধোঁয়া ভাবটা কেটে গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, একটা পিপে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে।

অনুতপ্ত স্বরে বললুম, দেখুন, এরকম দাঁড়ে চড়ার অভ্যাস আমার কোনও কালেই নেই। তাই

আরে গেল, এ যে আমার শ্রীখোলের সঙ্গে কথা কয়! মশাই কথা কইতে হয় তো আমার সঙ্গে কথা বলুন।

তখন ডান দিকে ফিরে দেখি, পথের ওপরে জেলি মাছের মতন কী একটা পড়ে রয়েছে। তার মাঝখানে একখানা থলথলে মুখ থরথর করে কাঁপছে। এবং তার চোখ দুটো ক্রোধে ও রুদ্ধ আক্রোশে আমার পানে তাকিয়ে যেন জ্বলে জ্বলে উঠছে! মুখখানা এক-এক বার ফুলছে, আবার হাওয়া বেরিয়ে গেলে ফুটবলের ব্লাডারের অবস্থা যেমন হয়, তেমনি চুপসে যাচ্ছে!

এখন ডোম্বলের হাসির ঘটা দেখে কে! হাসতে-হাসতে তার চোখ দিয়ে জল ঝরছে। অনেক চেষ্টার পর হাসি থামিয়ে সে বললে, অমল, তুমি একেবারে ও বেচারার মাঝখানে। গিয়ে ঝাঁপ খেয়েছ, আর ওর দম তাই ফুরিয়ে গেছে! ওহে নসু! ভায়া, এ লোকটি জেনেশুনে এ কাজ করেনি, তুমি ঠান্ডা হও! আর এও বলি, রাস্তার মাঝখানে শ্রীখোল থেকে বেরিয়ে আসা তোমার উচিত হয়নি!

নসু মুখ ভেংচে বললে, খুব তো মুখশাবাশি করছ, নিজে এ-দশায় পড়লে টের পেতে! আমার গা-টা নদী না পুকুর, যে ও লোকটা এসে অমন করে ঝপ খাবে! যাও, যাও আমার পিলে একেবারে চমকে গেছে! এমনি বকবক করতে করতে সে উঠে নিজের পিপের ভিতরে গিয়ে ঢুকল এবং তিনখানা ঠ্যাং ও খানকয়েক হাত বার করে বারকয়েক ছুড়লে এবং তারপর হঠাৎ সব গুটিয়ে নিয়ে গড়গড়িয়ে পথ দিয়ে ছুটে চলল!

ভোম্বল বললে, এই হচ্ছে আমাদের জাদুঘর। যাও, তুমি ভেতরে ঢুকে চারিদিক ভালো করে দেখে এসো গে যাও! মানকে! তুই এই ভদ্রলোককে সমস্ত দেখিয়ে আন! এই বলে সে একদিকে এগিয়ে চলল।

ভোম্বল আমাকে তুমি বলে ডাকছে, তা আমিও বললুম, ওহে ভোম্বল, তুমি কোথায় চললে?

হোটেলে, আর যৎকিঞ্চিৎ পেটে না দিলে চলে না! জাদুঘর দেখে-শুনে তুমি আবার আমার কাছে এসো। সে আর আমার দিকে ফিরেও তাকালে না–খাবারের গন্ধ বোধহয় তার নাকে ঢুকেছে।

আমারও পেটে এখন আগুন জ্বলছে। একবার ভাবলুম আমিও হোটেলে গিয়ে ঢুকি, কিন্তু এদেশে আমাদের টাকাপয়সা যদি না চলে, তবে খাবারের দাম দেব কেমন করে? এমনি সাত-পাঁচ ভেবে শ্রীমান মানকের সঙ্গে আমি যাদুঘরের ভিতরেই প্রবেশ করলুম।

জাদুঘরের ভিতরে ঢুকে আমি যে কত রকমের অজানা জিনিস দেখলুম তা আর গুনে ওঠা যায় না! এই অদ্ভুত জীবদের স্রষ্টার নিজের হাতে আঁকা অনেকগুলো ছবিতে বুঝিয়ে দেওয়া আছে, মানুষের দেহের উপাদান থেকে কেমন করে এদের দেহ গড়া হয়েছে, কেমন। করে তাদের মাংসের ভিতর থেকে হাড় বাদ দেওয়া হয়েছে, দ্রব্যগুণের মহিমায় এদের মগজের শক্তি কেমন করে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে প্রভৃতি। সেসব এখানে অকারণে বর্ণনা করে লাভ নেই, কারণ আসল ছবিগুলো না দেখলে কেউ কিছু বুঝতে পারবেন না!

অনেকগুলো পাথরের কিম্ভুতকিমাকার মূর্তি রয়েছে। সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় এই পিপে মানুষগুলোর চেহারা কীরকম ছিল, সেই মূর্তিগুলোর সাহায্যে তাইই দেখানো হয়েছে।

এক জায়গায় একটা যন্ত্র দেখলুম, তার নাম নরডিম্ব-প্রস্ফুটন-যন্ত্র! তার পাশে রয়েছে। উটপাখির ডিমের মতন মস্ত একটা ডিম–উপরে লেখা নরডিম! দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল বললেও কম বলা হয়!–ওরে বাবা! ঘোড়ার ডিমের কথা তো লোকের মুখে শুনেছি, মানুষের ডিম আবার কী? এর কথা তো ঠাট্টা করেও কেউ বলে না!

অনেকক্ষণ সেই ডিম আর যন্ত্রের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলুম। কিন্তু তবু কোনও হদিস না পেয়ে স্থির করলুম-নিশ্চয়ই এটা একটা বড় রকমের কৌতুক! জাদুঘরে এরকম গাঁজাখুরি কৌতুক থাকা উচিত নয়।

আর একটা ঘরে গিয়ে দেখলুম চন্দ্রসেনের প্রকাণ্ড প্রতিমূর্তি। চন্দ্রসেন–এই অদ্ভুত জীবদের স্রষ্টা! সে মূর্তি দেখে মনে কিছুমাত্র শ্রদ্ধার উদয় হল না। বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়া, শীর্ণদেহের এক বৃদ্ধ–তার দুই চক্ষে ঠিক যেন হিংসা-পাগল হত্যাকারীর দৃষ্টি। দেখলেই ভয়ে বুক শিউরে ওঠে! আমার মনে হল চন্দ্রসেনের চোখদুটো যেন কুটিল ভাবে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। এ-রাজ্যে সাধারণ মানুষের আবির্ভাব দেখে চোখদুটো যেন মোটেই খুশি নয়!

ঘরের ভিতরটা তখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে এসেছে। ভয়ে-ভয়ে পিছন পানে তাকিয়ে। দেখি, সেই মানকে বলে লোকটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে বললে, এ-ঘরে আর বেশিক্ষণ থাকবেন না।

আমি বললুম কেন?

মানকে ভয়েভয়ে খুব চুপিচুপি বললে, অন্ধকার হলে এ-ঘরে আর কেউ আসে না।

কেন?

একটা হাত তুলে চন্দ্রসেনের মূর্তি দেখিয়ে সে বললে, ওঁর ভয়ে!

আমি আবার মূর্তির দিকে তাকালুম। কোনও জানলার ফাঁক দিয়ে একটি ক্ষীণ আলোকের টুকরো মূর্তির ঠোঁটের ওপরে এসে পড়েছে। আমার মনে হল, চন্দ্রসেনের মুখে যেন একটা রক্তপিপাসু নিষ্ঠুর হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।

ফিরে বললুম, ওঁর ভয়ে কীরকম? ওটা তো পাথরের মূর্তি?

সে বললে, অন্ধকার হলেই ওই মূর্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে। তখন সকলেই শুনতে পায় কে যেন ভারী ভারী পাথুরে পা ফেলে ঘরময় চলে বেড়াচ্ছে। আসুন, আমি আর এখানে থাকব না।

আমি তার কথা বিশ্বাস করলুম না বটে, কিন্তু এই ঘরে–এমনকী জাদুঘরেও আর থাকতে ইচ্ছা হল না। একেবারে বাইরে বেরিয়ে হোটেলের দিকে গেলুম ভোম্বলের খোঁজে।

সেখানে গিয়ে দেখি, ভোম্বল ততক্ষণে মহাধুমধাড়াক্কা লাগিয়ে দিয়েছে। তার খাবার টেবিলের উপরে পঁচিশ-ত্রিশ খানা থালা পড়ে রয়েছে এবং একটা ঘটিতে মুখ দিয়ে ঢক ঢক করে কী পান করছে।

আমাকে দেখেই ভোম্বল টেবিল চাপড়ে খুব ফুর্তির সঙ্গে বলে উঠল, এই যে অমলা! এসো, এসো, একটু ভাং খাবে এসো!

মনের রাগ কোনওরকমে সামলে বললুম, আমি সিদ্ধি ছুঁই না! সন্ধের আগে আমার ফেরবার কথা, আমাকে নিয়ে চলো!

ভোম্বল তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ভাগ্যিস মনে করিয়ে দিলে! চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। নইলে পণ্ডিতবুড়োটা রাগ করবে, আর তার মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে না!

মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবে না মানে?

ওহ, তুমি জানো না বুঝি? কমলার সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ যে স্থির হয়ে আছে।

কমলা! অমন সুশ্রী মেয়ের সঙ্গে এই বিটকেল জন্তুটার বিয়ে হবে! আশ্চর্য!

ভোম্বল বললে, শোনো। আমি যে ভাং খাই, পণ্ডিতবুড়োকে একথা বোলো না। যদি বলল, তাহলে তুমি বিপদে পড়বে! এখন চলো।

আমরা দুজনে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলুম।

ভোম্বল বেজায় টলছিল। তাই বোধহয় তিনখানা পায়ে আর টাল সামলাতে না পেরে খান ছয়েক পা বার করে হাঁটতে লাগল। তারপর চারখানা হাত বার করে চার হাতে তালি। দিতে-দিতে গাইতে লাগল–

ও তার নামটি যে ভাই অমলা!
ও সে নয়কো তবু অবলা!
তাকে দাও না সবাই কানমলা–
কানমলা হো! কানমলা
কানমলা! তার নাম অমলা!
ঠ্যাং আছে তার মোটে দুটো,
মগজে তার মস্ত ফুটো, বু
দ্ধিতে তাই ডাহা ঝুটো–
করো না তাকে চ্যাং-দোলা!
ও তার নাম রেখেছি অমলা!

হয় কুপোকাৎ চড়লে গাড়ি,
ভবঘুরের নেইকো বাড়ি,
কী চেহারা! ঠিক আনাড়ি!
খোরাক খালি কাঁচকলা!
ও তার নাম রেখেছি অমলা!
ও সে নয়কো তবু অবলা!
তাকে। দাও না জোরে কানমলা,
কানমলা হো। কানমলা–
কানমলা! তার নাম অমলা!

আমার এমন রাগ হতে লাগল ইচ্ছা হল, মারি তার গালে ঠাস করে এক চড়! কিন্তু হতভাগা এখন মত্ত, একে মারা না মারা দুই-ই সমান! কাজেই মুখ বুজে তার সব অসভ্যতা সহ্য করতে হল।

.

দশম। আমি নতুন মানুষ হব

পরের দিন সকালে পাখির গানে আমার ঘুম ভেঙে গেল।

জানলার ধারে পুচ্ছ নাচিয়ে একটি চমৎকার রঙিন পাখি মিষ্টি সুরে গান গাইছিল।

আমাদের চেনা পৃথিবীর পাখি দেখে চোখ যেন জুড়িয়ে গেল! ভাগ্যিস, চন্দ্রসেনের মগজে এখানকার পাখিদের দেহকেও উন্নত করবার খেয়াল গজায়নি!

এমন সময়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলে সুন্দরী কমলা। তার মুখখানি কেমন যেন ম্লান ম্লান।

আমি শুধালুম, তোমার মুখ অমন কেন? অসুখ করেছে নাকি?

কমলা বললে, না! বাবা আমার ওপরে রাগ করেছেন।

কেন?

আমি এইরকম মূর্তি ধরেছি বলে। তিনি বললেন, আমি যদি শ্রীখোলের ভেতরে না থাকি তাহলে আমার পাপ হবে। একথা কি সত্যি?

তোমার যদি ভালো না লাগে, তবে কেন তুমি খোলার ভেতরে থাকবে?

আমিও তাই বলি। বাবা কিন্তু বোঝেন না। বাবা ভারি একরোখা মানুষ। আচ্ছা, বাবা যে বলেন, তুমি নাকি আমাদের মতন হরেকরকম মূর্তি ধরতে পারো না, তোমার দেহ নাকি হাড়ে হাড়ে ভরা, আর তুমি নাকি গড়াতে পারো না? একথা কি সত্যি?

সত্যি।

তোমার শ্রীখোল নেই?

নিশ্চয়ই নেই! আমাদের দেশে খোলার ভেতরে থাকে কেবল কচ্ছপ, কাঁকড়া, শামুক আর গেঁড়ি-গুগলিরা।

আমি কেতাবে তোমার মতন জীবের কথা পড়েছি বটে, কিন্তু এর আগে চোখে কখনও দেখিনি। আচ্ছা, তোমাদের দেশে সব মানুষই কি একরকম দেখতে?

হ্যাঁ।

তোমার চেহারা আমার খুব ভালো লাগে। আচ্ছা, তোমাদের দেশের মেয়েদেরও দেখতে কি আমাদেরই মতন?

হ্যাঁ। তবে তারা তোমার মতন এত সুন্দর নয়।

আমার কথা শুনে কমলা খুব খুশি হয়ে হাসতে লাগল।

জানালা দিয়ে দূরের একখানা বাড়ি দেখিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলুম, আচ্ছা কমলা, ওই যে মস্ত বাড়িখানা দেখা যাচ্ছে, ওখানে কী হয়?

কমলা একবার উঁকি মেরে দেখে বললে, ও হচ্ছে স্ফুটনাগার!

সে আবার কী?

দুর, তুমি ভারি বোকা! কিচ্ছু জানো না! ওখানে যে ছেলেমেয়েরা জন্মায়! আমার পিঠ কটকট করছে, আমি এখন শ্রীখোলের ভেতরে ঢুকতে চললুম। আমার সে মূর্তি আমি তোমাকে দেখাব না, তাহলে তুমি আমাকেও ঠাট্টা করবে! পিঠে কালো কেশমালা দুলিয়ে। কমলা একছুটে চলে গেল।

আমি দুই চোখ মুদে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলুম, স্ফুটনাগার আবার কাকে বলে? কমলার কথায় তো কিছুই স্পষ্ট হল না!

হঠাৎ ঘরের ভিতরে পণ্ডিতমশাই ও আর-একজনের গলা পেলুম। আমি উঠে বসতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তার পরেই ভাবলুম ওরা কি বলাবলি করে চুপিচুপি শোনাই যাক না!

খানিক পরেই বুঝলুম, ওরা আমার সম্বন্ধেই কথা কইছে! ওরা বোধহয় ভেবেছে, আমার ঘুম এখনও ভাঙেনি, আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না!

অচেনা গলায় কে বললে, পণ্ডিতমশাই, আপনার এই নমুনাটি বেশ সরেস নয়।

পণ্ডিত বললেন, তা না হতেও পারে। কিন্তু এই নিরেস নমুনা নিয়েই আমরা যদি কেল্লা ফতে করতে পারি, তাহলে তো আমাদের সুনাম আরও বেশিই হবে! আমার ধ্রুব বিশ্বাস যে একবার অস্ত্র করলেই আমি ওর দেহকে ঠিক বদলাতে পারব।

তারপর?

আরও অনেক মানুষ ধরে এনে এই একই উপায়ে আমাদের জাতির জীবনীশক্তি বাড়িয়ে তুলব। এ ছাড়া আর উপায় নেই–বহু বৎসরের পুরোনো হয়ে পড়েছে বলে এখানকার সকলেরই জীবনীশক্তির অবস্থা হয়ে আসছে ক্রমেই ক্ষীণ!

অস্ত্র করবার আগে ওই লোকটাকে কি সব কথা জানানো হবে?

অমরচন্দ্র, তুমি একটি আস্ত গাড়ল। আমাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলে অমল মোটেই খুশি হবে না।

কী পদ্ধতিতে আপনি কাজ করবেন?

প্রথমে অমলের দেহকে আমি লম্বালম্বি ভাবে ফালাফালা করে কাটব। তারপর দেহের সেই খণ্ডগুলোকে বাজের আগুনে তাতিয়ে হাড়গোড় সব বার করে নেব।

এতক্ষণ শান্ত ভাবে চুপ করে সব শুনছিলুম, কিন্তু এই পর্যন্ত শুনেই আতঙ্কে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলুম আর কী! ওরে চাঁদমুখো বুড়ো রাক্ষস, তোর মনে মনে এত শয়তানি?

অমরচন্দ্র বললে, কিন্তু পণ্ডিতমশাই, মনে আছে তো, গেল বছরে সেই তুর্কি লোকটার ওপরে অস্ত্রাঘাত করে আপনি বিফল হয়েছিলেন। সেই থেকে মহারাজা হুকুম দিয়েছেন, এ রাজ্যে কেউ আর এরকম পরীক্ষা করতে পারবে না?

হুঁ। কিছুই আমি ভুলিনি। কিন্তু আমি কাজ সারব খুব লুকিয়ে। তারপর যদি সফল হই, মহারাজা আর আমার ওপরে রাগ করতে পারবেন না। সেবারের পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছিল বলেই তো অত গোলমাল হয়!

এখানকার অনেক পণ্ডিতও আপনার শত্রু, এ কথাটাও মনে রাখবেন! আর রাজসভায় ভোম্বলদাসের খুবই পসার, সে-ও আপনার বিশেষ বন্ধু নয়!

পণ্ডিত বললেন, সবই আমার মনে আছে। যেদিন অস্ত্র করব, তুমি হাজির থাকবে তো?

নিশ্চয়ই! প্রমোদকেও নিয়ে আসব।

হ্যাঁ, তাকেও দরকার হবে বইকী,–ছুরি চালাতে ছোকরা খুব মজবুত!

অমরচন্দ্র বললে, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনার এবারকার পরীক্ষা যেন সার্থক হয়–চন্দ্রসেনের প্রেতাত্মা যেন আমাদের সাহায্য করেন।

তারপর পায়ের শব্দে বুঝলুম, দুই শয়তান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হুঁ, তা হলে আমার দেহকে লম্বালম্বি ভাবে ফালাফালা করে কেটে, বাজের আগুনে তাতিয়ে, হাড়গোড় বার করে নিয়ে নতুন এক পরীক্ষা করা হবে? ওঃ, কী সুমধুর কথা রে, শুনে অঙ্গ যেন জল হয়ে গেল!

আমি ভয় পেয়েছি? ধেৎ, ভয় তো খুব ছোট কথা, আমার বুকটা এরই মধ্যে কুঁকড়ে যেন শুকনো চামড়ার মতন শক্ত হয়ে উঠেছে।

এমন সময়ে ঘরের ভিতরে আবার পায়ের শব্দ!

ইনি আবার কোন অবতার? এখানে এসে বুক ধড়াস ধড়াস করেই প্রাণটা বেরিয়ে যাবে দেখছি। সর্বদাই নতুন-নতুন বিপদের ভাবনায় মনটা অস্থির হয়ে আছে। যে সৃষ্টিছাড়া দেশ!

কান পেতে মটকা মেরে পড়ে রইলুম।

তার পরেই ভোম্বলদাসের ভরাট ভারিকে গলায় শুনলুম, আরে ও কী! ওহে অমল, তোমাদের দেশের লোকেরা কি এত বেলা পর্যন্ত বিছানায় কাত হয়ে থাকে?

আমি উঠে বসে নির্বাক হয়ে রইলুম–ভোম্বল কালকে যে গানটা গেয়েছিল, সেটা এখনও আমি ভুলতে পারিনি। আমার নাম অমলা? আমায় দেবে কানমলা? বটে!

ভোম্বল তার কাতলা মাছের মতন ড্যাবডেবে চোখে আমার মুখের পানে চেয়ে বুঝতে পারলে যে, আমি তার ওপরে একটুও খুশি নই। সে আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললে, অমল! ভায়া! কাল সন্ধের সময়ে আমি বেঁকের মুখে একটা গান গেয়ে ফেলেছিলুম। তা ভাই, বন্ধুত্ব থাকলে অমন হয়েই থাকে। তুমি কিছু মনে কোরো না।

আমি নিজের মুখখানা আরও বেশি গোমড়া করে তুললুম। আর সত্যি বলতে কী, এই ভূতুড়ে জন্তুটা আমাকে তার বন্ধু মনে করে শুনে আমার রাগ যেন আরও বেড়ে উঠল। আমি হব এইসব অপরূপ চেহারার বন্ধু? তা আর জানি না কচুপোড়া খাও!

আমি এখনও কথা কইলুম না দেখে ভোম্বল আরও দমে গিয়ে বললে, হ্যাঁ ভাই অমল, তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে মাপ করবে না? দ্যাখো, এই আমি আট হাত বার করলুম! আট হাত জোড় করে আমি মাপ চাইছি এমন কাজ আর কক্ষনোও করব না! বলো তো আমি চার-পাঁচটা নাক বের করে চার-পাঁচটা নাকে খত দেব!

ধাঁ করে আমার মাথায় এক বুদ্ধি এল। আমি বেশ বুঝলুম ভোম্বলের সিদ্ধি খাওয়ার কথাটা পণ্ডিতের কানে তুলে দিলে পাছে কমলার সঙ্গে তার বিয়ের সম্বন্ধটা ভেঙে যায়, সেই ভয়েই সে আমার কাছে এত কাকুতিমিনতি করছে! নইলে মনেমনে সে নিশ্চয়ই আমাকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না! হাতে যখন পেয়েছি, তখন আর একে হাতছাড়া করা নয়! এই ভীষণ শত্ৰুপুরীতে একে দিয়েই কাজ করিয়ে নিতে–অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাটা তুলতে হবে।

কাজেই এইবারে আমি মুখ খুলে বললুম, ওরকম গান তুমি আর কখনও গাইবে না?

না, না, না! এই তিন সত্যি!

আচ্ছা, এবারের মতন তোমাকে মাপ করা গেল!

কালকের কথা কারুকে বোলো না?

না।…কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। তোমার কি রাজসভায় যাতায়াত আছে?

খুব আছে! রাজা যে আমাকে বড় ভালোবাসেন।

আচ্ছা ভোম্বল, তুমি অমরচন্দ্রকে চেনো?

খুব চিনি! কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?

তুমি বোধহয় ওই অমরচন্দ্র আর আমাদের পণ্ডিতকে দেখতে পারো না?

ভোম্বলের মুখ শুকিয়ে গেল। চারিদিকটা একবার দেখে নিয়ে ভয়ে-ভয়ে বললে, একথা তুমি জানলে কেমন করে?

আমি বললুম, যেমন করে তোক জেনেছি। আচ্ছা ভোম্বল, জ্যান্ত মানুষের দেহ নিয়ে ছুরি দিয়ে কাটাকুটি করা কি ভালো?

ভোম্বল বললে, কে কাটছে, আর কাকে কাটছে, তা না জেনে মত দি কেমন করে? এই ধরো, যদি কেউ বলে যে আমি বেঁচে থাকতে-থাকতেই ছুরি দিয়ে কেউ আমার দেহ ব্যবচ্ছেদ করবে, তাহলে আমি এমন চেঁচিয়ে আপত্তি করব যে আকাশ ফেটে যাবে। কিন্তু তোমার দেহ ব্যবচ্ছেদ করলে আমি আপত্তি না করতেও পারি!

আমি চোখ রাঙিয়ে বললুম, বটে, বটে! তাই নাকি?

থতমত খেয়ে ভোম্বল বললে, না ভাই, আমি ঠাট্টা করছিলুম!

এ ঠাট্টাটা তোমার কালকের গানের চেয়েও খারাপ।

যাই-ই বলো ভাই, তুমি ভারি বরসিক। ঠাট্টা বোঝে না। এ দেশের লোকরা খুব ঠাট্টা বোঝে। আমি একবার ঠাট্টা করে একজনের চারটে হাত কেটে নিয়েছিলুম। সে কিছু বলেনি।

বলবে কেন? চারটের জায়গায় তার আবার আটটা নতুন হাত গজিয়ে উঠেছিল।

হ্যাঁ, এ কথা সত্যি বটে। কিন্তু দ্যাখো অমল, তোমার আজকের কথা শুনে আমার আর একটা কথা মনে পড়ে গেল। কিছুদিন আগে একটা তুর্কি পথ ভুলে আমাদের দেশে এসে পড়েছিল। পণ্ডিতমশাই সেই তুর্কিটার জ্যান্ত দেহ নিয়েই কাটাকুটি করেছিলেন।

এর সঙ্গে যেন আমার নিজের কোনও সম্পর্কই নেই, এমনি উদাসীন ভাবে আমি বললুম, কেন?

কেন, তা ঠিক জানি না। তবে গুজবে শুনেছিলুম, আমাদের চেয়েও নাকি নতুন একরকম মানুষ তৈরি করবার চেষ্টা হচ্ছিল।

আমি শিউরে উঠে বললুম, তারপর?

নতুন মানুষ তৈরি হল না ছাই হল! মাঝখান থেকে সেই তুর্কি বেচারাই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে মারা পড়ল! সেই থেকে এখানে আইন হয়েছে, যার দেহ কাটাকুটি করা হবে, কাটবার আগে তার নিজের মত না নিলে চলবে না।

একটা অস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলুম, বুকের ওপর থেকে মস্ত একটা বোঝা নেমে গেল! পণ্ডিত যদি খুব আদর মাখা মিষ্টি সুরেও বলেন–অমল, তুমি লক্ষ্মীছেলে। আমি তোমার দেহখানি লম্বালম্বি ভাবে ছুরি দিয়ে কেটে ফালাফালা করতে চাই। আশাকরি আমার এ অনুরোধ তুমি রাখবে! তখন আমি নিশ্চয়ই বলব না যে, আপনার আদেশ আমি মাথায় পেতে নিলুম! তবে আর দেরি কেন? দয়া করে ছুরি উঁচিয়ে এগিয়ে আসুন, আমি ধন্য হই!

ভোম্বল বললে, দ্যাখো, আজ কদিন ধরে একটা ব্যাপার লক্ষ করছি! তুমি যার নাম করলে, ওই অমরা ব্যাটা আর পণ্ডিত প্রায়ই একসঙ্গে কী গুজগুজ করে। ওরা বোধহয় আবার কোনও শয়তানি করবার চেষ্টায় আছে!

আমি মনের ভাব লুকিয়ে বললুম, না, না, আমাদের পণ্ডিতমশাই খুব সাধু লোক। দয়ার শরীর!

হেঃ, সাধু লোক! দয়ার শরীর! তুমি তাহলে তোক চেনেন না! জুজুবুড়োজুজুবুড়ো, পণ্ডিত হচ্ছে, একটি জুজুবুড়ো! যাক সেকথা। আজ তুমি বেড়াতে যাবে নাকি?

আবার!

ভয় নেই! আজ আর আমি হোটেলেও যাব না–গান-টানও গাইব না!

তবে কোথায় যাব?

মন্ত্রীসভায়। সেখানে আজ তর্ক হবে।

আচ্ছা, পণ্ডিতমশাইকে জিজ্ঞাসা করে দেখব। তার মত নেওয়া চাই তো!

.

একাদশ । আবার নরডিম্ব

বৈকালে আমরা যখন চা পান করি, এরা তখন লঙ্কার শরবত খায়! পণ্ডিতমশাই বলেন, পৃথিবীর সবটাই যে সুখের নয়, এ সত্য মনে রাখবার জন্যেই লঙ্কার ঝাল শরবতের ব্যবস্থা।

পৃথিবীতে দুঃখ যে কত, জুজু রাজ্যের জুজুদের পাল্লায় পড়ে সেটা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি। তাই ঝাল শরবত পান করে সে দুঃখ আরও বাড়াবার চেষ্টা আমি কোনওদিন করিনি।

আজ বৈকালে ঝাল-শরবতের মহিমায় কমলা যখন হা হু করছিল, সেই সময়ে তার সঙ্গে আমার দেখা হল।

কমলা বললে, আজ নীল শাড়ি পরে আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?

আমি বললুম, চমৎকার।

হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করে বলল, ও অমলবাবু! তোমাদের দেশের খোকা-খুকুদের কেমন দেখতে?

আমাদের খোকা-খুকুদের একটু বর্ণনা দেবার চেষ্টা করলুম।

কমলা বললে, তোমার নিজের কোনও খোকা-খুকু আছে?

না।

কমলা দুঃখিত মনে বললে, আমারও নিজের কোনও খোকা-খুকু নেই! পঁচিশ বছর বয়স না হলে কেউ এখানে খোকা-খুকু কিনতে পারে না।

আমি বিস্ময়ে খানিকক্ষণ বোবা হয়ে রইলুম। তারপর বললুম, তোমরা খোকা-খুকু কেনো?

হ্যাঁ। খোকা-খুকুর বয়স যত কম, তার দামও হয় তত বেশি। আমার বাবা আমাকে দুই বৎসর বয়সে কিনেছিলেন।

এমন সময়ে পণ্ডিত এসে হাজির। আমাদের কথাবার্তা এইখানেই থেমে গেল। মনে মনে ঠিক করলুম, ভোম্বলের সঙ্গে দেখা হলে আসল কথা জেনে নিতে হবে। এই খোকা খুকুর ব্যাপারে একটা কিছু রহস্য আছে!

ভোম্বল যথাসময়েই এল। মন্ত্রণাসভায় যাবার পথে তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, আচ্ছা কমলা যে বলছিল দু-বছর বয়সের সময়ে তার বাবা তাকে কিনেছেন, এ কথার মানে কী?

ভোম্বল বললে, মানে তো খুবই সোজা! ও, বুঝেছি–কোথায় তোমার খটকা লেগেছে! তবে শোনো। চন্দ্রসেন যখন আমাদের সৃষ্টি করলেন, তখন ভেবে দেখলেন যে, সাধারণ দুর্বল মানুষরা যেভাবে জন্মায় সেভাবে আমরাও জন্মালে আমাদের সকলকার শক্তি ঠিক সমানভাবে বাড়বে না। এই দ্যাখো না, তোমাদের একই পিতা-মাতার পাঁচটি সন্তানের শক্তি আর বুদ্ধি একরকম হয় না। চন্দ্রসেন তাই স্থির করলেন, আমরা ডিম পাড়ব।

আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলুম না—

ডিম? তোমরা ডিম পাড়বে?

হ্যাঁ। আমরা ডিম পাড়ি। পাড়বার পর প্রত্যেক ডিমটিকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরীক্ষা করা হয়। যেসব ডিম নিরেস, অর্থাৎ খারাপ, সেগুলোকে নষ্ট করে ফেলা হয়। ভালো ডিমগুলোকে বেছে ফুটনাগারে নিয়ে গিয়ে যত্ন করে রাখা হয়। ডিম সেইখানে ফোটে।

কেন? যাদের ডিম তারাই ফোঁটায় না কেন?

তাহলে বেআইনি কাজ করা হবে। যেসব পুরুষ আর নারী নিজেদের ডিম লুকিয়ে রাখে, তারা কড়া শাস্তি পায়।

যেসব পুরুষ আর নারী?

হ্যাঁ। এদেশে পুরুষ আর নারী দুয়েরই ডিম হয়।

বলো কী! এখানে পুরুষরাও ডিম পাড়ে?

নিশ্চয়ই পাড়ে!

তারপর?

ওই সব ডিম ফোটবার পরেও খোকা-খুকুদের স্ফুটনাগারের ভেতরেই লালন-পালন করা হয়। তারপর যখন আমাদের সন্তান পালন করবার মতন বয়স হয়, তখন আমরা খোকা বা খুকিকে কিনে বাড়িতে নিয়ে আসি।

আমি সব শুনে এতটা হতভম্ব হয়ে গেলাম যে, মন্ত্রণাসভায় পৌঁছবার আগে আর কোনও কথাই কইতে পারলুম না।

মন্ত্রণাসভায় বাড়িখানা খুবই প্রকাণ্ড। গোল বাড়ি।

ঢোকবার মুখেই কয়েকজন সেপাই বা দারোয়ান আমাদের জামাকাপড় ভালো করে হাতড়ে দেখলে এবং যা কিছু সন্দেহজনক বা আপত্তিকর বলে মনে করলে, আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বললে, যাবার সময়ে চেয়ে নিয়ে যেও!

ভোম্বলকে শুধলুম, এ আবার কী নিয়ম?

ভোম্বলদাস দন্তবিকাশ করে হেসে সংক্ষেপে বললে, মন্ত্রণাসভাকে প্রজারা বেশি ভালোবাসে না।

বড় হলঘরটার ভিতরে গিয়ে আমরা যখন ঢুকলুম তখন সেখানে লোকজন ছিল না– কেবল মঞ্চের ওপরে বসে একটিমাত্র পিপে নাক ডাকিয়ে আরামে নিদ্রা দিচ্ছিল।

পিপের সামনেই চকচকে পিতলের একটি নলচে।

ভোম্বল বললে, ওই নলচের সাহায্যে শান্তিরক্ষা করা হয়। ওর ব্যবহার আজকেই তুমি বোধহয় দেখতে পাবে।

হলঘরটার বিশেষ বর্ণনা দেবার দরকার নেই। ঘরের মেঝেটা মাঝখান থেকে পাক খেয়ে ওপরে উঠে গেছে–এইমাত্র তার বিশেষত্ব। সমস্ত সভাস্থলের মধ্যে কোথাও একখানা চেয়ার দেখা গেল না। চেয়ারের এখানে কোনও কাজ নেই। পিপেরা আসে, পিপের তলার দিকটা মাটিতে রেখে বসে পড়ে। কোনও ল্যাঠা নেই।

ঘুমন্ত পিপেটা আচম্বিতে জেগে উঠে ঢং করে একবার কসর বাজালে। পরমুহূর্তে দুমদাম করে চারিদিককার অনেকগুলো দরজা খুলে গেল এবং দলে দলে পিপে হুড়মুড় করে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে যে যার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে আসন গেড়ে বসল। হট্টগোলে কান পাতা দায়!

মঞ্চের পিপেটা আবার ঢং করে কসর বাজিয়ে বললে, সভার কাজ আরম্ভ হোক!

অমনি একসঙ্গে ডজনখানেক পিপে দাঁড়িয়ে উঠে হাত-পা নেড়ে ও মুখভঙ্গি করে চাঁচাতে লাগল। তারা যেই থামল, অমনি আবার নতুন একদল পিপে লাফিয়ে উঠে গোলমাল শুরু করলে।

ভোম্বলের ভাব ও মাথা নাড়া দেখে আন্দাজ করলুম, পিপেরা যা বলছে সে তা বেশ বুঝতে পারছে। আমি কিন্তু সেই হ-য-ব-র-ল শুনে কোনও অর্থই আবিষ্কার করতে পারলুম না।

বললুম, কখন তর্ক শুরু হবে?

ভোম্বল বললে, তোমার মতন হাঁদাগঙ্গারাম আমি আর একটিও দেখিনি। ওই তো তর্ক চলছে!

এই তর্ক! কিন্তু ওরা যে সবাই একসঙ্গে কথা কইছে!

হ্যাঁ, একসঙ্গে কথা কইবে না তো কী করবে? একসঙ্গে কথা না কইলে ওরা কি সবাই আলাদা আলাদা করে কথা কইবার সময় কখনও পাবে?

কিন্তু ওই হট্টগোলে কী করে ওরা পরস্পরের কথা বুঝতে পারে?

বোঝবার কোনও দরকার নেই তো!

তাহলে রাজ্য চলবে কেন?

আমার দিকে খুব একটা দয়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভোম্বল বললে, তোমার বুদ্ধি দেখছি ভারি কাঁচা! এও বোঝে না, প্রত্যেক সভ্য যখন তার নিজের দলের জন্যেই ভোট দেয়, তখন তার কথা বোঝা না গেলেও ক্ষতি নেই!

তাহলে বাজে কথা কয়ে মিছে তর্ক করবার দরকার কী?

আচ্ছা আহাম্মকের পাল্লায় পড়লুম, যা হোক! ওহে বাপু, কথাই যদি না কইবে, তবে সভ্য হয়ে লাভ কী?

তাহলে পরস্পরের কথা শুনতে না পেলেও চলে?

নিশ্চয়! ওরা অন্যের কথা শুনতে চায় না, নিজেদের কথাই শোনাতে চায়! সেইজন্যেই ওরা সভ্য হয়েছে!

মঞ্চের পিপের নাক এই গোলমালের সময়ে রীতিমতো গর্জন করছিল। হঠাৎ আবার জেগে উঠে সে কাঁসর বাজালে। অমনি যেখানে যত পিপে সবাই একসঙ্গে চাঁচাতে চাচাতে একদিকে ছুটে গেল।

আমি বললুম, ও আবার কী?

ভোম্বল বললে, ওরা ভোট দিচ্ছে।

আচম্বিতে আর-একদিকে দুইদলের ভিতরে বিষম দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল।

মঞ্চের পিপে বোধহয় আবার ঘুমোবার চেষ্টায় ছিল, কিন্তু দাঙ্গাহাঙ্গামা দেখেই সে অত্যন্ত সজাগ হয়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর যেদিকে দাঙ্গা হচ্ছে, সামনের পিতলের নলচের মুখটাকে সেইদিকে ফিরিয়ে কী একটা টিপে দিলে। একটা ছোট গোলা দড়াম করে যথাস্থানে পড়ে ফেটে গেল। দেখলুম, তিনজন লোক মাটির ওপরে গিয়ে পড়ল–তখন তাদের আর পিপে বলে চেনবারই জো নেই! দেহগুলো ভেঙেচুরে তাল পাকিয়ে বা গুঁড়ো হয়ে গেছে।

ভোম্বল বলে উঠল, ওই যাঃ! বুড়ো দেবেনের গতর চুরমার হয়ে গেলে দেখছি।

সমস্ত চাঁচামেচি ও হুড়োহুড়ি একেবারে ঠান্ডা!

আমি সভয়ে বললুম, হা ভোম্বল, তাহলে সত্যিই কি ওরা মারা পড়ল?

ভোম্বল বললে, তা পড়ল বইকী! তা ছাড়া শান্তিরক্ষার আর কোনও উপায় ছিল না যে! দোষ তো দেবেনেরই। প্রতিবারেই সে একটা না একটা হাঙ্গামা না করে ছাড়বে না! এইবারে বাপধন শায়েস্তা হলেন! কিন্তু ও কী! অমল, তোমার কি হঠাৎ কোনও অসুখ করল?

আমি বললুম, তোমাদের মন্ত্রণাসভাকে নমস্কার করছি। আমাকে বাইরে নিয়ে চলো।

.

দ্বাদশ । বিপদ মূর্তিমান

মন্ত্রণাসভার বিশ্রী ব্যাপারটা দেখে আমার প্রাণ-মন কেমন নেতিয়ে পড়েছিল। বাসায় ফিরে এসেও কিছুই ভালো লাগল না।

দেওয়ালের গায়ে একখানা বেহালা টাঙানো ছিল, হঠাৎ তার দিকে আমার নজর গেল।

অন্যমনস্ক ভাবে বেহালাখানা নামিয়ে নিয়ে, তারগুলো বেঁধে একলাটি বসে বাজাতে লাগলুম।

একে তো এক উটকো সৃষ্টিছাড়া দেশে এসে প্রায় বন্দির মতনই আছি, তার ওপরে শিয়রে সর্বদাই খাঁড়া ঝুলছে, খুনে পণ্ডিত কখন যে আমার দেহব্যবচ্ছেদ করতে চাইবে কিছুই বলা যায় না, কাজেই এরকম মন নিয়ে আমি যে নিজের অজান্তে খুব একটা দুঃখের সুর বাজাব, তাতে আর সন্দেহ কী!

অনেকক্ষণ পরে যখন থামলুম, হঠাৎ একফোঁটা গরম জল আমার গলার ওপরে এসে। পড়ল!

চমকে ফিরে দেখি, ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে কমলা, আর তার বড় বড় দুই চোখ ভরে কান্নার জল উপচে পড়ছে। আমি এমন তন্ময় হয়ে ছিলুম যে, কখন সে ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে, একটুও টের পাইনি!

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, কমলা, কমলা! তুমি কাঁদছ কেন?

কমলা তাড়াতাড়ি তার চোখের জল মুছে ফেলে লজ্জার হাসি হেসে বললে, তুমি অমন দুঃখের সুর বাজাচ্ছিলে কেন? আমার যে কান্না পেল।

আমি হেসে বললুম, তবে আমার দুঃখের সুরকে তুমি তোমার হাসির স্রোতে ভাসিয়ে দাও! তুমি একটি গান গাও, আর আমি তার সঙ্গে বাজিয়ে যাই। গাইবে?

কমলা বললে, হু, তা কেন গাইব না? শোনো–

আকাশের চাঁদ-মুখ
ভেসে চলে নদীজলে
বাতাস কানেতে এসে
কত ভালোবাসি বলে।
নীল-লাল মুখ তুলি।
দুলে দুলে ফুলগুলি
আতর-স্বপন দেখে
ঝরে পড়ে দলে-দলে।
অচেনা গানের পাখি
আমারে বলিল ডাকি
হাসো-গাও! যতদিন
আছ ভাই, ধরাতলে!

