তার মাথার মধ্যে ব্যাপারটা এলোমেলো ভাবে ঘুরপাক খায়। তিনি নানা দিক থেকে এটাকে যাচাই করবার চেষ্ট করেন। শেষে নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে ওঠেন। কেন একটা আজগুবি আর অসম্ভব ব্যাপারটা নিয়ে তিনি শুধু শুধু মাথা ঘামাচ্ছেন? এমন হাস্যকর ব্যাপারকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কোন অর্থ হয় না। তিনি বুঝতে পারেন–এ শুধুই একটা চালবাজি। ধাপ্পা দিয়ে, ভয় দেখিয়ে তাকে নিবৃত্ত করার মত ছাড়া আর কিছুই নয়। অনর্থকভাবে বিচলিত হওয়ার জন্য নিজের কাছেই লজ্জিত হন তিনি।
চিন্তাটাকে মন থেকে জোর করে ঝেড়ে ফেলেন মিস্টার আফতাব। সুরাইয়াসহ মিস্টার রহমান সপরিবারে কুষ্টিয়া চলে গেছেন দুদিন আগে। শুভ দিন এগিয়ে আসছে। আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। আনন্দের কারাগুলো একে একে জ্বলতে শুরু করেছে তার মনের আকাশে। সেখানে কোনও মেঘই তিনি এ সময়ে জমতে দেবেন না।
তবুও মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন এসে জমা হয়। তিনি অস্বস্তি বোধ করেন। কিন্তু তা অল্পক্ষণের জন্যই তাঁর অবিশ্বাসের ঝড়ো হাওয়া সেগুলোকে তাড়িয়ে দেয়।
.
বিকেল তিনটায় স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা হবেন মিস্টার আফতাব। গোয়ালন্দ হয়ে যাবেন কুষ্টিয়া। দুপুরের আগেই তার বিছানাপত্র বাঁধাছাদা হয়ে গেছে। বাকি রয়েছে কয়েকটা জিনিস। নতুন আর দামি এ জিনিসগুলোর চাকরবাকরের হাতের ছোঁয়া লাগবে, তা পছন্দ নয় তার তাই মধ্যাহ্ন ভোজনের র তিনি নিজেই জিনিসগুলো গোছগাছ করতে লেগে গেছেন। ফর্দের সঙ্গে মিলিয়ে একটার পর একটা গয়নার বাক্স আর শাড়ি রাউজের প্যাকেট তুলছে একটা সুদৃশ্য চামড়ার বাক্সে।
দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছে।
তিনি পেছন ফিরে তাকান।
আতিয়া বেগমের চাপাশি। সালাম দিয়ে সে ঘরে ঢোকে। একটা লেফাপা তাঁর হাতে দিয়ে সে চলে যায়। লেপাকাট খুলে তিনি চিঠিটা পড়েন–
গ্রীন অ্যারো, ঢাকা স্টেশন,
২৩ শে জানুয়ারি, ১৯৬১
প্রিয় আফতাব,
দাম্পত্য জীবনে তুমি বা আমি কেউ আর এখন একনিষ্ঠ বলে দাবি করতে পারি। আমাদের দুজনেরই ভালোবাসা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে গেছে। সম্বোধনে আগের মত ‘প্রিয়তম’ লিখে কপটতা করা ইচ্ছে তাই নেই।
আজ সোয়া একটার ট্রেনে চাটগাঁ যাচ্ছি। ট্রেনে বসেই লিখছি এ চিঠি। কেন যাচ্ছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। তোমার দেখাদেখি আমিও পঁচিশ তারিখই ধার্য করেছি। ইতি–
আতিয়া
মিস্টার আফতাব ঘড়ি দেখেন। পৌনে দুটো। ট্রেন বহু আগেই ছেড়ে গেছে।
তার সারা মুখে কালো ছায়া। শিরদাঁড়া বেয়ে ওঠানামা করে কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি। তিনি আচ্ছন্নের মত বসে থাকেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনে নেন তিনি। তাঁর ঠোঁটের কোণে আগের মত ফুটে ওঠে অবিশ্বাসের হাসি। তিনি মনে মনে বলেন, এ আর এক নম্বর ধাপ্পাবাজি। মনে করেছে, ধাপ্পা দিয়ে সব বানচাল করে দেবে। ওঁহু, ও সবে এ বান্দা টলে না। পা যখন বাড়িয়েছি তখন কার সাধ্য পথ আটকায়!
