বেশ, তা হলে আমিও বিয়ে করব।
তা করো, কিন্তু বর জুটবে না।
নিশ্চয়ই জুটবে। তুমি দেখে নিও।
হ্যাঁ দেখব।
হ্যাঁ দেখবে, এই পঁচিশ তারিখের মধ্যেই দেখবে।
আচ্ছা আচ্ছা, করে দেখিও।
আতিয়া বেগম উঠে দাঁড়ান। রাগে তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। ঘর থেকে বেরিয়ে টলতে টলতে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান।
মিস্টার আফতাব ক্রুদ্ধ দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকেন খোলা দরজার দিকে। কিছুক্ষণ পরে দাঁড়ান। তার গম্ভীর মুখে ফুটে ওঠে অবজ্ঞার হাসি। নিজে নিজেই বলেন, যত সব আজগুবি থিওরি। এ নিয়ে তর্ক করা সোজা। কাজে খাটানো অত সোজা নয়। গাড়ির হর্ণ শুনে তিনি জানালা দিয়ে বাইরে দিকে তাকান। পরিচিত একটা ছোট্ট গাড়ি বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে গেল।
হঠাৎ তার গাড়ি নিয়ে বেরুবার কথা খেয়াল হয়। তিনি হাতঘড়ির দিকে তাকান। বারোটা বেজে দশ মিনিট। তিনি মনে মনে বলেন, শীতের রাত, এতক্ষণ কী আর সে জেগে আছে? হু একবার দেখতে দোষ কী!
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার শেলেটা একটা গলির মুখে বড় রাস্তার ওপর থামে। গাড়ি থেকে নেমে অন্ধকার গলি দিয়ে কিছু দূর এগিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে যান। সিগারেট ধরিয়ে একটা ছোট্ট বাড়ির বাইরের সিঁড়ির দিকে চেয়ে থাকেন।
হ্যাঁ, ঐ তো সিঁড়ি দিয়ে নামছে।
মিস্টার আফতাবের মনটা নেচে ওঠে।
ক্রিং—ক্রিং—ক্রিং—
মিস্টার রহমানের বাড়িতে টেলিফোন বাজছে। চার-পাঁচবার বাজবার পর আর ক্রিং শোনা যায় না। বোধ হয় রিসিভার তুলেছে কেউ।
সিঁড়ির নিচে এসে হঠাৎ থেমে গেছে সুরাইয়া। কান খাড়া করে কী যেন শুনছে।
এ কী। আবার দৌড়ে ওপরে যাচ্ছে কেন সে?
মিস্টার আফতাব অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকেন। তার বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই হঠাৎ দোতলার বাতি জ্বলে ওঠে। মিসেস রহমান স্তব্যক্তভাবে সুরাইয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছেন।
এবার তার মনে বিদ্যুৎ খেলে যায়। সুরাইয়ার হঠাৎ এভাবে ফিরে যাওয়ার আর তার ঘরে মিসেস রহমানের যাওয়ার পেছনে টেলিফোনের ডাকটাই নিশ্চয়ই দায়ী। তিনি রাগে ঠোঁট কামড়ান। মনে মনে বলেন, এ সব করেই কি আর আমাকে রুখতে পরবে?
.