গান শেষ হলে পর বললুম, কমলা! তোমার কী মিষ্টি গলা! সেদিন ভোম্বলের গান শুনে তোমাদের দেশের গানে অরুচি ধরে গিয়েছিল–

কমলা বললে, সে তোমাকেও গান শুনিয়েছিল নাকি! ওই তো তার রোগ! সবাইকে তার গান না শুনিয়ে ছাড়বে না! নিজেকে মস্ত ওস্তাদ মনে করে, ভাবে, সারা দুনিয়া তারই গান শোনবার জন্যে কান খাড়া করে আছে। আমাকেও মাঝে-মাঝে জোর করে ধরে বসিয়ে গান শোনায়–বাব্বাঃ! সে যে কী কাণ্ড! যেন তিনটে পাচা, দুটো গাধা আর একটা হুলো বেড়াল একসঙ্গে ঝগড়া করছে! গান শেষ হলে আবার জিজ্ঞাসা করা চাই–ভালো লাগল। তো? কিন্তু তার গান ভালো বললেই বিপদ বেশি! আমি যদি বলি–ভয়ংকর ভালো লাগল, তাহলে আর রক্ষে নেই, অমনি আবার তানপুরো ঘাড়ে করে বলে তাহলে আর একটা এর চেয়েও ভালো গান শোনো।

আমি হেসে ফেলে বললুম, না কমলা, ভোম্বল আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে, আমাকে সে আর কখনও গান শোনাবে না।

কমলা বললে, অমলবাবু, তাহলে মানতেই হবে যে, ভগবান তার মাথায় সুবুদ্ধি দিয়েছেন।

আমি বললুম, আচ্ছা কমলা, তুমি আমাকে অমলবাবু বলো কেন, দাদা বলতে পারো না?

দাদা বললে তুমি যদি রাগ করো?

কেন রাগ করব? আমি যে তোমাকে ঠিক ছোট বোনটির মতন দেখি!

কমলা বললে, একথা শুনে আমার ভারি আহ্লাদ হল। মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমি যদি তোমাদের মতন হতুম!

কেন কমলা, তুমি তো ঠিক আমাদেরই দেশের মেয়ের মতন দেখতে?

না, এটা তো আমার নকল দেহ। জাদুঘরে এইরকম মেয়ের ছবি দেখে আমার ভারি। ভালো লেগেছিল, তাই তো আমি শখ করে প্রায়ই এইরকম মূর্তি ধরি। কিন্তু এই নকল দেহ নিয়ে বেশিক্ষণ থাকতে তো পারি না, আমাদের হাড় নেই বলে খানিকক্ষণ পরেই কষ্ট হয়, তখন তাড়াতাড়ি আবার সেই বিশ্রী শ্রীখোলের ভেতরে গিয়ে ঢুকি! চন্দ্রসেন আমাদের দেহ বদলে ভালো কাজ করেননি! এই যে এখন আমার চেহারা তোমার ভালো লাগছে, আমাকে তুমি নিজের বোনের মতন দেখছ, একটু পরে আমাকে সেই শ্রীখোলের ভেতরে দেখলে তুমিই হয়তো ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেবে! কেমন, একথা কি সত্যি নয়?

আমি বললুম, ঘেন্না নয় কমলা, তবে ওরকম চেহারা দেখবার অভ্যাস নেই বলে অবাক হতে হয় বটে!

না, এ তুমি আমার মন রাখা কথা বলছ! আমি তোমার চোখের ভাব দেখেছি, তুমি খালি অবাক হও না, ভয় পাও, ঘেন্না করো!

কমলা, তুমি কি জানো, কেবল চন্দ্রসেন নন, একালেও তোমার বাবা আবার একরকম নতুন মানুষ তৈরি করতে চান?

না। তবে আজকাল বাবার মুখ দেখে আমার কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছে!

কী সন্দেহ?

কিছুকাল আগে বাবা এক তুর্কির দেহে ছুরি চালিয়ে-চালিয়ে সে অভাগাকে মেরে ফেলেছিলেন। সেই সময়ে তার মুখের ভাব যেরকম হয়েছিল, আজকাল তাকে দেখলে তার সেই মুখের ভাব আমার মনে পড়ে।

কমলা, তাহলে শোনো। তুমি আমার বোনের মতন। তোমার কাছে আমি কিছু লুকোব না–বলে সেদিন পণ্ডিত আর অমরচন্দ্রের ভিতরে যেসব কথাবার্তা হয়েছিল সমস্তই আমি কমলার কাছে প্রকাশ করলুম।

কমলা প্রথমটা স্তম্ভিতের মতন স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর উত্তেজিত স্বরে বললে, উঃ, বাবা এত নিষ্ঠুর? আবার তিনি তোমাকে হত্যা করতে চান? কিন্তু তোমার কোনও ভয় নেই, আমি তোমাকে সাহায্য করব! এখন এদেশে জ্যান্ত মানুষের দেহে ছুরি চালানো বেআইনি! আমি এখানকার এমন অনেক লোককে চিনি যারা বাবাকে এরকম পাপকাজ কিছুতেই করতে দেবে না। এই ষড়যন্ত্রের কথা আমি নিজে গিয়ে তাদের কাছে বলে আসব!

আচম্বিতে পিছন থেকে ক্রুদ্ধ গম্ভীর স্বরে শোনা গেল, যা শুনলুম, তা কি সত্য?

চমকে ফিরে সভয়ে দেখলুম, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পণ্ডিতমশাই! তার দুই চক্ষে দু-দুটো আগুনের শিখা! এবং সেই অগ্নিময় চোখদুটো একবার কোটরের বাইরে পাঁচ ছয় হাত বেরিয়ে আসছে, তারপর আবার কোটরের ভিতরে সেঁদিয়ে যাচ্ছে। এটা বোধহয় পিপে-মুল্লুকে বিশেষ রাগের লক্ষণ।

.

ত্রয়োদশ । কমলার পিপে

যে ভয়ানক দিনটাকে আজ কয়দিন মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছিলুম না, চোখের সামনে এখন সে যেন মূর্তি ধরে দেখা দিলে!

কমলার কথা পণ্ডিত শুনতে পেয়েছে। আমি যে তাদের ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছি, এটাও সে জানতে পেরেছে! আর আমার বাঁচোয়া নেই!

পণ্ডিতের এখনকার চেহারা দেখে ভোম্বলের কথা মনে পড়ল। জুজুবুড়ো–জুজুবুড়ো! তার মুখে-চোখে এখন পিশাচের ভাব ফুটে উঠেছে।

খুব টিটকিরি দিয়ে কমলার দিকে ফিরে পণ্ডিত বললে, মেয়ে আমার দেবী হয়েছেন। বাবাকে পাপ কাজ করতে দেবেন না! একটা বিদেশি জন্তুকে বাঁচাবার জন্যে পাঁচজনকে সব জানিয়ে আমার সর্বনাশের চেষ্টা করবেন! আহাহাহামরি মরি!

কমলা জবাব না দিয়ে মাথা হেঁট করলে। তার মুখ তখন ভয়ে সাদা হয়ে গেছে!

পণ্ডিত বললে, যখন-তখন তুই ওই সেকেলে মানুষগুলোকে নকল করিস বলে বরাবরই আমার সন্দেহ ছিল যে, তোর বুদ্ধির গোড়ায় গলদ আছে! কিন্তু তুই যে এতটা অধঃপাতে গিয়েছিস তা আমি বুঝতে পারিনি! জানিস, এ রাজ্যে বাপ-মায়ের অবাধ্য হলে ছেলে-মেয়েরা কী কঠিন শাস্তি পায়?

কমলা বললে, কিন্তু অমলদাদাকে তুমি কিছুতেই খুন করতে পারবে না!

দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে পণ্ডিত বললে, কী? অমলদাদা! ওই সেকেলে জড়ভরতটাকে তুই আমার সামনে দাদা বলে ডাকছিস। রোস, চুপ করে দাঁড়া! তোর সব ভিরকুটি আজকেই ঠান্ডা করে দেব।

পণ্ডিত উগ্রদৃষ্টিতে অগ্রসর হয়ে কমলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কীরকম অদ্ভুত ভঙ্গি তে দুটো হাত নাড়তে লাগল সঙ্গে-সঙ্গে কমলার মুখে চোখে ও সর্বাঙ্গে কেমন একটা তীব্র যাতনার ঢেউ বয়ে গেল,তার ভাব দেখে আমাদের মনে হল, সে যেন কী-একটা অদৃশ্য বিভীষিকাকে ঠেকিয়ে রাখবার জন্যে চেষ্টা করছে–প্রাণপণে চেষ্টা করছে।

পরমুহূর্তেই স্তম্ভিত দৃষ্টিতে দেখলুম, কমলার দেহ আকারহীন থলথলে মাংসপিণ্ডের মতন। মাটির ওপরে গড়াগড়ি দিচ্ছে! জাদুঘরে যাবার দিনে চাকা গাড়ি থেকে জেলিমাছের মতন যে দেহটার ওপরে আমি আঁপিয়ে পড়েছিলুম, কমলার দেহকে দেখতে হয়েছে এখন ঠিক সেইরকম।

মাংসপিণ্ডের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পণ্ডিত বললে, এইবারে আদর করে তোর অমলদাদাকে একবার ডেকে দেখ না! এখন ও আর তোর দিকে ফিরেও চাইবে না!

রাগে গা আমার স্কুলে গেল! একবার মাংসপিণ্ডের দিকে তাকালুম। তার ভিতর থেকে দুটি চোখ অত্যন্ত কাতর ও দুঃখিত ভাবে আমার মুখের পানে চেয়ে আছে! কমলার দেহ বদলেছে, কিন্তু তার চোখদুটির শ্রী এখনও ঠিক আগেকার মতনই আছে! আমি মমতা-ভরা স্বরে বলে উঠলুম, তা, না কমলা! তোমার চেহারা বদলেছে বলে আমি তোমাকে বোনের মতনই দেখছি!

পণ্ডিত ঠাট্টা করে বললে, ও হো হো হো! লক্ষ্মী বোনের লক্ষ্মী ভাই! চমৎকার! ওরে কে আছিস রে, কমলার শ্রীখোলটা এখানে নিয়ে আয় তো!

একটা বড় পিপে এসে হাজির–তার হাতে একটা ছোট পিপে।

পণ্ডিত কমলার দিকে ফিরে হুকুম দিলে, ঢোক ওর ভেতরে!

কমলার পিণ্ডাকৃতি দেহের ভিতর থেকে মিনতি মাখা করুণ স্বর এল, বাবা গো, তোমার পায়ে পড়ি! অমলদাদার সামনে আমাকে ওর ভেতরে ঢুকতে বোলো না, লজ্জায় আমি মরে যাব!

পণ্ডিত ক্যাঁক-কেঁকে গলায় হুমকি দিয়ে বললে, চোপরাও! তুই মলে তো আমি বাঁচি! ঢোক শ্রীখোলের ভেতরে!

মাংসপিণ্ডের মাঝখান থেকে তিনখানা হাত আর তিনখানা পা বেরিয়ে পড়ল। তারপর পিণ্ডটা উঠে পিপের ভিতরে গিয়ে ঢুকল। পিপের একদিকে একখানি মুখ–তা আমার চেনা কমলার মতন দেখতেও বটে, দেখতে নয়ও বটে! তার দুই চোখ দিয়ে টসটস করে জল ঝরছে, লজ্জার সে আমার দিকে তাকাতে পারছে না।

পণ্ডিত বললে, আমার এই হুকুম রইল, আজ থেকে এক মাস তুই ওই শ্রীখোল ছেড়ে বেরুতে পারবি না! যাঃ এখন নিজের ঘরে যা!

কমলা তার হাত-পা গুটিয়ে ফেললে, তারপর ধীরে ধীরে গড়াতে গড়াতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল! আমি বুঝলুম, এই নিষ্ঠুর শত্ৰুপুরীতে আমার একমাত্র যে বান্ধবী ছিল, আমার বিপদে-আপদে যে আমাকে প্রাণপণে সাহায্য করতে পারত, সে-ও আজ অসহায় ভাবে বন্দিনী হল। আজ থেকে আর কেউ আমার দিকে মুখ তুলে তাকাবে না। আমার জীবনরক্ষার আর উপায় নেই।

পণ্ডিত আমার দিকে চেয়ে বললে, এইবারে তোমার পালা।

আমি গম্ভীর ভাবে বললুম, তাহলে পালা শুরু করুন।

আমি তোমার প্রাণরক্ষা করেছি, তোমাকে আশ্রয় দিয়েছি, তার খুব প্রতিদান তুমি দিলে বটে!

আমি বললুম, আমি কোনও অন্যায় করেছি বলে মনে পড়ছে না!

পণ্ডিত চেঁচিয়ে বললে, অন্যায় করোনি? মেয়েকে বাপের অবাধ্য করা অন্যায় নয়? তোমাদের দেশে এটা অন্যায় না হতে পারে, কিন্তু এদেশে তা মহাপাপ! যে ছেলেমেয়েরা বাপের অবাধ্য, এদেশে তাদের প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হয় তা তুমি জানো কি?

আমি বললুম, না জানি না। জানতেও চাই না। আমি শুধু এইটুকু জানি যে, কমলাকে আমি কোনও দিন আপনার অবাধ্য হতে বলিনি।

বলোনি? হেঃ, এই কথা আমি বিশ্বাস করব? আমি কি সেকেলে মানুষের মতন বোকা ভ্যাড়াকান্ড? আমার বুদ্ধিশুদ্ধি কি মগজ থেকে কর্পূরের মতন উপে গেছে? তুমি তাকে কুশিক্ষা না দিলে সে কি কখনও আমার বিরুদ্ধে নালিশ করবার কথা মনেও আনতে পারে? আর আমি কিনা তোমারই প্রাণরক্ষা করেছি।

আমার অসহ্য হয়ে উঠল। বললুম, বার বার আমার প্রাণরক্ষা করেছেন বলে জাঁক করছেন কেন? আপনি কেন যে আমার প্রাণরক্ষা করে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন আমি কি তা জানি না? আপনি আমার প্রাণরক্ষা করেছেন আমার প্রাণবধ করবার জন্যে।

পণ্ডিত খাপ্পা হয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে আর আমি বাজে কথা কয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না। যাও, নিজের ঘরে গিয়ে বন্দি হয়ে থাকো গে! আর দয়া নয়!

.

চতুর্দশ । ভোম্বলদাসের আসল চেহারা

ঘরে ভিতরে একলা বসে যেন অকুলপাথারে ভাসছি।

বাঁচবার কোনও আশা নেই। এক আশা ছিল কমলা, কিন্তু সেও এখন আমারই মতন বন্দি। পণ্ডিতের ষড়যন্ত্রের কথা সে আর কারুর কাছে গিয়ে প্রকাশ করে দিতে পারবে না।

এই উদ্ভট, ভূতুড়ে দেশের আইনকানুন সবই আজব! এখানকার দয়া-মায়া-ভালোবাসা সবই ভিন্নরকম। পৃথিবীর সভ্যদেশে মাঝে-মাঝে ভূত-পেতনির কথা শুনতে পাই, নানারকম মূর্তি ধারণ করে মানুষদের যারা ভয় দেখায়। সেসব এদেরই কীর্তি নয়তো? তারা রাতআঁধারে দেখা দিয়ে দিনের আলোয় কোথায় লুকোয়, তারা কোথা থেকে আসে কেউ তা জানে না, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তারা এই দেশেরই লোক! মানুষ যে পরলোকের কথা জানে, এই পরলোক হয়তো এই এই পিপে-মুল্লুকেই! আমি চোখের সামনেই ভোম্বলকে আমার মূর্তি ধরতে দেখেছি। এরাই হয়তো মানুষের দেশে গিয়ে রাত্রিবেলায় আমাদের মৃত আত্মীয়স্বজনের মতন চেহারা নিয়ে দেখা দেয়, আর আমরা ভূত দেখেছি বলে ভয়ে আঁতকে উঠি! এরা নিজেদের বলে নতুন মানুষ! ছাই! পিপের ভিতরে কখনও মনুষ্যত্ব থাকে না!

হঠাৎ মৃদুস্বরে কে আমায় ডাকলে, অমলা, ও অমলা!

মুখ তুলে দেখি, জানলার বাইরে ভোম্বলের মোটা, আঁচিল ভরা, বারাকোশের মতন মস্ত মুখখানা!

আমি রাগ করে বললুম, আবার তুমি আমাকে ওই নামে ডাকছ? আমি মরতে বসেছি বলে তোমার বুঝি খুব আহ্লাদ হয়েছে?

ভোম্বল বললে, না ভাই, চটো কেন? তুমি তো জানোই আমরা মেয়ে-পুরুষ সবাই ডিম পাড়ি কাজেই আমাদের কাছে অমলও যে অমলাও সে! একটা আকারের তফাত বই তো নয়! যাক সে কথা, তুমি জানলার কাছে এসো। চেঁচিয়ে কথা কইলে কেউ শুনতে পাবে। যা বলতে এসেছি, চুপিচুপি বলে যাই!

জানি, এ অপদার্থটার দ্বারা আমার কোনওই উপকার হবে না, তবু সে কী বলে শোনবার জন্যে আমি উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম।

ভোম্বল চুপিচুপি বললে, তোমার জন্যে আমি কম চেষ্টা করিনি, এখানকার যেসব মোড়ল পণ্ডিত জুজুবুড়োকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না, তাদের অনেককেই গিয়ে ধরেছি। কিন্তু বিশেষ ফল হল না। তুমি একেবারে অচেনা লোক, তোমার নাম পর্যন্ত কেউ জানে না। তারা বলে, কোথাকার কোন একটা বাজে জীবের জন্যে পণ্ডিতের সঙ্গে আমরা ঝগড়া করে মরতে যাব কেন? পণ্ডিতের এখানে খুব পসার কিনা? সবাই বলে, পণ্ডিত হচ্ছে দেশভক্ত লোক,–সে যা করবে দেশের ভালোর জন্যেই করবে!

আমি বললুম, এ খবরটা জানাবার জন্যে তোমার কষ্ট করে এখানে না এলেও চলত!

ভোম্বল দন্তবিকাশ করে বললে, তা চলত বটে! তবু না এসে থাকতে পারলুম না, হাজার হোক তুমি আমার বন্ধু তো! তা দ্যাখো অমলা, তোমার জন্যে একটা কাজ আমি করেছি বোধহয়! মহারাজ একটা কথায় রাজি হয়েছেন। কেন যে ছুরি মেরে তোমার ভুড়ি ফঁসানো হবে না, এর বিরুদ্ধে যদি তোমার কোনও যুক্তি থাকে, মহারাজা তা শুনতে আপত্তি করবেন না। যুক্তি দেখিয়ে তুমি যদি তাকে বোঝাতে পারো তাহলে তোমার ভুড়ি এ যাত্রা বেঁচে গেলেও যেতে পারে। কাজে-কাজেই এক বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। তোমাকে আগে মহারাজার কাছে হাজির না করে তার হুকুম না নিয়ে কেউ তোমার এই নাদুস-নধর দেহটিকে খণ্ড খণ্ড করতে পারবে না!

আমি কৃতজ্ঞ স্বরে বললুম, ভাই ভোম্বল, এ খবরটা তবু মন্দের ভালো! তোমার এ উপকারের জন্যে ধন্যবাদ।

ভোম্বল বললে, ও বাজে ধন্যবাদ আমি চাই না। আগে বাঁচো, তারপর ধন্যবাদ দিও। আমার এখন খিদে পেয়েছে আমি হোটেলে চললুম! জানালার ধার থেকে তার মুখ সরে গেল।

আমি ভাবতে লাগলুম, ভোম্বলকে আগে যতটা মনে হয়েছিল, এখন দেখছি সে ততটা মন্দলোক নয়। ওর বাইরের চেহারা, হাবভাব আর কথাবার্তা কিঞ্চিৎ অভদ্র ও এলোমেলো হলেও ওর পিপের ভিতরে প্রাণ আর দয়া-মায়া আছে। ভোম্বল দেখছি একটি বর্ণচোরা আম।

হঠাৎ জানালার ধারে আবার ভোম্বলদাসের উদয় হল। বাইরের এদিকে-ওদিকে একবার চেয়ে সে বললে, হ্যাঁ ভালো কথা! খিদের চোটে একটা বিষয় ভুলে গিয়েছিলুম। এই ছোট নলচেটা নিয়ে ভালো করে লুকিয়ে রাখো। ওর পেছনে যে কল আছে সেটিকে টিপলেই ওই নলচেটি তোমাকে সাহায্য করবে। আর একবার দন্তবিকাশ করে হেসেই ভোম্বল আবার অদৃশ্য হল।

নলচেটি পরখ করে দেখলুম। সেদিন মন্ত্রণাসভায় এই রকমেরই একটি নলচের বিষম মহিমা দেখেছিলুম। তবে এটি তার চেয়ে ঢের ছোট, অনায়াসে পকেটে লুকিয়ে রাখা যায়। এই নলচেই বোধহয় পিপেদের বন্দুক!

এমন সময়ে দরজা খোলার শব্দ পেলুম। নলচেটাকে ভিতরকার জামার পকেটে লুকিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াল অমরচন্দ্র, পণ্ডিত ও আরও চারজন পিপে!

পণ্ডিত বললে, অমল, তোমাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে।

বুঝলুম, এরা আজকেই আমাকে মহারাজার কাছে হাজির করতে চায়। বিনা-বাক্যবায়ে আমি তাদের সঙ্গে চললুম! আগে আগে পণ্ডিত আর অমরচন্দ্র, আমার দুপাশে দুজন ও পিছনে দুজন পিপে! দস্তুরমতো কড়া পাহারা!

.

পঞ্চদশ । আমার মহা বীরত্ব

সবাই মিলে যে ঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম, সেটা হচ্ছে সেই ঘর–যেখানে এদেশে এসে আমার প্রথম জ্ঞানোদয় হয়!

আজ দেখছি সে ঘরের রূপ বদলে গেছে। মাঝখানে একটা লম্বা টেবিল, তার ওপরে অনেক অস্ত্রশস্ত্র, চারিধারে তাকে তাকে হরেকরকম ওষুধ ও আরক প্রভৃতির শিশি, বোতল ও কাচের পাত্র!

অমরচন্দ্র কী একরকম সন্দেহপূর্ণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললে, ভালো করে এর চেহারা দেখে আজ মনে হচ্ছে, এর দেহ নিয়ে বোধহয় আমাদের কার্যসিদ্ধি হবে না।

পণ্ডিত বললে, হোক আর নাই-ই হোক, পরীক্ষা আমি করবই!

আমি সভয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, আপনারা আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন?

পণ্ডিত বললে, তোমাকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করব বলে!

আমি উদ্বিগ্ন স্বরে বললুম, কীরকম? মহারাজার হুকুম কি আপনি জানেন না? আগে আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে হবে!

পণ্ডিত বিপুল বিস্ময়ে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, এ কথা কে তোমাকে বলেছে?

যেই-ই বলুক, আপনি আগে আমাকে মহারাজার কাছে নিয়ে চলুন।

অমরচন্দ্র দাঁত ছরকুটে বললে, তা আর জানি না! সেখানে আমাদের শত্রুপক্ষ আছে, তুমি আমাদের হাত ফসকে কলা দেখিয়ে পালাও আর কী?

আমি বললুম, সে কী, আপনারা মহারাজার হুকুম মানবেন না?

পণ্ডিত ঘন ঘন ঘাড় নেড়ে বললে, না, না, না! বিজ্ঞানের মর্যাদা রাখবার জন্যে আমরা মহারাজার হুকুম মানব না! তারপর পিপেদের দিকে ফিরে বললেন, তোরা ওকে ধর! ওর হাত-পা বেঁধে টেবিলের ওপর শুইয়ে দেয়।

এবারে রাগে অজ্ঞান হয়ে একলাফে পণ্ডিতের ওপরে লাফিয়ে পড়ে মারলুম আমি তাকে এক লাথি–সে বিকট আর্তনাদ করে মাটির ওপরে গড়িয়ে গেল। কিন্তু ততক্ষণে চারজন প্রহরী পিপে আমাকে সবেগে আক্রমণ করেছে!

টেবিলের ওপরে বোধকরি আমারই দেহ কাটবার অস্ত্রগুলো ছড়ানো ছিল, আমি বিদ্যুতের মতন হাত বাড়িয়ে একখানা মস্ত ধারালো ছুরি তুলে নিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে ডাইনে বাঁয়ে সামনে-পিছনে চালাতে লাগলুম! বেটাদের গায়ে তো হাড় ছিল না, আমার ছুরি তাদের হাতে-পায়ে যেখানে পড়ে সেইখানটাই কচুর মতন কাচ করে কেটে উড়ে যায়! তারা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সেখান থেকে টেনে লম্বা দিলে! ঘরের মেঝেতে পড়ে তাদের কাটা হাত পাগুলো টিকটিকির কাটা ল্যাজের মতন ধড়ফড় করতে লাগল।

তারপর আমি অমরচন্দ্রের দিকে ফিরে দাঁড়ালুম, কিন্তু চোখের পলক না ফেলতেই সে তার পিপের ভিতর থেকে উপাং করে মাটির ওপরে লাফিয়ে পড়ল এবং একটা বড় সাপের মতন কিলবিল করতে করতে দরজার ভিতর দিয়ে বেগে অদৃশ্য হল!

তারপর আমি পণ্ডিতের দিকে ফিরে দাঁড়ালুম–সে তখন ভীষণ চিৎকার করে চাকরদের ডাকাডাকি করছে!

আমি গর্জন করে বললুম, তবে রে জুজুবুড়ো! এবারে তোকে কে রক্ষা করে? আয়, আজ আমি তোরই অস্ত্র চিকিৎসা করিবলেই ছুরি উঁচিয়ে আমি তাকে আক্রমণ করলুম।

দারুণ আতঙ্কে পণ্ডিতের মুখ তখন মড়ার মতন সাদা হয়ে গেছে, চোখদুটো কপালে উঠেছে! হঠাৎ তার পিপের নীচে থেকে অনেকগুলো ঠ্যাং বেরিয়ে পড়ল এবং সেই বড় টেবিলটার চারিপাশ ঘিরে ঠিক একটা প্রকাণ্ড মাকড়সার মতন এত বেগে ছুটতে আরম্ভ করলে যে, আমি কিছুতেই তার নাগাল ধরতে পারলুম না।

মাত্র দুই পায়ে ভর দিয়ে অতগুলো পায়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব না হলেও আমি পণ্ডিতের পিছু ছাড়লুম না–সে-ও ছোটে, আমিও ছুটি! এই ব্যাপার আরও কতক্ষণ চলত এবং কীভাবে শেষ হত তা আমি জানি না, কিন্তু আচম্বিতে বাহির থেকে দলে দলে নানা আকারের পিপে এসে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল–তাদের সর্বাগ্রে রয়েছে ভোম্বলদাস!

কে একজন হোমরা-চোমরার মতন ভারিক্তে গলায় বলে উঠল, এসব কাণ্ডের অর্থ কী?

পণ্ডিত পরিত্রাহি চিৎকার করে বললে, মহারাজ, রক্ষা করুন! মহারাজ, রক্ষা করুন।

মহারাজ? ফিরে দেখি ভোম্বলদাসের চেয়েও ঢের মোটা আর ডাগর একটা পিপে– যে-রকম পিপেতে আমাদের দেশে সিমেন্ট রাখা হয় তার চেয়েও বড়! তার গালদুটো লাউয়ের মতন ফোলা-ফোলা এবং তার গোঁফজোড়া এত লম্বা যে ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে ঝুলে পড়েছে। এই হল এদের মহারাজের মূর্তি?

মহারাজার মস্তবড়ো ঢাকের মতন মুখের ভিতর থেকে ট্যাপারির মতন দুটো ছোট্ট চোখ কোটরের ভিতর থেকে প্রায় একহাত বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে দুই মিনিট ধরে ঘুরে-ফিরে নিরীক্ষণ করলে। তারপর চোখদুটোকে আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে এসে মহারাজা আমাকে সম্বোধন করে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি পাগল নও তো? তোমাকে দর্শন করে আমার কিন্তু তাই বিবেচনা হচ্ছে।

আমি এত দুঃখেও হেসে ফেলে বললুম, আজ্ঞে না মহারাজ! আমি এখনও পাগল হতে পারিনি। তবে শীঘ্রই হতে পারব বলে আশা রাখি।

মহারাজা দুলতে-দুলতে বললেন, শুনে সুখী হলুম। যাদের পাগল হবার আশা নেই, তারা অতিশয় অভাগা!…উঃ, বড় হাঁপিয়ে পড়েছি, ভারি জল-তেষ্টা! ভৃত্য! সুশীতল বারি আনয়ন করো!

ভৃত্য জল এনে দিলে। মহারাজ ঢকঢক করে জলপান করে ঊর্ধ্বমুখে বললেন, আঃ! এইবারে রাজকার্য! ওহে ভোম্বলদাস, তুমি এই বিদেশি লোকটির কথাই না আমার কাছে উত্থাপন করেছিলে? হুঁ। ওর নাম কী?

ভোম্বল আমার দিকে চেয়ে দন্তবিকাশ করে বললে, অমলা।

আমি বললুম, আজ্ঞে না মহারাজ। আমার নাম অমলা নয়, অমল।

মহারাজা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, চুপ করো। তোমার অপেক্ষা ভোম্বলদাসকে আমি বেশি চিনি। তোমার কী নাম হওয়া উচিত, তোমার চেয়ে ভোম্বলদাস তা বেশি জানে! তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে, তোমার নাম অমলা!…উঃ ভয়ংকর গ্রীষ্ম, ঘর্মে প্লাবিত হয়ে গেলুম যে! ভৃত্য! শীঘ্র ব্যজনী আনয়ন করো!

দু-দিকে দুটো পিপে এসে তালপাতার পাখা নেড়ে মহারাজের মাথা ও গতর ঠান্ডা করতে লাগল।

খানিকক্ষণ বায়ুসেবন করে একটু ধাতস্থ হয়ে মহারাজা আবার দুলতে দুলতে বললেন, হ্যাঁ, ভালো কথা! আচ্ছা অমলা, তুমি এতক্ষণ কী করছিলে? পণ্ডিতের সামনে দাঁড়িয়ে কি যুদ্ধের নৃত্য দেখাচ্ছিলে? ও নৃত্যটি আমার অত্যন্ত উত্তম লেগেছে। আর-একবার ওই নৃত্যটি আরম্ভ হোক!

আমি হাতজোড় করে বললুম, আজ্ঞে না মহারাজ! কী করে অস্ত্রচিকিৎসা করতে হয়, পণ্ডিতকে আমি দেখিয়ে দিচ্ছিলুম!

মহারাজ গর্জন করে বললেন, কী! তুমি কি অবগত নও যে, এ রাজ্যে অস্ত্রচিকিৎসা নিষিদ্ধ? আমরা কবিরাজি ঔযধ ছাড়া আর কিছু সেবন করি না? তার চেয়ে পণ্ডিতকে তুমি বিষ-বড়ি ভক্ষণ করতে দিলে না কেন?

আমি আবার হাতজোড় করে বললুম, আজ্ঞে, বিষ-বড়ির কথা আমার মনে ছিল না। তাহলে সেই ব্যবস্থাই করতুম।

পণ্ডিত কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মহারাজা দু-চোখ রাঙিয়ে এক ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, স্তব্ধ, হও! বৃদ্ধ, তুমি কি অবগত নও, আমি সম্বোধন না করলে আমার নিকটে কেউ বাক্য উচ্চারণ করতে পারবে না? উঃ, ভীষণ কান চুলকোচ্ছে, গেলুম যে! ভৃত্য! কান-খুশকি আনয়ন করো।

কান-খুশকি এল। মহারাজ দু-চোখ বুজে খুব আরাম করে পাঁচ মিনিট কান চুলকোলেন। তারপর সহসা দুই চোখ চেয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, অতঃপর?

আমি বললুম, মহারাজ, আপনি বোধহয় জানেন না যে, এই পণ্ডিত আজ ছুরি দিয়ে লম্বালম্বি ভাবে আমার দেহকে ফালাফালা করবার চেষ্টা করছিল!

মহারাজা ভয়ানক চটে উঠে বললেন, কী? তোমাকে আমার কাছে হাজির না করেই?

আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ! পণ্ডিত বলে সে বিজ্ঞানের মর্যাদা রাখবে, আপনার মর্যাদা রাখবে না।

মহারাজা দুই চক্ষু ছানাবড়া করে বললেন, অ্যাঁ! অ্যাঁ! এত বৃহৎ কথা! আমার মর্যাদা রাখবে না? উঃ, মস্তক বেজায় ঘূর্ণায়মান হচ্ছে–বোঁ-বোঁ-বো! ভৃত্য! অবিলম্বে আমার শিরোঘূর্ণন বন্ধ করো!

পিপের একমুখে মহারাজের গোল মাথাটা চরকির মতন এমন বনবন করে ঘুরছিল যে তাঁর চোখ-নাক-ঠোঁট কিছুই দেখা যাচ্ছিল না! ভৃত্য তাড়াতাড়ি ছুটে এসে মাথাটা প্রাণপণে। চেপে ধরে তার ঘুরুনি বন্ধ করে দিলে।

খানিকক্ষণ হাঁপাতে-হাঁপাতে দম নিয়ে মহারাজা বললেন, দুরাচার পণ্ডিত! আমার হুকুম না নিয়েই আবার তুমি লম্বালম্বি ভাবে মানুষের দেহ কর্তন করতে চাও? ভোম্বলদাস! সেবারের সেই কাণ্ডকারখানার কথা তোমার মনে আছে?

ভোম্বল চোখ পাকিয়ে বললে, ওঃ! মনে নেই আবার? পণ্ডিত সেই তুর্কি-চাচার দেহখানা এমন লম্বালম্বি ভাবে কেটেছিল যে, তাকে দেখতে হয়েছিল ঠিক পণ্ডিতেরই মতন!

পণ্ডিত প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে মাথা নেড়ে বললে, না, তাকে আমার মতন দেখতে হয়নি। আমি একথার আপত্তি করি।

মহারাজা বললেন, আবার তুমি গায়ে পড়ে বাক্য উচ্চারণ করছ? তুমি আপত্তি করতে পারবে না। কখন তোমার আপত্তি করা কর্তব্য, সেকথা আমি নিজেই বলে দেব।

পণ্ডিত বললে, কোন কথায় আমি আপত্তি করব, সেকথা আপনি জানবেন কেমন করে মহারাজ?

মহারাজা মহাবিস্ময়ে মুখব্যাদান করে বললেন, ওহে ভোম্বল, পণ্ডিতটা বলে কী হে? কোন কথায় ওর আপত্তি করা উচিত, তাই-ই যদি না বলতে পারব, তবে আমি কীসের মহারাজ?

ভোম্বল বললে, সত্যিই তো! তবে আপনি কীসের মহারাজা?

পণ্ডিত বললে, মহারাজা! আমি বিচার প্রার্থনা করি।

মহারাজা বললেন, বিচার? তুমি প্রার্থনা করো? ওহে ভোম্বল, পণ্ডিতটা যে বিচার প্রার্থনা করে! বেশ, আমি বিচার করব। ভোম্বলদাস, তুমি মন্ত্রীদের আসতে হুকুম দাও। আজ এখানেই আমার বিচারসভা বসবে। ভৃত্য! আমার রাজদণ্ড আনয়ন করো।

.

ষোড়শ । মহারাজের বিচার

রাজদণ্ড হাতে নিয়ে আরও বেশি গম্ভীর হয়ে মহারাজা বললেন, পণ্ডিত! এই সেকেলে মানুষটার দেহ কেন তুমি লম্বালম্বি ভাবে কর্তন করতে চাও, সেকথা আমার নিকটে যথাবিহিত সম্মানসহকারে নিবেদন করো।

পণ্ডিত বললে, আজ্ঞে, আমাদের চেয়েও একেলে মানুষ সৃষ্টি করব বলে।

মহারাজ ভুরু কুঁচকে বললেন, আমাদের চেয়েও আধুনিক? তবে কি তুমি বলতে চাও যে, আমরা ক্রমেই প্রাচীন হয়ে পড়ছি?

আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ! আমার তাই বিশ্বাস। মনে করে দেখুন মহারাজ, আমাদের চেয়েও একেলে মানুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম মানুষ হত ওই অমল! এ একটা কত বড় সম্মান! আমি ওকে হত্যা করতুম না, খুব আস্তে-আস্তে একটু-একটু করে ওর দেহটাকে জ্যান্ত অবস্থাতেই লম্বালম্বি ভাবে কাটতুম। এ কাজে কুড়ি দিনের বেশি সময় লাগত না। ভেবে দেখুন মহারাজ আমার উদ্দেশ্য কত সাধু!

মহারাজা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, হ্যাঁ, তোমার উদ্দেশ্য যে সাধু, সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। অমলা, তুমি পণ্ডিতদের সাধু উদ্দেশ্যে বাধা প্রদান করতে গিয়েছিলে কেন?

আমি বললুম, না মহারাজ, পণ্ডিতকে আমি বাধা দিইনি–আমি কেবল আত্মরক্ষা করেছিলুম। ওঁর মনকে খুশি রাখবার জন্যে বিশ দিন ধরে জ্যান্ত অবস্থায় একটু-একটু করে কচুকাটা হব, অথচ টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করব না, এই কি আপনার আদেশ মহারাজ?

মহারাজা বললেন, না, এমন অন্যায় আদেশ কদাপি আমি প্রচার করি না!

আমি বললুম, তারপর আর একটা কথা মহারাজ বিচার করে দেখুন। আপনাকে আগে জানিয়ে পণ্ডিত যদি আমার ওপরে ছুরি চালাত, তাহলে কখনওই আমি আত্মরক্ষার চেষ্টা করতুম। না, কিন্তু পণ্ডিত আপনার একটু হুকুম পর্যন্ত নেয়নি। এটা কি অপরাধ নয়?

মহারাজা বললেন, অপরাধ নয় আবার? মহাগুরুতর অপরাধ! ভৃত্য! আমার আইন পুস্তকের পঞ্চম খণ্ড আনয়ন করো! দেখি, এটা কত ধারার অপরাধ!

আইনের বই এল। মহারাজ পাতা উলটে বললেন, এই যে! এটা সাতশো সাতাশ ধারার অপরাধ! এর শাস্তি–প্রাণদণ্ড। পণ্ডিত! তোমার প্রাণদণ্ড হবে!

পণ্ডিত ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বললে, মহারাজ, রক্ষা করুন! প্রাণদণ্ড দিলে আমি আর কিছুতেই বাঁচব না! এখনও আপনি সব কথা শোনেননি! ওই সেকেলে মানুষটা আমার মেয়েকে আমার অবাধ্য করে তুলেছে,

মহারাজা শিউরে উঠে বললেন, আঁ, বলো কী? মেয়েকে পিতার অবাধ্য করে তোলা। এ যে সাতশো ধারার চেয়েও গুরুতর অপরাধ! অমলা! তোমার কি কিছু বক্তব্য আছে?

আমি মনে-মনে প্রমাদ গুনে বললুম, আছে মহারাজ! আগে আপনি গোড়া থেকে সব কথা শুনুন। কাল যখন আমি বসে-বসে বাজনা বাজাচ্ছিলুম–

মহারাজা বললেন, বটে, বটে, বটে! তুমি বাজনা বাজাতে পারো?

পারি মহারাজ!

তুমি গান গাইতে পারো?

পারি মহারাজ!

বটে, বটে, বটে! একটা গান আমাকে শোনাও না!

আমি দুই হাতজোড় করে বললুম, কিন্তু মহারাজ, আমি হচ্ছি ওস্তাদ লোক। তবলা বাঁয়ার সঙ্গত না থাকলে কেমন করে গান গাইব?

মহারাজা ব্যস্তসমস্ত হয়ে আদেশ দিলেন–ভৃত্য? তবলা-বাঁয়া আনয়ন করো!

ভোম্বলদাস তাড়াতাড়ি মহারাজের কানে-কানে কী বললে, মহারাজা সব শুনে আমার দিকে ফিরে বললেন, অমলা! এটা হচ্ছে অস্ত্রোপচারের গৃহ–এখানে তবলা-বাঁয়া থাকে না। এখন উপায়?

আমি বললুম, উপায় আছে মহারাজ! পণ্ডিতমশাইয়ের গাল দুখানা দিব্যি চ্যাটালো। ওঁকে আমার কাছে আসতে হুকুম দিন। তবলা-বাঁয়ার অভাবে আমি ওঁর দুটো গাল দু-হাতে বাজিয়ে তাল রেখে গান গাইতে পারব।

পণ্ডিত বললে, মহারাজ, আমি এ প্রস্তাব সমর্থন করি না।

মহারাজা প্রকাণ্ড এক ধমক দিয়ে বললেন, পুনরায় তুমি বাঁচালতা প্রকাশ করছ? অমলার ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব তোমাকে সমর্থন করতেই হবে! যাও অমলার কাছে!

