অদৃশ্য মানুষ! শ্রীপুরের আর সকলের মতো আমারও মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? এও কি সম্ভব? হ্যাঁ, সমুদ্রের জলে যারা বাস করে, আমাদের চোখে তারা অদৃশ্য বটে! পুকুরের জলে যে-সব জীব বাস করে, তারাও অদৃশ্য! কিন্তু পৃথিবীর হাওয়ার জগতে যারা বাস করে, তারা কখনও অদৃশ্য হতে পারে না!
ভেবে-চিন্তেও তিনি কুলকিনারা পেলেন না।..রাত পুইয়ে গেল। সকালবেলায় খবরের কাগজ এল। খবরের কাগজে পূর্ণবাবু অত্যন্ত আগ্রহের সহিত অদৃশ্য মানুষের সমস্ত কীর্তিকলাপ পড়ে ফেললেন। যে-কথাগুলি তিনি জানতে পারলেন, সেগুলি হচ্ছে এই :
(১) অদৃশ্য মানুষ স্বাস্থ্যনিবাসের উপরে বিষম অত্যাচার করেছে। (২) অদৃশ্য মানুষ ডাক্তার মানিকবাবুর বাড়ি থেকে টাকা চুরি করেছে। (৩) অদৃশ্য মানুষ শ্রীপুরের অসংখ্য স্ত্রী-পুরুষকে আহত করেছে। (৪) অদৃশ্য মানুষ শ্রীপুরের ব্যাঙ্ক থেকে কয়েক হাজার টাকার নোট নিয়ে পালিয়েছে এবং রাজপথের পথিকদের পকেট কেটে অনেক টাকা সরিয়েছে! প্রভৃতি।
পূর্ণবাবু নিজের মনেই বললেন, সর্বনাশ। বিধু কেবল অদৃশ্য নয়, উন্মত্তও বটে! ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে সে সাংঘাতিক কাণ্ডও করতে পারে। মানুষের সমাজের সমস্ত নিয়ম বদলে দিতে পারে! আর আমি কিনা তাকে স্বাধীনভাবে আমারই ঘরে ছেড়ে রেখে এসেছি! তাকে কি স্বাধীনতা দেওয়া উচিত? কখনওই নয়।
পূর্ণবাবু একখানা কাগজে তাড়াতাড়ি কি লিখলেন। তারপর কাগজখানা একখানা খামের ভিতরে পুরে চাকরকে ডেকে বললেন, এই চিঠিখানা চুপিচুপি থানায় দিয়ে এসো।
ঠিক সেই সময়েই তার শয়ন-ঘরের ভিতরে ঝনঝন করে একটা বেজায় আওয়াজ হল– যেন কাচের কি কতগুলো ভেঙে পড়ল! পূর্ণবাবু তাড়াতাড়ি শয়ন ঘরের দিকে ছুটলেন।
ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখলেন, একটা জানলার সামনে বিধুর স্কন্ধকাটা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং জানলার সার্সির ভাঙা কাচগুলো ঘরের মেঝের উপর ছড়িয়ে রয়েছে!
পূর্ণবাবু বললেন, এ কী ব্যাপার?
বিধু বিরক্তমুখে বললে, আমার মেজাজ বেজায় তিক্ত হয়ে আছে! কিছুই ভালো লাগছে না। ভয়ানক রাগ হচ্ছে। রাগের ঝেকে তোমার সার্সির কাচগুলো ভেঙে ফেলেছি!
পূর্ণবাবু মনে মনে বললেন, উন্মাদ রোগের পূর্বলক্ষণ! প্রকাশ্যে বললেন, তুমি আজকাল মাঝে মাঝে এইরকম করো নাকি?
করি।
পূর্ণবাবু ঘরের ভিতর নীরবে খানিকক্ষণ পায়চারি করলেন। তারপর বিধুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বললেন, বিধু, শান্ত হয়ে বসো। কেমন করে তুমি অদৃশ্য হলে, সে কথা আমাকে বলোনি। আমার শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।
অদৃশ্য হওয়া খুবই সহজ কথা!
