তিনি ঘড়ির দিকে তাকান। রাত ন’টা। ট্রেন আসার আর আধ ঘণ্টা মাত্র দেরি। তিনি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে যান রেল-স্টেশনে।
অস্থিরভাবে তিনি প্ল্যাটফর্মের এমাথা ও-মাথা করেন বারকয়েক। হঠাৎ ঘন্টির আওয়াজ শোনা যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায়। ফার্স্ট ক্লাস কামরাগুলো প্রায় তার বরাবরই এসে থেমেছে। তিনি মুখ ঘুরিয়ে পেছন দিকে সরে যান। ভিড়ে মাঝে দাড়িয়ে দুর থেকে চেয়ে থাকেন কামরাগুলোর দিকে।
দরজায় আতিয়া বেগমের মুখ দেখা যায়। কে একজন ফেল্ট-হ্যাটধারী এগিয়ে যাচ্ছে কামরার দিকে। আতিয়া বেগম হেসে তারদিকে হাত বাড়িয়ে দেন।
মিস্টার আফতারে বুকের ভেতর ধক করে ওঠে।
বাজ-বিছানা মাথায় নিয়ে কুলি আগে আগে চলছে। তার পেছনে আতিয়া বেগম আর সেই লোকটি। তাঁরা পাশাপাশি কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন। আতিয়া বেগমের চেয়ে দুতিন ইঞ্চি লম্বাই হবে লোকটি। ও পুরুষ হিসেবে তাকে একটু বেঁটেই মনে হয়।
মিস্টার আফতাব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তাঁদের অনুসরণ করতে থাকেন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি-স্টণ্ডের দিকে হারে ইশারা করে লোকটি। একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায়। বাক্স-বিছানা ক্যারিয়ারে ভোলা হলে তোকটা গাড়ির দরজা খুলে ধরে।
এতক্ষণে লোকটার মুখ দেখবার সুযোগ পান মিস্টার আফতাব। উজ্জ্বল ফরসা রঙ, টিকালো নাক, মাধুর্যমণ্ডিত মুখ। বয়স চব্বিশ পঁচিশের বেশি হবে না।
লোকটির সুন্দর চেহারার দিকে তাকিয়ে তার নিজের চেহারা বিকৃত হয়ে যায়, বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকে।
আতিয়া বেগম গাড়িতে উঠে বসেন। লোকটি তার পাশে বসে দরজা বন্ধ করে দেয় ট্যাক্সি রওনা হয়।
মিস্টার আফতাব তাড়াতাড়ি আর একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়েন। আগের ট্যাক্সিটার পিছু পিছু যাওয়ার নির্দেশ দেন ড্রাইভারকে।
অনেকটা পথ চলে, অনেক মোড় ঘুরে ট্যাক্সিটা কমমোপলিটান হোটেলের দরজায় গিয়ে থামে। কারো বাড়িতে যাচ্ছে না সে!
যে আশার আলো নিভু নিভু করেও তার মনে এতক্ষণ জ্বলছিল, তা এবার দুপ করে নিভে যায়। তিনি অনুমান করেছিলেন-আতিয়া বেগম মনের দুঃখে আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে এসেছে। সঙ্গে যুবকটি সেই বাড়িরই কেউ।
মিস্টার আফতাব তাঁর ট্যাক্সিটা থামিয়ে রাস্তার পাশে নেমে পড়েন।
ট্যাক্সি থেকে নেমে যুবকটির সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান আতিয়া বেগম। তাদের অনুসরণ করে তে-তলা পর্যন্ত যান আফতাব। কিন্তু তাদের আর দেখতে পাওয়া যায়না। তারা কোন কামরায় ঢুকে পড়েছে নিশ্চয়। সামনে এগিয়ে যাবেন, না নেমে যাবেন স্থির করবার আগেই দেখেন বাক্স-বিছানা নিয়ে দু’জন বেয়ারা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। তিনি কয়েক পা এগিয় গিয়ে বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে বাইরের দিকে চেয়ে থাকেন। বেয়ারা দু’জন তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিছুদূর গিয়ে তারা একটা কামরায় ঢুকতে তিনি সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যান। কামরাটার নম্বর যোগাড় করেই নেমে যান নিচে।
আতিয়া বেগম যে রুমে উঠেছে, তার উল্টো দিকে একটা রুম পেয়ে যান। মিস্টার আফতাব। কামরায় ঢুকেই চেয়ার টেনে জানালার পাশে বসেন। পর্দা ফাঁক করে চেয়ে থাকেন সুমুখের দরজার দিকে।
.
দু’জনের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু যুবকটির বেরুবার নামগন্ধ নেই। সে কি ওখানই রাত কাটাবে নাকি!
মিস্টার আফতাবের মনের চিন্তাগুলো বিছার মত কিলবিল শুরু করে দেয়। ক্রোধে তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। তিনি অস্থিরভাবে চুল টানতে থাকেন।
একবার তাঁর মনে হয়—আর সময় দেওয়া ঠিক নয়। সর্বনাশ ঘটবার আগেই চড়াও হওয়া দরকার।
পকেট থেকে পিস্তল হাতে নিয়ে তিনি দরজা পর্যন্ত এগোন। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে আগেন। হৈ-হট্টগোল করবার তাঁর মোটেই ইচ্ছে নেই।
রাত বেড়ে চলেছে। মিস্টার আফতার পর্দা ফাঁক করে একভাবে চেয়ে আছে। কিন্তু লোকটা বেরুচ্ছে না কেন? ওখানেই শুয়ে পড়ল নাকি?
এবার তাঁর বাঁধ ভেঙে যায়। পিস্তলটা মুঠোয় ধরে তিনি কামরা থেকে বার হন কিন্তু ঐ রুমের দরজার কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়ান। কথাবার্তার ক্ষীণ আওয়াজ পাওয়া যায়। তিনি আবার নিজের কামরায় ফিরে আসেন। চেয়ারটায় বসে দাঁতে দাঁতে ঘষতে থাকেন।
কিছুক্ষণ পরে লোকটি বেরিয়ে আসে। মিস্টার আফতার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
কিন্তু লোকটা যে ঐ রুমটার ঠিক পাশেরটায় ঢুকল।
আর এক মুহূর্ত দেরি করা ঠিক নয়। লোকটা হয় তো এখনি গিয়ে ঢুকবে অবর।
মিস্টার আফতাব দ্রুত-পায়ে ঘর থেকে বের হন। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েন আতিয়া বেগমের রুমে।
আতিয়া বেগম শোবার আয়োজন করছিলেন। হঠাৎ তাঁকে দেখে চমকে ওঠেন। ভয়ে পিছিয়ে যান দু’কদম।
মিস্টার আফতাবের চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। তিনি রাগে কাঁপছে।
কিছুক্ষণ কারও মুখ থেকে কোন কথা বেরোয় না। মিস্টার আফতাবই প্রথমে কথা বলেন, এ কী হচ্ছে? বজ্র-গম্ভীর তাঁর স্বর।
কোথায় কী হচ্ছে?
কোথায় কি হচ্ছে। আমি কিছুই দেখিনি মনে করেছ?
দেখেছ, বেশ করেছ! কিন্তু চিল্পাচ্ছ কেন? লোক জড় করবার ইচ্ছে আছে?
আতিয়া বেগম এগিয় গিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেন। ফিরে এসে বলেন, কী বলতে চাও, ধীরে সুস্থে বলো। দয়া করে চিল্লাচিল্লি করো না।