পণ্ডিত নিরুপায় হয়ে ভয়ে-ভয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। কিন্তু যেই আমি হাত তুলে তার গালে চপেটাঘাত করতে যাব, অমনি সে মুখ সরিয়ে নিলে! আর একবার চেষ্টা করেও বিফল হয়ে আমি বললুম, মহারাজ, পণ্ডিতমশাই তাঁর গাল বাজাতে দিচ্ছেন না!

মহারাজা বললেন, বটে, বটে, বটে! প্রহরীগণ! দুষ্ট পণ্ডিতকে তোমরা ধৃত করো!

প্রহরীরা তখন এসে পণ্ডিতকে আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরলে এবং আমিও দুই হাতে মনের সাধে তালে তালে তার দুই গালে চড় মারতে মারতে গান ধরলুম–

জুজুবুড়ির দেশে এসে।
দেখেছি এক জুজুবুড়ো,
মামদো-ভূতের সমন্ধী সে,
হামদো-মুখোর বাবা-খুড়ো–
দেখেছি এক জুজুবুড়ো।

চোখদুটো গোল পানের ডিপে,
পেটের ওপর একটা পিপে,
বাক্যিগুলি মিষ্টি কত?
ঠিক যেন ভাই লঙ্কাগুঁড়ো–
দেখেছি এক জুজুবুড়ো।

করলে আদর ধমকে ওঠেন,
ধরলে গীতি চমকে ছোটেন,
থমকে হঠাৎ পটকে লোঠেন–
মেজাজটি তাঁর উড়ো-উড়ো–
দেখেছি এক জুজুবুড়ো।

তিনি যদি আসেন কাছে,
দৌড়ে চোড়ো শ্যাওড়া-গাছে,
ওপর থেকে থুতু দিয়ো,
কিংবা ছেঁড়া জুতো ছুড়ো–
দেখেছি এক জুজুবুড়ো।

মহারাজা ঘাড় নেড়ে তারিফ করে বললেন, আ-হা-হা-হা! সাধু, সাধু, খাসা গলা! না ভোম্বল?

ভোম্বল বললে, খাসা!

পণ্ডিত তার দুই গালে হাত বুলোতে-বুলোতে বললে, মহারাজ, এ গানে আমি আপত্তি করি।

মহারাজা বললেন, না তুমি আপত্তি করবে না। তুমি কোথায় আপত্তি করবে, আমি বলে দেব।

পণ্ডিত বললে, মহারাজ, ও গান আমাকে লক্ষ করে লেখা হয়েছে।

মহারাজা বললেন, তুমি কি নিজেকে জুজুবুড়ো বলে মানো?

পণ্ডিত বললে, না, আমি মানি না।

মহারাজা বললেন, তাহলে ও-গানে তুমি আপত্তি করতে পারো না। ওটা জুজুবুড়োর গান। না অমলা?

আমি বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ!

ভোম্বল বললে, মহারাজ, রাজকার্যে বেলা বাড়ছে। আমার খিদে পেয়েছে।

মহারাজা বললেন, ভোম্বলের খিদে পেয়েছে। আমি আর দেরি করতে পারি না। অমলা! পণ্ডিত! তাহলে আমার আজ্ঞা শোন! তোমরা দুজনেই গুরুতর অপরাধ করেছ। তোমাদের দুজনেরই প্রাণদণ্ড হবে। মন্ত্রিগণ! এখন কার প্রাণদণ্ড আগে হবে, সেটা তোমরাই স্থির করো। কিন্তু বেশি দেরি কোরো না। ভোম্বলের খিদে পেয়েছে।

মন্ত্রিগণ বেশি দেরি করলেন না। বললেন, অমলার অপরাধ গুরুতর। আগে ওরই প্রাণদণ্ড হওয়া উচিত।

মহারাজা বললেন, এইজন্যেই তো মন্ত্রীগণের দরকার! কত তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে গেল! অমলা! মন্ত্রীগণের কথা স্বকর্ণে শ্রবণ করলে তো? অগ্রে তোমারই প্রাণদণ্ড হবে। পণ্ডিত! তুমি অমলাকে ওই টেবিলটার ওপরে শুইয়ে ওর দেহ লম্বালম্বি ভাবে কর্তন করো!

আমি চক্ষে সর্ষের ফুল দেখতে লাগলাম! যেমন হবুচন্দ্র রাজা, তেমনি গবুচন্দ্র মন্ত্রি! এখন উপায়? অত্যন্ত অসহায় ভাবে ডোম্বলের দিকে তাকালুম।

ভোম্বল দন্তবিকাশ করে কী যেন ইশারা করতে লাগল।

তার ইশারায় একটা কথা আমার মনে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি ভিতরকার জামার পকেটে হাত দিয়ে দেখি সেখানে নলচেটা এখনও আছে!

মহারাজ বললেন, অমলা! তোমার বোধহয় আর কিছু বলবার নেই?

আমি বললুম, মহারাজ! আমার আর দুটো কথা বলবার আছে।

মহারাজা বললেন, তাড়াতাড়ি বলো। ভোম্বলের খিদে পেয়েছে!

আমি বললুম, মহারাজ! আমার প্রথম কথা হচ্ছে, আপনি আমাকে অমলা বলে ডাকতে পারবেন না। আমার দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমার প্রাণদণ্ডের হুকুম আপনাকে নাকচ করতে হবে।

মহারাজা বললেন, আমি যদি তোমার ও-দুটো কথা না শুনি?

পকেট থেকে নলচে বার করে মহারাজার মাথার কাছে ধরে আমি বললুম, তাহলে এখনই আমি নলচে ছুড়ব।

মহারাজা ব্যস্ত হয়ে হাঁক দিলেন, প্রহরী! প্রহরী!

আমি বললুম, প্রহরীরা এদিকে আসবার আগেই এ রাজ্যের সিংহাসন খালি হবে!

মহারাজা বললেন, প্রহরীগণ! তোমরা শীঘ্র বিদায় হও, এদিকে এসো না–খবরদার!

ভোম্বল বললে, মহারাজ! আমার খিদে পেয়েছে।

মহারাজা বললেন, আচ্ছা, তোমাকে আর অমলা বলে ডাকব না। তোমার প্রাণদণ্ডও হবে না।

নলচে নামিয়ে আমি বললুম, মহারাজের জয় হোক!

মহারাজা বললেন, কিন্তু প্রাণদণ্ডের বদলে তোমাকে নির্বাসনদণ্ড দিলুম। তুমি এ রাজ্যে থাকবার উপযুক্ত নও। ভোম্বলের খিদে পেয়েছে। অতএব সভা ভঙ্গ হোক।

.

সপ্তদশ । আমার নির্বাসন

দলে দলে পিপে-প্রহরী চারিদিক থেকে আমাকে ঘিরে ফেললে এবং আমার হাত থেকে নলচেটা কেড়ে নিলে।

তারপর রাজপথ দিয়ে আমাকে নিয়ে চলল।

যেদিকে তাকাই সেইদিকেই দেখি, পিলপিল করে পিপের দল ছুটে আসছে। পুরুষ-পিপে, মেয়ে-পিপে, খোকা-পিপে, খুকু-পিপে! এ দেশে এত পিপে-মানুষ আছে, আমি তা কল্পনাও করতে পারিনি।

প্রত্যেক পিপেই আমার ওপরে মারমুখো হয়ে আছে। তাদের মহারাজের বিরুদ্ধে আমি যে নলচে ধরে দাঁড়িয়েছি, একথা বোধহয় দিকে দিকে রটে গেছে! পদে-পদে আমার ভয় হতে লাগল–এই বুঝি তারা আমাকে আক্রমণ করতে আসে। কিন্তু তারা আক্রমণ করলে না, সকলে মিলে কেবল আমাকে ভয়ানক বিশ্রী মুখ ভ্যাংচাতে লাগল।

মহারাজার চাকা-গাড়ি আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। মহারাজ আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না, কিন্তু তার পাশে বসে ভোম্বলদাসও আমাকে যাচ্ছেতাই মুখ ভ্যাংচাতে ভ্যাংচাতে গেল।

আমি চিৎকার করে ডাকলুম–মহারাজা! মহারাজা!

মহারাজার চাকা-গাড়ি থামল। গাড়ির ওপরে ফিরে বসে মহারাজা বললেন, আমাকে পিছু ডাকলে কেন? কী ব্যাপার!

আমি বললুম, একটা নালিশ আছে।

আবার কীসের নালিশ?

ভোম্বল আমাকে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে।

মহারাজা আমার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন, তোমার কাছে সেই নলচেটা নেই তো?

আমি বললুম, না মহারাজ, প্রহরীরা সেটা কেড়ে নিয়েছে।

মহারাজা বললেন, তাহলে ভোম্বল অনায়াসেই তোমাকে মুখ ভ্যাংচাতে পারে। খিদে পেলে ভোম্বল আমাকেও মুখ ভ্যাংচায়! না ভোম্বল?

ভোম্বলদাস আবার আমাকে মুখ ভ্যাংচাতে-ভ্যাংচাতে বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ! কিন্তু ওই যাঃ! ভারি ভুল হয়ে গেল তো!

মহারাজা ভয়ানক চমকে উঠে বললেন, অ্যা বলো কী ভুল হয়ে গেছে? কী ভুল?

ভোম্বল বললে, মহারাজ, পণ্ডিতের প্রাণদণ্ডটা তো হল না!

মহারাজা একগাল হেসে বললেন, ওঃ, এই ভুল? তার জন্যে আর ভাবনা কী? পণ্ডিতও তো আর নির্বাসনে যাচ্ছে না, আগে তোমার খিদে ঠান্ডা হোক, তারপর তাকে ধরে এনে প্রাণদণ্ড দিলেই হবে! গাড়োয়ানগণ! গাড়ি চালাও!

মহারাজার চাকা-গাড়ি বোঁ-বোঁ করে চোখের আড়ালে মিলিয়ে গেল!

.

প্রহরীরা একখানা কাপড়ে আমার চোখ বেঁধে দিলে। এ রাজ্যে আসবার পথ-ঘাট পাছে আমি চিনে রাখি, বোধহয় সেইজন্যেই এই ব্যবস্থা!

একদিন একরাত পরে এক জায়গায় এসে তারা আমার চোখের বাঁধন খুলে দিলে। চেয়ে দেখি, আমি আবার জুজু-পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি!

প্রহরীরা সবাই হাত তুলে কড়া গলায় বললে–বিদেয় হও!

হঠাৎ প্রহরীদের পিছনে আমার চোখ গেল।

দেখি একটা গুহার সামনে ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে আছে কমলা।

প্রহরীরা বললে, এখনও গেলে না? যাও বলছি!

বিমর্ষ প্রাণে চলে এলুম। মনে হল, আমার বোনকে আমি পিছনে ফেলে রেখে যাচ্ছি। মন কাঁদতে লাগল।

 

অমৃত-দ্বীপ (উপন্যাস)

গোড়াপত্তন

গোড়ায় একটুখানি গৌরচন্দ্রিকার দরকার। যদিও অমৃত-দ্বীপ নতুন উপন্যাস, তবু এর কাহিনি আরম্ভ হয়েছে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন নামে উপন্যাস থেকে। বিমল, কুমার, জয়ন্ত, মানিক ও ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু কয়েকটি রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের তদ্বিরে নিযুক্ত হয়ে তাও ধর্মমতের প্রবর্তক প্রাচীন চিনা সাধক লাউ-জুর জেড পাথরে গড়া একটি ছোট প্রতিমূর্তি এবং অমৃত-দ্বীপে যাওয়ার একখানি ম্যাপ হস্তগত করে। খ্রিস্ট জন্মাবার ছয়শত চার বৎসর আগে চিনদেশে লাউ-জুর আবির্ভাব হয়।

চিনদেশের প্রাচীন পুথিপত্রে প্রকাশ, তাও সাধুদের মতে, প্রশান্ত মহাসাগরে একটি দ্বীপ আছে, তার নাম অমৃত-দ্বীপ। সেখানে সিয়েন অর্থাৎ অমররা বাস করে। সেখানে অমর লতা জন্মায়, তার অমৃত-ফল ভক্ষণ করলে মানুষও অমর হয়। যারা তাও ধর্ম গ্রহণ করে তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, অমৃত-দ্বীপে যাওয়া। আর, সেখানে গেলে লাউ-জুর মন্ত্রপূত প্রতিমূর্তি সঙ্গে থাকা চাই।

বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের মতন তাও-ধর্মও পরের যুগে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। তার মধ্যে ক্রমেই ভূত-প্রেত, মন্ত্র-তন্ত্র, ঝাড়-ফুক আর হরেক রকম ম্যাজিকের আবির্ভাব হয়। তাও সাধকরা বলে, তাদের সিদ্ধপুরুষরা কেবল অমরই হয় না, জলে-স্থলে-শূন্যে তাদের গতি হয় অবাধ।

আধুনিক যুগে এ-সব কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় বটে, কিন্তু চিনাদের পবিত্র পাহাড় থাইসানে-র তলদেশে অবস্থিত থাইআনফু মন্দিরে গিয়ে এক সমাধিমগ্ন তাও সিদ্ধপুরুষকে দেখে রিচার্ড উইলহেলম্ নামে এক জার্মান সাহেব সবিস্ময়ে লিখেছেন, এই সমাধিস্থ তাও সাধক মৌনব্রতী। তিনি কতকাল খাদ্য আর পানীয় গ্রহণ করেননি। বাইরের কোনও কিছুই তার ধ্যান ভঙ্গ করতে পারে না। তার দেহ শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে গেছে, দেখতেও তাকে মড়ার মতো, কিন্তু তার দেহ সম্পূর্ণ তাজা, একটুও পচে যায়নি। (The Soul of China নামক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)।

অমৃত দ্বীপের পাঠকদের পক্ষে এইটুকু তথ্যই যথেষ্ট। যাঁদের আরও কিছু জানবার আগ্রহ আছে তারা ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন পড়ে দেখবেন।

.

প্রথম পরিচ্ছেদ। শত্রুর ওপরে শত্রু

জাহাজ ভেসেছে নীল জলে। এ জাহাজ একেবারেই তাদের নিজস্ব। অমৃত-দ্বীপে যাওয়ার সমস্ত জলপথটাই তাদের ম্যাপে আঁকা ছিল। সেই ম্যাপ দেখেই বোঝা যায়, কোনও বাণিজ্য-তরী বা যাত্রী-জাহাজই ও-দ্বীপে গিয়ে লাগে না, চার্টে ও-দ্বীপের কোনও উল্লেখই নেই।

কাজেই বিমল ও কুমারের প্রস্তাবে একখানা গোটা জাহাজই চার্টার বা ভাড়া করা হয়েছে। এটাও তাদের পক্ষে নতুন নয়। কারণ এইরকম একখানা গোটা জাহাজ ভাড়া করেই তারা আর একবার লিস্ট আটলান্টিস্-কে পুনরাবিষ্কার করেছিল। (নীলসায়রের অচিন পুরে নামক উপন্যাস দ্রষ্টব্য।)।

জয়ন্ত, মানিক ও সুন্দরবাবুর এ অভিযানে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। বিমল ও কুমার একরকম জোর করেই তাদের সঙ্গে টেনে এনেছে।

কাজে কাজেই তাদের পুরাতন ভৃত্য ও দস্তুরমতো অভিভাবক রামহরিও যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করেও অন্যান্য বারের মতো এবারেও শেষপর্যন্ত সঙ্গ নিতে ছাড়েনি।

এবং এমন ক্ষেত্রে তাদের চির-অনুগত চতুষ্পদ যোদ্ধা বাঘাও যে সঙ্গে-সঙ্গে লাঙুল আস্ফালন করে আসতে ছাড়বে না, সেকথা বলাই বাহুল্য।

তাদের পুরাতন দলের মধ্যে কেবল বিনয়বাবু আর কমলকে এবারে সঙ্গীরূপে পাওয়া গেল না। বিনয়বাবু এখন ম্যালেরিয়ার তাড়নায় কুইনিন ও আদার কুচির সদ্ব্যবহারে ব্যস্ত এবং কমল দেবে এবার মেডিকেল কলেজের শেষ পরীক্ষা।

জাহাজখানির নাম লিটল ম্যাজেস্টিক। আকারে ছোট হলেও যাত্রীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে এর মধ্যে চমৎকার সাজানো-গোছানো লাউঞ্জ ডাইনিং সেলুন, প্রমেনেড ডেক ও পাম কোট প্রভৃতিরও অভাব ছিল না। এরকম জাহাজ চার্টার করা বহুব্যয়সাধ্য বটে, কিন্তু বিমল ও কুমার যে অত্যন্ত ধনবান একথা সকলেই জানেন। তার ওপরে জয়ন্তও বিনা পয়সার অতিথি হতে রাজি হয়নি এবং সে-ও রীতিমতো ধনী ব্যক্তি।

জাহাজ তখন টুংহাই বা পূর্বসাগর প্রায় পার হয়ে রিউ-কিউ দ্বীপপুঞ্জের কাছ দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

ওপরে, নীচে চারিদিকে ছড়িয়ে আছে কেবল অনন্ত নীলিমা কাছে চঞ্চল, দূরে প্রশান্ত।

এই নীলিমার জগতে এখন নতুন বর্ণ সৃষ্টি করছে নিম্নে শুধু শুভ্র ফেনার মালা এবং শুন্যে শুভ্র সাগর-বিহঙ্গের দল। প্রকৃতির রঙের ডালায় এখন আর কোনও রং নেই।

প্রাকৃতিক সংগীতেও এখানে নব-নব রাগিণীর ঝংকার নেই। না আছে উচ্ছ্বসিত শ্যামলতার মর্মর, না আছে গীতকারী পাখিদের সুরের খেলা, বইছে কেবল হু-হু শব্দে বাতাস এবং জাগছে কেবল আদিম সাগরের উচ্ছল কলকল মন্ত্র–এ দুই ধ্বনির সৃষ্টি পৃথিবীর প্রথম যুগে, যখন সবুজ গাছ আর গানের পাখির জন্মই হয়নি।

খোলা ‘প্রমেনেড ডেকে’-র ওপরে পায়চারি করতে করতে মানিক বলল, আমাদের সমুদ্র যাত্রা শেষ হতে আরও কত দেরি বিমলবাবু?

বিমল বললে, আর বেশি দেরি নেই। চার ভাগ পথের তিন ভাগই আমরা পার হয়ে এসেছি। ম্যাপখানা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আরও কিছু দূর এগুলেই বোনি দ্বীপপুঞ্জের কাছে গিয়ে পড়ব। তাদের বাঁয়ে রেখে আমাদের অগ্রসর হতে হবে প্রায় পূর্ব-দক্ষিণ দিকে। তারপরই অমৃত-দ্বীপ।

মানিক বললে, দ্বীপটি নিশ্চয়ই বড় নয়। কারণ তাহলে নাবিকদের চার্টে তার উল্লেখ থাকত। এখানকার সমুদ্রে এমন অজানা ছোট-ছোট দ্বীপ দেখছি তো অসংখ্য। অমৃত-দ্বীপকে আপনি চিনবেন কেমন করে?

ম্যাপে অমৃত-দ্বীপের ছোট্ট একটা নকশা আছে, আপনি কি ভালো করে দেখেননি? সে দ্বীপের প্রথম বিশেষত্ব হচ্ছে, তার চারিপাশই পাহাড় দিয়ে ঘেরা পাহাড় কোথাও কোথাও দেড়-দুই হাজার ফুট উঁচু। তার দ্বিতীয় বিশেষত্ব, দ্বীপের ঠিক উত্তর-পশ্চিম কোণে পাহাড়ের ওপরে আছে ঠিক পাশাপাশি পাঁচটি শিখর। সবচেয়ে উঁচু শিখরের উচ্চতা দুই হাজার তিনশো ফুট। এরকম দ্বীপ দূর থেকে দেখলেও চেনা শক্ত হবে না। বলেই ফিরে দাঁড়িয়ে বিমল চোখে দুরবিন লাগিয়ে সমুদ্রের পশ্চিম দিকে তাকিয়ে কি দেখতে লাগল।

সুন্দরবাবু বললেন, হুম! আচ্ছা বিমলবাবু, আমরা যাচ্ছি তো পূর্বদিকে! অথচ আজ কদিন ধরেই লক্ষ করছি, আপনি যখন-তখন চোখে দূরবিন লাগিয়ে পশ্চিম দিকে কি যেন দেখবার চেষ্টা করছেন। এর মানে কী?

জয়ন্ত এতক্ষণ পরে মুখ খুলে বললে, এর মানে আমি আপনাকে বলতে পারি। বিমলবাবু দেখছেন আমাদের পেছনে কোনও শত্রুজাহাজ আসছে কি না!

এখানে আবার শত্রু আসবে কে?

কেন, কলকাতাকে যারা ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন দেখিয়েছিল, আপনি এরই মধ্যে তাদের কথা ভুলে গেলেন নাকি?

কী যে বলো তার ঠিক নেই! সে দল তো ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে!

কেমন করে জানলেন?

পালের গোদা কুপোকাত হলে দল কি আর থাকে?

দূরবিন নামিয়ে বিমল বললে, আমার বিশ্বাস অন্য রকম। সে দলের প্রত্যেক লোকই মরিয়া, তারা সকলেই অমৃত-দ্বীপে যাওয়ার জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু ও-দ্বীপের ঠিকানা তারা জানে না, কারণ ম্যাপখানা আছে আমাদের হাতে। আমরা যে তাদের দেশের কাছ দিয়ে অমৃত দ্বীপে যাত্রা করেছি, নিশ্চয়ই এ-সন্ধান তারা রাখে। যারা লাউ-জুর মূর্তি আর ওই ম্যাপের লোভে সুদূর চিন থেকে বাংলাদেশে হানা দিতে পেরেছিল তারা যে আর একবার শেষচেষ্টা করে দেখবে না, একথা আমার মনে হয় না।

সুন্দরবাবু বললেন, হুম, শেষচেষ্টা মানে? আপনি কি বলতে চান, তাহলে জাহাজের সঙ্গে আমাদের জলযুদ্ধ হবে?

আশ্চর্য নয়।

সুন্দরবাবু বিস্ফারিত চক্ষে ও উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, আশ্চর্য নয় মানে? জলযুদ্ধ অমনি হলেই হল? আমাদের সেপাই কোথায়? কামান কোথায়? আমরা ঘুসি ছুঁড়ে লড়াই করব নাকি?

কুমার হেসে বললে, কামান নাই বা রইল, আমাদের সকলেরই হাতে আছে অটোমেটিক বন্দুক। আর আমাদের সেপাই হচ্ছি আমরাই।

সুন্দরবাবু অধিকতর উত্তেজিত হয়ে আরও কি বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ বিকট স্বরে হুম শব্দ করে মস্ত এক লাফ মেরে পাঁচ হাত তফাতে গিয়ে পড়লেন।

মানিক বললে, কী হল সুন্দরবাবু, কী হল? আপনার হুঁড়িটা কি ফট করে ফেটে গেল?

সুন্দরবাবু ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, যাও, যাও! দেখতে যেন পাওনি, আবার ন্যাকামি করা হচ্ছে! কুমারবাবু, আপনার ওই হতচ্ছাড়া কুকুরটাকে এবার থেকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবেন। আমাকে দেখলেই ও-বেটা কোত্থেকে ছুটে এসে ফেঁশ করে আমার পায়ের ওপরে নিশ্বাস ফেলে কি শোকে, বলতে পারেন মশাই?

মানিক বললে, আপনার পাদপদ্মের গন্ধ বাঘার বোধহয় ভালো লাগে।

ইয়ার্কি কোরো না মানিক, তোমার ইয়ার্কি বাঘার ব্যবহারের চেয়েও অভদ্র। ওই নেড়ে কুত্তাটাকে আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না, চললুম আমি এখান থেকে।

সুন্দরবাবু লম্বা-লম্বা পা ফেলে অদৃশ্য হলেন, বাঘা বিলক্ষণ অপ্রতিভভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এ-লোকটি যে তাকে দু-চোখে দেখতে পারে না, এটা সে খুবই বোঝে। তাই বাঘার কৌতূহল হয়, সুন্দরবাবুকে কাছে পেলেই সে তার পা শুঁকে দেখে। মানুষের চরিত্র পরীক্ষা করবার এর চেয়ে ভদ্র উপায় পৃথিবীর কোনও কুকুরই জানে না।

*

পরদিন প্রভাতে ব্রেকফাস্টে-র পর বিমল ও কুমার জাহাজের ডেকে উঠে গেল। জয়ন্ত লেবলাঁকের লেখা একখানা ডিটেকটিভ উপন্যাস নিয়ে লাউঞ্জে গিয়ে আরাম করে বসল, মানিকও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলে।

সুন্দরবাবু বিরক্তি ভরে বললেন, জাহাজে উঠে পর্যন্ত দেখছি, বিমলবাবু আর কুমারবাবু অদৃশ্য শত্রুর কাল্পনিক ছায়া দেখবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত, আর তোমরা গাঁজাখুরি ডিটেকটিভের গল্প নিয়েই বিভোর! কারুর সঙ্গে দুটো প্রাণের কথা বলবার ফাঁক নেই!

জয়ন্ত জবাব দিলে না। মানিক বললে, আচ্ছা, এই রইল আমার বই! এখন প্রকাশ করুন আপনার প্রাণের কথা।

সুন্দরবাবু নিম্নস্বরে বললেন, কথাটা কি জানো? এই অমৃত-দ্বীপ, অমর-লতা, জলে স্থলে-শূন্যে চিরজীবী মানুষের অবাধ গতি, এসব কি তুমি বিশ্বাস করো ভায়া?

আমার কথা ছেড়ে দিন। আগে বলুন, আপনার কি মত?

হুম, আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে! বিমল আর কুমারবাবুর মাথায় তোমাদেরও চেয়ে বোধহয় বেশি ছিট আছে!–বলেই সুন্দরবাবু ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

হঠাৎ অমন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কেন?

কি জানো ভায়া, প্রথমটা আমার কিঞ্চিৎ লোভ হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, সবই ভুয়ো! যা নয় তাই!

কীসের লোভ সুন্দরবাবু?

ওই অমর-লতার লোভ আর কি! ভেবেছিলুম দু-একটা অমৃত-ফল খেয়ে যমকে কলা দেখাব। কিন্তু এখন যতই ভেবে দেখছি ততই হতাশ হয়ে পড়ছি। আমরা ছুটেছি মরীচিৎকার। পেছনে, কেবল কাদা ঘেঁটেই ফিরে আসতে হবে।

তাহলে আপনি কেবল অমর হওয়ার লোভেই বিমলবাবুদের অতিথি হয়েছেন?

না বলি আর কেমন করে? অমর হতে কে না চায়?

অমর হওয়ার বিপদ কত জানেন?

বিপদ।

হ্যাঁ। দু-একটার কথা বলি শুনুন। ধরুন, আপনি অমর হয়েছেন। তারপর কুমারবাবুর কুকুর বাঘা হঠাৎ পাগলা হয়ে গিয়ে আপনাকে কামড়ে দিল। তখন কি হবে?

হুম, কি আবার হবে? আমি হাইড্রোফোবিয়া রোগের চিকিৎসা করাব!

চিকিৎসায় রোগ যদি না সারে, তাহলে? আপনি অমর, সুতরাং মরবেন না। কিন্তু সারাজীবন–অর্থাৎ অনন্তকাল আপনাকে ওই বিষম রোগের যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ সারাজীবন চেঁচিয়ে মরতে হবে পাগলা কুকুরের মতন ঘেউ-ঘেউ করে!

তাই তো হে, এসব কথা তো আমি ভেবে দেখিনি!

তারপর শুনুন। আপনি অমর হলেও আপনার দেহ বোধকরি অস্ত্রে অকাট্য হবে না। কেউ যদি খাঁড়া দিয়ে আপনার গলায় এক কোপ বসিয়ে দেয়, তাহলে কি মুশকিল হতে পারে ভেবে দেখেছেন কি? আপনি অমর। অতএব হয় আপনার মুণ্ড, নয় আপনার দেহ, নয়তো ও-দুটোই চিরকাল বেঁচে থাকবে। কিন্তু সেই কন্ধকাটা দেহ আর দেহহীন মুণ্ড নিয়ে আপনি অমরতার কি সুখ ভোগ করবেন?

মানিক, তুমি কি ঠাট্টা করছ?

মোটেই নয়। অমর হওয়ার আরও সব বিপদের কথা শুনতে চান?

না, শুনতে চাই না। তুমি বড্ড মন খারাপ করে দাও। অমৃত-ফল পেলেও আমি আর খেতে পারব কিনা সন্দেহ।

জয়ন্ত এতক্ষণ কেতাবের আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসছিল। এখন কেতাব সরিয়ে বলল, সুন্দরবাবু, অমৃত-দ্বীপের কথা হয়তো রূপকথা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আজকের শুকনো বৈজ্ঞানিক জগতে সরস রূপকথার বড়ই অভাব হয়েছে। সেই অভাব পূরণের কৌতূহলেই আমরা বেরিয়েছি অমৃত-দ্বীপের সন্ধানে। সুতরাং অমর-লতা না পেলেও আমরা দুঃখিত হব না। অন্তত যে-কদিন পারি রূপকথার রঙিন কল্পনায় মনকে স্নিগ্ধ করে তোলবার অবকাশ তো পাব। আর ওরই মধ্যে থাকবে যেটুকু অ্যাডভেঞ্চার, সেটুকুকে মস্ত লাভ বলেই মনে করব!

এমন সময়ে একজন নাবিক এসে খবর দিল, বিমল সবাইকে এখনি ডেকের ওপরে যেতে বলেছে।

সকলে ওপরে গিয়ে দেখলে, ডেকের রেলিংয়ের ওপরে ঝুঁকে বিমল দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার চোখে দূরবিন।

জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে, বিমলবাবু কি আমাদের ডেকেছেন?

বিমল ফিরে বললে, হ্যাঁ জয়ন্তবাবু! পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখুন।

পশ্চিম দিকে চেয়েই জয়ন্ত দেখতে পেলে, একখানা জাহাজ তাদের দিকে বেগে এগিয়ে আসছে।

বিমল বললে, আমি খুব ভোরবেলা থেকেই ও-জাহাজখানাকে লক্ষ করছি। প্রথমটা ওর ওপরে আমার সন্দেহ হয়নি। কিন্তু তারপরে বেশ বুঝলুম, ও আসছে আমাদেরই পেছনে। জানেন তো, এখানকার সমুদ্রে চিনে-বোম্বেটেদের কীরকম উৎপাত! খুব সম্ভব, আমাদের শত্রুরা কোনও বোম্বেটে জাহাজের আশ্রয় নিয়েছে। দূরবিন দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ও-জাহাজখানায় লোক আছে অনেক–আর অনেকেরই হাতে রয়েছে বন্দুক। আমাদের কাপ্তেন-সায়েবের সঙ্গে আমি আর কুমার পরামর্শ করেছি। কাপ্তেন বললেন, জলে ওরা আক্রমণ করলে আমাদের পক্ষে আত্মরক্ষা করা সহজ হবে না।

তাহলে উপায়?

দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে দেখুন।

দক্ষিণ দিকে মাইল দুয়েক তফাতে রয়েছে ছোট্ট একটি তরুশ্যামল দ্বীপ।

আমরা আপাতত ওই দ্বীপের দিকেই যাচ্ছি। আশাকরি শত্রুদের জাহাজ আক্রমণ করবার আগেই আমরা ওই দ্বীপে গিয়ে নামতে পারব। তারপর পায়ের তলায় থাকে যদি মাটি, আর একটা যুতসই স্থান যদি নির্বাচন করতে পারি, তাহলে এক হাজার শত্রুকেও আমি ভয় করি না। আপনার কি মত?

জয়ন্ত বললে, বিমলবাবু, এ অভিযানের নায়ক হচ্ছেন আপনি। আমরা আপনার সহচর মাত্র। আপনার মতই আমাদের মত।

সুন্দরবাবু নীরস স্বরে বললেন, তাহলে সত্যি-সত্যিই আমাদের যুদ্ধ করতে হবে?

কুমার বললে, তা ছাড়া আর উপায় কি? বিনা যুদ্ধে ওরা আমাদের মুক্তি দেবে বলে বোধহয় না। তবে আশার কথা এই যে, আমরা ওদের আগেই ডাঙায় গিয়ে নামতে পারব।

সুন্দরবাবু বিষণ্ণভাবে বললেন, এরমধ্যে আশা করবার মতো কিছুই আমি দেখতে পাচ্ছি না। ওই চিনে বোম্বেটে-বেটারাও তো দলে-দলে ডাঙায় গিয়ে নামবে?

ভুলে যাবেন না, আমরা থাকব ডাঙায়, গাছপালা বা ঢিপিঢ়পা বা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে। আমাদের এই অটোমেটিক বন্দুকগুলোর সুমুখ দিয়েই নৌকোয় করে ওদের ডাঙার ওপরে উঠতে হবে। আমাদের এক-একটা অটোমেটিক বন্দুক প্রতি মিনিটে কতগুলি বৃষ্টি করতে পারে জানেন তো? সাতশো! আধুনিক বিজ্ঞানের অদ্ভুত মারণাস্ত্র!

সুন্দরবাবু ভয়ে-ভয়ে বললেন, কিন্তু এভাবে মানুষ খুন করে শেষটা আইনের পাকে আমাদেরও বিপদে পড়তে হবে না তো?

কুমার হেসে বললে, সুন্দরবাবু, এ জায়গা হচ্ছে অরাজক। এই বোম্বেটেদের জল-রাজ্যে একমাত্র আইন হচ্ছে–হয় মারো, নয় মরো।

সুন্দরবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হুম্!

বিমল তখন আবার চোখে দুরবিন লাগিয়ে শত্রু-জাহাজের গতিবিধ লক্ষ করছিল। কিন্তু সে জাহাজ তখন এত কাছে এসে পড়েছে যে আর দূরবিনের দরকার হয় না। খালি চোখেই বেশ দেখা যাচ্ছে, তার ডেকের ওপরে দলে-দলে চিনেম্যান ব্যস্ত, উত্তেজিতভাবে এদিকে-ওদিকে আনাগোনা বা ছুটোছুটি করছে!

হঠাৎ বিমল দূরবিন নামিয়ে আবার ফিরে দাঁড়াল। তার মুখ বিবর্ণ, দৃষ্টি ভয়চকিত।

বিমলের মুখেচোখে ভয়ের চিহ্ন! এটা কি অসম্ভব! কুমার রীতিমতো অবাক হয়ে গেল।

জয়ন্ত বিস্মিত স্বরে বললে, কি হল বিমলবাবু, আপনার মুখচোখ অমনধারা কেন?

বিমল দূরবিনটা জয়ন্তের হাতে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললে, শত্রু-জাহাজের পিছনে চেয়ে দেখুন, বোম্বেটেদেরও চেয়ে ভয়াবহ এক শত্রু আমাদের গ্রাস করতে আসছে! আমি এখন ব্রিজের ওপরে কাপ্তেনের কাছে চললুম, আরও তাড়াতাড়ি ওই দ্বীপে গিয়ে উঠতে না পারলে আর রক্ষা নেই!

সুন্দরবাবু আঁতকে উঠে বললেন, বোম্বেটেরও চেয়ে ভয়াবহ শত্রু? ও বাবা, বলেন কি?

হ্যাঁ, হা, সুন্দরবাবু! এমন আর-এক শত্রু আমাদের আক্রমণ করতে আসছে, যার নামে ভয়ে কঁপে সারা দুনিয়া! তার সামনে আমাদের অটোমেটিক বন্দুকও কোনও কাজে লাগবে না!

এই বলেই বিমল জাহাজের বিজে-র দিকে ছুটল দ্রুতপদে।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ । সুন্দরবাবুর সাগর-স্নান

চোখে দূরবিন লাগিয়ে জয়ন্ত যা দেখলে তা ভয়াবহই বটে!

বোম্বেটেদের জাহাজেরও অনেক পেছনে–বহু দুরে, আকাশ ও সমুদ্রের চেহারা একেবারে বদলে গেছে! নীচে বিপুল মাথা নাড়া দিয়ে উঠেছে প্রচণ্ড, উন্মত্ত, বৃহৎ তরঙ্গের-পর-তরঙ্গ বলা চলে তাদের পর্বত-প্রমাণ! তারা লাফিয়ে ওপরে উঠছে, আঁপিয়ে নীচে পড়ছে, আবার উঠছে, আবার নামছে এবং ঘুরপাক খেতে-খেতে ফেনায়-ফেনায় সেখানকার নীলিমাকে যেন খণ্ড-খণ্ড করে দিয়ে এগিয়ে আসছে উল্কার মতন তীব্রগতিতে! ওপরে আকাশের রং হয়ে গেছে কালো মেঘে-মেঘে ঘোরা-রাত্রির মতোই অন্ধকার! বেশ বোঝা যায়, জেগে উঠেছে সেখানে সর্বধ্বংসী আকস্মিক ঝঞ্জাবায়ু–যার মস্তকান্দোলনে দিকে দিকে ঠিকরে পড়ছে বাঁধন-হারা নিকষ কালো মেঘের জটা এবং ঘনঘন পদাঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে উথলে উঠছে তরঙ্গাকুল মহাসমুদ্র!

ফিরে দাঁড়িয়ে অভিভূত স্বরে জয়ন্ত বললে, টাইফুন?

কুমার খালি চোখেই সেদিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিয়ে বললে, হ্যাঁ, আমরা যাকে বলি ঘূর্ণাবর্ত।

মানিক বললে, কিন্তু আমাদের এখানে তো একটুও বাতাস নেই, অসহ্য উত্তাপে গা যেন পুড়ে যাচ্ছে।

কুমার বললে, ওসব টাইফুনের পূর্ব-লক্ষণ। এ-অঞ্চলে টাইফুন জাগবার সম্ভাবনা ওই লক্ষণ থেকেই জানা যায়।

জয়ন্ত বললে, কুমারবাবু, সমুদ্রযাত্রা আমার এই প্রথম, এর আগে টাইফুন কখনও দেখিনি। কিন্তু শুনেছি চিনা-সমুদ্রে টাইফুনের পাল্লায় পড়ে ফি-বৎসরেই অনেক জাহাজ অতলে তলিয়ে যায়।

সেইজন্যেই তো ওকে আমরা বোম্বেটেদেরও চেয়ে ভয়ানক বলে মনে করছি। বোম্বেটেদের সঙ্গে লড়া যায়, কিন্তু টাইফুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা অসম্ভব। এখন আমাদের একমাত্র আশা ওই দ্বীপ। যদি টাইফুনের আগে ওখানে গিয়ে পৌঁছতে পারি! হয়তো পারবও, কারণ, আমরা দ্বীপের খুব কাছে এসে পড়েছি। এই দেখুন, আমাদের জাহাজের গতি আরও বেড়ে উঠেছে!

এতক্ষণ সুন্দরবাবু ছিলেন ভয়ে হতভম্বের মতো। এইবারে মুখ খুলে তিনি বলে উঠলেন, হুম! দুর্গে দুর্গতিনাশিনী!

জয়ন্ত বললে, কিন্তু বোম্বেটেদের জাহাজ এখনও দূরে রয়েছে, সে কি টাইফুনকে ফাঁকি দিতে পারবে?

কুমার বললে, ওদের নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই।

মানিক বললে, কি আশ্চর্য দৃশ্য! সমুদ্রের আর সব দিক শান্ত, কেবল একদিকেই জেগেছে। নটরাজের প্রলয়-নাচন!

কুমার বললে, সাধারণ সাইক্লোনে-র মতো টাইফুন বহু দূর ব্যেপে ছোটে না, ওইটেই তার বিশেষত্ব। কিন্তু ছোট হলেও তার জোর ঢের বেশি–যেটুকু জায়গা জুড়ে আসে, তার ভেতরে পড়লে আর রক্ষে নেই!

দূর থেকে মেগাফোনে বিমলের উচ্চ কণ্ঠস্বর জাগল–কুমার, সবাইকে নিয়ে তুমি ডাঙায় নামবার জন্যে প্রস্তুত হও। কেবল নিতান্ত দরকারি জিনিসগুলো গুছিয়ে নাও।

সবাই কেবিনের দিকে ছুটল। তারপর তাড়াতাড়ি কতকগুলো ব্যাগ ভরতি করে আবার তারা যখন ডেকের ওপরে এসে দাঁড়াল, দ্বীপ তখন একেবারে তাদের সামনে!

মানিক বিস্মিত কণ্ঠে বললে, সমুদ্র যে এখানে প্রকাণ্ড এক নদীর মতো হয়ে দ্বীপের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে! এ যে এক স্বাভাবিক বন্দর!

জয়ন্ত বললে, হ্যাঁ, আমাদের জাহাজও এই বন্দরে ঢুকছে।

সুন্দরবাবু উৎফুল্ল স্বরে বললেন, জয় মা কালী! আমরা বন্দরে আশ্রয় পেয়েছি!