তোমার কাছে সহজ হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে এটা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার!
কলেজ ছাড়বার পর আমি যে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে খুব মেতে উঠেছিলুম, সে কথা বোধহয় তুমি জানো না। মোহনপুরে আমার বাসা ছিল। সেখানে প্রায় দিন-রাত একটা ঘরে বন্দি হয়ে আমি কেবল পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে হরেকরকম পরীক্ষা করতুম। সেই পরীক্ষার ফলেই অদৃশ্য হবার এই অদ্ভুত উপায় আবিষ্কার করেছি।
সে উপায়টা কি শুনি?
সে কথা ভালো করে বোঝাতে গেলে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক কঠিন বিষয় নিয়ে এখন ব্যাখ্যা করতে হয়। সে সময় আমার নেই। তবে খুব সংক্ষেপে দু-একটা কথা বলছি, শোনো। ধরো, কাচের কথা। পাথরের চেয়ে কাচ স্বচ্ছ, তাই পাথরের ভিতর দিয়ে দেখা যায় না, কিন্তু কাচের ভিতর দিয়ে যায়। অস্পষ্ট আলোতে খুব পাতলা কাচ সহজে চোখে পড়ে না– কারণ, সে আলো শোষণ ও প্রতিফলিত করতে পারে খুবই অল্প। সাধারণ সাদা কাচ তুমি যদি জলের ভিতরে ফেলে দাও, তাহলে সে বিশেষরূপে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আবার জলের চেয়ে ঘন কোনও তরল পদার্থের ভিতরে কাচকে ফেলে দিলে সে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়– কারণ, সেই তরল পদার্থ ভেদ করে খুব অল্প আলোই তার কাছে গিয়ে পৌঁছোতে পারে। ঠিক এই কারণেই বাতাসের ভিতরে হাইড্রোজেন গ্যাস অদৃশ্য হয়ে থাকে। কাচকে যদি ভেঙে গুঁড়ো করা হয় তাহলে বায়ু-চলাচলের স্থানে তাকে রাখলে সকলেই দেখতে পায়! কিন্তু সেই দৃশ্যমান কাচের গুঁড়ো জলের মধ্যে ফেলে দিলে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। সাদা কাগজ স্বচ্ছ নয়–তার ভিতর দিয়ে দৃষ্টি চলে । কিন্তু ভালো করে তেল মাখিয়ে সাদা কাগজকেও স্বচ্ছ করা যায়।.এইরকম সব ব্যাপারের উপরেই নির্ভর করে আমি এই অপূর্ব আবিষ্কার করেছি।
পূর্ণবাবু বললেন, তারপর কি হল বলো!
বিধু বলতে লাগলঃ
কয়েক বৎসর চেষ্টার পরে যখন আমার মনে হল যে আমি পরীক্ষার সফল হয়েছি, তখন একদিন একটা বিড়ালকে ধরে আনলুম। তারপর সেই বিড়ালের উপরে আমি আমার আবিষ্কৃত ওষুধ প্রয়োগ করলুম। বিড়ালটা ওষুধ খেয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তারপর আমার চোখের সামনেই ধীরে ধীরে তার দেহ শূন্যে মিলিয়ে গেল। তার দেহ মিলিয়ে গেল বটে, কিন্তু তার মিউ মিউ করে কান্নার জ্বালায় আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠল। শেষটা অনেক কষ্ট করে ও তাড়াহুড়ো দিয়ে বিড়ালটাকে ঘর থেকে বিদায় করলুম। কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে পথে গিয়ে আবার সে হইচই বাধিয়ে তুললে। বিড়াল মিউ মিউ করছে, অথচ তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! রাজপথে বেশ ভিড় জমে গেল। যখন বিড়ালটাকে কিছুতেই আবিষ্কার করা গেল না, তখন তাকে ভূতুড়ে বিড়াল মনে করে সবাই সেখান থেকে পলায়ন করলে।