একটু চিন্তা করে অস্ফুট স্বরে বলেন আবার, আমার সঙ্গে আড়ি দিয়ে দিন ধার্য করা হয়েছে। আমি যাচ্ছি কুষ্টিয়া আর উনি যাচ্ছেন চাটগাঁ। চমৎকার চাল। এখনি বাসায় টেলিফোন করলে সব ফাস হয়ে যাবে।
মিস্টার আফতাব উঠে গিয়ে টেলিফোন করেন, হ্যালো, কে? …গভর্নের্স? বেগমকে ডেকে দিন।…অ্যাঁ, নেই? কোথায় গেছেন?…চাটগাঁ!
রিসিভার রেখে দিয়ে তিনি আবার ভাবেন—চাটগাঁ যেতে হলে নিশ্চয়ই ছুটি নিতে হয়েছে অফিসে খোঁজ নিলে বেরিয়ে পড়বে কেমন চাটগাঁ যাওয়া হয়েছে।
তিনি তখনি টেলিফোন করেন আতিয়া বেগমের অফিসে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ইন্সপেকট্রেস দু’সপ্তাহের ছুটি নিয়েছেন।
এবার তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকেন ঘরের এদিক ওদিক।
ড্রাইভার এসে স্মরণ করিয়ে দেয়, হুজুর, সোয়া দুইটা বাজে। মালপত্র গাড়িতে তুলব?
মিস্টর আফতাব শূন্য দৃষ্টিতে ড্রাইভারের দিকে তাকান। অন্যমনস্কভাবে বলেন, অ্যাঁ, কী বলল
সময় হয়ে গেছে, হুজুর।
সময় হয়ে গেছে! আচ্ছা যাচ্ছি।
মালপত্র গাড়িতে তুলব?
একটু পরে।
ড্রাইভার চলে যায়।
মিস্টার আফতাব রিসিভার তোলেন। নম্বর ডায়াল করে ডাকেন, হ্যালো, পি. আই. এ. রিজার্ভেশন….গুড আফটার নুন। দেখুন, আজ সন্ধ্যের ফ্লাইটে চিটাগাং-এর একটা সিট দরকার। ….আচ্ছা, খোঁজ করে বলুন….আঁ, আছে? ধন্যবাদ। নাম লিখে নিন, এ. আহমদ। আমি এখনি টিকেট কিনতে লোক পাঠাচ্ছি।
মিস্টার আফতাব চাটগাঁ যেতে পারেন—এরকম সন্দেহ আতিয়া বেগমের মনেও জেগেছিল। তিনি অনুমান করেছিলেন কুষ্টিয়া যাওয়া বাতিল করে আফতাব হয়তো তার পিছু ধাওয়া করবেন, চাটগাঁ গিয়ে হৈ-হট্টগোল করতে চাইবেন। তাই রওনা হবার সময় শাহীন-মমতার গভর্নের্স-এর কাছে তিনি চাটগাঁর একটা টেলিফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশ মত চাটগাঁর প্লেন ছাড়বার সময় পার করে গভর্নেন্স টেলিফোন করেন আফতাবের বাড়িতে। খবরটা যোগাড় করে তক্ষুনি চাটগাঁর নম্বরে ট্রাঙ্ককল করে জানিয়ে দেন–মিস্টার আফতাব সন্ধ্যার প্লেনে চাটগা রওনা হয়ে। গেছেন।
‘হোটেল রয়েল’-এর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ। আরামকেদারায় গা ঢেলে দিয়ে নির্জীবের মতো পড়ে আছে মিস্টার আফতাব। প্লেনে বসে প্রতিকারের যে সমস্ত উপায়গুলো তিনি সারাক্ষণ ভাবতে ভাবতে এসেছিলেন, সেগুলোরই রোমন্থন চলে তাঁর মনের মধ্যে। কিন্তু উপায়গুলোর একটাও তার মনঃপুত হয় নি। ওর যে কোনটার আশ্রয় নিতে গেলেই হৈ-চৈ হবে, মানইজ্জত বিপন্ন হবে। মাঝে মাঝে তিনি আঁকড়ে ধরেন তার সেই অবিশ্বাসের খুটি। মনে মনে বলেন, ও সবের কোনই দরকার হবে না। গোপনে পিছু নিলেই সব চালবাজি বেরিয়ে পড়বে।