মানিক বলল, হ্যাঁ, আরও ভালো করে মা কালীকে ডাকুন সুন্দরবাবু! কারণ তিনি হচ্ছেন যুদ্ধের দেবী, আর বোম্বেটেরাও এই বন্দরে আসছে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেই।

সুন্দরবাবু দুই হাত জোড় করে মা কালীর উদ্দেশ্যে চক্ষু মুদে তিনবার প্রণাম করে বললেন, মানিক, এসময়ে আর ভয় দেখিও না, মা-জগদম্বাকে একবার প্রাণ ভরে ডাকতে দাও।

কুমার ফিরে দেখলে শত্রুরা দ্বীপ লক্ষ করে প্রাণপণে জাহাজ চালিয়েছে এবং দুরে তার দিকে বেগে তাড়া করে আসছে সাগর-তরঙ্গ তোলপাড় করে মূর্তিমান মহাকালের মতো সুভীষণ ঘূর্ণাবর্ত!

দ্বীপের ভেতরে ঢুকে সমুদ্রের জল আবার মোড় ফিরে গেছে, কাজেই জাহাজও সঙ্গে সঙ্গে মোড় ফিরলে। তখন দ্বীপের বনজঙ্গল ঠিক যবনিকার মতোই বাহির-সমুদ্র, ঘূর্ণাবর্ত ও বোম্বেটে-জাহাজের সমস্ত দৃশ্য একেবারে ঢেকে দিলে।

এমনসময়ে বিমল দৌড়ে সকলের কাছে এসে বললে, জয়ন্তবাবু, কাপ্তেন বললেন এখানকার জল গভীর নয়, জাহাজ আর চলবে না। নাবিকেরা নৌকোগুলো নামাচ্ছে, আমাদেরও জাহাজ থেকে নামতে হবে।

সুন্দরবাবু বললেন, কেন?

বোম্বেটেরাও এখানে আসছে, তারা আমাদের চেয়ে দলে ঢের ভারী। আমরা ডাঙায় না নামলে তাদের আক্রমণ ঠেকাতে পারব না।

সুন্দরবাবু আবার মুষড়ে পড়ে বললেন, তাহলে যুদ্ধ আমাদের করতেই হবে?

নিশ্চয়! টাইফুন আর বোম্বেটে–আমাদের এখন যুদ্ধ করতে হবে দুই শত্রুর সঙ্গে! ওই দেখুন, সেলর-রা এরই মধ্যে লাইফবোট ভাসিয়ে ফেলেছে! ওই শুনুন, মেগাফোনে কাপ্তেন-সায়েবের গলা! তিনি আমাদের নৌকোয় তাড়াতাড়ি নামতে বলছেন–নইলে ঝোড়ো ঢেউ এখানেও এসে পড়তে পারে! চলুন, আর দেরি নয়। রামহরি, তুমি বাঘাকে সামলাও!

লাইফবোট যেখানে থামল, সেখানে জলের ধার থেকেই একটি ছোট্ট পাহাড় প্রায় একশো ফুট উঁচু হয়ে উঠেছে।

বিমল বললে, এইখানেই বন্দুক নিয়ে আমরা সবাই পাথরের আড়ালে অপেক্ষা করব। বোম্বেটেরা আমাদের বন্দুক এড়িয়ে নিতান্তই যদি ডাঙায় এসে নামে, তাহলে অবস্থা বুঝে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। আপাতত এই পাহাড়টাই হবে আমাদের দুর্গ। কি বলো কুমার, কি বলেন জয়ন্তবাবু?

জয়ন্ত বললে, সাধুপ্রস্তাব। কিন্তু বিমলবাবু, একটা গোলমাল শুনতে পাচ্ছেন?

হুঁ, ঝোড়ো বাতাসের গোঁ-গোঁ হু-হু, সমুদ্রের হুঙ্কার!

কুমার বললে, কেবল তাই নয়দূর থেকে যেন অনেক মানুষের কোলাহলও ভেসে আসছে!

রামহরি বললে, এতক্ষণ চারিদিক গুমোট করে ছিল, এখন জোর হাওয়ায় এখানকার গাছপালাগুলো নুয়ে-নুয়ে পড়ছে! ঝড় বোধহয় এল!

মানিক বললে, ঝড় এল, কিন্তু বোম্বেটে-জাহাজ কোথায়?

সুন্দরবাবু বললেন, হুম!

বাঘা বললে, ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ!

বিমল বললে, তবে কি বোম্বেটেগুলো ঝড়ের খপ্পরেই পড়ল? দাঁড়াও, দেখে আসি—বলেই সে তাড়াতাড়ি পাহাড়ের ওপরে উঠতে লাগল।

রামহরি উদ্বিগ্ন স্বরে বললে, ওপরে উঠো না খোকাবাবু, ওপরে উঠো না! বেশি ঝড় এলে উড়ে যাবে!

কিন্তু বিমল মানা মানলে না। পাহাড়ের প্রায় মাঝবরাবর উঠেই দাঁড়িয়ে পড়ে একদিকে তাকিয়ে সে চমৎকৃত স্বরে বললে, আশ্চর্য, আশ্চর্য! কুমার, কুমার, শিগগির দেখে যাও।

বিপুল কৌতূহলে সবাই দ্রুতপদে ওপরে উঠতে লাগল–একমাত্র সুন্দরবাবু ছাড়া। তার বিপুল উঁড়ি উর্ধমার্গের উপযোগী নয়।

বাস্তবিকই সে এক আশ্চর্য দৃশ্য! যে বিষম টাইফুনের ভয়ে তারা সবাই এখানে এসে। আশ্রয় নিয়েছে, সে-ভয়ঙ্কর দ্বীপের দিকে না এসে যেন পাশ কাটিয়েই প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে চলেছে অন্য দিকে হু-হু করে! দ্বীপের দিকে এসেছে খানিকটা উদ্দাম হাওয়ার ঝটকা মাত্র, কিন্তু টাইফুন নিজে যেখান দিয়ে যাচ্ছে সেখানকার শূন্যে দুলছে নিরন্ধ্র অন্ধকার নীচে কেবল। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে রুদ্র সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গদলের হিন্দোলা! আর ভেসে-ভেসে আসছে প্রমত্ত ঘূর্ণাবর্তের বিকট চিৎকার, গম্ভীর জল কল্লোল, বহু মানবকণ্ঠের আর্তনাদ!

কুমার অভিভূত স্বরে বললে, এমন বিচিত্র ঝড় আর কখনও দেখিনি! কিন্তু বোম্বেটেদের জাহাজাখানা কোথায় গেল?

বিমল বললে, ওখানকার অন্ধকার ভেদ করে কিছুই দেখবার উপায় নেই! তবে মানুষের গোলমাল শুনে বোধ হচ্ছে, ঝড়ের সঙ্গে-সঙ্গে সে-ও কোথায় ছুটে চলেছে, হয়তো সমুদ্র এখনি তাকে গিলে ফেলবে!

রামহরি সানন্দে বললে, জয় বাবা পবনদেব! আজ তুমিই আমাদের সহায়!

খানিকক্ষণ পরেই চারিদিক আবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শূন্যে নেই অন্ধ মেঘের কালিমা, সমুদ্রে নেই বিভীষণের তাণ্ডবলীলা। একটু আগে কিছুই যেন হয়নি, এমনিভাবেই মুখর নীলসাগর আবার বোবা নীলাকাশের কাছে আদিম যুগের জীবহীনা ধরিত্রীর পুরাতন গল্প-বলা শুরু করলে।

সূর্য সাগর-স্নানে নেমে অদৃশ্য হল, কিন্তু আকাশ আর পৃথিবীতে এখনও আলো যেন ধরছে না! দূর থেকে আঁকে-ঝকে সামুদ্রিক পাখি ফিরে আসছে দ্বীপের দিকে।

পাহাড়ের ওপরে বসে সবাই বিশ্রাম করছিল। সেখান থেকে দ্বীপটিকে দেখাচ্ছে চমৎকার পরিস্থানের মতো। নানা জাতের গাছেরা সেখানে সংগীতময় সবুজ উৎসবে মেতে আছে এবং তাদের মধ্যে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাম-জাতীয় গাছেরাই।

কোথাও পাহাড়ের আনন্দাশ্রুধারার মতো ঝরে পড়ছে ঠিক যেন একটি খেলাঘরের ঝরনা। রূপালি ফিতার মতো তার শীর্ণ ধারা সকৌতুকে পাথরে-পাথরে নাচতে নাচতে নেমে এসেছে নীচেকার সুন্দরশ্যাম জমির ওপরে–যেখানে শ্যামলতাকে সচিত্র করে তুলেছে রং-বেরঙের পুঞ্জ পুঞ্জ ফুলের দল। খানিক পরেই রাত হবে, তারার সভায় উঁদ হাসবে, আর নতুন জ্যোৎস্নার ঝলমলে আলো মেঘে স্বপ্নবালারা আসবে যেন সেই ফুলের ঘাস-গালিচার ওপরে বসে ঝরনার কলগান শুনতে!

বিমল এইসব দেখতে-দেখতে একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে, শহর আর সভ্যতা ছেড়ে পৃথিবীর যেখানেই যাই সেখানেই দেখি, রেখায়-রেখায় লেখা আছে সৌন্দর্যের কবিতা। শহরে বসে হাজার টাকা খরচ করে যতই ড্রয়িং রুম সাজাও, কখনওই জাগবে না সেখানে রূপের এমন ঐশ্বর্য, লাবণ্যের এত ছন্দ! শহরে বসে আমরা যা করি তা হচ্ছে আসল সৌন্দর্যের ক্যারিকেচার মাত্র, কাগজের ফুলের মতোই অসার! তাই তো আমি যখন-তখন কুৎসিত শহর আর কপট সভ্যতাকে পেছনে ফেলে ছুটে যেতে চাই সৌন্দর্যময় অজানা বিজনতার ভেতরে। রামহরি জানে, আমরা দুরন্ত ডানপিটে, খুঁজি খালি অ্যাডভেঞ্চার। কিন্তু তুমি জানো কুমার, এ কথা সত্য নয়! চোখের সামনে রয়েছে এই যে অপরূপের নাট্যশালা, আমাদের কল্পনা কি এখানে অভিনয় করতে ভালোবাসে না? আমরা কি কেবল ঘুষোঘুষি করতে আর বন্দুক ছুঁড়তেই জানি, কবিতা পড়তে পারি না?

কুমার বললে, আমার কি মনে হচ্ছে জানো বিমল? ওই ফুলের বনে, ওই ঝরনার ধারে একখানি পাতার কুঁড়েঘর গড়ে সত্যিকার কবিতার জীবনযাপন করি! চারিদিকে বনের গান, পাখির তান, বাতাসের ঝঙ্কার, মৌমাছির গুঞ্জন, ফুলের সঙ্গে প্রজাপতির রঙের খেলা, দিনে মাঠে-মাঠে রোদের কাঁচা সোনা, রাতে গাছে-গাছে চাঁদনির ঝিলিমিলি, আর এরই মধ্য থেকে সর্বক্ষণ শোনা যায় অনন্ত সমুদ্রের মুখে মহাকাব্যের আবৃত্তি! কলকাতার পায়রার খোপে। আর আমার ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

জয়ন্ত বললে, পৃথিবীকে আমার যখন বড় ভালো লাগে তখন আমি চাই বাঁশি বাজাতে! কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এখন আমার সঙ্গে আছে বাঁশির বদলে বন্দুক। বন্দুকের নল থেকে তো। গান বেরোয় না, বেরোয় কেবল বিষম ধমক।

মানিক বললে, কেন জয়ন্ত, খুশি হলেই তো তুমি আর একটি জিনিস ব্যবহার করো! নস্যির ডিবেটাও কি তুমি সঙ্গে আননি?

জয়ন্ত বললে, হ্যাঁ, মানিক, নস্যির ডিবেটা আমার পকেটেই আছে। কিন্তু কবিতা কোনওদিন ডিবের ভেতরে নস্যির সঙ্গে বাস করে না। আজ আমাদের সামনে দেখছি যে। মূর্তিমান সংগীতকে, তার নাচের ছন্দ জাগতে পারে কেবল আমার বাঁশির মধ্যেই।

সুন্দরবাবু ধীরে-ধীরে অনেক কষ্টে দোদুল্যমান ভূঁড়ির বিদ্রোহিতাকে আমলে না এনেই পাহাড়ের ওপরে উঠে এসেছিলেন। কিন্তু বন্ধুদের কবিত্ব-চর্চা, আর তিনি বরদাস্ত করতে পারলেন না, বিরক্ত স্বরে বললেন, হুম! পাহাড় থেকে ঝরনা ঝরছে, বাতাসের ধাক্কা খেয়ে গাছগুলো নড়ে-চড়ে শব্দ করছে, কতগুলো পাখি চাঁ-া করে চাঁচাচ্ছে, আর মাঠে ঘাস গজাচ্ছে, এসব নিয়ে এত বড়-বড় কথার কিছু মানে হয় না। চল হে রামহরি, আমরা সরে পড়ি।

জয়ন্ত হাসতে-হাসতে বললে, কিন্তু যাবেন কোথায়? জাহাজে?

না। গরমে ছুটোছুটি করে শরীরটা কেমন এলিয়ে পড়েছে। এখানকার পাহাড়ের তলায় সমুদ্রের ঠান্ডা জলে বেশি ঢেউ নেই দেখছি। একটু সমুদ্র-স্নান করবার ইচ্ছে হয়েছে। রামহরি, কি বলো?

রামহরি বললে, বেশ তো, চলুন না! আমিও একবার চান করে নিই-গে। আয় রে বাঘা!

কিন্তু তোমার বাঘাকে আগে-আগে যেতে বলো রামহরি, নইলে ও আবার হয়তো আমার পা শুঁকতে আসবে!

রামহরি বললে, বাঘা, সাবধান! আবার যেন আমাদের সুন্দরবাবুর সঙ্গে গায়ে পড়ে ভাব করতে যেও না! যাও, এগিয়ে যাও।

বাঘার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল না যে, সুন্দরবাবুর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাবার জন্যে তার মনে আর কিছুমাত্র বাসনা আছে। কিন্তু সে রামহরির কথা বুঝে ল্যাজ উঁচু করে আগের দিকে দিলে লম্বা এক দৌড়।

রামহরির সঙ্গে সুন্দরবাবু যখন পাহাড় থেকে নেমে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন, তখন আকাশের আলো তার উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলছে ধীরে-ধীরে।

রামহরি বললে, শিগগির দুটো ডুব দিয়ে নিন, আলো থাকতে থাকতেই আমাদের আবার জাহাজে গিয়ে উঠতে হবে।

কিছু ভয় নেই রামহরি, আজ পূর্ণিমা। আজ অন্ধকার জব্দ!

ওই শুনুন, কু দিয়ে জাহাজ আমাদের ডাকছে। ওই দেখুন, পাহাড়ের ওপর থেকে ওঁরা সবাই নেমে আসছেন!

সুন্দরবাবু জলের ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটি সুদীর্ঘ আঃ উচ্চারণ করলেন। তারপর বললেন, বাঃ, তোমাদের বাঘা দেখছি যে দিব্যি সাঁতার কাটছে! আমিও একটু সাঁতার দিয়ে নি। কি চমৎকার ঠান্ডা জল! দেহ যেন জুড়িয়ে গেল!

জল কেবল ঠান্ডা নয়, নীলিমা-মাখানো সুন্দর, স্বচ্ছ। তলাকার প্রত্যেক বালুকণাটি পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে–এখানকার জলের মধ্যে কোনওই অজানা রহস্য নেই। কাজেই সুন্দরবাবু মনের সুখে নির্ভয়ে সাঁতার কাটতে লাগলেন।

দূর থেকে মানিক চিৎকার করে বললে, উঠে আসুন সুন্দরবাবু, অত আর সাঁতার কাটতে হবে না। এখানকার সমুদ্রে হাঙর আছে!

সুন্দরবাবু আঁতকে উঠে বললেন, হুম, কি বললে? হাঙর? তাই তো হে, একথা তো এতক্ষণ মনে হয়নি! বাব্বাঃ! দরকার নেই আমার সাঁতার কেটে! তিনি তীরের দিকে ফিরলেন এবং সঙ্গে-সঙ্গেই অনুভব করলেন জলের ভিতর থেকে প্রাণপণে কে তার কোমর জড়িয়ে ধরলে!

ওরে বাবা রে, হুম-হুম! হাঙর, হাঙর! জয়ন্ত, মানিক, রামহরি! আমাকে হাঙরে ধরেছে হু-হু-হুঁ-হুঁ-হুম!

রামহরি একটু তফাতে ছিল। কিন্তু সেইখান থেকেই সে স্তম্ভিত চোখে বেশ দেখতে পেল যে, সুন্দরবাবুর দেহের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে রয়েছে, সুদীর্ঘ একটা ছায়ামূর্তি!

সুন্দরবাবু পরিত্রাহি চিৎকার করে বললেন, বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও! হাঙর নয়, এ যে একটা মানুষ! এ যে মড়া! ওরে বাবা, এ যে ভূত! এ যে আমাকে জলের ভেতরে টানছে–ও জয়ন্ত, ও মানিক!

বিমল, কুমার, জয়ন্ত ও মানিক তিরের মতো পাহাড় থেকে নেমে এল। ভূতের নামে রামহরি একবার শিউরে উঠল বটে, কিন্তু তখনি সে দুর্বলতা সামলে নিয়ে বেগে সাঁতার কেটে সুন্দরবাবুর দিকে অগ্রসর হল। কিন্তু সর্বাগ্রে সুন্দরবাবুর কাছে গিয়ে পড়ল বাঘা– তার দুই চক্ষু জ্বলছে তখন তীব্র উত্তেজনায়!

আর পারছি না, একটা জ্যান্ত মড়া আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাঁচাও!

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ । জীবন্ত মৃতদেহ

ডুবে মলুম, ডুবে মলুম, বাঁচাও!–সুন্দরবাবু আবার একবার চেঁচিয়ে উঠলেন।

তিনি বেশ অনুভব করলেন, দু-খানা অস্থিচর্মসার, কিন্তু লোহার মতন কঠিন এবং বরফের মতন ঠান্ডা-কনকনে বাহু তাকে জড়িয়ে ধরে পাতালের দিকে টানছে, ক্রমাগত টানছে!

দারুণ ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি তার দিকে ভালো করে তাকাতে পারলেন না বটে, কিন্তু আবছা-আবছা যেটুকু দেখতে পেলেন তাই-ই হল তাঁর পক্ষে যথেষ্ট। সে হচ্ছে একটা মৃত-মানুষের জীবন্ত মৃত মানুষের মূর্তি, আর তার চোখদুটো হচ্ছে মরা মাছের মতো!

রামহরি দু-হাতে জল কেটে এগুতে-এগুতে সভয়ে দেখল, হুম বলে বিকট এক চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গে সুন্দরবাবু হুশ করে ডুবে গেলেন এবং সেই মুহূর্তে বাঘাও দিলে জলের তলায় ডুব।

ওদিকে বিমল, কুমার, জয়ন্ত ও মানিকও ততক্ষণে জলে ঝাঁপ দিয়ে এগিয়ে আসছে।

কিন্তু তাদের আর বেশিদূর এগিয়ে আসতে হল না হঠাৎ দেখা গেল, সুন্দরবাবু আবার ভেসে উঠে প্রাণপণে সাঁতার কেটে তীরের দিকে ফিরে আসছেন! বাঘাও আবার ভেসে উঠেছে।

রামহরি খুব কাছে ছিল। সে দেখতে পেলে, জলের ওপরে খানিকটা রক্তের দাগ এবং বাঘার মুখও রক্তাক্ত।

ব্যাপারটা বুঝে তারিফ করে সে বললে, বাহাদুর বাঘা, বাহাদুর!

কিন্তু সেই আশ্চর্য ও অসম্ভব মূর্তিটার আর কোনও পাত্তাই পাওয়া গেল না।

সকলে ডাঙার ওপরে উঠল। সুন্দরবাবু আর রামহরি ও বাঘা ছাড়া সে বিকট মূর্তিটাকে আর কেউ দেখেনি, সুতরাং আসল ব্যাপারটাও এখনও কেউ বুঝতে পারলে না।

বালির ওপরে হাত-পা ছড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে সুন্দরবাবু হাঁপাতে লাগলেন হাপরের মতো।

বিমল জিজ্ঞাসা করলে, সুন্দরবাবু, আপনাকে কি হাঙরে ধরেছিল?

কুমার বললে, না বিমল, তা হতে পারে না। হাঙরে ধরলে উনি অমন অক্ষত দেহে ফিরে আসতেন না।

বিমল বললে, হুঁ, সেকথা ঠিক। কিন্তু তবে কে ওঁকে জলের ভেতরে আক্রমণ করতে পারে?

সুন্দরবাবু বেদম হয়ে খালি হাঁপান! এখন তার একটা হুম পর্যন্ত বলবার শক্তি নেই। বাঘা গম্ভীর মুখে এসে সুন্দরবাবুর সর্বাঙ্গ শুঁকে বোধহয় পরীক্ষা করে দেখলে যে, তাঁর দেহ অটুট আছে কি না! পরীক্ষার ফল নিশ্চয়ই সন্তোষজনক হল, কারণ ঘনঘন ল্যাজ নেড়ে সে মনের আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল।

জয়ন্ত বললে, এখানে জলের ভেতরে অক্টোপাস থাকে না তো?

রামহরি বললে, কি বললেন?

অক্টোপাস।

তাকে কি মানুষের মতন দেখতে?

মোটেই নয়। তোমাকে কতকটা বোঝাবার জন্যে বরং বলা যায়, তাকে দেখতে অনেকটা বিরাট ও অদ্ভুত মাকড়শার মতো। সমুদ্রের জলে তারা লুকিয়ে থাকে আর আটখানা পা দিয়ে জড়িয়ে শিকার ধরে মাংস-রক্ত শুষে খায়।

না বাবু, না। আপনি যে কিম্ভুতকিমাকার জানোয়ারের কথা বললেন নিশ্চয়ই সেটা ভয়ানক, কিন্তু সুন্দরবাবুকে যে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে দেখতে মানুষের মতো।

বিমল হো-হো করে হেসে উঠে বললে, কি যে বলো রামহরি! মানুষ কি জলচর জীব? জলের ভেতর থেকে আক্রমণ করে সে কি এতক্ষণ ধরে জলের তলাতেই ডুব মেরে থাকতে পারে?

মানিক মুখ ফিরিয়ে দেখলে, সেই বিশাল হ্রদের মতো জলরাশি একেবারে স্থির হয়ে রয়েছে। তাদের জাহাজ আর লাইফবোট ছাড়া তার ওপরে আর কোনও জীবজন্তুর চিহ্নমাত্র নেই। বিমল ঠিক কথাই বলেছে। সুন্দরবাবুকে যে আক্রমণ করেছিল নিশ্চয়ই সে মানুষ নয়।

রামহরি দৃঢ়স্বরে বললে, না খোকাবাবু, আমি মিছে কথা বলিনি। সে মানুষ কি না জানি না, কিন্তু তার চেহারা মানুষের মতোই। সুন্দরবাবুর কোমর সে নীচে থেকে দু-হাতে আঁকড়ে ধরেছিল। কাচের মতো পরিষ্কার জলে তার হাত, পা, মুখ, দেহ বেশ দেখা যাচ্ছিল।

এতক্ষণ পরে সুন্দরবাবুর হাঁপ-ছাড়া হল সমাপ্ত। দু-হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে তিনি বললেন, হুম। রামহরি কিচ্ছু ভুল বলছে না। আমাকে ধরেছিল একটা জ্যান্ত মরা-মানুষ!

জ্যান্ত মরা-মানুষ!

হ্যাঁ, আমি তাকে স্বচক্ষে দেখেছি–একেবারে আসল মড়া! আমি তার হাতের ছোঁয়া পেয়েছি–একেবারে কনকনে অস্বাভাবিক ঠান্ডা! কিন্তু সে জ্যান্ত, তার হাতের চাপে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল! মরা মাছের মতো স্থির দুই চোখে আমার দিকে সে তাকিয়ে ছিল– বাপ রে, ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়!

রামহরি বললে, জ্যান্ত মড়া মানেই হচ্ছে, পিশাচ। সুন্দরবাবু নিশ্চয়ই কোনও পিশাচের পাল্লায় পড়েছিলেন। ভাগ্যে আমাদের বাঘা ছিল, তাই এ-যাত্রা কোনও-গতিকে বেঁচে গেলেন! বাঘার কাছে পিশাচও জব্দ!

সুন্দরবাবু কৃতজ্ঞ-দৃষ্টিতে বাঘার দিকে তাকিয়ে বললেন, হুম্। বাঘা, আয় রে, আমার কাছে আয়! তুই যে কি রত্ন, এতদিন আমি চিনতে পারিনি। এবার থেকে আর তোকে আমি কিছু বলব না, তোকে ভালো-ভালো খাবার খেতে দেব। খাসা কুকুর, লক্ষ্মী কুকুর!

মানিক বললে, সুন্দরবাবু, আপনি নিশ্চয় মৎস্যনারী আর নাগকন্যার গল্প শুনেছেন?

সুন্দরবাবু বেশ বুঝলেন মানিকের মাথায় কোনও নতুন দুষ্টুমি বুদ্ধির উদয় হয়েছে, তার পেছনে লাগা হচ্ছে তার চিরকেলে স্বভাব। বললেন, হুঁ, শুনেছি। কি হয়েছে তা?

আমার বোধহয় কোন মৎস্য-নারী কি নাগ-কন্যা আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছিল।

একটু গরম হয়ে সুন্দরবাবু বললেন, আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে সে কি করত?

বিয়ে করত। আপনাকে দেখে তার পছন্দ হয়েছিল কিনা।

একেবারে মারমুখো হয়ে সুন্দরবাবু বললেন, চোপরাও মানিক, চোপরাও! তোমার মতন তাঁদোড় আমি জীবনে আর দেখিনি, আমার হাতে একদিন তুমি মার খাবে জেনো।

বিমল গম্ভীরমুখে ভাবতে-ভাবতে বললে, জয়ন্তবাবু, আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?

কিছু না। কেবল এইটুকু বুঝতে পারছি, সুন্দরবাবুর চোখের ভ্রম হয়েছে।

সুন্দরবাবুর আর রামহরির–দুজনেরই একসঙ্গে চোখের ভ্রম হল?

ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন মামলার ফলেই আজ আমরা এখানে এসেছি। সেই মামলাটার কথা ভেবে দেখুন। লোকের-পর-লোক দেখতে লাগল, শূন্য-পথে ছায়ামূর্তির মতন কে উড়ে যায়। কিন্তু তারা সকলেই কি ভুল দেখেনি? হুঃ, জ্যান্ত মড়া! পিশাচ! সে আবার বাস করে জলের তলায়! বলেন কি মশাই, এসব কি বিশ্বাস করবার কথা?

বিশ্বাস আপনাকে কিছুই করতে বলছি না জয়ন্তবাবু! কিন্তু আমার মন হচ্ছে, এ ব্যাপারটার মধ্যে কোনও অলৌকিক বা অসাধারণ রহস্য থাকলেও থাকতে পারে। জীবনে অনেকবারই আমাকে আর কুমারকে এমন সব ঘটনার মধ্যে গিয়ে পড়তে হয়েছে, যা অলৌকিক ছাড়া আর কিছুই নয়। বলতে কি, অলৌকিক ব্যাপার দেখে-দেখে এখন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। আর এটাও ভুলবেন না যে, আজ আমরা সকলেই চলেছি কোনও এক অজানা দেশে, কেবল অলৌকিক দৃশ্য দেখবারই আশায়। এখন আমরা সেই অমৃত-দ্বীপের খুব কাছে এসে পড়েছি। আজ হয়তো এইখান থেকেই অলৌকিক রহস্যের আরম্ভ হল! ওই শুনুন, জাহাজ থেকে আবার আমাদের ডাকছে, সন্ধ্যাও হয়েছে, আর এখানে নয়।

পাম জাতীয় একদল গাছের ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমা-চাঁদের মুখ উঁকি মারছিল সকৌতুকে। জলে-স্থলে-শুন্যে সর্বত্রই জ্যোত্সার রূপলেখা পড়েছে ছড়িয়ে এবং দিনের সঙ্গে রাতের ভাব হয়েছে দেখে অন্ধকার আজ যেন ভয়ে নিজ-মূর্তি ধারণ করতে পারছে না।

সকলে একে-একে লাইফবোটে গিয়ে উঠল! হ্রদের স্বচ্ছ জল ভেদ করে চাঁদের আলো নেমে গিয়েছে নীচের দিকে। কিন্তু তাদের দৃষ্টি সেখানে যাকে খুঁজছিল তাকে দেখতে পেলে না। তবু একটা ভয়াবহ অসম্ভবের সম্ভাবনা হ্রদের নীলিমাকে করে রেখেছিল রহস্যময়।

.

চাঁদের বাতি নিবিয়ে দিয়ে এল অরুণ প্রভাত। মহাসাগরকে আলোময় করে সে পূর্বাকাশে এঁকে দিলে তরুণ সূর্যের রক্ততিলক। জাহাজ বেগে ছুটেছে অমৃত-দ্বীপের উদ্দেশে।

ডেকের ওপরে মর্নিং ওয়াক করতে করতে সুন্দরবাবু জাহাজের রেলিং ধরে একবার দাঁড়ালেন। এবং তৎক্ষণাৎ তার চোখদুটো উঠল বেজায় চমকে। উত্তেজিত স্বরে তিনি ডাকলেন, জয়ন্ত! মানিক! বিমলবাবু! কুমারবাবু!

সবাই এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সুন্দরবাবুর জোর-তলবে তাড়াতাড়ি সেখানে ছুটে এল।

সুন্দরবাবু বিবর্ণমুখে সমুদ্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।

জাহাজের পাশেই নীলজলে ভাসছে মানুষের একটা রক্তহীন সাদা মৃতদেহ। তার ভাবহীন, নিষ্পলক, বিস্ফারিত দুটো চোখ শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে আছে জাহাজের দিকে। তার আড়ষ্ট দেহে বিন্দুমাত্র জীবনের চিহ্ন নেই বটে, কিন্তু কী আশ্চর্য, স্রোতের বিরুদ্ধে বেগবান জাহাজের সঙ্গে সঙ্গেই সেটা ভেসে চলেছে সোঁ-সোঁ করে!

হতভম্ব মুখে জয়ন্ত বললে, আমি কি স্বপ্ন দেখছি?

বিমল কিছু বললে না, রেলিংয়ের ওপরে ঝুঁকে পড়ে আরও ভালো করে মুর্তিটাকে দেখতে লাগল।

সুন্দরবাবু তিক্তস্বরে বললেন, মানিক, ওই কি তোমার মৎস্যনারী? দেখছ, ওটা একটা বুড়ো চিনেম্যানের মড়া? ওই-ই কাল আমাকে আক্রমণ করেছিল!

মানিক বললে, নিশ্চয় ও বোম্বেটে-জাহাজের যাত্রী ছিল, কালকের টাইফুনে জলে ডুবে মারা পড়েছে।

হুম, মারা পড়েছেই বটে! তাই স্রোতের উলটোমুখে এগিয়ে চলেছে কলের জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে!

রামহরি কাঁপতে কাঁপতে বললে, সকলে রাম-নাম করো–রাম-নাম করো–রাম-নাম করো। ও পিশাচ, আমাদের রক্ত খেতে চায়!

কুমার বললে, বিমল, তাও সাধুদের কথা স্মরণ কর। যারা সিয়েন বা অমর হয়, জলে-স্থলে-শুন্যে তাদের গতি হয় অবাধ! আমরা হয়তো অমৃত-দ্বীপের কোনও সিয়েন কেই আজ চোখের সামনে স্পষ্ট দেখছি।

জয়ন্ত বললে, আজকের যুগে ও-সব আজগুবি কথা মানি কি করে?

বিমল বললে, না মেনেও তো উপায় নেই জয়ন্তবাবু! ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন মামলার সময়েই আমি কি আপনাকে মনে করিয়ে দিইনি যে, কাশীর ত্রৈলঙ্গস্বামী কত শত বৎসর বেঁচেছিলেন তা কেউ বলতে পারে না? সময়ে সময়ে তাঁরও দেহ বৎসরের-পর-বৎসর ধরে গঙ্গাজলে ভেসে ভেসে বেড়াত? ত্রৈলঙ্গস্বামীর কথা তো পৌরাণিক কথা নয়, আধুনিক যুগেরই কথা!

বিমলবাবু, আপনার বিরুদ্ধে কিছু বলবার মতো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না, আর চোখের সামনে যা স্পষ্ট দেখছি তাকে উড়িয়ে দেওয়ার শক্তিও আমার নেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমরা সবাই একসঙ্গে পাগল হয়ে গেছি! এ-ও কি সম্ভব? বেগবান অথচ আড়ষ্ট নিশ্চেষ্ট মৃতদেহ ছোটে আধুনিক কলের জাহাজের সঙ্গে। এর পরেও আর অবিশ্বাস করব কিসে? এখন অচল পাহাড়কেও চলতে দেখলে আমি বিস্মিত হব না!

সুন্দরাবাবু বললেন, ও-সব তর্ক থো করুন মশাই, থো করুন। আমার কথা হচ্ছে, সিয়েন-রা কি মানুষের মাংস খায়? নইলে ও কাল আমাকে আক্রমণ করেছিল কেন?

বিমল বললে, বোধহয় ও আমাদের উদ্দেশ্য জানতে পেরেছে। ও তাই বাধা দিতে চায়, আমাদের আক্রমণ করতে চায়!

তাই নাকি? হুম্।–বলেই সুন্দরবাবু এক ছুটে নিজের কামরায় গিয়ে একটি বন্দুক নিয়ে ফিরে এলেন।

কুমার বললে, আপনি কি করতে চান সুন্দরবাবু?

সুন্দরবাবু বললেন, আমি দেখতে চাই, অমৃত-দ্বীপে যারা থাকে তারা কেমনধারা অমর? আমি দেখতে চাই, ওই জ্যান্ত মড়াটা বন্দুকের গরমাগরম বুলেট হজম করতে পারে কিনা?

রামহরি সভয়ে বললে, পিশাচকে ঘাঁটাবেন না বাবু, পিশাচকে ঘাঁটাবেন না। কিসে কি হয় বলা তো যায় না!

আরে, রেখে দাও তোমার পিশাচ-ফিশাচ! পুলিশের কাজই হচ্ছে যত নরপিশাচ বধ করা।–এই বলেই সুন্দরবাবু বন্দুক তুলে সেই ভাসন্ত দেহটার দিকে লক্ষ্য স্থির করলেন!

ফল কি হয় দেখবার জন্যে সকলে অপেক্ষা করতে লাগল, সাগ্রহে।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ । দ্বীপে

সুন্দরবাবু তার অটোমেটিক বন্দুক ছুড়লেন–এক সেকেন্ডের মধ্যে সেই সাংঘাতিক আধুনিক মারণাস্ত্রের গর্ভ থেকে বেরিয়ে হুড়হুড় করে বয়ে গেল অনেকগুলো গুলির ঝড়।

কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্রের বুকে ভাসন্ত সেই আশ্চর্য জীবিত বা মৃত দেহটা জলের তলায় অদৃশ্য হল!

সুন্দরবাবু বন্দুক নামিয়ে বললেন, হুম। আমার লক্ষ্য অব্যর্থ। বেটার গা নিশ্চয় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।

জয়ন্ত বললে, আমার বোধহয় গুলি লাগবার আগেই ও আপদটা সমুদ্রে ডুব মেরেছ!

বিমল বললে, আমারও সেই বিশ্বাস।

কুমার বললে, মড়াটা খালি জ্যান্ত নয়, বেজায় ধূর্ত!

মানিক বললে, ও হয়তো এখন ডুব সাঁতার দিচ্ছে!

রামহরি বললে, রাম, রাম, রাম, রাম! পিশাচকে ঘাঁটিয়ে ভালো কাজ হল না।

সুন্দরবাবু বললেন, অমরই বলো, জ্যান্ত মড়াই বলো আর পিশাচই বলো, অটোমেটিক বন্দুকের কাছে কোনও বাবাজির কোনওই ওস্তাদি খাটবে না। এতক্ষণে বেটার দেহ ভেঙে গুঁড়ো হয়ে অতলে তলিয়ে গেছে।

কিন্তু সুন্দরবাবুর মুখের কথা ফুরুতে-না-ফুরুতেই সেই রক্তশূন্য সাদা দেহটা হুশ করে আবার ভেসে উঠল! তার মুখে ভয়ের বা রাগের কোনও চিহ্নই নেই এবং তার ভাবহীন ও পলকহীন চোখদুটো আগেকার মতোই বিস্ফারিত হয়ে তাকিয়ে আছে জাহাজের দিকে!

রামহরি আর সে দৃশ্য সইতে পারলে না, ওঠে-কি-পড়ে এমনি বেগে ছুটে আড়ালে পালিয়ে গেল।

বিমল হাসতে হাসতে বললে, ও সুন্দরবাবু, এখন আপনার মত কি? দেখছেন, মড়াটা এখনও অটুট দেহে বেঁচে আছে?

প্রথমটা সুন্দরবাবু রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেই সেভাব সামলে নিয়ে বললেন, তবে আমার টিপ ঠিক হয়নি। রোসো, এইবারে দেখাচ্ছি মজাটা! আরে, আরে, বন্দুক তুলতে-না-তুলতেই বেটা যে আবার ডুব মারলে হে! এমন ধড়িবাজ মড়া তো কখনও দেখিনি! হুম, কিন্তু যাবে কোথায়? এই আমি বন্দুক বাগিয়ে রইলুম, উঠেছে কি গুলি করেছি। আমার সঙ্গে কোনও চালাকিই খাটবে না বাবা!

কিন্তু দেহটা আর ভেসে উঠল না। সুন্দরবাবু তার প্রস্তুত বন্দুক নিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার পর বললেন, নাঃ! হতভাগা গুলি খেতে রাজি নয়, সরে পড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে!

জয়ন্তের মুখ গম্ভীর। সে চিন্তিতভাবে বললে, আজ যা দেখলুম, লোকের কাছে বললে আমাদের পাগল বলে ঠাট্টা করবে। বিমলবাবু, জানি না অমৃত-দ্বীপ কেমন ঠাই! কিন্তু সেখানে যারা বাস করে, তাদের চেহারা কি ওই ভাসন্ত দেহটার মতো।

বিমল মাথা নেড়ে বললে, আমিও জানি না।

মানিক বললে, আমার কিন্তু কেমন ভয়-ভয় করছে!

কুমার বললে, ভয়! ভয়কে আমরা চিনি না। ভয় আমাদের কাছে আসতে ভয় পায়।

মানিক একটু হেসে বললে, ভয় নেই, কুমারবাবু, আমিও ভীরু নই। এমন আজগুবি ভুতুড়ে দৃশ্য দেখে আমার বুকটা ছাঁৎ-ছাঁৎ করছে বটে, কিন্তু সেটা হচ্ছে মানুষের সংস্কারের দোষ। আমাকে কাপুরুষ ভাববেন না, দরকার হলে আমি ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানবেরও সঙ্গে হাতাহাতি করতে রাজি আছি। আমি–

কুমার বাধা দিয়ে মানিকের একখানা হাত চেপে ধরে বললে, আমি মাপ চাইছি মানিকবাবু! আমি আপনাকে কাপুরুষ মনে করি না।

সুন্দরবাবু বললেন, তা কুমারবাবু, আপনি আমাকে ভীতুই ভাবুন, আর কাপুরুষই ভাবুন, আমি কিন্তু একটা স্পষ্ট কথা বলতে চাই হুম!

বলুন। স্পষ্ট কথা শুনতে আমি ভালোবাসি।

আমি আর অমৃত-দ্বীপে গিয়ে অমর-লতার খোঁজ-টোজ করব না।

করবেন না?

না, না, না, নিশ্চয়ই না। আমি অমর হতে চাই না। অমর-লতার খোঁজ তো দুরের কথা, আমি আপনাদের দ্বীপের মাটি পর্যন্ত মাড়াতে রাজি নই।

কেন?

জয়ন্তের কথাটা আমারও মনে লাগছে। অমৃত-দ্বীপে যারা থাকে নিশ্চয় তারাও হচ্ছে। জ্যান্ত মড়া! মড়া যেখানে জ্যান্ত হয়, সে দেশকে আমি ঘেন্না করি। থুঃ থুঃ হুম! আমি জাহাজ থেকে নামব না।

কিন্তু তারা যদি জাহাজে উঠে আপনার সঙ্গে ভাব করতে আসে?

কী! আমার সঙ্গে ভাব করতে আসবে? ইশ, তা আর আসতে হয় না, আমার হাতে বন্দুক আছে কি জন্যে? কিন্তু যেতে দিন ও-সব ছাই কথা, এখন কেবিনের ভেতরে চলুন, খিদের চোটে আমার পেট চোঁ-চোঁ করছে।

মানিক বললে, এইটুকুই হচ্ছে আমাদের সুন্দরবাবুর মস্ত বিশেষত্ব। হাজার ভয় পেলেও উনি খিদে ভোলেন না! হয়তো মৃত্যুকালেও উনি অন্তত এক ডজন লুচি আর একটা গোটা ফাউল-রোস্ট খেতে চাইবেন।

সুন্দরবাবু খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলে উঠলেন, মানিক, ফের তুমি ফ্যাচ-ফ্যাচ্‌ করছ! ফাজিল ছোকরা কোথাকার!

*

লিটল ম্যাজেস্টিক জল কেটে সমুদ্রের নীল বুকে সাদা ফেনার উচ্ছ্বাস রচনা করতে করতে এগিয়ে চলেছে। মেঘশূন্য নীলাকাশ থেকে ঝরে পড়ছে পরিপূর্ণ রৌদ্র।

ক্রমে রোদের আঁচ কমে এল, সূর্যের রাঙা মুখ পশ্চিম আকাশ দিয়ে নামতে লাগল। নীচের দিকে।

কুমার ডেকের ওপরে এসে দেখলে, পূর্বদিকে তাকিয়ে বিমল চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার কাছে গিয়ে বললে, কি শুনছ বিমল? মহাসাগরের চিরন্তন সংগীত?

আমি কিছুই শুনছি না ভাই! আমি এখন পূর্বদিকে একটা দৃশ্য দেখবার চেষ্টা করছি।

সূর্যাস্তের দেরি নেই। এখন তো রঙিন দৃশ্যপট খুলবে পশ্চিম আকাশে। আজ প্রতিপদ, চাঁদও আসবে খানিক পরে। তবে পূর্বদিকে এখন তুমি কি দেখবার আশা করো?

যে আশায় এতদূর এসেছি।

মানে?

কুমার, এইমাত্র দূরবিনে দেখলুম পূর্বদিকে একটি পাহাড়ে ঘেরা দ্বীপকে তার একদিকে রয়েছে পাশাপাশি পাঁচটি শিখর! আমি সেই দিকেই তাকিয়ে আছি। খালি-চোখেও ওকে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তুমি ভালো করে দেখতে চাও তো এই নাও দূরবিন।

কুমার বিপুল আগ্রহে দুরবিনটা নিয়ে তাড়াতাড়ি চোখে তুলে অবাক হয়ে দেখলে, বিমলের কথা সত্য!

ছোট্ট একটি দ্বীপ। তার পায়ে উছলে পড়ে নমস্কার করে বয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের চঞ্চল। ঢেউ এবং তার মাথার ওপরে উড়ছে আকাশের পটে চলচ্চিত্রের মতো সাগর-কপোতরা। পশ্চিম আকাশের রক্তসূর্য যেন নিজের পুঁজি নিঃশেষ করে সমস্ত কিরণমালা জড়িয়ে দিয়েছে ওই দ্বীপবাসী শ্যামল শৈলশ্রেণির শিখরে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, ও যেন মায়াদ্বীপ, চোখকে ফাঁকি দিয়ে ও যেন এখনি ডুব মরতে পারে অতল নীলসাগরে!

ততক্ষণে জয়ন্ত ও মানিকের সঙ্গে সুন্দরবাবুও জাহাজের ধারে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং রামহরিরও সঙ্গে এসেছে বাঘা। দ্বীপটিকে খালি-চোখেও দেখা যাচ্ছিল, সকলে কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

কুমার বললে, ওহে বিমল, দ্বীপটি তো দেখছি একরকম পাহাড়ে মোড়া বললেই হয়! পাহাড়ের গা একেবারে খাড়া উঠে গিয়েছে ওপরদিকে অনেকখানি! ও দ্বীপ যেন পাহাড়ের উঁচু পাঁচিল তুলে সমস্ত বাইরের জগৎকে আলাদা করে দিয়েছে, ওর ভেতরে যেন বাইরের মানুষের প্রবেশ নিষেধ। ও-দ্বীপে ঢোকবার পথ কোন দিকে?

বিমল পকেট থেকে অমৃত-দ্বীপের নকশা বার করে বললে, এই দ্যাখো! দ্বীপের উত্তর পশ্চিম কোণে পাঁচ-পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু শিখরওয়ালা পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। দ্বীপের ভেতর থেকে একটি নদী পাহাড় ভেদ করে সমুদ্রের ওপর এসে পড়েছে। আমাদের দ্বীপে ঢুকতে হবে ওই নদীতেই নৌকো বেয়ে।

সুন্দরবাবু বললেন, আমি আগে থাকতেই জানিয়ে রাখছি, আমায় যেন জাহাজ থেকে নামতে বলা না হয়! কেমন রামহরি, তুমিও তো আমার দলেই?

রামহরি প্রথমটা চুপ করে রইল? তারপর মাথা নাড়তে-নাড়তে বললে, তা হয় না মশাই! খোকাবাবুরা যদি নামেন, আমাকেও নামতে হবে।

সুন্দরবাবু বিস্মিত স্বরে বললেন, সে কি হে রামহরি, ও দ্বীপ যে পিশাচদের দ্বীপ! ওখানে যারা মরে যায় তারাও চলে বেড়ায়!

রামহরি বললে, খোকাবাবুদের জন্যে আমি প্রাণও দিতে পারি।

সূর্য অস্ত গেল। জাহাজ তখন দ্বীপের খুব কাছে। ঘনিয়ে উঠল সন্ধ্যার অন্ধকার। জাহাজ শৈল-দ্বীপের পঞ্চশিখরের তলায় গিয়ে দাঁড়াল।

সমুদ্রের পাখিরা তখন নীরব। আকাশ-আসরেও লক্ষ-লক্ষ তারা প্রতিপদের চন্দ্রের জন্যে রয়েছে মৌন অপেক্ষায়। দ্বীপের ভেতর থেকেও কোনওরকম জীবনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

সমুদ্র কিন্তু সেখানেও বোবা নয়, তার কল্লোলকে শোনাচ্ছে স্তব্ধতার বীণায় অপূর্ব এক গীতিধ্বনির মতো।

তারপর ধীরে-ধীরে উঠল চাঁদ, অন্ধকারের নিকষে রূপোলি আলোর ঢেউ খেলিয়ে।

বিমল বললে, জয়ন্তবাবু, দ্বীপে ঢোকবার নদীর মুখেই আমাদের জাহাজ নোঙর করেছে। এখন যদি বোটে করে আমরা একবার দ্বীপের ভেতরটা ঘুরে আসি?

মানিক বললে, কি সর্বনাশ, এই রাত্রে?

জয়ন্ত বললে, লুকিয়ে খবরাখবর নেওয়ার পক্ষে রাত্রিই তো ভালো সময়, মানিক। চাঁদের ধবধবে আলো রয়েছে, আমাদের কোনওই অসুবিধা হবে না।

বিমল বললে, আজ আমরা দ্বীপের খানিকটা দেখেই ফিরে আসব। আমি, কুমার আর জয়ন্তবাবু ছাড়া আজ আর কারুর যাওয়ার দরকার নেই। ফিরে আসবার পর কাল সকালে আমাদের আসল অভিযান শুরু হবে।

মানিক নারাজের মতন মুখের ভাব করে বললে, কিন্তু যদি আপনারা কোনও বিপদে পড়েন?

বিপদের সম্ভাবনা দেখলেই সরে পড়ব। নয়তো একসঙ্গে তিনজনেই বন্দুক ছুঁড়ে সঙ্কেত করব। উত্তরে আপনারাও বন্দুক ছুঁড়ে আমাদের জানিয়ে জাহাজের নাবিকদের নিয়ে সদলবলে দ্বীপের ভেতরে প্রবেশ করবেন!

*

চন্দ্রালোকের স্বপ্নজাল ভেদ করে তাদের নৌকা ভেসে চলল দ্বীপের নদীতে নাচতে নাচতে। নৌকোর দাঁড় টানছে বিমল ও জয়ন্ত, হাল ধরেছে কুমার। চুপিচুপি কাজ সারবে বলে তারা নাবিকদেরও সাহায্য নেয়নি।

খানিকক্ষণ নদীর দুই তীরেই দেখা গেল, পাহাড়রা দাঁড়িয়ে আছে চিরস্তব্ধ প্রহরীর মতো। ঘণ্টাখানেক পরে তারা পাহাড়ের এলাকা পার হয়ে গেল।

দুই তীরে তখন চোখে পড়ল মাঝে-মাঝে খোলা জায়গা, মাঝে-মাঝে ছোট-বড় জঙ্গল ও অরণ্য। চাঁদের আলো দিকে দিকে নানা রূপের মতো মাধুরীর ছবি এঁকে রেখেছে, কিন্তু সেদিকে আকৃষ্ট হল না তখন তাদের দৃষ্টি।

দ্বীপের কোথাও যে-কোনও মানুষের চোখ এই সৌন্দর্য উপভোগ করছে, এমন প্রমাণও তারা পেলে না। এ দ্বীপ যেন একেবারে জনহীন–এ যেন সবুজক্ষেত্র, বৃহৎ বনস্পতি ও আকাশ-ছোঁয়া পাহাড়দের নিজস্ব রাজত্ব!

জয়ন্ত বললে, বিমলবাবু, এই যদি আপনার অমৃত-দ্বীপ হয়, তাহলে বলতে হবে যে এখানকার অমররা হচ্ছে অশরীরী!

বিমল হঠাৎ বললে, কুমার, নৌকোর মুখ তীরের দিকে ফেরাও।

জয়ন্ত বললে, কেন?

ডাঙায় নেমে দ্বীপের ভেতরটা ভালো করে দেখতে চাই।

কিন্তু নৌকো থেকে বেশি দূরে যাওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?

বিমল কি জবাব দিতে গিয়েই চমকে থেমে পড়ল। আচম্বিতে অনেক দূর থেকে জেগে উঠল বহুকণ্ঠে এক আশ্চর্য সংগীত! সে গানে পুরুষের গলাও আছে, মেয়ের গলাও আছে! গানের ভাষা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু বিচিত্র তার সুর–অপুর্ব মিষ্টতায় মধুময়।

কুমার চমৎকৃত কণ্ঠে বললে, ও কারা গান গাইছে? ও গান আসছে কোথা থেকে?

বিমল নদীর বাম তীরের দিকে চেয়ে দেখলে। প্রথমটা খোলা জমি, তারপর অরণ্য।

সে বললে, মনে হচ্ছে গান আসছে ওই বনের ভেতর থেকে। নৌকো তীরের দিকে নিয়ে চলো কুমার! কারা ও গান গাইছে সেটা না জেনে ফেরা হবে না।

খানিক পরেই নৌকো তীরে গিয়ে লাগল। বিমল, কুমার ও জয়ন্ত নিজের নিজের বন্দুক নিয়ে ডাঙায় নেমে পড়ল।

বিমল বললে, খুব সাবধানে, চারিদিকে নজর রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

তারা ধীরে-ধীরে অগ্রসর হল নরম ঘাসে ঢাকা এক মাঠের ওপর দিয়ে। সেই অদ্ভুত সম্মিলিত সংগীতের স্বর স্তরে-স্তরে ওপরে–আরও ওপরে উঠছে এবং তার ধ্বনি জাগিয়ে দিচ্ছে বহুদুরের প্রতিধ্বনিকে! সে যেন এক অপার্থিব সংগীত, ভেসে আসছে নিশীথরাতের রহস্যময় বুকের ভেতর থেকে!

যখন তারা বনের কাছে এসে পড়েছে, কুমার হঠাৎ পেছন ফিরে তাকিয়ে চকিত স্বরে বললে, বিমল, বিমল! পিছনে কারা আসছে দ্যাখো!

বিমল ও জয়ন্ত একসঙ্গে ফিরে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত নেত্রে দেখলে, নদীর দিক থেকে সার বেঁধে এগিয়ে আসছে বহুবহু মূর্তি! সংখ্যায় তারা পাঁচ-ছয়শোর কম হবে না!

বিমল মহাবিস্ময়ে বললে, নদীর ধারে তো জনপ্রাণী ছিল না! কোত্থেকে ওরা আবির্ভূত হল?

যেন আকাশ থেকে সদ্য-পতিত এই জনতার দিকে তারা তাকিয়ে রইল আড়ষ্ট নেত্রে। চাঁদের আলোয় দূর থেকে মূর্তিগুলোকে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল না বটে, কিন্তু তাদের মনে হল মূর্তিগুলো মানুষের মূর্তি হলেও, প্রত্যেকেরই ভাবভঙ্গি হচ্ছে অত্যন্ত অমানুষিক!

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ । ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন

যে দল এগিয়ে আসছে তার ভেতরকার প্রত্যেক মূর্তিটাই যেন মানুষের মতন দেখতে কলের পুতুলের মতন। কেবল চলছে তাদের পাগুলো, কিন্তু ওপর-দেহের অংশ একেবারেই কাঠের মতো আড়ষ্ট! তাদের হাত দুলছে না, মাথাগুলোও এদিকে-ওদিকে কোনওদিকেই ফিরছে না! আশ্চর্য!

দূর থেকে কেবল এইটুকুই বোঝা গেল, আর দেখা গেল খালি শত-শত চোখে স্থির আগুনের মতন উজ্জ্বল দৃষ্টি!

কিন্তু অগ্নি-উজ্জ্বল এইসব দৃষ্টি এবং এইসব আড়ষ্ট দেহের চলন্ত পদের চেয়েও অস্বাভাবিক কেমন একটা অজানা-অজানা ভাব মূর্তিগুলোর চারিদিকে কি যেন এক ভূতুড়ে রহস্য সৃষ্টি করেছে!

কুমার শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি নিজের বন্দুক তুললে।

বিমল বললে, বন্ধু, অকারণে নরহত্যা করে লাভ নেই।

কুমার বললে, নরহত্যা নয় বিমল, আমি প্রেতহত্যা করব। রামহরি ঠিক বলেছে, এ হচ্ছে পিশাচদের দ্বীপ, এখানে মানুষ থাকে না।

কুমার, পাগলামি কোরো না।

পাগলামি? ওরা কারা? এইমাত্র দেখে এলুম নদীর ধারে জনপ্রাণী নেই, তবু ওরা কোত্থেকে আবির্ভূত হল? ওরা মাটি খুঁড়ে গজিয়ে উঠল, না আকাশ থেকে খসে পড়ল? ওদের আর কাছে আসতে দেওয়া উচিত নয়, বন্দুক ছোড়ো বিমল, বন্দুক ছোড়ো।

বিমল ঘাড় নেড়ে বললে, কি হবে বন্দুক ছুঁড়ে? ওরা যদি একসঙ্গে আক্রমণ করে তাহলে বন্দুক ছুঁড়েও আমরা আত্মরক্ষা করতে পারব না, উলটে বন্দুকের শব্দে সজাগ হয়ে দ্বীপের সমস্ত বাসিন্দা এদিকে ছুটে আসতে পারে।

জয়ন্ত চমৎকৃত স্বরে বললে, বিমলবাবু, এ কি আশ্চর্য ব্যাপার! প্রায় পাঁচশো লোক মাটির ওপরে একসঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে আসছে, তবু কোনওরকম পায়ের আওয়াজই শোনা যাচ্ছে না? এও কি সম্ভব? না, আমরা কি কালা হয়ে গেছি?

কুমার বললে, বিমল, বিমল! তবে কি বিনা বাধায় আমাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে? না বন্ধু, এতে আমি রাজি নই।

বিমল বললে, না, আত্মসমর্পণ করব কেন? আমরা ছুটে ওই বনের ভেতরে গিয়ে ঢুকব।

তবে ছোটো! ওরা যে এসে পড়ল!

জয়ন্ত বললে, কিন্তু যারা গান গাইছে তারা ওই বনের ভেতরেই আছে। শেষকালে যদি আমরা দু-দিক থেকে আক্রান্ত হই?

বিমল চটপট চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে, মূর্তিগুলো আসছে পশ্চিম দিক থেকে, আর গানের আওয়াজ আসছে পূর্বদিক থেকে। পূর্ব-দক্ষিণ কোণেও রয়েছে বন। চলুন, আমরা ওই দিকেই দৌড় দি।

পূর্ব-দক্ষিণ কোণ লক্ষ করে তিনজনেই বেগে দৌড়তে লাগল। খানিকক্ষণ পরে বন ও মাঠের সীমারেখায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে তারা আর একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলে।

সেই বিচিত্র মুর্তি বৃহৎ দল দ্রুতবেগে তাদের অনুসরণ করেনি, তাদের গতি একটুও বাড়েনি। তারা যেমন ভাবে অগ্রসর হচ্ছিল এখনও ঠিক সেই ভাবেই এগিয়ে আসছে–যেন। তাদের কোনওই তাড়া নেই! তফাতের মধ্যে খালি এই, এখন তারা আসছে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে।

বিমল আশ্চর্য হয়ে বললে, ওরা যে আমাদের পেছনে-পেছনে আসছে সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যাপার কি বলো দেখি কুমার? ওরা তো একটুও তাড়াহুড়ো করছে না, রাহু যেমন নিশ্চয়ই চাঁদকে গ্রাস করতে পারবে জেনে এগুতে থাকে ধীরে-ধীরে, ওরাও অগ্রসর হচ্ছে সেইভাবেই! যেন ওরা জানে, যত জোরেই চালাই ওদের কবল থেকে কিছুতেই আমরা পালাতে পারব না!

কুমার বললে, ওদের ধরন-ধারণ দেখলে মনে হয় যেন নিশ্চিত মৃত্যুর দল মূর্তিধারণ করে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে!

জয়ন্ত বললে, ওরা কারা তা জানি না, কিন্তু আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়।

বিমল বললে, এখন দেখছি সঙ্গীদের জাহাজে রেখে এসে ভালো কাজ করিনি। এই রহস্যময় দ্বীপে অদৃষ্টে কি আছে জানি না, কিন্তু চলুন, আমরা বনের ভেতরে গিয়ে ঢুকি।

আর এক দৌড়ে তারা মাঠ ছেড়ে বনের ভেতরে গিয়ে পড়ল।

বন সেখানে খুব ঘন নয়, গাছগুলোর তলায়-তলায় ও ফাঁকে-ফাঁকে দেখা যাচ্ছে খানিক কালো আর খানিক আলোয় খেলা। ঝোপঝাড়ের মাঝখান দিয়েও ফুটে উঠেছে আলো কালো মাখা পথের রেখা।

এবং দূর থেকে তখনও ভেসে আসছিল সেই বিচিত্র সংগীতের তান।

কুমার বললে, এখন আমরা কোনদিকে যাব?

বিমল বললে, পূর্ব-দক্ষিণ দিকে আরও খানিক এগিয়ে তারপর আবার আমরা নদীর দিকে ফেরবার চেষ্টা করব।

বিমলের মুখের কথা শেষ হতেই সারা অরণ্য যেন চমকে উঠল কি এক পৈশাচিক হো হো অট্টহাস্যে! তাদের আশপাশ, সুমুখ পেছন থেকে ছুটল হাসির হররার পর হাসির হররা! সে বিকট হাসির স্রোত বইছে যেন পায়ের তলা দিয়ে, সে হাসি যেন ঝরে ঝরে পড়ছে শূন্যতল থেকে, সে হাসির ধাক্কায় যেন চঞ্চল হয়ে উঠল বনব্যাপী আলোর রেখা, কালোর রেখা!

বিমল, কুমার ও জয়ন্ত বিভ্রান্তের মতো চতুর্দিকে ঘুরে-ফিরে তাকাতে লাগল, কিন্তু কোনওদিকেই দেখা গেল না জনপ্রাণীকে।

জয়ন্ত বললে, কারা হাসে? কোথা থেকে হাসে? কেন হাসে?

কুমার ও বিমল কখনও পাগলের মতো এ-গাছের ও-গাছের দিকে ছুটে যায় কখনও ডাইনের কখনও বাঁয়ের ঝোপঝাড়ের ওপরে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে বারবার আঘাত করে, কিন্তু কোথাও কেউ নেই–অথচ অট্ট-অট্ট হাসির তরঙ্গের-পর-তরঙ্গ আসছে প্রতি ঝোপের ভেতর থেকে, প্রতি গাছের আড়াল থেকে! এ অদ্ভুত হাসির জন্ম যেন সর্বত্রই।

যেমন আচম্বিতে জেগেছিল, তেমনি হঠাৎ আবার থেমে গেল হাসির হুল্লোড়! কেবল শোনা যেতে লাগল সুদূরের সংগীতলহরী।

বিমল কান পেতে শুনে বললে, জয়ন্তবাবু, এবারে কেবল গান নয়, আর একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছেন?

জয়ন্ত বললে, হুঁ। বনময় ছড়ানো শুকনো পাতার ওপরে পড়ছে যেন তালে-তালে শত শত পা! বোধহয় মাঠের বন্ধুরা বনে ঢুকছে, কিন্তু এবারে তারা আর নিঃশব্দে আসছে না।

বিমল বললে, ছোট কুমার, যত জোরে পারো ছোট। আবার জাগ্রত হল বহুকণ্ঠে সেই ভীষণ অট্টহাস্য!

কুমার বললে, কিন্তু কোন দিকে ছুটব বিমল? দূরে শত্রুদের পদশব্দ, আশেপাশে শত্রুদের পাগলা হাসির ধূম! চারিদিকে অদৃশ্য শত্ৰু, কোনদিকে যাব ভাই?

সামনের দিকে সামনের দিকে। শত্রুরা দৃশ্যমান হলেই বন্দুক ছুড়বে।

তিনজনে আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে লাগল এবং তাদের সঙ্গে-সঙ্গেই ছুটতে লাগল যেন। সেই বেয়াড়া হাসির আওয়াজ! এইটুকুই কেবল বোঝা গেল যে, তাদের এপাশে-ওপাশে পেছনে জাগ্রত অট্টহাসি থাকলেও সামনের দিকে হাসি এখন একেবারেই নীরব। যেন সেই অপার্থিব হাসি তাদের সুমুখের পথ রোধ করতে চায় না! যেন কারা তাদের ওইদিকেই তাড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়!

প্রায় বারো-তেরো মিনিট ধরে তারা ছুটে চলল এইভাবেই এবং এরমধ্যে সেই হাসির স্রোত বন্ধ হল না একবারও।

তার পরেই থেমে গেল হাসি, শেষ হয়ে গেল বনের পথ এবং সামনেই দেখা গেল পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে খুব উঁচু একটা প্রাচীর।

কুমার হতাশভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, সামনের পথ বন্ধ! এখন আমরা কি করব?

বিমল ও জয়ন্ত উপায়হীনের মতো এদিকে-ওদিকে তাকাতে লাগল।

হঠাৎ বনের ভেতরে জাগল আবার শত-শত পায়ের আঘাতে শুকনো পাতার আর্তনাদ।

জয়ন্ত বললে, এবারে পায়ের শব্দ আসছে আমাদের দুপাশ আর পিছন থেকে। আমাদের সুমুখে রয়েছে খাড়া দেওয়াল। আর আমাদের পালাবার উপায় নেই।

বিমল ম্লান হাসি হেসে বললে, আমরা পালাচ্ছি না–রিট্রিট করছি।

জয়ন্তও হাসবার চেষ্টা করে বললে, বেশ, মানলুম এসব হচ্ছে আমাদের ট্যাকটিক্যাল মুভমেন্টস; কিন্তু এবারে আমরা কোন দিকে যাত্রা করব?

বিমল বললে, সামনের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখুন, আমাদের সুমুখের দেওয়ালের গায়ে রয়েছে একটা ছোট দরজা! ওর পাল্লাও বন্ধ নেই।

জয়ন্ত দুই পা এগিয়ে ভালো করে দেখে বুঝলে, বিমলের কথা সত্য! তারপর বললে, দেখছি, অন্ধকারে আপনার চোখ আমাদের চেয়ে ভালো চলে। কিন্তু ওর ভেতরে ঢুকলে কি আর আমরা বেরিয়ে আসতে পারব? বেশ বোঝা যাচ্ছে, দুই পাশের আর পেছনের অদৃশ্য শত্রুরা অট্টহাস্য আর পায়ের শব্দ করে আমাদের এই দিকেই তাড়িয়ে আনতে চায়। শিকারীরা বাঘ-সিংহকে যেমনভাবে নির্দিষ্ট পথে চালনা করে ফাঁদে ফেলে, শত্রুরাও সেই কৌশল অবলম্বন করেছে।

বিমল বললে, ঠিক। তাদের উদ্দেশ্য আমিও বুঝতে পেরেছি। আর আমাদের ঢোকবার সুবিধা হবে বলে দয়া করে তারা দরজার পাল্লা-দুখানাও খুলে রেখেছে! অতএব তাদের ধন্যবাদ দিয়ে আমাদের এখন দরজার ফাঁকেই মাথা গলাতে হবে, কারণ পায়ের শব্দ আর দূরে নেই!

কুমার বললে, দরজার ওপাশে যদি নতুন বিপদ থাকে?

অকুতোভয়ে সেই বিপদকে আমরা বরণ করব–বলেই বিমল বন্দুক উদ্যত করে সর্বাগ্রে দরজার ভেতরে গিয়ে ঢুকল। তার পেছনে-পেছনে গেল কুমার ও জয়ন্ত!

ভেতরে ঢুকে তারা অবাক হয়ে দেখলে, একটা বৃক্ষহীন, তৃণহীন ছোটখাটো ময়দানের মতন জায়গা এবং তার চারিদিকেই প্রায় চারতলার সমান উঁচু প্রাচীর। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, যেন সর্বহারা মরুভূমির খাঁ-খাঁ করা ভয়াল স্তব্ধতাকে সেখানে কেউ প্রাচীর তুলে কয়েদ করে রেখেছে!

জয়ন্ত বললে, এর মানে কি? একটা মাঠকে এমন উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে কেন?

বিমল অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, অনেকদিন আগে আমরা গিয়েছিলুম চম্পাদ্বীপে। কুমার, আজকের এই গর্জন শুনে কি সেখানকার কোনও-কোনও জীবের কথা মনে পড়ে না?

কুমার বললে, এরা কি এখানে আমাদের বন্দি করে রাখতে চায়?

যেন তার জিজ্ঞাসার উত্তরেই তাদের পিছনকার দরজার পাল্লা দু-খানা বন্ধ হয়ে গেল। সশব্দে।

বিমল দৌড়ে গিয়ে দরজা ধরে টানাটানি করে বললে, হা কুমার, অমৃত-দ্বীপে এসে। আমাদের ভাগ্যে উঠবে বোধহয় নিছক গরলই। এ দরজা এমন মজবুত যে মত্ত হস্তিও এর কিছুই করতে পারবে না! এতক্ষণ লক্ষ করে দেখিনি, কিন্তু এ হচ্ছে পুরু লোহার দরজা; আর এই পাঁচিল হচ্ছে পাথরের। এই দরজা আর পাঁচিল ভাঙতে হলে কামানের দরকার!

অকস্মাৎ চারিদিকের নিস্তব্ধতা খণ্ডখণ্ড হয়ে গেল ভয়াবহ গর্জনের-পর-গর্জনে! সে যে কি বিকট, কি বীভৎস, কি ভৈরব হুঙ্কার, ভাষায় তা প্রকাশ করা অসম্ভব। পৃথিবীর মাটি, আকাশের চাঁদ-তারা, নিশীথ-রাতের বুক সে হুঙ্কার শুনে যেন কেঁপে কেঁপে-কেঁপে উঠল! যেন বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধায় ছটফট করতে করতে বহু দিনের উপবাসী কোন অতিকায় দানব হিংস্র, বিষাক্ত চিৎকারের-পর-চিৎকার করে হঠাৎ আবার স্তব্ধ হয়ে পড়ল!

বিমল, কুমার ও জয়ন্ত খানিকক্ষণ স্তম্ভিত ও বোবার মতন দাঁড়িয়ে রইল।

সর্বপ্রথমে কথা কইলে জয়ন্ত; কম্পিতস্বরে সে বললে, এ কোন জীবের গর্জন বিমলবাবু? চল্লিশ-পঞ্চাশটা সিংহও যে একসঙ্গে এত জোরে গর্জন করতে পারে না! এ-রকম ভয়ানক গর্জন করবার শক্তি কি পৃথিবীর কোনও জীবের আছে?

কুমার বললে, মনে-মনে আমিও সেই কথাই ভাবছিলুম!

বিমল বললে, কিন্তু আন্দাজ করতে পারছ কি এ জীবটা কোত্থেকে গর্জন করছে? মনে হচ্ছে যেন সে আছে আমাদের খুব কাছেই। অথচ এই পাঁচিল ঘেরা জায়গাটার মধ্যে চাঁদের আলোর কোনও জীবের ছায়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না!

জয়ন্ত বললে, কিন্তু পূর্বদিকে খানিক দূরে তাকিয়ে দেখুন। ওখানে চাঁদের আলোর জলের মতন কি চকচক করছে না?

বিমল খানিকক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, হ্যাঁ জয়ন্তবাবু, ওখানে একটা জলাশয়ের মতন কিছু আছে বলেই মনে হচ্ছে!

কুমার বললে, একটু এগিয়ে দেখব নাকি?

বিমল খপ করে কুমারের হাত চেপে ধরে বললে, খবরদার কুমার, ওদিকে যাওয়ার নামও কোরও না।

কেন বিমল, ওদিকে তো কেউ নেই?

হ্যাঁ, চোখে কারুকে দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু আগে এখানকার ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝে দ্যাখো। প্রথমে ধরো, রীতিমতো মাঠের মতন এমন একটা জায়গা অকারণে কেউ এত উঁচু পাথরের পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রাখে না। এখানটা ঘিরে রাখবার কারণ কি? দ্বিতীয়ত, পাঁচিলের ওই দরজা পুরু লোহা দিয়ে তৈরি কেন? এই ফর্দা জায়গায় এমনকী বিভীষিকা আছে যাকে এখানে ধরে রাখবার জন্যে অমন মজবুত দরজার দরকার হয়? তৃতীয়ত, পাঁচিল-ঘেরা এতখানি জায়গার ভেতরে দ্রষ্টব্য আর কিছুই নেই–না গাছপালা, না ঘরবাড়ি, না জীবনের চিহ্ন! আছে। কেবল একটা জলাশয়! কেন ওখানে জলাশয় খখাড়া রয়েছে, ওর ভেতরে কি আছে? আমাদের খুব কাছে এখনি যে দানব-জানোয়ারটা বিষম গর্জন করলে, কে বলতে পারে সে ওই জলাশয়ে বাস করে কিনা? হয়তো সে উভচর–জলে-স্থলে তার অবাধ গতি! ওদিকে যাওয়া নিরাপদ নয় কুমার, ওদিকে যাওয়া নিরাপদ নয়।

জয়ন্ত শিউরে উঠে বললে, তবে কি ওই দানবের খোরাক হওয়ার জন্যেই আমাদের তাড়িয়ে এইখানে নিয়ে আসা হয়েছে?

আমার তো তাই বিশ্বাস।

কুমার বললে, ওই বিভীষিকা যদি স্থলচর হয়, তাহলে আমরা তো এখানে থেকেও বাঁচতে পারব না! সে তো আমাদের দেখতে পেলেই আক্রমণ করবে! তখন কি হবে?

তখন ভরসা আমাদের এই তিনটে অটোমেটিক বন্দুক! কিন্তু এই বন্দুক তিনটে যে নিশ্চয়ই আমাদের প্রাণরক্ষা করতে পারবে একথা জোর করে বলা যায় না! চম্পাদ্বীপে আমরা এমন সব জীবও স্বচক্ষে দেখেছি যাদের কাছে বন্দুকও হচ্ছে তুচ্ছ অস্ত্র।

জয়ন্ত কিছু না বলে প্রাচীরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর প্রাচীরের গায়ে হাত বুলিয়ে বললে, দেখছি পাঁচিলের গা তেলা নয়, রীতিমতো এবড়ো-খেবড়ো। ভালো লক্ষণ।

বিমল বললে, পাঁচিলের গা অসমতল হলে আমাদের কি সুবিধা হবে জয়ন্তবাবু?

জয়ন্ত সে-কথার জবাব না দিয়ে বললে, বিমলবাবু, যদি একগাছা হাত-চল্লিশ-পঞ্চাশ লম্বা দড়ি পেতুম, তাহলে আমাদের আর কোনওই ভাবনা ছিল না।

বিমল বিস্মিত স্বরে বললে, দড়ি? দড়ি নিয়ে কি করবেন? দড়ি তো আমার কাছেই আছে! জয়ন্তবাবু, আমি আর কুমার হচ্ছি পয়লা নম্বরের ভবঘুরে, পথে পা বাড়ালেই সবকিছুর জন্যেই প্রস্তুত হয়ে থাকি। আমাদের দুজনের পাশে ঝুলছে এই যে দুটো ব্যাগ, এর মধ্যে আছে দস্তুরমতো সংসারের এক-একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। আমার ব্যাগে আছে ষাট হাত ম্যানিলা দড়ি। জানেন তো, দেখতে সরু হলেও ম্যানিলা দড়ি দিয়ে সিংহকেও বেঁধে রাখা যায়?

জয়ন্ত বললে, উত্তম। আর চাই একটা হাতুড়ি আর একগাছা হুক।

ও দুটি জিনিস আছে কুমারের ব্যাগে।

চমৎকার! তাহলে আমার সঙ্গে আসুন। আমি চাই চার পাঁচিলের একটা কোণ বেছে নিতে, সেখানে গেলে হাত বাড়িয়ে পাব দু-দিকের দেওয়াল।

জয়ন্ত পায়ে-পায়ে এগুলো। কিছুই বুঝতে না পেরে বিমল ও কুমারও চলল তার পেছনে পেছনে।

প্রাচীরের পূর্ব-উত্তর কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত বললে, এইবারে দড়ি আর হুক আর হাতুড়ি নিয়ে আমি উঠব পাঁচিলের ওপরে। তারপর টঙে গিয়ে দুখানা পাথরের জোড়ের মুখে হুক বসিয়ে তার সঙ্গে দড়ি বেঁধে নীচে ঝুলিয়ে দেব। তারপর আপনারা দুজনেও একে একে দড়ি ধরে ওপরে গিয়ে উঠবেন। তারপর সেই দড়ি বেয়েই পাঁচিলের ওপারে পৃথিবীর মাটিতে অবতীর্ণ হতে বেশিক্ষণ লাগবে না।

বিমল খিলখিল করে হেসে উঠে বললে, বাঃ, সবই তো জলের মতন বেশ বোঝা গেল! কিন্তু জয়ন্তবাবু, প্রথমেই বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? অর্থাৎ পাঁচিলের টঙে গিয়ে চড়বে কে? আপনি, না আমি, না কুমার? দুঃখের বিষয় আমরা কেউই টিকটিকির মূর্তিধারণ করতে পারি না!

জয়ন্ত বললে, বিমলবাবু, আমি ঠাট্টা বা আকাশকুসুম চয়ন করছি না। কিছুকাল আগে নিউইয়র্ক টাইমসে আমি কারাগার থেকে পলায়নের এক আশ্চর্য খবর পড়েছিলুম। কাল্পনিক নয়, সম্পূর্ণ সত্যকাহিনি। আমেরিকার এক নামজাদা খুনে ডাকাতকে সেখানকার সবচেয়ে সুরক্ষিত জেলখানায় বন্দি করে রাখা হয়। সে-জেল ভেঙে কোনও বন্দি কখনও পালাতে পারেনি, তার চারিদিকে ছিল অত্যন্ত উঁচু পাঁচিল। কিন্তু ওই ডাকাতটা এক অদ্ভুত উপায়ে সেই পাঁচিলও পার হয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। উপায়টা যে কি, মুখে বললে আপনারা তা অসম্ভব বলে মনে করবেন–আর খবরটা প্রথমে পড়ে আমিও অসম্ভব বলেই ভেবেছিলুম। কিন্তু কিছুদিন ধরে অভ্যাস করবার পর আমিও দেখলুম, উপায়টা দুঃসাধ্য হলেও অসাধ্য নয়। তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে এ উপায়টা চিরদিনই অসম্ভব হয়ে থাকবে বটে, কারণ এ উপায় যে অবলম্বন করবে তার পক্ষে দরকার কেবল হাত-পায়ের কৌশল নয়–অসাধারণ দেহের শক্তিও।

বিমল কৌতূহলে প্রদীপ্ত হয়ে বললে, জয়ন্তবাবু, শিগগির বলুন, সে উপায়টা কি?

জয়ন্ত বললে, উপায়টা এমন ধারণাতীত যে মুখে বললে আপনারা বিশ্বাস করবেন না। তার চেয়ে এই দেখুন, আপনাদের চোখের সমুখে আমি নিজেই সেই উপায়টা অবলম্বন করছিবলেই সে দুই দিকের প্রাচীর যেখানে মিলেছে সেই কোণে গিয়ে দাঁড়াল।

তারপর বিমল ও কুমার যে অবাক করা ব্যাপারটা দেখলে কোনওদিনই সেটা তারা সম্ভবপর বলে মনে করেনি! জয়ন্ত কোণে গিয়ে দুই দিকের প্রাচীরে দুই হাত ও দুই পা রেখে কেবল হাত ও পায়ের ওপরে প্রবল চাপ দিয়ে ওপরদিকে উঠে যেতে লাগল, প্রায় অনায়াসেই! বিপুল বিস্ময়ে নির্বাক ও রুদ্ধশ্বাস হয়ে তারা বিস্ফারিত চোখে ওপর-পানে তাকিয়ে রইল।

জয়ন্ত যখন প্রাচীরের ওপর পর্যন্ত পৌঁছল, বিমল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে তারিফ করে বললে, সাধু জয়ন্তবাবু, সাধু! আপনি আজ সত্য করে তুললেন ধারণাতীত স্বপ্নকে!

ঠিক সেই সময়েই জাগল আবার চারিদিক কাঁপয়ে ও ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করে কোন অজ্ঞাত দানবের বিভীষণ হুহুঙ্কার। সে যেন সমস্ত জীবজগতের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদ–সে যেন বিরাট বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা!

জয়ন্ত তখন প্রাচীরের ওপরে উঠে বসে হাঁপ নিচ্ছে, কিন্তু এমন ভয়ানক সেই চিৎকার যে, চমকে উঠে সে আর একটু হলেই টলে নীচে পড়ে যাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি দুই হাতে প্রাচীর চেপে ধরে সরোবরের দিকে সভয়ে তাকিয়ে দেখলে।…হা, বিমলের অনুমানই ঠিক। একটু আগে যারা আজগুবি হাসি হাসছিল তারা দেখা দেয়নি বটে, কিন্তু এখন যে হুঙ্কারের-পর-হুঁঙ্কার ছাড়ছে সে আর অদৃশ্য হয়ে নেই!

চাঁদ তখন পশ্চিম আকাশে। এবং পশ্চিম দিকের উঁচু প্রাচীরের কালো ছায়া এসে পড়ে সরোবরের আধাআধি অংশ করে তুলেছে অন্ধকারময়। এবং সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে অন্ধকারেরই একটা জীবন্ত অংশের মতো কী যে সে কিম্ভুতকিমাকার বিপুল মূর্তির খানিকটা আত্মপ্রকাশ করেছে, দূর হতে স্পষ্ট করে তা বোঝা গেল না। কিন্তু তার প্রকাণ্ড দেহটা সরোবরের জ্যোৎস্না-উজ্জ্বল অংশের ওপরে ক্রমেই আরও প্রকাণ্ড হয়ে উঠতে লাগল! তবে কি সে তাদের দেখতে পেয়েছে? সে কি এগিয়ে আসছে জল ছেড়ে ডাঙায় ওঠবার জন্যে?

জয়ন্ত অত্যন্ত ব্যস্তভাবে প্রাচীরের পাথরের ফাঁকে হুক বসিয়ে ঠকঠক হাতুড়ির ঘা মারতে লাগল।

নীচে থেকে বিমল অধীর স্বরে চিৎকার করে বললে, ও আমাদের দেখতে পেয়েছে– ও আমাদের দেখতে পেয়েছে! জয়ন্তবাবু, দড়ি–দড়ি!

কুমার ফিরে সচকিত চোখে দেখলে, প্রায় আশি ফুট লম্বা ও পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ ফুট উঁচু একটা বিরাট কালি কালো দেহ মূর্তিমান দুঃস্বপ্নের মতো সরোবরের তীরে বসে সশব্দে প্রচণ্ড গা-ঝাড়া দিচ্ছে!

ওপর থেকে ঝপাং করে একগাছা দড়ি নীচে এসে পড়ল।

কুমার এস্ত স্বরে বললে, লাউ-জুর ভক্তরা কি একেই ড্রাগন বলে ডাকে?

বিমল দড়ি চেপে ধরে বলল, চুলোয় যাক নাউজুর ভক্তরা! এখন নিজের প্রাণ বাঁচাও। তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গেই দড়ি ধরে ওপরে উঠে এসো।

—– —-

তারা একে-একে প্রাচীরের ওপারে মাটির ওপরে গিয়ে নেমে আড়ষ্টভাবে শুনলে, ওধার থেকে ঘনঘন জাগছে মহাব্রুদ্ধ দানবের হতাশ হুহুঙ্কার! সে নিশ্চয়ই চারিদিকে মুখের গ্রাস খুঁজে বেড়াচ্ছে, কেন না তার বিপুল দেহের বিষম দাপাদাপির চোটে প্রাচীরের এ-পাশের মাটিও কেঁপে উঠছে থরথর করে।

কুমার শ্রান্তের মতন কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললে, উঃ, দানবটা আর এক মিনিট আগে আমাদের দেখতে পেলে আর আমরা বাঁচতুম না!

বিমল গম্ভীর স্বরে বললে, এখনও আমাদের বাঁচবার সম্ভাবনা নেই কুমার! ডাইনে বাঁয়ে সামনের দিকে চেয়ে দ্যাখো!

সর্বনাশ! আবার সেই অপার্থিব দৃশ্য! তারা দাঁড়িয়ে আছে প্রান্তরের মতন একটা স্থানে এবং সেই প্রান্তরের যেদিকে তাকানো যায় সেই দিকেই চোখে পড়ে, কলে-চলা পুতুলের মতন দলে-দলে মানুষ-মূর্তি অর্ধচন্দ্রাকারে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে! নীরব, নিঃশব্দ, নিষ্ঠুর সব মূর্তি।

পেছনে প্রাচীর এবং সামনে ও দুই পাশে রয়েছে এই অমানুষিক মানুষের দল। এবারে আর পালাবার কোনও পথই খোলা নেই।

জয়ন্ত অবসন্নের মতো বসে পড়ে বললে, আর কোনও চেষ্টা করা বৃথা।

.

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ । দ্বীপের নিরুদ্দেশ যাত্রা

সেই ভয়ানক অর্ধচন্দ্র ব্যুহ এমনভাবে তিন দিক আগলে এগিয়ে আসছে যে, মুক্তিলাভের কোনও পথই আর ভোলা রইল না।

ব্যুহ যারা গঠন করেছে তাদের দিকে তাকালেও বুক করতে থাকে ছাঁৎ-ছাঁৎ! তারা মানুষ, না অমানুষ? তারা যখন মাটির ওপরে পদ সঞ্চালন করে অগ্রসর হচ্ছে তখন তাদের জ্যান্ত মানুষ বলেই না মেনে উপায় নেই, কিন্তু দেখলে মনে হয়, যেন দলে-দলে কবরের মড়া হঠাৎ কোনও মোহিনী মন্ত্রে পদচালনা করবার শক্তি অর্জন করেছে! এবং এবারেও সবাই লক্ষ করলে যে, কেবল দুই পা ছাড়া তাদের প্রত্যেকেরই অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিক যেন মৃত্যু আড়ষ্ট হয়ে আছে!

অর্ধচন্দ্র-ব্যুহের দুই প্রান্ত বিমলদের পেছনকার প্রাচীরের দুই দিকে সংলগ্ন হল, মাঝে থাকল একটুখানি মাত্র ফাঁক, যেখানে অবাক ও অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারা তিনজনে।

এদের উদ্দেশ্য কি? এরা তাদের বন্দি করতে, না বধ করতে চায়? ওদের মুখ দেখে কিছু বোঝা অসম্ভব, কারণ মড়ার মুখের মতন কোনও মুখই কোনও ভাব প্রকাশ করছে না– কেবল তাদের অপলক চোখে চোখে জ্বলছে যেন নিষ্কম্প অগ্নিশিখা, যা দেখলে হয় হৃৎকম্প।

কুমার মরিয়ার মতন চিৎকার করে বললে, কপালে যা আছে বুঝতেই পারছি, আমি কিন্তু পোকার মতন ওদের পায়ের তলায় পড়ে প্রাণ দিতে রাজি নই–যতক্ষণ শক্তি আছে বিমল, বন্দুক ছোড়ো, বন্দুক ছোড়!

সঙ্গে-সঙ্গে শত-শত কণ্ঠে আবার জাগল অট্টহাস্যর-পর-অট্টহাস্যের উচ্ছ্বাস!

সঙ্গে-সঙ্গে প্রাচীরের ওপার থেকেও ভীষণ হুঙ্কার করে সাড়া দিতে লাগল সেই শিকার বঞ্চিত হতাশ দানব জন্তুটা!

সেই সমান-ভয়াবহ হাস্য ও গর্জনের প্রচণ্ডতায় চতুর্দিক হয়ে উঠল যেন বিষাক্ত!

ও-দানবটা যেন চাঁচাচ্ছে পেটের জ্বালায় অস্থির হয়ে, কিন্তু এই মূর্তিমান প্রেতগুলো এত হাসে কেন?

বিমল বললে, জাহাজের সঙ্গে-সঙ্গে সমুদ্রে যে মূর্তিটা ভেসে আসছিল, তাকেও দেখতে ঠিক এদেরই মতো। সে-ও হয়তো এই দলেই আছে।

কুমার তখন তার বন্দুক তুলেছিল। কিন্তু হঠাৎ কি ভেবে বন্দুক নামিয়ে বললে, বিমল, বিমল, একটা কথা মনে হচ্ছে!

কি কথা?

লাউ-ৎজুর মূর্তিটা আমার সঙ্গেই আছে। জান তো, তাও সাধুরা বলে সে মূর্তি মন্ত্রপূত আর তাকে সঙ্গে না আনলে এ-দ্বীপে আসা যায় না?

বিমল কতকটা আশ্বস্ত স্বরে বললে, ঠিক বলেছ কুমার, এতক্ষণ ওকথা আমি ভুলেই গিয়েছিলুম! ওই মূর্তির লোভেই কলকাতায় মানুষের-পর-মানুষ খুন হয়েছে। তার এত মহিমা কীসের, এইবারে হয়তো বুঝতে পারা যাবে! বার করো তো একবার মূর্তিটাকে, দেখি সেটা দেখে এই ভূতগুলো কি করে?

কুমার তাড়াতাড়ি ব্যাগের ভেতর থেকে জেডপাথরে গড়া, রামছাগলে চড়া সাধক লাউ-জুর সেই অর্ধর্তপ্ত অর্ধ-শীতল মূর্তিটা বার করে ফেললে এবং ডানহাতে করে এমনভাবে তাকে মাথার ওপরে তুলে ধরলে যে, সকলেই তাকে স্পষ্ট দেখতে পেলে।

ফল হল কল্পনাতীত!

মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল অট্টহাস্য এবং আচম্বিতে যেন কোন অদৃশ্য বৈদ্যুতিক শক্তির ধাক্কা খেয়ে সেই শত-শত আড়ষ্টমূর্তি অত্যন্ত তাড়াতাড়ি পিছিয়ে যেতে-যেতে ছত্রভঙ্গ হয়ে নানাদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল!

জয়ন্ত, বিমল ও কুমার–তিনজনেই অত্যন্ত বিস্মিতের মতো একবার এ-ওর মুখের দিকে এবং একবার সেই পশ্চাৎপদ বীভৎস মূর্তিগুলোর দিকে ফিরে-ফিরে তাকাতে লাগল বারংবার!

অবশেষে হাঁপ ছেড়ে জয়ন্ত বললে, এতটুকু মূর্তির এত বড় গুণ, একথা যে বিশ্বাস করতেও প্রবৃত্তি হচ্ছে না!

বিমল বললে, এতক্ষণে বোঝা গেল, এই দ্বীপে ওই পবিত্র মুর্তিই হবে আমাদের রক্ষাকবচের মতো। ওকে সঙ্গে করে এখন আমরা যেখানে খুশি যেতে পারি।

জয়ন্ত বললে, না বিমলবাবু, না! এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপ আমাদের মতন মানুষের জন্যে তৈরি হয়নি। এখানে পদে-পদে যত সব অস্বাভাবিক বিপদ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে, এরপর হয়তো লাউ-জুর মুর্তিও আর আমাদের বাঁচাতে পারবে না। আমি চাই নদীর ধারে যেতে, যেখানে বাঁধা আছে আমাদের নৌকা!

কুমার বললে, আপাতত আমিও জয়ন্তবাবুর কথায় সায় দি। আবার যদি এখানে আসি, দলে ভারী হয়েই আসব। কিন্তু নদী কোন দিকে?

বিমল বললে, নিশ্চয়ই পশ্চিম দিকে! ওই দ্যাখো, চাঁদের আলো নিবে আসছে, পূর্বের আকাশ ফরসা হচ্ছে!

যেন সমুজ্জ্বল স্বপ্নের মতো স্নিগ্ধতার মধ্যে দেখা গেল, প্রান্তরের মাঝে-মাঝে দাঁড়িয়ে আছে তালজাতীয় তরুকুঞ্জ ও ছোট-ছোট বন। এতক্ষণ যারা এসে এখানে বিভীষিকা সৃষ্টি করছিল সেই অপার্থিব মূর্তিগুলো এখন অদৃশ্য হয়েছে চোখের আড়ালে, কোথায়!

বিমল সব দিকে চোখ বুলিয়ে বললে, আর বোধ হয় ওরা আমাদের ভয় দেখাতে আসবে না! চলল কুমার, আমরা ওই বনের দিকে যাই। খুব সম্ভব, ওই বনের পরেই পাব নদী।

তারা বন লক্ষ করে অগ্রসর হল এবং চলতে-চলতে বারবার শুনতে লাগল, সেই অজানা অতিকায় জানোয়ারটা তখনও আকাশ কাঁপিয়ে দারুণ ক্রোধে চিৎকার করছে ক্রমাগত!

প্রায় সিকি মাইল পথ চলবার পর বনের কাছে এসে তারা শুনতে পেলে, গাছে গাছে জেগে উঠে ভোরের পাখিরা গাইছে নতুন উষার প্রথম জয়গীতি। আঁধার তখন নিঃশেষে পালিয়ে গেছে কোথায় কোন দুঃস্বপ্নলোকের অন্তঃপুরে।

দানবের চিৎকারও থেমে গেল। হয়তো সেও ফিরে গেল হতাশ হয়ে তার পাতালপুরে। হয়তো রাত্রির জীব সে, সূর্যালোক তার চোখের বালি।

বাতাসও এতক্ষণ ছিল যেন শ্বাসরোধ করে, এখন ফিরে এল নিয়ে তার স্নিগ্ধ স্পর্শ, বনে-বনে সবুজ গাছের পাতায়-পাতায় জাগল নির্ভীক আনন্দের বিচিত্র শিহরন!

জয়ন্ত বললে, এই তো আমার চির-পরিচিত প্রিয় পৃথিবী! জানি এর আলো-ছায়ার মিলন-লীলাকে, এর শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের মাধুর্যকে, এর ফুল ফোঁটানো শ্যামলতাকে, আমি বাঁচতে চাই এদেরই মাঝখানে! কালকের মতো যুক্তিহীন আজগুবি রাত আর আমার জীবনে কখনও যেন না আসে! এ-রাতের কাহিনি কারুর কাছে মুখ ফুটে বললেও সে আমাকে পাগল বলে মনে করবে!

ঠিক সেই সময়ে কী এক অভাবনীয় ভাবে সকলের মন অভিভূত হয়ে গেল।

প্রথমটা সবিস্ময়ে কারণ বোঝবার চেষ্টা করেও কেউ কিছুই বুঝতে পারলে না।

তার পরেই কুমার বললে, একি বিমল, একি! ভূমিকম্প, হচ্ছে নাকি?

চারিদিকে একবার চেয়ে বিমল বললে, এ তো ঠিক ভূমিকম্পের মতন মনে হচ্ছে না কুমার! মনে হচ্ছে, আমরা আছি টলমলে জলে নৌকার ওপরে! একি আশ্চর্য!

জয়ন্ত বললে, দেখুন দেখুন, ওইদিকে তাকিয়ে দেখুন! যে মাঠ দিয়ে আমরা এসেছি, সেখানে হঠাৎ এক নদীর সৃষ্টি হয়েছে! আঁঃ এও কি সম্ভব?

বিপরীত দিকে তাকিয়ে কুমার বললে, ওদিকেও যে ওই ব্যাপার! আমরা যে জমির ওপরে দাঁড়িয়ে আছি তার দুই দিকেই নদীর আবির্ভাব হয়েছে!

দুই হাতে চোখ কচলে চমৎকৃত কণ্ঠে বিমল বললে, এ তো দৃষ্টি বিভ্রম নয়! কুমার, আমাদের সামনের দিকেও খানিক তফাতে চেয়ে দেখ। ওখানেও জল! পেছনদিকে বন ভেদ করে চোখ চলছে না, খুব সম্ভব ওদিকেও আছে জল! কারণ এটা বেশ বুঝতে পারছি যে, আমরা আছি এখন দ্বীপের মতন একটা জমির ওপরে, আর এই দ্বীপটা ভেসে যাচ্ছে ঠিক নৌকোর মতোই! না, এইবারে আমি হার মানলুম! দ্বীপ হল নৌকো! না এটাকে বলব ভাসন্ত। দ্বীপ?

সত্য! জলের ওপারে প্রান্তরের বনজঙ্গল দেখতে-দেখতে পেছনে সরে যাচ্ছে–যেমন সরে যেতে দেখা যায় রেলগাড়ির ভেতরে বা নৌকো-জাহাজের ওপরে গিয়ে বসলে! গঙা সাঁতার কাটছে জলে!

বিমল অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, জয়ন্তবাবু আপনি হ্যাঁমার্টনের ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি অফ দি ওয়ার্ল্ড পড়েছেন?

রেখে দিন মশাই, হিস্ট্রি-ফিস্ট্রি! আমার মাথা এমন বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে! নিজেকে আর জয়ন্ত বলেই মনে হচ্ছে না!

শুনুন। ওই হিস্ট্রির ষষ্ঠ খণ্ডে ৩৫২২ পৃষ্ঠায় একখানি ছবি দেখবেন। চার-পাঁচ শ বছর আগে চিনদেশে সিং-রাজবংশের সময়ে একজন চিনা পটুয়া অমৃত-দ্বীপের যে চিত্র এঁকেছিলেন, ওখানি হচ্ছে তারই প্রতিলিপি। তাতে দেখা যায়, জনকয় তাও-ধর্মাবলম্বী লোক একটি ভাসন্ত দ্বীপে বসে পানভোজন আমোদ-আহ্বাদ করছে, আর একটি মেয়ে হাল ধরে দ্বীপটিকে করছে নির্দিষ্ট পথে চালনা!

আরে মশাই, কবি আর চিত্রকররা উদ্ভট কল্পনায় যা দেখে, তাই কি আমাদেরও বিশ্বাস। করতে হবে?

জয়ন্তবাবু, সময়-বিশেষে কল্পনাও যে হয় সত্যের মতো, আর সত্যও হয় কল্পনায় মতো, আজ স্বচক্ষেও তা দেখে আপনি তাকে স্বীকার করবেন না।

পাগলের কাছে সবই সত্য হতে পারে। আমাদের সকলেরই মাথা হঠাৎ বিগড়ে গেছে।

না জয়ন্তবাবু, শিশুরও কাছে সবই সত্য হতে পারে। এই লক্ষ-কোটি বৎসরের অতি বৃদ্ধ পৃথিবীর কোলে ক্ষুদ্র মানুষ হচ্ছে শিশুর চেয়ে শিশু। সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরেও যে অসাধারণ প্রাকৃতিক নিয়ম থাকতে পারে, ভালো করে তা জানতে পারবার আগেই ক্ষণজীবী মানুষের মৃত্যু হয়। আজ লোহা জলে ভাসে, ধাতু আকাশে ওড়ে, বন্দি বিদ্যুৎ গোলামি করে, শূন্য দিয়ে সাত সাগর পেরিয়ে বেতারে মানুষের চেহারা আর কণ্ঠস্বর ছোটাছুটি করে, ছবি জ্যান্ত হয়ে কথা কয়, রসায়নাগারে নূতন জীবের সৃষ্টি হয়, কিছুকাল আগেও এসব ছিল সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে, আজগুবি কল্পনার মতো। তবু আমরা কতটুকুই বা দেখতে কি জানতে পেরেছি? পৃথিবীতে যা-কিছু আমরা দেখিনি-শুনিনি তাহাই অসম্ভব না হতেও পারে!

আপনার বক্তৃতাটি যে খুবই শিক্ষাপ্রদ, তা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আপাতত বক্তৃতা শোনবার আগ্রহ আমার নেই। এখন আমরা কি করব সেইটেই ভাবা উচিত, এ-দ্বীপ আমাদের নিয়ে জলপথে হয়তো নিরুদ্দেশ যাত্রা করতে চায়, এখন আমাদের কি করা উচিত?

কুমার বললে, আমাদের উচিত, জলে ঝাঁপ দেওয়া।

জয়ন্ত বললে, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে যদি তরল জল আবার কঠিন মৃত্তিকায় পরিণত হয়, তাহলেও আমি আর অবাক হব না!

বিমল বললে, কিংবা জলের ভেতরে আবার দেখা দিতে পারে দলে-দলে জ্যান্ত মড়া!

কুমার শিউরে উঠে ব্যাগটা টিপেটুপে অনুভব করে দেখলে, লাউ-জুর মূর্তিটা যথাস্থানে আছে কি না!

তারপর এগিয়ে ধারে গিয়ে তারা দেখলে, দ্বীপ তখন ছুটে চলেছে রীতিমতো বেগে এবং তটের তলায় উচ্ছল স্রোত ডাকছে কলকল করে! নদীর আকার তখন চওড়া হয়ে উঠেছে এবং খণ্ডদ্বীপের দুই দিকে দুই তীর সরে গেছে অনেক দূরে।

জয়ন্ত আবার বললে, এখন উপায় কি বিমলবাবু, কী আমরা করব?

বিমল বললে, এখানে জল-স্থল দুই-ই বিপদজনক। বাকি আছে শূন্যপথ, কিন্তু আমাদের ডানা নেই!

কুমার বললে, নদীর সঙ্গে আমরা যাচ্ছি সমুদ্রের দিকে। হয়তো অমৃত-দ্বীপের বাসিন্দারা আমাদের মতো অনাহুত অতিথিদের বাহির-সমুদ্রে তাড়িয়ে দিতে চায়।

জয়ন্ত আশান্বিত হয়ে বললে, তাহলে তো সেটা হবে আমাদের পক্ষে শাপে বর! নদীর মুখেই আছে আমাদের জাহাজ!

বিমল বললে, কিন্তু জাহাজ শুদ্ধ লোক আমাদের এই অতুলনীয় দ্বীপ-নৌকা দেখে কি মনে করবে, সেটা ভেবে এখন থেকেই আমার হাসি পাচ্ছে!

কিন্তু বিমলের মুখে হাসির আভাস ফোটবার আগেই হাসি ফুটল আর এক নতুন কণ্ঠে। দস্তুরমত কৌতুক-হাসি!

সকলে চমকে পেছন ফিরে অবাক হয়ে দেখলে, একটু তফাতে বনের সামনে গাছতলায় বসে আছে আবার এক অমানুষিক মুর্তি! কিন্তু এবারে তার মুখ আর ভাবহীন নয়, কৌতুক হাস্যে সমুজ্জ্বল।

জয়ন্ত বললে, এ-মূর্তি আবার কোথা থেকে এল?

বিমল বললে, যেখান থেকেই আসুক, এর চোখে-মুখে বিভীষিকার চিহ্ন নেই, এ হয়তো আমাদের ভয় দেখাতে আসেনি।

মূর্তি পরিষ্কার ইংরেজি ভাষায় বললে, কে তোমরা? পরেছ ইংরেজি পোশাক, কিন্তু দেখছি তোমরা ইংরেজ নও!

বিমল দুই পা এগিয়ে বললে, তুমি যেমন চিনা হয়েও ইংরেজি বলছ, আমরাও তেমনি ইংরেজি পোশাক পরেও জাতে ভারতীয়!

–ঋষি বুদ্ধদেবের দেশ থেকে তোমরা প্রভু লাউ-জুর দেশে এসেছ কেন? তোমরা কি জানো না, এ-দেশ হচ্ছে পৃথিবীর স্বর্গ, এখানে বাস করে আমার মতন অমরেরা জলে স্থলে-শূন্যে যাদের অবাধ গতি? এখানে নশ্বর মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ!

বিমল হেসে বললে, অমর হওয়ার জন্যে আমার মনে একটুও লোভ নেই!

মূর্তি উপেক্ষার হাসি হেসে বললে, মুখ! আমাদের দেহের মর্যাদা তোমরা বুঝবে না! দেহ তো একটা তুচ্ছ খোলস মাত্র, মানুষ বলতে আসলে বোঝায় মানুষের মনকে। আমাদের দেহ নামে মাত্র আছে, কিন্তু আমরা করি কেবল মনের সাধনা, আমাদের আড়ষ্ট দেহে কর্মশীল কেবল আমাদের মন। কিন্তু থাক ওসব কথা। কে তোমরা? কেন এখানে এসেছ? সিয়েন হতে?

না। তোমাদের দেখবার পর আর অমর হওয়ার সাধ নেই। আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি।

বেড়াতে! এটা নশ্বর মানুষের বেড়াবার জায়গা নয়! জানো, তোমাদের মতো আরও কত কৌতূহলী এখানে বেড়াতে এসে মারা পড়েছে আমাদের হাতে?

সেটা তোমাদের অভ্যর্থনার পদ্ধতি দেখেই বুঝতে পেরেছি। কেবল আমাদের মারতে পারোনি, কারণ, সে শক্তি তোমাদের নেই!

মূর্খ! তোমাদের বধ করতে পারি এই মুহূর্তেই! কেবল প্রভু লাউ-জুর পবিত্র মূর্তি তোমাদের সঙ্গে আছে বলেই এখনও তোমরা বেঁচে আছ। ও-মূর্তি কোথায় পেলে?

সে খবর তোমাকে দেব না।

তোমরা কি তাও-ধর্মে দীক্ষা নিয়েছ?

না। আমরা হিন্দু। তবে সাধক বলে লাউ-জুকে আমরা শ্রদ্ধা করি।

কেবল মুখের শ্রদ্ধা ব্যর্থ, তোমাদের মন অপবিত্র। প্রভু লাউ-জুর মূর্তির মহিমায় তোমাদের প্রাণরক্ষা হল বটে, কিন্তু এখানে আর তোমাদের ঠাঁই নেই। শীঘ্র চলে যাও এখান থেকে!

খুব লম্বা হুকুম তো দিলে, এই জ্যান্ত মড়ার মুল্লুক থেকে চলেও তো যেতে চাই, কিন্তু যাই কেমন করে?

কেন?

আগে ছিলুম মাঠে। তারপর মাঠ হল জলে-ঘেরা দ্বীপ। তারপর দ্বীপ হল আশ্চর্য এক নৌকো। খুব মজার ম্যাজিক দেখিয়ে আরব্য উপন্যাসকেও তো লজ্জা দিলে বাবা, এখন দয়া করে দ্বীপনৌকোকে আবার স্থলের সঙ্গে জুড়ে দাও দেখি, আমরাও ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই।

তোমার সুবুদ্ধি দেখে খুশি হলুম। দ্বীপের পূর্বদিকে চেয়ে দ্যাখো।

সকলে বিপুল বিস্ময়ে ফিরে দেখলে, ইতিমধ্যে কখন যে দ্বীপের পূর্ব-প্রান্ত আবার মাঠের সঙ্গে জুড়ে এক হয়ে গেছে তারা কেউ জানতেও পারেনি! স্থির মাটি, পায়ের তলায় আর টলমল করছে না।

এতক্ষণ পরে বিমল শ্রদ্ধাপূর্ণস্বরে বললে, তোমাকে শতশত ধন্যবাদ!

এখান থেকে সোজা পশ্চিম দিকে গেলেই দেখবে, নদীর ধারে তোমাদের নৌকো বাঁধা আছে। যাও!

পরমুহূর্তেই আর-এক অদ্ভুত দৃশ্য! সেই উপবিষ্ট মূর্তি আচম্বিতে বিনা অবলম্বনেই শূন্যে ঊধ্বদিকে উঠল এবং তারপর ধনুক থেকে ছোঁড়া তিরের মতন বেগে বনের ওপর দিয়ে কোথায় চোখের আড়ালে মিলিয়ে গেল!

কুমার হতভম্ভের মতন বললে, এ কি দেখলুম বিমল, এ কি দেখলুম!

বিমল বললে, আমি কিন্তু এই শেষ ম্যাজিকটা দেখে আশ্চর্য বলে মনে করছি না!

জয়ন্ত বললে, বিমলবাবু, তাহলে আপনার কাছে আশ্চর্য বলে কোনও কিছুই নেই!

জয়ন্তবাবু, আপনি কি সেই অদ্ভুত ইংরেজের কথা শোনেননি টলষ্টয়, থ্যাকারের সঙ্গে আরও অনেক বিশ্ববিখ্যাত লোক স্বচক্ষে দেখে যার বর্ণনা করে গেছেন? তিনি সাধকও নন, যাদুকরও নন, আমাদেরই মতন সাধারণ মানুষ। কিন্তু তার দেহ শুন্যে উঠে এক জানলা দিয়ে। শূন্যপথেই আবার ঘরের ভেতরে ফিরে আসত!

দোহাই মশাই, দোহাই! আর নতুন-নতুন দৃষ্টান্ত দিয়ে অসম্ভবের স্বাভাবিক ব্যাখ্যা করবেন! আপনাদের অ্যাডভেঞ্চার আমার ধারণার বাইরে। এখানকার মাটিতে আর পাঁচ মিনিট দাঁড়ালেও আমার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে! মাঠ আবার দ্বীপ হওয়ার আগেই ছুটে চলুন নৌকোর খোঁজে।

সকলে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হল। পূর্বাকাশের রংমহলে প্রবেশ করেছে তখন নবীন সূর্য। নদীর জল যেন গলানো সোনার ধারা। নৌকো যথাস্থানেই বাঁধা আছে।

অমৃত-দ্বীপের আরও কত রহস্য অমৃত-দ্বীপের ভেতরেই রেখে তারা খুলে দিলে নৌকার বাঁধন।

 

অলৌকিক

এক

ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু। নতুন নতুন খাবরের দিকে বরাবরই তাঁর প্রচণ্ড লোভ। আজ বৈকালি চায়ের আসরে পদার্পণ করেই বলে উঠলেন, জয়ন্ত ওবেলা কি বলেছিলে, মনে আছে তো?

জয়ন্ত হেসে বললে, মনে না থাকে, মনে করিয়ে দিন।

নতুন খাবার খাওয়াবে বলেছিলে।

–ও, এই কথা? খাবার তো প্রস্তুত।

খাবারের নাম শুনতে পাই না?

–মাছের প্যাটি আর অ্যাসপ্যারাগাস ওমলেট।

–রেঁধেছে কে?

–আমাদের মধু।

–মধু একটি জিনিয়াস। আনতে বলো, আনতে বলো।

চা পর্ব শেষ হল যথাসময়ে। অনেকগুলো প্যাটি আর ওমলেট উড়িয়ে সুন্দরবাবুর আনন্দ আর ধরে না।

পরিতৃপ্ত ভুঁড়ির ওপরে সস্নেহে হাত বুলোতে বুলোতে তিনি বললেন, মনের মতো পানাহারের মতো সুখ দুনিয়ায় আর কিছু নেই, কি বলো মানিক?

মানিক বললে, কিন্তু অত সুখের ভিতরেও কি একটি ট্রাজেডি নেই?

কীরকম?

–খেলেই খাবার ফুরিয়ে যায়।

–তা যা বলেছ।

–আবার অনেক সময় খাবার ফুরোবার আগে পেটই ভরে যায়।

–হ্যাঁ ভায়া, ওটা আবার খাবার ফুরোনোর চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার। খাবার আছে, পেট কিন্তু গ্রহণ করতে নারাজ। অসহনীয় দুঃখ।

ঠিক এমন সময়ে একটি লোক ঘরের ভিতর প্রবেশ করল।

তাকে দেখেই জয়ন্ত বলে উঠল, আরে, আরে হরেন যে। বোসো ভাই, বোসো। সুন্দরবাবু, হরেন হচ্ছে আমার আর মানিকের বাল্যবন্ধু।

মানিক বললে, হরেন, ইনি হচ্ছেন সুন্দরবাবু, বিখ্যাত পুলিশ ইনস্পেকটর আর প্রখ্যাত ঔদারিক।

–হুম, ঔদারিক মানে কি মানিক? শুধোলেন সুন্দরবাবু।

–ঔদারিক, অর্থাৎ উদরপরায়ণ।

–অর্থাৎ পেটুক। বেশ ভাই, বেশ, যা খুশি বলো, তোমার কথায় রাগ করে আজকের এমন খাওয়ার আনন্দটা মাটি করব না।

জয়ন্ত বললে, তারপর হরেন, তুমি কি এখন কলকাতাতেই আছ?

না, কাল এসেছি। আজই দেশে ফিরব। কিন্তু যাবার আগে তোমাদের একটা খবর দিয়ে যেতে চাই।

কীরকম খবর?

–যেরকম খবর তোমরা ভালোবাসো।

–কোনও অসাধারণ ঘটনা।

–তাই।

–তাহলে আমরা শুনতে প্রস্তুত। সম্প্রতি অসাধারণ ঘটনার অভাবে আমরা কিঞ্চিৎ স্রিয়মান হয়ে আছি। ঝাড়ো তোমার খবরের ঝুলি।

.

দুই

হরেন বললে, সুন্দরবাবু, জয়ন্ত আর মানিক আমাদের দেশে গিয়েছে, কিন্তু আপনার কাছে আগে তার কিছু পরিচয় দেওয়া দরকার। আমাদের দেশ হচ্ছে একটি ছোট শহর, কলিকাতা থেকে মাইল ত্রিশ দূরে। সেখানে পনেরো-ষোলো হাজার লোকের বাস। অনেক ডেলিপ্যাসেঞ্জার কলকাতায় চাকরি করতে আসেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন বড় অফিসারও আছেন। স্টেশন থেকে শহরের দূরত্ব প্রায় দেড় মাইল। এই পথটা বেশিরভাগ লোকই পায়ে হেঁটে পার হয়, যাদের সঙ্গতি আছে তারা ছ্যাকড়া গাড়ি কি সাইকেল রিকশার সাহায্য নেয়।

মাসখানেক আগে অর্থাৎ গেল মাসের প্রথম দিনে সুরথবাবু আর অবিনাশবাবু সাইকেল রিকশার চড়ে স্টেশন থেকে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন। তাঁরা দুজনেই বড় অফিসার, একজন মাহিনা পান হাজার টাকা, আর একজন আটশত টাকা। সেই দিনই তারা মাহিনা পেয়েছিলেন। স্টেশন থেকে মাইলখানেক পথ এগিয়ে এসে একটা জঙ্গলের কাছে তারা দেখতে পেলেন আজব এক মূর্তি। তখন রাত হয়েছে, আকাশে ছিল সামান্য একটু চাঁদের আলো, স্পষ্ট করে কিছুই চোখে পড়ে না। তবু বোঝা গেল, মূর্তিটা অসম্ভব ঢ্যাঙা, মাথায় অন্তত নয় ফুটের কম উঁচু হবে না। প্রথমে তাদের মনে হয়েছিল সেটা কোনও নারীর মূর্তি, কারণ তার দেহের নীচের দিকে ছিল ঘাঘরার মতো কাপড়। কিন্তু তার কাছে গিয়েই বোঝা গেল সে নারী নয়, পুরুষ। ভীষণ কালো মুখখানা সম্পূর্ণ অমানুষিক। তার হাতে ছিল লাঠির বদলে লম্বা একগাছা বাঁশ। পথের ঠিক মাঝখানে একেবারে নিশ্চল হয়ে সে দাঁড়িয়েছিল।

রিকশাখানা কাছে গিয়ে, তাকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই সে বিষম চিৎকার করে ধমকে বলে উঠল, এই উল্লুক, গাড়ি থামা। তার পরেই সে রিভলভার বার করে ঘোড়া টিপে দিলে। দুম করে শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রিকশার চালক গাড়ি ফেলে পলায়ন করলে। সুরথবাবু আর অবিনাশবাবুও গাড়ি থেকে নেমে পড়বার উপক্রম করতেই মূর্তিটা তাঁদের দিকে রিভলভার তুলে কর্কশ স্বরে বললে, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, সঙ্গে যা আছে সব রিকশার ওপরে রেখে এখান থেকে সরে পড়ো।

তারা প্রাণে বাঁচতেই চাইলেন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সঙ্গের সমস্ত টাকা, হাতঘড়ি, আংটি এমনকী ফাউন্টেন পেনটি পর্যন্ত সেইখানে ফেলে রেখে তারা তাড়াতাড়ি চম্পট দিলেন। পরে পুলিশ এসে ঘটনাস্থলে রিকশার পাশে কুড়িয়ে পায় কেবল সেই লম্বা বাঁশটাকে।

প্রথম ঘটনার সাতদিন পরে ঘটে দ্বিতীয় ঘটনা। মৃণালবাবু আমাদের দেশের লোক। মেয়ের বিয়ের জন্যে তিনি কলকাতায় গহনা গড়াতে গিয়েছিলেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যার সময়ে ট্রেন থেকে নেমে পাঁচ হাজার টাকার গহনা নিয়ে পদব্রজেই আসছিলেন। তিনিও একটা জঙ্গলের পাশে সেই সুদীর্ঘ ভয়াবহ মূর্তিটিকে অস্পষ্টভাবে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেদিন কতকটা স্পষ্ট চাঁদের আলো ছিল বটে কিন্তু জঙ্গলের ছায়া ঘেঁষে মূর্তিটা এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল যে ভালো করে কিছুই দেখবার যো ছিল না। সেদিনও মুর্তিটা রিভলভার ছুঁড়ে ভয় দেখিয়ে মৃণালবাবুর গহনাগুলো কেড়ে নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়। সেবারেও পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে পাওয়া যায় কেবল একগাছা লম্বা বাঁশ।

এইবারে তৃতীয় ঘটনা। শশীপদ আমার প্রতিবেশী। কলকাতার বড়বাজারে তার কাপড়ের দোকান। ফি শনিবারে সে দেশে আসে–গেল শনিবারেও আসছিল। তখন সন্ধ্যা উতরে গিয়েছিল, কিন্তু উঁদ ওঠেনি। স্টেশন থেকে শহরে আসতে-আসতে পথের একটা মোড় ফিরেই। শশীপদ সভয়ে দেখতে পায় সেই অসম্ভব ঢ্যাঙা বীভৎস মূর্তিটাকে। মানে ভালো করে সে। কিছুই দেখতে পায়নি, কেবল এইটুকু বুঝেছিল যে মূর্তিটা সহজ মানুষের চেয়ে প্রায় ডবল উঁচু। সেদিনও সে রিভলভার ছুঁড়ে শশীপদর কাছ থেকে সাত হাজার টাকা হস্তগত করে। শশীপদ দৌড়ে একটা জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারপর সেইখানে বসেই শুনতে পায় খটাখট খটাখট-খটাখট করে কীসের শব্দ। ক্রমেই দূরে গিয়ে সে শব্দ মিলিয়ে যায়। শশীপদ ভয়ে সারা রাত বসেছিল জঙ্গলের ভিতরেই। সকালে বাইরে এসে পথের ওপরে দেখতে পায় একগাছা বাঁশ।

জয়ন্ত, এই তো ব্যাপার। পরপর তিন-তিনটে অদ্ভুত ঘটনা ঘটায় আমাদের শহর রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যার পর দলে খুব ভারী না হলে পথিকরা স্টেশন থেকে ওপথ দিয়ে শহরে আসতে চায় না। অনেকেই মূর্তিটাকে অলৌকিক বলেই ধরে নিয়েছে। এখন তোমার মত কি?

.

তিন

জয়ন্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কয়েক মিনিট। তারপর ধীরে ধীরে বললে, ঘটনাগুলোর মধ্যে কী কী লক্ষ করবার আছে, তা দেখ। বাংলাদেশে নয় ফুট উঁচু মানুষ থাকলে এতদিনে সে সুবিখ্যাত হয়ে পড়ত। সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে অপরাধী নয় ফুট উঁচু নয়। সে দেহের নীচের দিকটা ঘাগরায় বা ঘেরাটোপে ঢেকে রাখে। কেন? তার মুখ অমানুষিক বলে মনে হয়। কেন? সে একটা লম্বা বাঁশ হাতে করে দাঁড়িয়ে থাকে, আবার বাঁশটাকে ঘটনাস্থলে ফেলে রেখে যায়। কেন? সে প্রত্যেকবারেই চেষ্টা করে, তার চেহারা কেউ যেন স্পষ্ট করে দেখতে না পায় কেন? শশীপদ শুনেছে, খটাখট খটাখট করে একটা শব্দ ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছে। কীসের শব্দ?

সুন্দরবাবু বললেন, তুমি কিছু অনুমান করতে পারছ?

কিছু কিছু পারছি বইকী! হরেন, ওই তিনটে ঘটনায় যাঁদের টাকা খোয়া গিয়েছে, তারা কি শহরের বিভিন্ন পল্লির লোক?

না, তারা সকলেই প্রায় এক পাড়াতেই বাস করেন।

–তবে তোমাদের পাড়ায় বা পাড়ার কাছাকাছি কোথাও বাস করে এই অপরাধী!

–কেমন করে জানলে?

নইলে ঠিক কোন দিনে কোন সময়ে কোন ব্যক্তি প্রচুর টাকা নিয়ে দেশে ফিরে আসবে, অপরাধী নিশ্চয়ই সে খবর রাখতে পারত না।

না জয়ন্ত, আমাদের পাড়ায় কেন, আমাদের শহরেও নয় ফুট উঁচু লোক নেই।

–আমিও ওকথা জানি।

–তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।

–আপাতত বেশি কিছু বুঝেও কাজ নেই। আমাকে আরও কিঞ্চিৎ চিন্তা করবার সময় দাও। তুমি দেশে ফিরে যাচ্ছ তো?

হ্যাঁ।

–পরশুদিনই আমার কাছ থেকে একখানা জরুরি চিঠি পাবে। আমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। তার ঠিক এক সপ্তাহ পরে তুমি কলকাতার এসে আমাদের দেশে নিয়ে যাবে।

হরেন চলে গেল। জয়ন্ত যেন নিজের মনেই গুণগুণ করে বলল, খটাখট খটখট খটাখট। মূল্যবান সূত্র।

.

চার

নির্দিষ্ট দিনে দুপুরবেলায় হরেন এসে হাজির।

জয়ন্ত শুধোলে, চিঠিতে যা যা বলেছি ঠিক সেইমতো কাজ করেছ তো?

–অবিকল।

–মানিক, সুন্দরবাবুকে ফোন করে জানাও, আজ সাড়ে পাঁচটার ট্রেনে আমরা যাত্রা করব।

প্রায় সাড়ে সাতটার সময়ে তারা হরেনদের দেশে এসে নামল।

আকাশ সেদিন নিশ্চন্দ্র। স্টেশন থেকে শহরে যাবার রাস্তায় সরকারি তেলের আলোগুলো অনেক তফাতে-তফাতে থেকে মিটমিট করে জ্বলে যেন অন্ধকারের নিবিড়তাকেই আরও ভালো করে দেখবার চেষ্টা করছিল! নির্জন পথ! আশপাশের ঝোপঝাড়ের বাসিন্দা কেবল মুখর ঝিল্লির দল। দুখানা সাইকেল রিকশায় চড়ে তারা যাচ্ছিল। প্রথম গাড়িতে বসেছিল হরেন ও মানিক। দ্বিতীয় গাড়িতে জয়ন্ত ও সুন্দরবাবু।

সুন্দরবাবু বললেন, তুমি কি যে বুঝেছ তা তুমিই জানো, আমি তো ছাই এ ব্যাপারটার ল্যাজামুড়ো কিছুতেই ধরতে পারিনি।

জয়ন্ত বললে, ঘটনাগুলো আমিও শুনেছি, আপনিও শুনেছেন। তারপর প্রধান প্রধান সূত্রের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে ছাড়িনি। মাথা খাটালে আপনি অনেকখানিই আন্দাজ করতে পারতেন।

–মস্তক যথেষ্ট ঘর্মাক্ত করবার চেষ্টা করেছি ভায়া, কিন্তু খানিকটা ধোঁয়া (তাও গাঁজার ধোঁয়া) ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি।

–মুটেরাও মস্তককে যথেষ্ট ঘর্মাক্ত করে কিন্তু তারা উপলব্ধি করে কতটুকু সুন্দরবাবু, আমি আপনাকে মস্তক ঘর্মাক্ত করতে বলছি না, মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে বলছি।

–একটা শক্ত রকম গালাগালি দিলে বটে কিন্তু তোমার কি বিশ্বাস, আজকেই তুমি এই মামলাটার কিনারা করতে পারবে?

–হয়তো পারব, কারণ অপরাধীরা প্রায়ই নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করে বিপদে পড়ে। হয়তো পারব না, কারণ কোনও কোনও অপরাধী নিজের নির্দিষ্ট পদ্ধতি ত্যাগ করতেও পারে। কিন্তু হুশিয়ার! পথের মাঝখানে আবছায়া গোছের কি-একটা দেখা যাচ্ছে না?

হ্যাঁ, দেখা যাচ্ছে বটে! মুক্ত আকাশের স্বাভাবিক আলো দেখিয়ে দিলে, অন্ধকারের মধ্যে একটা অচঞ্চল ও নিশ্চল ও সুদীর্ঘ ছায়ামূর্তি। বাতাসে নড়ে-নড়ে উঠছে কেবল তার পরনের জামা-কাপড়গুলো।

আচম্বিতে একটা অত্যন্ত কর্কশ ও হিংস্র চিৎকার চারিদিকের নিস্তব্ধতাকে চমকে দিয়ে জেগে উঠল–এই! থামাও গাড়ি, থামাও গাড়ি! সঙ্গে-সঙ্গে রিভলভারের শব্দ।

কিন্তু তার আগেই অতি-সতর্ক জয়ন্ত ছুটন্ত গাড়ি থেকে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়েছে। এবং গর্জন করে উঠেছে তারও হাতের রিভলভার!

গুলি গিয়ে বিদ্ধ করল মূর্তির ডান হাতখানা, তার রিভলভারটা খসে পড়ল মাটির ওপরে সশব্দে। কেবল রিভলভার নয়, আর একটাও কি মাটিতে পড়ার শব্দ হল–বোধহয় বংশদণ্ড! অস্ফুট আর্তনাদ করে মূর্তিটা ফিরে দাঁড়িয়ে পালাবার উপক্রম করলে, কিন্তু পারলে না, এক সেকেন্ড টলটলায়মান হয়েই হুড়মুড় করে লম্বমান হল একেবারে পথের উপর।

দপদপিয়ে জ্বলে উঠল চার-চারটে টর্চের বিদ্যুত্বহ্নি।

জয়ন্ত ক্ষিপ্রহস্তে ভূপতিত মূর্তিটার গা থেকে কাপড়-চোপড়গুলো টান মেরে খুলে দিলে। দেখা গেল, তার দুই পদের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে আছে দুইখানা সুদীর্ঘ যষ্টি ইংরেজিতে যাকে বলে still। এবং বাংলায় যাকে বলে রণ-পা।

জয়ন্ত বললে, দেখছি, এর মুখে রয়েছে একটা প্রকাণ্ড মুখোশকাফ্রির মুখোশ। এখন। মুখোশের তলায় আছে কার শ্রীমুখ, সেটাও দেখা যেতে পারে। আর এক টানে খসে পড়ল মুখোশও।

হরেন সবিস্ময়ে বলে উঠল, আরে, এ যে দেখছি আমাদের পাড়ার বাপে-খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলে রামধন মুখুয্যে। এ বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই কুপথে যায়, কুসঙ্গীদের দলে মেশে, নেশাখোর হয়, জুয়া খেলে, পাড়ার লোকদের ওপরে অত্যাচার করে। এর জন্যে সবাই এ্যস্ত, ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু এর পেটে-পেটে যে এমন শয়তানি, এতটা তো আমাদের স্বপ্নেরও অগোচর। ছিল!

.

পাঁচ

জয়ন্ত বললে, সুন্দরবাবু, প্রধান প্রধান সূত্রের কথা আগেই বলেছি, এখন সব কথা আবার নতুন করে বলবার দরকার নেই। কেবল দু-তিনটে ইঙ্গিত দিলেই যথেষ্ট হবে। গোড়া থেকেই আমার দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, অপরাধী হরেনেরই পাড়ার লোক। সে পাড়ায়–এমনকী, সে শহরেও নয় ফুট উঁচু কোনও লোকই নেই। সুতরাং ধরে নিলুম সে উঁচু হয়েছিল কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করে। অপরাধের সময়ে সে আবছায়ায় অবস্থান করে–পাছে কেউ তার কৃত্রিম উপায়টা আবিষ্কার করে ফেলে; তাতেই আমার ধারণা হল দৃঢ়মূল। এখন সেই কৃত্রিম উপায়টা কি হতে পারে? শশীপদ শুনেছিল, খটাখট খটাখট করে কি একটা শব্দ ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে! এই নিয়ে ভাবতে-ভাবতে ধাঁ করে আমার মাথায় আসে রণ-পার কথা। রণ-পার ওপরে আরোহণ করলে মানুষ কেবল উঁচু হয়ে ওঠে না, খুব দ্রুতবেগে চলাচলও করতে পারে। সেকালে বাংলাদেশের ডাকাতরা এই রণ-পায় চড়ে এক এক রাতেই পঞ্চাশ-ষাট মাইল পার হয়ে যেতে পারত। পদক্ষেপের সময়ে রণ-পা যখন মাটির ওপরে পড়ে, তখন খটাখট করে শব্দ হয়, কিন্তু রণ-পা-এ উঠে কেউ স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, টাল সামলাবার জন্যে চলাফেরা করতে হয়। অপরাধী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার জন্যে একগাছা বাঁশের সাহায্য গ্রহণ করত। কার্য সিদ্ধির পর বাঁশটাকে সে ঘটনাস্থলেই পরিত্যাগ করে যেত, কারণ রণ-পা-এ চড়ে ছোটবার সময় এত বড় একটা বাঁশ হয়ে ওঠে উপসর্গ মতো।

সুন্দরবাবু বললেন, হুম এসব তো বুঝলুম, কিন্তু আসামি এমন বোকার মতো আমাদের হাতে ধরা দিলে কেন, সেটাতো বোঝা যাচ্ছে না।

জয়ন্ত হাসতে-হাসতে বললে, ওটা আবার কল্পনা শক্তির মহিমা। আগেই বলেছি তো, অপরাধীরা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করতে গিয়েই বিপদে পড়ে। অপরাধী সর্বদাই খবর রাখত, পাড়ার কোনও ব্যক্তি কবে কী করবে বা কী করবে না। আমার নির্দেশ অনুসারে হরেন রটিয়ে দিয়েছিল, কলকাতার ব্যাঙ্কের পর ব্যাঙ্ক ফেল হচ্ছে, সে ব্যাঙ্কে আর নিজের টাকা রাখবে না। অমুক তারিখে কলকাতায় গিয়ে সব টাকা তুলে নিয়ে আসবে। অপরাধী এ টোপ না গিলে পারেনি।

সুন্দরবাবু বললেন, একেই বলে, ফাঁকতালে কিস্তিমাত।

 

অলৌকিক বিভীষিকা (উপন্যাস)

এক । খবরের কাগজের রিপোর্ট

বঙ্গদেশ হচ্ছে একখানি সাপ্তাহিক পত্র। তাতে এই খবরটি বেরিয়েছেঃ

সুন্দরবনের নিকটে মানসপুর। মানসপুরকে একখানি বড়সড়ো গ্রাম বা ছোটখাটো শহর বলা চলে। কারণ সেখানে প্রায় তিন হাজার লোকের বসবাস।

সম্প্রতি মানসপুরের বাসিন্দারা অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছে। প্রতি অমাবস্যার রাত্রে সেখানে এক অলৌকিক বিভীষিকার আবির্ভাব হয়।

আসল ব্যাপারটা যে কি, কেহ-ই সেটা আন্দাজ করিতে পারিতেছে না। পুলিশ প্রাণপণে তদন্ত করিয়াও বিশেষ কিছুই স্থির করিতে পারে নাই। গ্রামের চারিদিকে কড়া পাহারা বসিয়াছে। বন্দুকধারী সিপাহীরা সর্বদাই প্রস্তুত হইয়া থাকে। তথাপি প্রতি অমাবস্যার রাত্রে মানসপুর হইতে এক একজন মানুষ অন্তর্হিত হয়।

আজ এক বৎসর কাল ধরিয়া এই অদ্ভুত কাণ্ড হইতেছে। গত বারোটি অমাবস্যার রাত্রে বারোজন লোক অদৃশ্য হইয়াছে। প্রতি দুর্ঘটনার রাত্রেই একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ করা গিয়াছে। মানসপুর সুন্দরবনের কাছাকাছি হইলেও, তার ভিতরে এতদিন ব্যাঘ্রের উৎপাত বড়-একটা ছিল না। কিন্তু দুর্ঘটনার আগেই এখন ঘটনাস্থলের চারিদিকে ঘন ঘন ব্যাঘ্রের চিৎকার শোনা যায়। ঠিক অমাবস্যার রাত্রি ছাড়া আর কোনওদিনই এই অদ্ভুত ব্যাঘ্রের সাড়া পাওয়া যায় না। এ ব্যাঘ্র যে কোথা হইতে আসে এবং কোথায় অদৃশ্য হয় কেহ-ই তা জানে না। আজ পর্যন্ত কেহই তাকে চোখে দেখে নাই।

আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, অদৃশ্য হইয়াছে তাদের মধ্যে একজনও পুরুষ নাই! প্রত্যেকেই স্ত্রীলোকে এবং প্রত্যেকেরই গায়ে ছিল অনেক টাকার গহনা।

পুলিশ প্রথমে স্থির করিয়াছিল যে, এসমস্ত অনিষ্টরই মূল হইতেছে কোন নরখাদক ব্যাঘ্র। কিন্তু নানা কারণে পুলিশের মনে এখন অন্যরকম সন্দেহের উদয় হইয়াছে। সুন্দরবনের ভিতরে আছে ভুলু-ডাকাতের আস্তানা এবং দল ও অঞ্চলে প্রায়ই অত্যাচার করিয়া থাকে। অনেক চেষ্টা ও পুরস্কার ঘোষণা করিয়াও পুলিশ আজ পর্যন্ত ভুলু-ডাকাতকে গ্রেপ্তার করিতে পারে নাই। পুলিশের বিশ্বাস, মানসপুরের সমস্ত দুর্ঘটনার জন্য ওই ভুলু-ডাকাতই দায়ী।

কে যে দায়ী এবং কে যে দায়ী নয়, একথা আমরা জানিনা বটে, কিন্তু এটা বেশ বুঝা যাইতেছে যে, মানসপুরের দুর্ঘটনার মধ্যে আশ্চর্য কোনও রহস্য আছে। আমরা বিশ শতাব্দীর মানুষ না হইলে এসব ব্যাপারকে হয়তো ভূতুড়ে কাণ্ড বলিয়া মনে করিতাম। ডাকাত করে ডাকাতি, ঠিক অমাবস্যার রাত্রেই চোরের মতো আসিয়া তারা কেবল এক-একজন স্ত্রীলোককে চুরি করিয়া লইয়া যাইবে কেন? আর এই ব্যাঘ্র রহস্যটাই বা কি? এ কোন দেশী ব্যাঘ্র? এ কি পাঁজি পড়িতে জানে? পাঁজি-পুথি পড়িয়া ঠিক অমাবস্যার রাত্রে মানসপুরের আসরে গর্জন-গান গাহিতে আসে? কে এ প্রশ্নের উত্তর দিবে?

.

দুই । বাঘার বিপদ

খবরের কাগজখানা হাত থেকে নামিয়ে রেখে কুমার নিজের মনেই বললে, এ প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করব, আমি!..বঙ্গদেশ-এর রিপোর্টার ঠিক আন্দাজ করেছেন, এর মধ্যে নিশ্চয় কোনও রহস্য আছে, হ্যাঁ, আশ্চর্য কোনও রহস্য! উপর-উপরি বারোটি মেয়ে অদৃশ্য, অমাবস্যার রাত, অদ্ভুত বাঘের আবির্ভাব আর অন্তর্ধান, তার ওপরে আবার ভুলু-ডাকাতের দল! কারুর সঙ্গে কারুর কোনও সম্পর্ক বোঝা যাচ্ছে না, সমস্তই যেন অস্বাভাবিক কাণ্ড।…এসময়ে বিমল যদি কাছে থাকত! কিন্তু আজ সাত-আট দিন ধরে রামহরিকে নিয়ে সে যে কোথায় ডুব। মেরে আছে, শিবের বাবা বোধহয় তা জানেন না!

একখানা পঞ্জিকা নিয়ে তার ভিতরে চোখ বুলিয়ে কুমার আবার ভাবতে লাগল, হু, পরশু আবার অমাবস্যার রাত আসবে, মানসপুর থেকে হয়তো আবার এক অভাগী নারী অদৃশ্য হবে! আমার যে এখনি সেখানে উড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে! এমন একটা অ্যাডভেঞ্চার এর সুযোগ তো ছেড়ে দিলে চলবে না, বিমলের কপাল খারাপ তাই নিজের দোষেই এবারে সে ফাঁকে পড়ল, আমি কি করব?..বাঘা, বাঘা!

বাঘা তখন ঘরের এককোণে বসে একপাল মাছির সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ করছিল। মাছিদের ইচ্ছা, বাঘার গায়ের ওপরে তারা মনের আনন্দে খেলা করে বেড়ায়, কিন্তু তার দেহটা যে মাছিদের বেড়াবার জায়গা হবে, এটা ভাবতেও বাঘা রাগে পাগল হয়ে উঠছিল। বড় বড় হাঁ করে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সে এক-একবারে একাধিক মাছিকে গ্রাস করে ফেলছিল কিন্তু মাছিরাও বিষম নাছোড়বান্দা, প্রাণের মায়া ছেড়ে ভন ভন ভন ভন করতে করতে বাঘার মাথা থেকে ল্যাজের ডগা পর্যন্ত বারবার তারা ছেয়ে ফেলছিল। যে বাঘা আজ জলে-স্থলে-শূন্যমার্গে কত মানব, দানব, ও অদ্ভুত জীবের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে, বিমল ও কুমারের সঙ্গে যার নাম এই বাংলাদেশে বিখ্যাত, তুচ্ছ একদল মক্ষিকার আক্রমণ আজ তাকে যেরকম কাবু করে ফেলেছে তা দেখলে শত্রুরও মায়া হবে! এমনি সময়ে কুমারের ডাক শুনে সে গা ও ল্যাজ ঝাড়তে ঝাড়তে তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।

কুমার বললে, বাঘা বাঘা! বিমলও নেই রামহরিও নেই,–খালি তুমি আর আমি! অমাবস্যার রাত, বাঘের গর্জন, ডাকাতের দল, মানুষের পর মানুষ অদৃশ্য! শুনে কি তোমার ভয় হচ্ছে?

বাঘা কান খাড়া করে মনিবের সব কথা মন দিয়ে শুনলে। কি বুঝলে জানি না, কিন্তু বললে, ঘেউ ঘেউ ঘেউ!

বাঘা, এ বড় যে-সে ব্যাঘ্র নয়, বুঝেচ? এ তোমার চেয়েও চালাক! এ তিথি-নক্ষত্র বিচার করে কাজ করে। এর সঙ্গে আমরা পাল্লা দিতে পারব কি?

ঘেউ ঘেউ ঘেউ!

তার ওপরে আছে ভুলু-ডাকাতের দল। পুলিশও তাদের কাছে হার মেনেছে, খালি তোমাকে আর আমাকে তারা গ্রাহ্য করবে কি?

ঘেউ ঘেউ ঘেউ! বলেই বাঘা টপ করে মুখ ফিরিয়ে ল্যাজের ডগা থেকে একটা মাছিকে ধরে গপ করে গিলে ফেললে!

একখানা খাম ও চিঠির কাগজ বার করে কুমার লিখতে বসল–

ভাই বিমল,

একবার এক জায়গা থেকে দলে-দলে মানুষ অন্তর্হিত হচ্ছিল শুনে সে ব্যাপারটা আমরা দেখতে গিয়েছিলুম। কিন্তু সেই কৌতূহলের ফলে বন্দি হয়ে আমাদের যেতে হয়েছিল পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলগ্রহে।

এবারেও মানসপুরে মানুষের পর মানুষ (কিন্তু কেবল স্ত্রীলোক) অদৃশ্য হচ্ছে। শুনেই আমার চডুকে পিঠ আবার সড় সড় করছে। আমি আর বাঘা তাই ঘটনাস্থলে চললুম। জানি না এবারেও আমাদের আবার পৃথিবী ছাড়তে হবে কিনা!

খবরের কাগজের রিপোর্টও এই খামের ভিতর দিলুম। এটা পড়লেই তুমি বুঝতে পারবে, কেন আমি তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করতে পারলুম না। আসছে পরশু অমাবস্যা, আজ যাত্রা না করলে যথাসময়ে মানসপুরে গিয়ে পৌঁছোতে পারব না।

বিমল, তোমার জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে। এবারের অ্যাডভেঞ্চার-এ তুমি বেচারি ফাঁকে পড়ে গেলে। কি আর করবে বলো, যদি প্রাণ নিয়ে ফিরি, আমার মুখে সমস্ত গল্প শুনো তখন। ইতি–

তোমার কুমার

.

তিন । পটলবাবু, চন্দ্রবাবু ও মোহনলাল

পরদিন কুমার মানসপুরে গিয়ে হাজির হল।

সেখানে তখন ভীষণ বিভীষিকার সৃষ্টি হয়েছে।

আসছে কাল সেই-অমাবস্যা আসছে এবং সেই অজানা শত্রু কাল আবার কোন পরিবারে গিয়ে হানা দেবে কেউ তা জানে না। সকলে এখন থেকেই প্রস্তুত হচ্ছে, ধনীরা বাড়ির চারিদিকে ডবল করে পাহারা বসাচ্ছে, সাধারণ গৃহস্থদের কেউ কেউ সপরিবারে স্থানান্তরে পালাচ্ছে এবং কেউ কেউ বাড়ির মেয়েদের গ্রামান্তরে পাঠিয়ে দিচ্ছে কারণ এই অদ্ভুত শত্রুর দৃষ্টি কেবল মেয়েদের দিকেই।

শহরের যুবকরা নানা স্থানে পল্লী-রক্ষা-সমিতি গঠন করেছে এবং কী করে এই আসন্ন বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করা যায়, তাই নিয়ে তাদের মধ্যে জল্পনা কল্পনা ও তর্কাতর্কির অন্ত নেই।

চারিদিকে এখন থেকেই সরকারি চৌকিদারের সংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ!

কুমার আগে ঘুরে ঘুরে সমস্ত মানসপুরের অবস্থাটা ভালো করে দেখে নিলে।

অধিকাংশ স্থানেই একটি লোকের মূর্তি বারবার তার চোখে পড়ল।

সে-লোকটি খুব সপ্রতিভ ও ব্যস্ত ভাবেই সর্বত্র ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, এবং কোন। দিক দিয়ে বিপদ আসবার সম্ভাবনা, সে-সম্বন্ধ পল্লী-রক্ষা-সমিতি-র যুবকগণকে নানান রকম পরামর্শ দিচ্ছে।

একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে কুমার জানলে যে, তাঁর নাম পটলবাবু; ধনী না হলেও গাঁয়ের একজন হোমরা-চোমরা মাতব্বর ব্যক্তি এবং পল্লী-রক্ষা-সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক।

কিন্তু পটলবাবুর চোখে কুমার এমন একটি বিশেষত্ব আবিষ্কার করল, সে আর কোনও মানুষের চোখে দেখেনি।

পটলবাবুর গায়ের রং মোষের মতো কালো, তার দেহখানি লম্বায়–খুব খাটো কিন্তু আড়ে বেজায় চওড়া, মাথায় ইস্পাতের মতন চকচকে টাক, কিন্তু ঠোঁটের ওপরে ও গালে জানোয়ারের মতো বড় বড় চুল–যেন তিনি বিপুল দাড়ি-গোঁফের দ্বারা মাথার কেশের অভাবটা পূরণ করে নিতে চান।

কিন্তু পটলবাবুর চেহারার মধ্যে আসল দ্রষ্টব্য হচ্ছে তার দুই চোখ। পটলবাবুর হাত পা খুব নড়ছে, তার মুখ অনবরত কথা কইছে, কিন্তু তার চোখদুটো ঠিক যেন মরা মানুষের চোখ! শ্মশানের চিতার আগুনের ভিতর থেকে একটা মড়া যেন দানোয় পেয়ে জ্যান্ত পৃথিবীর পানে মিট মিট করে তাকিয়ে দেখছে,–পটলবাবুর চোখ দেখে এমনি একটা ভাবই কুমারের মনকে নাড়া দিতে লাগল।

চারদিক দেখে-শুনে কুমার, মানসপুর থানার ইনস্পেক্টর চন্দ্রবাবুর সন্ধানে চলল। কলকাতাতেই সে খবর পেয়েছিল যে, চন্দ্রবাবুর জ্যেষ্ঠপুত্র অশোকের সঙ্গে স্কুলে ও কলেজে সে একসঙ্গে অনেককাল ধরে পড়াশুনা করেছিল। অশোক এখন কলকাতায়। কিন্তু এখানে আসবার আগে সে বুদ্ধি করে অশোকের কাছ থেকে চন্দ্রবাবুর নামে নিজের একখানি পরিচয়-পত্র আনতে ভোলেনি। কারণ, সে বুঝেছিল যে মানসপুরের রহস্য সমাধান করতে হলে চন্দ্রবাবুর কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা।

থানায় গিয়ে সে নিজের পরিচয় পত্রখানি ভিতরে পাঠিয়ে দিলে। অল্পক্ষণ পরেই তার ডাক এল।

চন্দ্রবাবু তখন টেবিলের সামনে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন তাঁর বয়স হবে পঞ্চান্ন, বেশ লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ গৌরবর্ণ মূর্তি, মুখখানি হাসিতে উজ্জ্বল,–দেখলে পুরাতন পুলিশ কর্মচারী বলে মনে হয় না।

কুমারকে দেখেই চন্দ্রবাবু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে, হাত বাড়িয়ে তার একখানি হাত ধরে বললেন, তুমিই অশোকের বন্ধু কুমার? এই বয়সে তুমি এত নাম কিনেছ? তোমার আর তোমার বন্ধু বিমলের অদ্ভুত সাহস আর বীরত্বের কথা শুনে আমি তোমাদের গোঁড়া ভক্ত হয়ে পড়েছি। এসো, এসো, ভালো করে বোসো,–ওরে চা নিয়ে আয় রে।

কুমার আসন গ্রহণ করলে পর চন্দ্রবাবু বললেন, তারপর? হঠাৎ এখানে কি মনে করে? নতুন অ্যাডভেঞ্চার-এর গন্ধ পেয়েছ বুঝি?

কুমার হাসতে হাসতে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ।

চন্দ্রবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, ব্যাপারটা বড়ই রহস্যময়, বড়ই আশ্চর্য! জীবনে এমন সমস্যায় কখনও পড়িনি। কে বা কারা এরকম ভাবে মেয়ে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে? বাঘ? না ভুলু-ডাকাতের দল? সবাই সাবধান হয়ে আছে, চারিদিকে কড়া পাহারা, তার ভিতর থেকেই বারো-বারোটি মেয়ে চুরি হয়ে গেল, অথচ চোর ধরা দূরের কথা–তার টিকিটি পর্যন্ত কারুর চোখে পড়ল না। এও কি সম্ভব?ব্যাপারটা যেরকম দাঁড়িয়েছে, আমার চাকরি বুঝি আর টেকে না। আসছে কাল অমাবস্যা, আমিও সেজন্য যতটা সম্ভব প্রস্তুত হয়ে আছি, কাল একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব! কিন্তু কালও যদি চোর ধরতে না পারি, তা হলে আমার কপালে কি আছে জানি না–উপরওয়ালা নিশ্চয়ই ভাববেন, আমি একটি প্রকাণ্ড অপদার্থ!

কুমার সুধোলে, অমাবস্যার রাতে ঠিক কোন সময়ে মেয়ে চুরি যায়, তার কি কিছু স্থিরতা আছে?

চন্দ্রবাবু বললে, এ ব্যাপারের সবটাই আজগুবি। বিংশ শতাব্দীর এই সভ্য বাঘটি শুধু পাঁজি-পুঁথি পড়তেই শেখেনি,কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি ধরে কাজ করতেও শিখেছে! প্রতিবারেই ঠিক রাত দুপুরের সময়ে তার প্রথম চিৎকার শোনা যায়!

কিন্তু এ বাঘটা কি সত্যিই আসল বাঘ, না সবাইকে ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করবার জন্যে কোনও হরবোলা মানুষ অবিকল বাঘের ডাক নকল করে?

সে সন্দেহ করবারও কোনও উপায় নেই। প্রতিবারেই বাঘের অগুন্তি পায়ের দাগ আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি।

কুমারের চা এল। চা পান করতে করতে নীরবে সে ভাবতে লাগল।

চন্দ্রবাবু বললেন, রহস্যের ওপর রহস্য! আজ দিনকয় হল মানসপুরে কে-একজন অচেনা লোক এসে বাসা বেঁধেছে, তাকে সর্বত্রই দেখা যায়, কিন্তু সে যে কে, তা কেউ জানে না। লোকটার সমস্ত ব্যবহারই সন্দেহজনক! এখানকার মুরুব্বি পটলবাবু বলেন, নিশ্চয়ই সে ভুলু ডাকাতের চর! আপাতত ইচ্ছা থাকলেও আমরা তার সম্বন্ধে ভালো করে খোঁজখবর নিতে পারছি না, কারণ এই মেয়েচুরির হাঙ্গামের জন্যে আমার আর কোনও দিকেই ফিরে তাকাবার অবসর নেই। তবে তার ওপরেও কড়া পাহারা রাখতে আমি ভুলিনি।

কুমার বললে, লোকটার নাম কী?

মোহনলাল বসু। শুনলুম, সে কোথাকার জমিদার, এখানে এসেছে বেড়াতে। যদিও এখানে সমুদ্রের হাওয়া বয়, কারণ খানিক তফাতেই সমুদ্র আছে, কিন্তু এটা কি বেড়াতে আসবার জায়গা, বিশেষ এই বিভীষিকার সময়ে?..তারপর শুনলাম সে কাল গাঁয়ের অনেকের কাছে গল্প করে বেড়িয়েছে যে তার বাড়িতে নাকি নগদ অনেক হাজার টাকা আছে। এমন বোকা লোকের কথা কখনও শুনেছ? আশপাশে প্রায়ই ভুলু-ডাকাত হানা দিয়ে বেড়াচ্ছে, সেটা জেনেও একথাটা প্রকাশ করতে কি তার ভয় হল না ভুলু-ডাকাতের কানে এতক্ষণ মোহনলালের টাকার কথা গিয়ে পৌঁছেছে, আর পটলবাবুর সন্দেহ যদি ভুল হয়, অর্থাৎ মোহনলাল যদি ভুলু-ডাকাতের চর না হয়, তাহলে আসছে কাল অমাবস্যার গোলমালে ভুলু যে তার বাড়িতে হানা দেবে, এটা আমি মনে ঠিক দিয়ে রেখেছি।

খানিকক্ষণ চিন্তিত ভাবে নীরব থেকে চন্দ্রবাবু বললেন, এখন বুঝেছ, আমি কীরকম মুশকিলে ঠেকেছি? একেই এই মেয়ে-চুরির মামলা নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি, তার ওপরে কাল ওই মোহনলালের বাড়ির আনাচে-কানাচেই আমাকে রাত কাটাতে হবে, কারণ শ্রীমান ভুলু বাবাজি কাল হয়তো দয়া করে ওখানে পায়ের ধুলো দিলেও দিতে পারেন!

কুমার বললে, চন্দ্রবাবু, আপনি আমার একটি কথা রাখবেন?

কি কথা? তুমি যখন অশোকের বন্ধু তখন তুমি আমারও ছেলের মতো। সাধ্যমতো আমাকে তোমার আবদার রাখতে হবে বইকী!

কুমার বললে, যতদিন না এই মামলার কোনও নিষ্পত্তি হয়, ততদিন আপনার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে থাকতে দেবেন কি?

চন্দ্রবাবু খুব খুশি মুখে বললেন, একথা আর বলতে? তোমার মতন সাহসী আর বুদ্ধিমান সঙ্গী পেলে তো আমি বর্তে যাই! তুমি যদি আমার সঙ্গে থাকো, তা হলে আমি হয়তো খুব শীঘ্রই এ মামলাটার একটা কিনারা করে ফেলতে পারব!

.

চার । আধুনিক ব্যাঘ্র

অমাবস্যার রাত!

নিঝুম রাত করছে ঝাঁ-ঝাঁ, নিরেট অন্ধকার করছে ঘুটঘুট!

তার ওপরে বিভীষিকাকে আরও ভয়ানক করে তোলবার জন্যেই যেন কালো আকাশকে মুড়ে আরও বেশি কালো মেঘের পর মেঘের সারি দৈত্যদানবের নিষ্ঠুর সৈন্যশ্রেণির মতো শূন্যপথে ধেয়ে চলেছে, দিশেহারা হয়ে!

মাঝে-মাঝে দপদপ করে বিদ্যুৎ জ্বলে জ্বলে উঠছে–সে যেন জ্বালামুখী প্রেতিনীদের আগুন-হাসি!

বন জঙ্গল, বড় বড় গাছপালাকে দুলিয়ে, ধাক্কা মেরে নুইয়ে দুরন্ত বাতাসের সঙ্গে কারা যেন পৃথিবীময় পাগলের কান্না কেঁদে ছুটে ছুটে আর মাথা কুটে কুটে বুক চাপড়ে বেড়াচ্ছে।

মানসপুর যেন এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে ডুবে প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে। সেখানে যে ঘরে ঘরে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হাতে করে সজাগ হয়ে বসে আছে, বাহির থেকে এমন কোনও সাড়াই পাওয়া যাচ্ছে না।

খুব উঁচু একটা বটগাছের ডালে বসে কুমার নিজের রেডিয়মের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলে, রাত বারোটা বাজতে আর মোটে দশ মিনিট দেরি আছে!

বন্দুকটা ভালো করে বাগিয়ে ধরে কুমার গাছের ডালের ওপরে যতটা পারে সোজা হয়ে বসল। সে নিজেই এই গাছটা পছন্দ করে নিয়েছে। যদি কোনও সাহায্যের দরকার হয়, তাই তার জন্যে চন্দ্রবাবু গাছের নীচেই এক চৌকিদারকে মোতায়েন রেখেছেন।…এই গাছ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ ফুট দূরেই সেই নির্বোধ মোহনলালের বাসাবাড়ি। চন্দ্রবাবু নিজেও কাছাকাছি কোনও ঝোপঝাপের ভিতরে সদলবলে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন।

কুমার নিজের মনে-মনেই বললে, আর আট মিনিট! আঃ, এ মিনিটগুলো যেন ঘড়ির কাটার জোড় করে টেনে রেখেছে–এরা যেন তাকে এগুতে দিতে রাজি নয়! আর ছমিনিট! চন্দ্রবাবুর কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে বারোটা বাজলেই সেই আশ্চর্য বাঘের চিৎকার শোনা যাবে। একেলে বাঘগুলোও কি সভ্য হয়ে উঠল, ঘড়ি না দেখে মানুষের ঘাড় ভাঙতে বেরোয় না?…হাওয়ার রোখ ক্রমেই বেড়ে উঠছে, গাছটা বেজায় দুলছে,–শেষটা ধপাস করে পপাত ধরণীতলে না হই!..আর চার মিনিট!.আর তিন-মিনিট…আর দু-মিনিট! কুমারের হৃৎপিণ্ডটা বিষম উত্তেজনায় যেন লাফাতে শুরু করলে, ছিদ্রহীন অন্ধকারের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত আগ্রহদীপ্ত চোখ দুটোকে ক্রমাগত বুলিয়ে সে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল–যে মূর্তিমান আতঙ্ক এখনি এখানে এসে আবির্ভূত হবে! কিন্তু তার কোনও খোঁজই মিলল না!

আচ্ছা, বাঘ যদি এদিক না এসে অন্যদিকে যায়। কিন্তু যেদিকেই যাক, বাঘের ডাক তো আর সেতারের মিনমিনে আওয়াজ নয়, তার গর্জন আমি শুনতে পাবই। আর বাঘের বদলে যদি এদিকে আসে ভুলু-ডাকাতের দল, তাহলেও বড় মন্দ মজা হবে না–আর আধ মিনিট!

গোঁ-গোঁ-গোঁ-গোঁ করে আচম্বিতে ঝড় জেগে উঠে বটগাছটার ওপরে ভীষণ একটা ঝাঁপটা মারলে–পড়তে-পড়তে কুমার কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিলে।

ঠিক রাত বারোটা!

সঙ্গে সঙ্গে কান-ফাটানো এক ব্যাঘ্রের গর্জন! বাঘের ডাক যে এমন ভয়ানক আর অস্বাভাবিক হতে পারে, কুমারের সে ধারণাই ছিল না, তার সমস্ত শরীর যেন শিউরে শিউরে মুচ্ছিত হয়ে পড়বার মতো হল।

আবার সেই গর্জন–একবার, দুইবার, তিনবার! সে গর্জন শুনে ঝড়ও যেন ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল!

আকাশের কালো মেঘের বুক ছিঁড়ে ফালাফালা করে সুদীর্ঘ এক বিদ্যুতের লকলকে শিখা জ্বলে উঠল–

এবং নীচের দিকে তাকিয়ে কুমার স্পষ্ট দেখলে, প্রকাণ্ড একটা ব্যাঘ্র সামনের জঙ্গলের ভিতর থেকে তিরের মতো বেরিয়ে এল–

এবং অমনি তার বন্দুক ধ্রুম করে অগ্নিবৃষ্টি করলে!

–তার পরেই প্রথমে ব্যাঘ্রের গর্জন এবং সেই সঙ্গে মানুষের করুণ আর্তনাদ।

.

পাঁচ । মানুষ শিকার

বাঘের ডাক আর মানুষের আর্তনাদ থামতে না থামতেই সারি সারি লণ্ঠনের ও বিজলি মশালের (ইলেকট্রিক টর্চ) আলোতে চারিদিকের অন্ধকার যেন খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল! ঝোপঝাপের ভিতর থেকে দলে দলে পুলিশের লোক গোলমাল করতে করতে বেরিয়ে আসতে লাগল।

কুমারও তর তর করে গাছের ওপর থেকে নেমে এল। কিন্তু নেমে এসে গাছের নীচে চৌকিদারকে আর দেখতে পেলে না। নিশ্চয়ই বাঘের ডাক শুনেই পৈত্রিক প্রাণটি হাতে করে সে চম্পট দিয়েছে।

মুখ তুলেই দেখে, চন্দ্রবাবু একহাতে রিভলভার আর এক হাতে বিজলি-মশাল নিয়ে ছুটতে ছুটতে তার দিকেই আসছেন।

কাছে এসেই চন্দ্রবাবু উত্তেজিত স্বরে বললেন, কুমার, তুমিই কি বন্দুক ছুঁড়েছ?

কুমার বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি বাঘটাকে দেখেই বন্দুক ছুঁড়েছি, কিন্তু আর্তনাদ করে উঠল একজন মানুষ!

বাঘটাকে তুমি কোনখানে দেখছে!

খুব কাছেই। ওই যে, ওইখানে!

চন্দ্রবাবু সেইদিকে বিজলি-মশালের আলো ফেলে বললেন, কই, ওখানে তো বাঘের চিহ্নও নেই! কিন্তু মাটির ওপরে ওখানে কে বসে আছে?–দু-পা এগিয়েই তিনি বিস্মিত স্বরে বললেন, আরে এ যে আমাদের পটলবাবু।

কুমার এগিয়ে গিয়ে দেখলে পটলবাবু মাটিতে বসে গায়ের চাদরখানা দিয়ে নিজের ডান পা-খানা বাঁধবার চেষ্টা করছেন।

চন্দ্রবাবু বললেন, এ কী পটলবাবু, আপনি এখানে কেন? আপনার পায়ে কি হয়েছে, চাদর জড়াচ্ছেন যে!

পটলবাবু যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে বললেন, যে-জন্যে আপনারা এখানে, আমিও সেইজন্যেই এখানে এসে লুকিয়েছিলুম! কিন্তু ওই ভদ্রলোক যে গুলি করে আমায় একখানা পায়ের দফা একেবারে রফা করে দেবেন, তা তো আমি জানতুম না! গুলিটা যদি আমার মাথায় কি বুকে লাগত তাহলে কি হত বলুন দেখি?

কুমার অপ্রস্তুত স্বরে বললে, কিন্তু আমি যে স্বচক্ষে বাঘটাকে দেখেই বন্দুক ছুঁড়েছি। আপনার পায়ে কেমন করে গুলি লাগল কিছুই তো বুঝতে পারছি না!

ক্রুদ্ধস্বরে পটলবাবু বললেন, বাঘকে দেখে বন্দুক ছুঁড়েছেন না, ঘোড়ার ডিম করেছেন। কাছেই কোথায় একটা বাঘ ডেকেছিল বটে, কিন্তু এখানটায় কোনও বাঘই আসেনি। এখানে বাঘ এলে আমি কি দেখতে পেতুম না? আপনি স্বপ্নে বাঘ দেখে আঁতকে উঠেছেন!

ঠিক মাথার উপরকার একটা গাছ থেকে কে বলে উঠল, না, কুমারবাবু সজাগ হয়েই বাঘ দেখেছেন–আমিও সজাগ হয়েই বাঘ দেখেছি! পটলবাবু যেখানে বসে আছেন, বাঘটা ঠিক ওইখানেই এসে দাঁড়িয়েছিল!

সকলে আশ্চর্য হয়ে উপরপানে তাকিয়ে দেখলে গাছের গুঁড়ি ধরে একজন লোক নীচে নেমে আসছে।

চন্দ্রবাবু সবিস্ময়ে বললেন, একি, মোহনলালবাবু যে! গাছের ওপরে চড়ে আপনি এতক্ষণ কী করছিলেন!

কুমারের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে মোহনলাল বললে, গাছে বসে ওই ভদ্রলোকেও যা করছিলেন, আমিও তাই করছিলুম। অর্থাৎ দেখছিলুম বিপদ কোনদিক দিয়ে আসে!

মোহনলালের বয়স হবে প্রায় চুয়াল্লিশ, মাথায় কাঁচা-পাকা বাবরি-কাটা চুল, কাঁচা-পাকা গোঁফ ও ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, রং শ্যামবর্ণ, দেহখানি খুব লম্বা-চওড়া–দেখলেই বোঝা যায়, বয়সে প্রৌঢ় হলেও তার গায়ে রীতিমতো শক্তি আছে।

চন্দ্রবাবু বললেন, আপনি, বাঘের কথা কি বলছিলেন না?

মোহনলাল বললে, হ্যাঁ। পটলবাবু যেখানে বসে আছেন, বিদ্যুতের আলোতে ঠিক ওইখানেই আমি একটা মস্তবড় বাঘকে স্বচক্ষে দেখেছি। তার পরেই বন্দুকের আওয়াজ হল– সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম বাঘের গর্জন আর মানুষের আর্তনাদ! তারপরে এখন দেখছি, এখানে বাঘের বদলে রয়েছেন পটলবাবু।

পটলবাবুর মরা-মানুষের চোখের মতো চোখদুটো হঠাৎ একবার জ্যান্ত হয়ে উঠেই আবার ঝিমিয়ে পড়ল। তারপর তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন, এখানে যে বাঘ-টাঘ আসেনি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছি আমি নিজে। বাঘটা এখানে এলে আমি এতক্ষণ জ্যান্ত থাকতুম না।

চন্দ্রবাবুও সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, পটলবাবুর এ যুক্তি মানতে হবে। আপনারা দুজনেই ভুল দেখেছেন!

পটলবাবু বললেন, দুজনে কেন, একশো জনে ভুল দেখলেও কোনও ক্ষতি ছিল না, কিন্তু সত্যি সত্যি বন্দুক ছোঁড়াটা অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে।…এঃ, আমার ঠ্যাংখানার দফা একেবারে রফা হয়ে গেছে,উঃ! আমি যে আর উঠতেও পারছি না।

কুমার বেচারি একদম হতভম্বের মতন হয়ে গেল! সে যে বাঘটাকে দেখেছে। এবং তাকে দেখেই বন্দুক ছুড়ছে, এবিষয়ে তার কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না, অথচ অন্যের সন্দেহভঞ্জন করবার জন্যে কোনও প্রমাণই তার হাতে নেই।

মোহনলাল একটা বিজলি মশাল নিয়ে মাটির ওপরে ফেলে বলে উঠল, এই দেখুন চন্দ্রবাবু বাঘ যে এখানে এসেছিল তার স্পষ্ট প্রমাণ দেখুন। এই দেখুন, কাঁচামাটির ওপরে বাঘের থাবার দাগ। এই দেখুন, ওই ঝোপটার ভেতর থেকে থাবার দাগগুলো এইখানে এগিয়ে এসেছে!..কিন্তু কী আশ্চর্য! দেখুন চন্দ্রবাবু দেখুন!

চন্দ্রবাবুও বাঘের পায়ের দাগগুলো দেখে সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, এ কী ব্যাপার! পায়ের দাগ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে, বাঘটা এদিক পানেই এসেছে বটে, কিন্তু সে যে এখান থেকে আবার ফিরে গেছে, পায়ের দাগ দেখে সেটা মনে হচ্ছে না তো!

আশেপাশে যে লোকগুলো ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল তারা প্রত্যেকেই চমকে উঠল এবং সভয়ে বারংবার চারিদিকে তাকাতে লাগল কি জানি, বাঘটা যদি কাছেই কোনও জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে থাকে।

পটলবাবু বললেন, বন্দুকের শব্দ শুনেই বাঘটা হয়তো লম্বা একটা লাফ মেরে পাশের কোনও ঝোপের ভেতরে গিয়ে পড়েছে। কিন্তু এখানে কোনও বাঘ এসেছে বলে এখনও আমি মানতে রাজি নই,কারণ আমি নিজে কোনও বাঘ দেখিনি!

বাঘের পায়ের দাগগুলো আরও খানিকক্ষণ পরখ করে মোহনলাল বললে, না বাঘ যে এখানে এসেছিল, সেবিষয়ে আর কোনওই সন্দেহ নেই! এখান থেকে সবচেয়ে কাছের ঝোপ হচ্ছে অন্তত চল্লিশ হাত তফাতে। কোনও বাঘই একলাফে অতদূর গিয়ে পড়তে পারে না! কিন্তু কথা হচ্ছে, বাঘটা তবে গেল কোথায়?

পটলবাবু বললেন, সেকথা নিয়ে পরে অনেক মাথা ঘামাবার সময় পাবেন। আপাতত আপনারা আমাকে একটু সাহায্য করুন দেখি,–আমার আর দাঁড়াবার শক্তি নেই? এঃ, ঠ্যাং খানার দফা একেবারে রফা করে দিয়েছে দেখছি! কুমারবাবু মস্ত শিকারি আপনি! বাঘ মারতে এসে মারলেন কিনা মানুষকে! আর মানুষ বলে মানুষ–একেবারে আমাকেই।

লজ্জায়, অনুতাপে কুমার মাথা না হেঁট করে পারলে না।

মোহনলাল কোনও দিকেই না চেয়ে আপন মনে তখনও বাঘের পায়ের দাগগুলো পরীক্ষা করতেই ব্যস্ত ছিল।

পটলবাবু টিটকারি দিয়ে বললেন, বাঘের পা থেকে ধুলোয় দাগ হয় বটে, কিন্তু সে দাগ থেকে আর আস্ত বাঘ জন্মায় না মোহনলালবাবু! মিছেই সময় নষ্ট করছেন!

মোহনলাল মাথা না তুলেই বললে, আমার যেন মনে হচ্ছে, এই বাঘের পায়ের দাগের ভেতর থেকেই আসল বাঘ আমাদের কাছে ধরা দেবে!

পটলবাবুর মরা চোখ আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল–ক্ষণিকের জন্যে। তিনি বললেন, বলেন কি মশাই? দাগ থেকে জন্মাবে আস্ত বাঘ, এ কোন জাদুমন্ত্রে?

মোহনলাল বললে, যে জাদুমন্ত্রে মাটিতে পায়ের দাগ রেখে বাঘ শূন্যে উড়ে যায়!

চন্দ্রবাবু বললেন, কথাকাটাকাটি করে লাভ নেই। চলুন, পটলবাবু, আপনি জখম হয়েছেন, আপনাকে আমরা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।

ঠিক সেই মুহূর্তে দূর থেকে সুতীক্ষ ফুটবল বাঁশির আওয়াজ শোনা গেল।

চন্দ্রবাবু সচমকে বলে উঠলেন, আমার গুপ্তচরের বাঁশি! সবাই ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে পড়ো সবাই ঝোপের ভেতর লুকিয়ে পড়ো! শিগগির আলো নিভিয়ে দাও!

কুমার সুধোলে, ব্যাপার কী চন্দ্রবাবু? এ বাঁশির আওয়াজের মানে কি?

চন্দ্রবাবু বললেন, আমার গুপ্তচর বাঁশির সঙ্কেতে জানিয়ে দিলে যে, ভুলু-ডাকাতের দল এইদিকেই আসছে। তারা আসছে নিশ্চয় মোহনলালবাবুর বাড়ি লুঠ করতে?…কিন্তু মোহনলাল কোথায় গেলেন?..পটলবাবুই বা কোথায়?

মোহনলাল ও পটলবাবু দুজনেই একেবারে অদৃশ্য!

কুমার বললে, বোধ হয় ভুলু-ডাকাতের নাম শুনেই ভয়ে তারা চম্পট দিয়েছেন।

তাই হবে। এসো কুমার, আমরাও এই ঝোপটার ভেতরে গিয়ে অদৃশ্য হই–বলেই কুমারের হাত ধরে টেনে চন্দ্রবাবু পাশেই একটা জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলেন!

বিপদের ওপরে বিপদ! ঠিক সেই সময়ে আকাশের অন্ধকার মেঘগুলো যেন ছ্যাদা হয়ে গেল ঝুপঝুপ করে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরে নিরানন্দের মাত্রা যেন পূর্ণ করে তুললে।

চন্দ্রবাবু বললেন, কুমার, তোমার বন্দুকে টোটা পুরে নাও–এবারে আর বাঘ নয়, হয়তো আমাদের মানুষ শিকারই করতে হবে!

কুমার বললে, সে অভ্যাস আমার আছে। এর আগেও আমাকে মানুষ-শিকার করতে হয়েছে!

.

ছয় । কালো কালো হাত

সে কি বৃষ্টি!–ফেঁটা ফোঁটা করে নয়, অন্ধকার শূন্যের ভিতর থেকে এক এক বিরাট প্রপাত হুড় হুড় করে জল ঢালছে আর ঢালছে।

চন্দ্রবাবু সঙ্গে কুমার যে-ঝোপটার ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নিলে, সেটা ছিল ঢালু জমির উপরে। অল্পক্ষণ পরেই তাদের প্রায় কোমর পর্যন্ত ডুবিয়ে দিয়ে কলকল আওয়াজে জলধারা ছুটতে লাগল।

চন্দ্রবাবু বিরক্তকণ্ঠে বললেন,–কপাল যাদের নেহাত পোড়া, তারাই পুলিশে চাকরি নেয়। শ্যাল কুকুররাও আজ বাইরে নেই, আমরা তাদেরও অধম!

কুমার তড়াক করে এক লাফ মেরে বললে, কী মুশকিল। সাপের মতন কি-একটা আমার গায়ের ওপর দিয়ে সাঁত করে চলে গেল!

খুব সাবধান কুমার! বর্ষাকাল সুন্দরবনে সাপের বড় উৎপাত! একটা ছোবল মারলেই ভবলীলা একেবারে সাঙ্গ!…দেখো, দেখো, ওই দেখো! মাঝে-মাঝে ইলেকট্রিক টর্চ জ্বালিয়ে কারা সব এই দিকেই আসছে! নিশ্চয়ই ভুলু-ডাকাতের দল!

কুমার বললে, ভুলু-ডাকাতকে আপনি কখনও দেখেছেন?

কেউ কোনওদিন তাকে দেখেনি। সে নিজে দলের সঙ্গে থাকে না। দলের সঙ্গে থাকে কালু-সর্দার, সে ভুলুর হুকুম মতো দলকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়। কালু-সর্দারকে আমি দেখেছি, সে যেন এক মাংসের পাহাড়, মানুষের দেহ যে তেমন বিপুল হতে পারে, না দেখলে আমি তা বিশ্বাস করতুম না। কালুর গায়ে জোরও তেমনি। শুনেছি, সে নাকি শুধু হাতে এক আছাড়ে একটা বাঘকে বধ করেছিল। একবার সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। কিন্তু রাত্রে বেলায় হাজত-ঘরের দেওয়াল থেকে একটা আস্ত জানলা উপড়ে ফেলে সে চম্পট দেয়।

চন্দ্রবাবুর কথা শুনতে-শুনতে কুমার দেখতে লাগল, চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত তফাত দিয়ে ডাকাতদের দল ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের কারুকে দেখা যাচ্ছিল না বটে, কিন্তু বিজলি মশালগুলোর আলো দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তাদের গতি কোন দিকে!

চন্দ্রবাবু বললেন, দু-একটা আশ্চর্য রহস্যের কোনও কিনারাই আমি করতে পারছি না। ভুলু-ডাকাতদের দল ডাকাতি করতে বেরোয় কেবল অমাবস্যার রাত্রে। আর যে-অঞ্চলেই তার দল ডাকাতি করতে যায়, সেইখানেতেই বাঘের বিষম অত্যাচার হয়! বাঘের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেই তারা যেন ডাকাতি করতে যায়। একবার একজন সাহেবগোয়েন্দা ভুলুকে ধরতে এসেছিল। কিন্তু শেষটা বাঘের কবলেই তার প্রাণ যায়। লোকের মুখে শুনি, বাঘই না কি ভুলুর ইস্টদেবতা, রোজ সে বাঘ-পুজো করে!

বাঘ-পুজো?

হ্যাঁ। সুন্দরবনে এটা কিছু নতুন কথা নয়। অনেকেই এখানে বাঘকে পুজো করে।

দেখুন, দেখুন! ডাকাতের দল অন্য দিকে যাচ্ছে।

হু, ওই দিকেই মোহনলালের বাসায় যাবার পথ। ওরা যে মোহনলালের বাসার দিকেই যাবে, সেটা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলুম। পটলবাবুর সন্দেহ ভুল–মোহনলাল যদি ভুলুর দলের লোক হত, তাহলে ডাকাতরা কখনওই তার বাড়ি লুট করতে আসত না।

কুমার বললে, এখন আপনি কি করবেন?

পকেট থেকে একটা বাঁশি বার করে চন্দ্রবাবু বললেন, এইভাবে আমি বাঁশি বাজাব। ডাকাতরা জানে না, ওরা আজ কী ফাঁদে পা দিয়েছে! আমি বাঁশি বাজালেই আমার দলের লোকেরা ওদের ঘেরাও করে ফেলবে। কুমার প্রস্তুত হও!–চন্দ্রবাবু বাঁশি বাজাতে উদ্যত হলেন।

সেই মুহূর্তেই তীব্র স্বরে একটা ফুটবল বাঁশি বেজে উঠল কিন্তু সে চন্দ্রবাবুর বাঁশি নয়!…ডাকাতদের বিজলি মশালগুলো এক পলকে নিবে গেল?

চন্দ্রবাবু এক লাফে ঝোপের বাইরে এসে বললেন, ও বাঁশি কে বাজালে? ডাকাতদের কে সাবধান করে দিলে?–বলতে-বলতে তিনিও বাঁশিতে ফুঁ দিলেন–একবার, দুবার, তিনবার।

জঙ্গলের চারিদিকে পুলিশের লণ্ঠন জ্বলে উঠল, চারিধারে ঝোপঝাপ থেকে দলে-দলে পুলিশের লোক বেরিয়ে এল,–তাদের কারুর হাতে বন্দুক, কারুর হাতে লাঠি।

চন্দ্রবাবু চিৎকার করে বললেন, ডাকাতরা পালাচ্ছে, ওদের আক্রমণ করো! ওইদিকে– ওইদিকে–শিগগির। চন্দ্রবাবু ও কুমার রিভলভার ও বন্দুক ছুঁড়তে-ছুঁড়তে ডাকাতরা যেদিকে ছিল সেইদিকে ছুটতে লাগলেন!

কিন্তু যথাস্থানে উপস্থিত হয়ে চন্দ্রবাবু ডাকাতদের কারুর টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পেলেন না! দারুণ বৃষ্টিতে মাটির ওপর দিয়ে যেন বন্যা ছুটছে, এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়ায় বন-জঙ্গল উজ্জ্বল ভাবে দুলছে, বিজলির মশালের সীমানার বাইরে অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে, এর মধ্যে ডাকাতরা যে কোথায়, কোনওদিকে গা ঢাকা দিয়েছে তা স্থির করা অসম্ভব বললেই চলে।

চন্দ্রবাবু হতাশভাবে বললেন, নাঃ, আজও খালি কাদা ঘেঁটে মরাই সার হল দেখছি। কিন্তু কোন রাস্কেল বাঁশি বাজিয়ে তাদের সাবধান করে দিলে, সেটা তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!

কুমার বললে, বোধহয়, ডাকাতদের কোনও চর বনের ভেতরে লুকিয়ে থেকে আমাদের গতিবিধি লক্ষ করছিল!

সম্ভব। কিন্তু আর এখানে অপেক্ষা করে লাভ নেই, আমরা চন্দ্রবাবু কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ পাশের জঙ্গলের ভিতর থেকেই দুখানা বড় বড় কালো হাত বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে এল এবং পরমুহূর্তে তারা কুমারকে ধরে শূন্যে তুলে নিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল, কুমার একটা চিৎকার করবার অবসর পর্যন্ত পেলে না! বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়ে কুমার নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করলে, সঙ্গে সঙ্গে সেই মহা-বলবান অজ্ঞাত শত্রু তার দেহ ধরে এমন এক প্রচণ্ড আঁকানি দিলে যে, তার সমস্ত জ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে গেল।

.

সাত । বাঘের গর্তে

নীচে কল কল করে জলের বন্যা ছুটে চলেছে, উপরেও ঝড়ের তোড়ে নিবিড় গাছপালার ভিতর দিয়ে যেন শব্দের বন্যা ডেকে ডেকে উঠছে এবং এ সমস্তকেই গ্রাস করে নীরবে বয়ে যাচ্ছে যেন অন্ধকারের বন্যা!

এরই মধ্যে কুমার কখন জ্ঞান ফিরে পেলে।

অনুভবে বুঝলে, তার দেহটা দুমড়ে কার কাঁধের ওপরে পড়ে রয়েছে।

সে একটু নড়বার চেষ্টা করতেই একখানা লোহার মতো শক্ত হাতে তাকে টিপে ধরে কে কর্কশ স্বরে বললে, চুপ। ছটফট করলেই টুটি টিপে মেরে ফেলব! তার হাতের চাপেই কুমারের কোমরটা বিষম ব্যথায় টনটনিয়ে উঠল!

ভীমের মতন গায়ের জোর,–কে এই ব্যক্তি? কাঁধে করে কোথায় তাকে নিয়ে যাচ্ছে? কুমারের ইচ্ছা হল, তার মুখখানা একবার দেখে নেয়। কিন্তু যা ঘুটঘুটে অন্ধকার!

পায়ের শব্দে বুঝলে, তার আশেপাশে আরও অনেক লোক আছে। কে এরা? ভুলু ডাকাতের দল? কিন্তু এত লোক থাকতে এরা তাকে বন্দি করল কেন? তাকে নিয়ে এরা কি করতে চায়?

অন্ধকারের ভিতর থেকে কে বললে, বাপরে বাপ, এত অন্ধকার তো কখনও দেখিনি! পথ চলা যে দায় হয়ে উঠল, আলো জ্বালব নাকি?

যে তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সে বললে, খর্বদার নিশে, আলো জ্বালাবার নাম মুখেও আনিস নে! পুলিশের লোক যদি পিছু নিয়ে থাকে তাহলে আলো জ্বাললেই ধরা পড়বি! তার ওপরে এই ছোকরাকে আমি আমার মুখ দেখাতে চাই না!

আর একজন বললে, ওকে মুখই বা দেখাব কেন, আর অমন করে বয়েই বা মরছ কেন? দাওনা এক আছাড়ে সাবাড় করে।

ভোঁদা ব্যাটার বাপ ছেলের ঠিক নামই রেখেছিল। ভোদানইলে অমন বুদ্ধি হয়? ওরে গাধা, আমি কি শখ করে এ ছোঁড়াটাকে ঘাড়ে করে বয়ে মরছি?

ওকে নিয়ে গিয়ে তোমার কি লাভ হবে?

ওরে ব্যাটা ভোঁদা, তোর চেয়ে ভোঁদড়ও চালাক দেখছি। এ ছোঁড়াকে নিয়ে কি করব, এতক্ষণে তাও বুঝিসনি? শোন তবে? আপাতত এ ছোঁড়া আমাদের আড্ডায় বন্দি থাকবে। আসছে অমাবস্যার ডাকাতি করতে বেরুবার আগে মা কালীর সামনে একে বলি দেব। মা বোধ হয় আমাদের ওপর রেগেছেন। তিনি মুখ ফিরিয়েছেন বলেই এ-যাত্রা আমাদের কাদা ঘেঁটে মরাই সার হল। এমন তো কখনও হয় না। মা নিশ্চয় নরবলি চান।

লোকটার মুখের কথা শেষ হতে না-হতেই ভীষণ এক ব্যাঘ্রের গর্জনে আকাশের মেঘ আর অরণ্যের অন্ধকার যেন থর থর করে কেঁপে কেঁপে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে মানুষের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ–বারবার তিনবার! তার পরেই সব চুপচাপ!

মহা-আতঙ্কে কম্পিত কণ্ঠে কে বললে, সর্দার!

হু!

বাঘ!

না, আমাদের মা বাঘাইচণ্ডী! বললুম তো, মায়ের খিদে পেয়েছে, মা নরবলি চান। তোরা মাকে খেতে দিলিনে, মা তাই নিজেই খিদে মেটাতে এসেছে।

কিন্তু মা যে আমাদেরই কাকে ধরে নিয়ে গেলেন! এ কীরকম মা নিজের পেটের ছেলেকেই পেটে পুরবেন?

খিদের সময়ে আত্মপর জ্ঞান থাকে না রে ভোদা, আত্মপর জ্ঞান থাকে না। আর কে-ই বা মায়ের ছেলে নয়–মা তো জগৎ জননী, সবাই তো মায়ের ছেলে।

কুমার চুপ করে সব কথা শুনে যাচ্ছিল। নিজের পরিণামের কথাও শুনলে। বলির পশুর মতন তাকে মরতে হবে! তার মনটা যে খুব খুশি হয়ে উঠল না, সে কথা বলাই বাহুল্য।

সর্দার বলে যাকে ডাকা হচ্ছে, তাকে যে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কে এই লোকটা? এই-ই কি ভুলু-ডাকাত? না তার প্রধান অনুচর কালু-সর্দার?

হঠাৎ বিমলের কথা তার মনে হল! সে এখন কলকাতায়। তার বন্ধু যে আজ মরণের পথে এগিয়ে চলেছে একথা সে জানেও না। কুমারের মনে এখন অনুতাপ হতে লাগল, কেন সে বিমলের জন্যে অপেক্ষা করেনি? কেন সে একলা এই বিপদের রাজ্যে এল? বিমল যদি আজ এখানে থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই সে প্রাণপণে তাকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করত–আর খুব সম্ভব তাকে উদ্ধার করতে পারতও হয়তো

আচম্বিতে কি যে হল, কেবল এইটুকুই তার মনে হল, অন্ধকারের ভিতর দিয়ে হুস করে সে নীচের দিকে নেমে গেল, তার পরেই ঝপাং করে একটা শব্দ সঙ্গে সঙ্গে বুঝলে, সে আর মাটির ওপরে নেই, জলের ভিতরে গিয়ে পড়েছে।

একেবারে এক গলা জল? যে লোকটার কাঁধে চড়ে এতক্ষণ সে যাচ্ছিল, সেও এখন জলের মধ্যে!…নিজেকে সামলে নিয়ে হাতড়ে সে বুঝলে, তার সঙ্গের লোকটা একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেছে!

উপরপানে তাকিয়ে দেখলে খালি ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। তা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।

আবার চারিদিক হাতড়ে হাতড়ে সে বুঝলে, তারা একটা গভীর গর্তের ভিতরে গিয়ে পড়েছে। সুন্দরবনের বাসিন্দারা বাঘ ধরবার জন্যে বনের মাঝে-মাঝে গর্ত খুঁড়ে গর্তের মুখটা ঘাস-পাতা-গাছপালা দিয়ে ঢেকে রাখে। এটা নিশ্চয়ই সেইরকম কোনও গর্ত।

কুমার কান পেতে শুনতে লাগল। ডাকাতদের কোনও সাড়াশব্দ নেই। তাদের সর্দার যে মা-বাঘাইচণ্ডীর বলি নিয়ে গর্তের মধ্যে কুপোকাত, একথা নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পারেনি। অন্ধকারে অন্ধ হয়ে নিশ্চয়ই তারা এগিয়ে গিয়েছে!

কিন্তু একটু পরেই তো তারা নিজেদের ভ্রম বুঝতে পারবে। তখন আবার তারা সদলবলে ফিরে আসবে।

যদি পালাতে হয় তো এই হচ্ছে পালাবার সময়।

কিন্তু চারিদিককার দেওয়ালে হাত বুলিয়ে কুমার বুঝলে দেওয়াল খাড়া ভাবে ওপরে উঠেছে সাপ আর টিকটিকি না হলে তা বয়ে ওপরে ওঠা অসম্ভব।

সে হতাশ হয়ে পড়ল।

হঠাৎ ওপরে কার দ্রুত পায়ের শব্দ হল,–মাত্র একজনের পায়ের শব্দ!

কে এ? ডাকাতরা কি আবার ফিরে এল? কিন্তু তারা এলে তো দল বেঁধে ফিরে আসবে।

তবে কি এ পুলিশের চর? ডাকাতদের পিছু নিয়েছে?

যা থাকে কপালে–এই ভেবে কুমার চেঁচিয়ে ডাকলে, কে যায়? আমি গর্তের ভেতরে পড়ে গেছি, আমাকে বাঁচাও!

কোন জবাব পাওয়া গেল না। কুমার আবার চেঁচিয়ে বললে, আমি গর্তের মধ্যে পড়ে গেছি আমাকে বাঁচাও!

তখনও জবাব নেই।

কিন্তু হঠাৎ কুমারের মুখের ওপরে কি একটা এসে পড়ল, ঠিক একটা সাপের মতো।

কুমার সভয়ে চমকে উঠল–কিন্তু তার পরেই বুঝলে, ওপর থেকে গর্তের ভিতরে এক গোছ মোটা দড়ি ঝুলছে!

কুমার বিস্মিত হবারও অবকাশ পেলে না–তাড়াতাড়ি দড়িগাছা চেপে ধরতেই ওপর থেকে কে তাকে টেনে তুলতে লাগল!

পাতাল ছেড়ে পৃথিবীর ওপরে এসে দড়ি ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে কুমার উল্লসিত কণ্ঠে বললে, কে তুমি ভাই, আমাকে যমের মুখ থেকে বাঁচালে?

কাউকে দেখা গেল না–খালি অন্ধকার! কোনও জবাব এল না–খালি শোনা গেল কার দ্রুত পায়ের শব্দ! কে যেন সেখান থেকে চলে গেল! যেন ভৌতিক কাণ্ড!

কে এই অজ্ঞাত ব্যক্তি? কেন সে তার সঙ্গে কথা কইলে না, কেন সে পরিচয় দিলে না, কেন সে তাকে বাঁচিয়ে এমন করে পালিয়ে গেল? এ কী আশ্চর্য রহস্য!

খানিক তফাত থেকে অনেক লোকের গলার আওয়াজ শোনা যেতে লাগল।…ডাকাতরা ফিরে আসছে। তারা বুঝতে পেরেছে, সর্দার আর তাদের দলে নেই।

কুমার বেগে অন্য দিকে দৌড় দিল।

.

আট । পটলবাবুর বাড়ি

অমাবস্যার রাতের সেই রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের পর কুমারের গায়ের ব্যথা মরতে গেল, এক হপ্তারও বেশি।

সেদিন সকালবেলায় থানার সামনের মাঠে পায়চারি করতে করতে কুমার নানান কথা ভাবছিল।

নানান ভাবনার মধ্যে তার সবচেয়ে বড় ভাবনা হচ্ছে, বাঘের গর্তের ভিতর থেকে যে তাকে সেদিন উদ্ধার করলে, কে সেই ব্যক্তি? নিশ্চয়ই সে ডাকাতদের দলের কেউ নয়। গাঁয়ের ভিতরেও কুমারের এমন কোনও বন্ধু নেই (একমাত্র চন্দ্রবাবু ছাড়া) তার জন্যে যার এতটা মাথাব্যথা হবে! এই রহস্যময় ব্যক্তি তার প্রাণরক্ষা করলে, অথচ তাকে দেখাই বা দিলে না কেন?

সে রাতের সব ব্যাপারের সঙ্গেই গভীর রহস্যের যোগ আছে। সে স্বচক্ষে বাঘ দেখলে, বন্দুক ছুড়লে, অথচ জখম হলেন পটলবাবু। বাঘের পায়ের দাগ রয়েছে, অথচ পটলবাবু বলেন, সেখানে বাঘ আসেনি।

কুমার মনে-মনে এমনি সব নাড়াচাড়া করছে, এমন সময়ে দেখতে পেলে, পথ দিয়ে হন হন করে এগিয়ে চলছে মোহনলাল।

মোহনলালও তাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, এই যে কুমারবাবু নমস্কার! শুনলুম আপনি নাকি মস্ত বিপদে পড়েছিলেন?

হ্যাঁ। কিন্তু যেমন হঠাৎ বিপদে পড়েছিলুম, তেমনি হঠাৎ উদ্ধারও পেয়েছি!

মোহনলাল বললে, আমি বরাবরই দেখে আসছি কুমারবাবু বিপদের যারা তোয়াক্কা রাখে না, বিপদও যেন তাদের এড়িয়ে চলে।

কুমার একটু হেসে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, অন্তত আমার জীবনে বারবার তাই-ই হয়েছে। বটে!… কিন্তু এত সকালে আপনি যাচ্ছেন কোথায়?

মোহনলাল বললে, একবার পটলবাবুকে দেখতে যাচ্ছি। সেদিন আর একটু হলেই তো পটলবাবু আপনার হাতেই পটল তুলেছিলেন, নিতান্ত পরমায়ু ছিল বলেই বেচারি এ যাত্রা বেঁচে গেলেন! ভদ্রলোক কেমন আছেন সেই খোঁজ নিতেই চলেছি।

কুমার লজ্জিত ভাবে বললে, চলুন, আমিও আপনার সঙ্গী হব। আমার জন্যেই তাঁর এই দুর্দশা, তার খবর নেওয়া আমার কর্তব্য।

মোহনলালের সঙ্গে খানিকদূর অগ্রসর হয়ে কুমার শুধোলে, আচ্ছা মোহনবাবু, সেদিন যে আমি সত্যি-সত্যিই বাঘ দেখে বন্দুক ছুঁড়েছি, এবিষয়ে আপনার কোনও সন্দেহ আছে কি?

প্রবল ভাবে মাথা নেড়ে মোহনলাল বললে, একটুও না–একটুও না। তার প্রমাণও দেখুন–বলেই সে পকেট থেকে কাগজের ছোট এক মোড়ক বার করলে।

মোড়কের ভিতরে রয়েছে একগোছা লোম। বাঘের লোম।

কুমার বিস্মিত ভাবে বললে, এ লোম আপনি কোথায় পেলেন?

আপনার গুলি খেয়ে পটলবাবু যেখানে পড়ে ছটফট করছিলেন, সেইখানে।

লোমগুলোতে এখনও শুকনো রক্তও লেগে রয়েছে দেখছি।

হ্যাঁ, এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আপনার গুলি বাঘের গায়েও লেগেছে!

কুমার বললে, তা না হতেও পারে। হয়তো পটলবাবুর আহত পায়ের রক্তই লোমগুলোতে লেগে আছে।

কুমারবাবু, এ মানুষের রক্ত নয়।

কি করে জানলেন আপনি?

মোহনলাল গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি পরীক্ষা করে দেখেছি।

পরীক্ষা? শুকনো রক্তের দাগ কি লেখা থাকে যে তা মানুষ না পশুর রক্ত?

থাকে কুমারবাবু, থাকে। আপনি কি Bordet Reaction-এর কথা শোনেননি? Bordet সাহেব একরকম পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যার সাহায্যে শুকনো রক্তের দাগ পেলেই বলে দেওয়া যায়, তা মানুষ কি পশুর রক্ত!

আর সে-পদ্ধতি আপনি জানেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই পদ্ধতিতেই পরীক্ষা করে বুঝেছি, এ রক্ত মানুষের রক্ত নয়।

কুমার বিস্ময়ে ও নিজের অজ্ঞতায় নির্বাক হয়ে রইল। তার চোখে মোহনলাল আজ নতুন রূপে ধরা দিলে। সে বেশ বুঝলে, এ ব্যক্তি তো সাধারণ লোক নয়–নিশ্চয়ই এ অনেক ব্যাপারই জানে এবং বোঝে; এবং এ যে এখানে এসেছে, নিশ্চয়ই তার মধ্যে কোনও গূঢ় কারণ আছে!

খানিকক্ষণ পরে কুমার বললে, বাঘের ডাক শুনলুম, তাকে দেখলুম, গুলি করলুম, সে আহত হল, তার রক্তও পাওয়া গেল, কিন্তু তারপর? কর্পূরের মতো বাঘ কোথায় উবে গেল?

মোহনলাল চিন্তিত মুখে বললে, সেইটেই তো হচ্ছে আসল প্রশ্ন! একটা মস্ত বাঘ তার আস্ত দেহ নিয়ে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়?

আর তার সেই খোঁড়া ঠ্যাং নিয়ে পটলবাবুই বা চোখের নিমিষে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন কেমন করে?

হো হো করে হেসে উঠে মোহনলাল বললে, প্রাণের দায়ে অসম্ভবও সম্ভব হয়, কচ্ছপও দৌড়ে হরিণকে হারিয়ে দিতে পারে!…তবে পটলবাবু হয়তো ডাকাতদের ভয়ে পিঠটান দেননি।

তবে?

আপনার ভয়েই তিনি বোধ হয় একটি মাত্র ঠ্যাংয়ে ভর দিয়েই লম্বা দিয়েছিলেন।

আমার ভয়ে?

হ্যাঁ। আপনার লক্ষ্যভেদ করবার শক্তির ওপরে হয়তো তার মোটেই বিশ্বাস নেই। একবার বাঘ বধ করতে গিয়ে মারতে গিয়ে পা খোঁড়া করে দিয়েছিলেন, তারপর আবার ডাকাত মারতে গিয়ে আপনি যে তারই প্রাণপাখিকে খাঁচাছাড়া করতেন না, সেটা তিনি ভাবতে পারেননি। কাজে কাজেই যঃ পলায়তি স জীবতি! পটলবাবু বুদ্ধিমানের কাজই করেছিলেন।

কুমার অপ্রতিভ হয়ে হেঁট করলে।

মোহনলাল তারপর যেন নিজের মনে মনেই বললে, কিন্তু এ কীরকম কথা? বাঘের গায়ে লাগল গুলি, বাঘ হল জখম, তবে পটলবাবুর পা কেমন করে খোঁড়া হল?

তাই তো, এ কথাটা তো কুমার এতক্ষণ ভেবে দেখেনি। এও বা কেমন করে সম্ভব হয়?

এখানকার সমস্ত কাণ্ডই যেন আজগুবি, এ বিপুল রহস্যের সমুদ্রে যেন কিছুতেই থই পাবার যো নেই।

তারা পটলবাবুর বাড়ির সুমুখে এসে হাজির হল।

পটলবাবুকে প্রথম দেখে কুমারের যেমন মনে হয়েছিল শ্মশানের চিতার আগুনের ভিতর থেকে একটা মড়া যেন দানোয় পেয়ে জ্যান্ত পৃথিবীর পানে মিটমিট করে তাকিয়ে দেখছে, তেমনি পটলবাবুর বাড়িখানাকেও দেখে কুমারের মনে হল–এ যেন কার বিজন সমাধিভবন।

চারিধারে ঝোপঝাপ, ঘন বাঁশঝাড়, পোড়ো জমি; এক কোণে একটা পচা ডোবা; মাঝখানে একটা পানা-ধরা পুকুর–এক সময়ে তার সব দিকেই বাঁধানো ঘাট ছিল এখন তার একটাও টিকে নেই। সেই পুকুরেরই পূর্বদিকে পটলবাবুর জীর্ণ, পুরোনো ও প্রকাণ্ড বাড়িখানা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন ভাবছে, এইবারে কবে সে একেবারে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। এ-বাড়িকে কেবল বাড়ি বললেই ঠিক বলা হবে না, একে অট্টালিকা বলাই উচিত সাত-মহলা অট্টালিকা! কিন্তু তার এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত চোখ চালিয়ে; খালি দেখা যায়, লোনা ধরা, ক্ষয়ে যাওয়া, বালি-খসা ইটগুলো যেন ছাল ওঠা ঘায়ের মতন লাল হয়ে আছে! অজগর সাপের মতন শিকড় দিয়ে দেওয়ালকে জড়িয়ে বড় বড় সব গাছ হাওয়ার ছোঁয়ায় শিউরে আর্তনাদ করে উঠছে,–এক একটা গাছ এত বড় যে, তার ডাল বয়ে আট-দশজন মানুষ উঠলেও তারা নুয়ে পড়বে না!

কুমার সবিস্ময়ে বললে; এ তো বাড়ি নয়, এ যে শহর। পটলবাবুর পূর্বপুরুষরা নিশ্চয়ই খুব ধনী ছিলেন?

মোহনলাল বললে, জানি না। তবে এইটুকু জানি যে, এ-বাড়ি পটলবাবুর পূর্বপুরুষের নয়। পটলবাবু এ-গাঁয়ে এসে বাসা বেঁধেছেন মোটে তিন বছর। এই পোড়া বাড়ি আর জমি। তিনি জলের দরে কিনে নিয়েছেন।

বাড়িখানাকে কিনে এর এমন অবস্থা করে রেখেছেন কেন?

এত বড় বাড়ি মেরামত করতে গেলেও কত হাজার টাকার দরকার, তা কি বুঝতে পারছেন না? বাড়িখানার একটা মহলই পটলবাবুর পক্ষে যথেষ্ট। সেই অংশটুকু মেরামত করে নিয়ে পটলবাবু সেইখানেই থাকেন।

কিন্তু এ-বাড়ি আগে কার ছিল, আপনি কি তা জানেন?

সে খোঁজও আমি নিয়েছি। বাংলাদেশের অনেক বড় জমিদারের পূর্বপুরুষ ডাকাত ছিলেন। প্রায় তিনশো বছর আগে এমনি এক ডাকাত-জমিদার এই বাড়িখানা তৈরি করিয়েছিলেন। এরকম সেকেলে বাড়ির ভেতরে অনেক রহস্য থাকে। আমরা খোঁজ নিলে আজও তার কিছু কিছু পরিচয় পেতে পারি।

বাড়ির সদর দরজা এমন মস্ত যে তার ভিতরে অনায়াসেই হাতি ঢুকতে পারে। এতকাল পরেও দরজার লোহার খিল মারা পুরু পাল্লা দুখানা একটুও জীর্ণ হয়ে পড়েনি।

মোহনলালের সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ির ভিতরে ঢুকে কুমার বললে, পটলবাবু কোন অংশে থাকেন; আপনি জানেন তো?

জানি কিন্তু তার আগে বাড়ির অন্য অন্য মহলগুলো একবার বেড়িয়ে এলে আপনার কষ্ট হবে কি?

কুমার পরম উৎসাহিত হয়ে বললে, কিছু না কিছু না! বলতে কি, আমিও সেই কথাই ভাবছিলুম। কিন্তু পটলবাবুকে আগে তো সেটা একবার জানানো দরকার?

কোনও দরকার নেই; পটলবাবুর মহল একেবারে আলাদা তার দরজাও অন্য দিকে। এ মহলগুলোয় জনপ্রাণী বাস করে না, এগুলো এমনি খোলাই পড়ে থাকে, এর মধ্যে যে কেউ ঢুকতে পারে কত শেয়াল কুকুর আর সাপ-খোপ যে এর ভেতর বাসা বেঁধে আছে, কে তা বলতে পারে?

একে-একে তারা তিন-চারটে মহল পার হল–বাড়ির ভিতরের অবস্থাও তথৈবচ। বড় বড় উঠান, দালান, চক মিলানো ঘর, কারুকাজ করা খিলান, কার্নিশ, থাম ও দরজা কিন্তু বহুকালের অযত্নে আর কোথাও কোনও শ্রী নেই। ঘরে ঘরে বাদুড় দুলছে, চামচিকে উড়ছে, কোলা ব্যাং লাফাচ্ছে, পথ দিয়ে চলতে গেলে জংলা গাছপালা হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা দেয়, ঘুমন্ত সাপ-জোগ রেগে ফোঁশ করে ওঠে, তফাতে-তফাতে পলাতক জানোয়ারদের দ্রুত পদশব্দ শোনা যায়।

মাঝে মাঝে সব অলিগলি, শুড়িপথ–তাদের ভিতরে কষ্টিপাথরের মতন জমাট বাধা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কুমারের বার বার মনে হতে লাগল, সেই সব অন্ধকারের মধ্যে থেকে থেকে যেন ভীষণ সব চোখের আগুন জ্বলে-জ্বলে উঠছে,–সে হিংসুক, ক্ষুধিত দৃষ্টিগুলো যেন মানুষের রক্তপান করবার জন্যে দিবারাত্র সেখানে জাগ্রত হয়ে আছে!..আর সে কী স্তব্ধতা! সে স্তব্ধতাকে যেন হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করা যায়।

হঠাৎ কুমার বলে উঠল, দেখুন মোহনবাবু, মাটির দিকে চেয়ে দেখুন!

মাটির পানে তাকিয়েই একটি লাফ মেরে মোহনলাল বলে উঠল অ্যাঃ! আমি কি চোখের মাথা খেয়েছি যে, এটা দেখতে না পেয়ে বোকার মতন এগিয়ে চলেছি! ভাগ্যিস আপনি দেখতে পেলেন! বলেই সে আগ্রহ-ভরে মাটির ওপরে হেঁট হয়ে পড়ল।

মাটির ওপর দিয়ে বরাবর এগিয়ে চলেছে বাঘের বড় বড় থাবার চিহ্ন!

সেই পায়ের দাগ ধরে অগ্রসর হয়ে মোহনলাল ও কুমার গিয়ে দাঁড়াল একটা শুঁড়িপথের সামনে। সেখানে আবার নতুন ও পুরাতন অসংখ্য পায়ের দাগ–দেখলেই বেশ বোঝা যায়, ব্যাঘ্র মহাশয় সেখানে প্রায়ই বেড়াতে আসেন।

মোহনলাল বললে, পটলবাবুর এই রাজপ্রাসাদে যে এত বেশি বাঘের আনাগোনা, গাঁয়ের কেউ তো সে খবর জানে না।

চিড়িয়াখানার বাঘদের ঘরে যেরকম দুর্গন্ধ হয়, শুড়িপথের গাঢ় অন্ধকারের ভিতর থেকে ঠিক সেইরকম একটা বিশ্রী, বোঁটকা গন্ধ বাইরে বেরিয়ে আসছে!

মোহনলাল একবার সেই ভয়াবহ শুড়িপথের ভিতর দিয়ে দৃষ্টিপাত করলে, তারপর ফিরে কুমারের দিকে তাকিয়ে বললে, কুমারবাবু, এর ভেতরে ঢোকবার সাহস আপনার আছে?

কুমার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললে, পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

তাহলে আমার সঙ্গে আসুন বলেই মোহনলাল বিনা দ্বিধায় সেই অন্ধকারে অদৃশ্য বিপদ ও রহস্যেপূর্ণ শুড়িপথের ভিতরে প্রবেশ করল এবং তার সঙ্গে-সঙ্গে এগুলো কুমার–অটল পদে, নির্ভীক প্রাণে।

.

নয়। মরণের সামনে

মোহনলাল যে একজন বিশেষ বুদ্ধিমান ওরহস্যময় ব্যক্তি, আজকে তার সঙ্গে ভালো করে কথা কয়ে কুমার এটা তো বেশ বুঝতে পারলেন, তার ওপরে বুকের পাটা দেখে সে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেল।

কুমার আর একজন মাত্র লোককে জানে, এরকম মরিয়ার মতো সে এমনই মৃত্যুভয় ভরা অজানা বিপদের মধ্যে ঝাঁপ দিতে ভালোবাসে। সে হচ্ছে তার বন্ধু বিমল। ছেলেবেলা থেকেই বিপদের পাঠশালায় সে মানুষ।

কিন্তু মোহনলাল কেন যে যেচে এই মৃত্যু-খেলায় যোগ দিয়েছে, কুমার সেটা কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছে না। সেও কি তাদেরই মতন শখ করে নিরাপদ বিছানার আরাম ছেড়ে চারিদিকে বিপদকে খুঁজে খুঁজে বেড়ায়, না নিজের কোনও স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই অমাবস্যার রাতের এই ভীষণ গুপ্তকথাটা সে জানতে চায়?

কিন্তু এখন এসব কথা ভাববার সময় নয়। কী ভয়ানক শুড়িপথ এ? কয়েক পা এগিয়েই কুমার দেখলে গলির মুখ দিয়ে বাইরের একটুখানি যে আলোর আভা আসছিল, তাও অদৃশ্য হয়ে গেছে! এখন খালি অন্ধকার আর অন্ধকার–সে নিবিড় অন্ধকারের প্রাচীর ঠেলে কোনও মানুষের চোখই কোনওদিকে অগ্রসর হতে পারে না।

শুঁড়িপথের দুদিকের এবড়ো-খেবড়ো দেওয়াল এত বেশি স্যাঁতসেঁতে যে, হাত দিতেই কুমারের হাত ভিজে গেল! আর সেই জানোয়ারি বোঁটকা গন্ধ! নাকে খুব কষে কাপড়-চাপা দিয়েও কুমারের মনে হতে লাগল, তার পেট থেকে অন্নপ্রাশনের ভাত পর্যন্ত আজ বোধ হয় উঠে আসবে।

মোহনলালের হাতে, সেই অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে হঠাৎ একটা ছোট ইলেকট্রিক লণ্ঠনের উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল। কুমার বুঝলে, মোহনলাল রীতিমতো প্রস্তুত হয়েই এসেছে।

মোহনলাল বললে, কুমারবাবু, আপনার কাছে কোন অস্ত্র-টস্ত্র আছে?

না।

আপনি দেখছি আমার চেয়েও সাহসী! নিরস্ত্র হয়ে এই ভীষণ স্থানে ঢুকতে ভয় পেলেন না?

আপনিও তো এখানে ঢুকেছেন, আপনিও তো বড় কম সাহসী নন!

কিন্তু আমার কাছে রিভলভার আছে। বলেই মোহনলাল ফস করে হাতের আলোটা নিবিয়ে ফেললে।

ও কি আলো নেবালেন কেন?

একবার খালি দেখে নিলুম, পথটা কীরকম। অজানা পথ না হলে এখানে আলো জ্বালতুম না–শত্রুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে লাভ কি?

শত্রু?

হ্যাঁ। এই পথের মাটির ওপরে আলো ফেলে এই মাত্র দেখল