প্রাতরাশের পর সিগারেট ধরিয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসেন মিস্টার আফতাব। রোজকার মতো খবরের হেডিংগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে বের করেন বিজ্ঞাপনের পাতা। টেন্ডারের বিজ্ঞপ্তি খুঁজতে খুঁজতে একটা বিজ্ঞাপনের ওপর চোখ পড়ে তার। এ ধরনের বিজ্ঞাপন পড়তে এখনো পুলক জাগে তার মনে। কিন্তু ওটা পরেই তিনি চমকে উঠেন। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। তিনি আবার পড়েন বিজ্ঞাপনটা
উচ্চ শিক্ষিত, উদারচেতা এবং সংস্কারমুক্ত পাত্র চাই। পাত্রে রক্ত A, B শ্রেণীর হওয়া আবশ্যক। পাত্রী সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, উচ্চ শিক্ষিতা এবং উপাজর্নক্ষম। বিস্তারিত বিবরণসহ পত্রালাপ করুন. জি.পি.ও. বক্স নম্বর ৪২৩১।
মিস্টার আফতাব কাগজ হাতে নিয়ে গুম হয়ে বসে থাকেন। ছাইদানির ওপর তাঁর জ্বলন্ত সিগারটেটা পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
বেয়ারার পায়ের শব্দে তাঁর চমক ভাঙে। ছাইদানির ওপর রাখা সিগারেটটার দিকে একবার তাকিয়ে তিনি আর একটা সিগারেট ধরান। এঁটো পেয়ালা-পিরিচ ট্রে তে সাজিয়ে নিয়ে বেয়ারা চলে যায়। তিনি পাশ থেকে টেলিফোন তুলে নেন। ডায়াল করে ডাকেন, হ্যালো কে? বক্স নম্বর ৪২৩১?…হ্যাঁ দেখলাম।…না, আশ্চর্য হইনি, বরং খুশি হলাম। আশা করি বিজ্ঞাপনদাতার ইচ্ছে পূর্ণ হবে।…..আমার ইচ্ছে? আমারটা তো পূর্ণ হবেই।… পাত্রীর বিশেষণগুলো পড়ে কিন্তু আমারই আবার পাত্র সাজবার লোভ হচ্ছে।… হ্যাঁ,–হ্যাঁ, তা ঠিকই। কিন্তু আসল বিশেষণগুলো বাদ পড়ল কেন?……কোনগুলো? যারটা তারই তো জানা উচিত আমার বলতে হবে কেন? ..আঁা, আমার মুখ থেকে শুনতে ভালো লাগবে? আচ্ছা বলছি, কালকের বিজ্ঞাপনে তা জুড়ে দেওয়া হবে তো?…ও পছন্দ হলে। আচ্ছা বলছি-পাত্রী ব্রিাহিতা এবং দুই সন্তানের জননী। কেমন পছন্দ হল তো?…না? অ্যাঁ? লেখা হবে না? কেন?…ও, পরে প্রার্থীদের জানানো হবে? তা বেশ। কিন্তু তখন জেনেশুনে বাসি ফুলের ওপর কি আর মৌমাছি বসবে? উঁহু! যদি বসে তো বসবে বোলতা, না হয় গুবরে মাছিহ্যালো হ্যালো।
তিনি আবার ডায়াল করে ডাকেন, ‘হ্যালো’ একি! ছেড়ে দেওয়া হল কেন?….নোংরা! নোরা কথা বললাম কখন?…ওগো সত্য কথাই তো বলেছি। বাসি ফুলের ওপর গুবরে মাছি বসবে না তো কি মৌমাছি বসবে? হ্যালো—আহ্, আবার ছেড়ে দিয়েছে।
রিসিভারটা নামিয়ে রাখেন মিস্টার আফতাব। সোফায় হেলান দিয়ে বসেন আরাম করে। তাঁর মুখ থেকে এমন মোক্ষম, এমন লাগসই একটা উপমা বের হওয়ার জন্য তিনি খুশি হন খুব। তাঁর মরে ভার অনেকটা হালকা হয়।
.
তারপর সপ্তাহখানেক চলে যায়।
দিনগুলো যে তার নির্ভাবনায় কেটেছে, তা নয়। বিজ্ঞাপনের ফল জাবার জন্য মাঝে মাঝে তার মনে কৌতূহল জেগেছে। কিন্তু জোর করে তিনি তা দমন করেছেন, শেষ এক দিন কৌতূহলের সঙ্গে যোগ হয় টিটকারি দেওয়ার লোভ। তিনি টেলিফোনে আতিয়া বেগমকে ডাকেন। কিন্তু র শুনে চমকে ওঠেন, তার টিটকারি দেওয়ার লোভ উবে যায়। ভাবনার ঢলে ডুবে যায় তার মন :
দুনিয়ায় এমন ক্যবলাও আছে তা হলে? ব জেনে-শুনে রাজি হয়ে গেল। বোধহয় তাকে কিছুই ভেঙ্গে বলা হয়নি। ঠগবাজি করে বড়শিতে গাঁথা হচ্ছে। কিন্তু বয়সটাও কি বিবেচনা করে দেখেনি আহাম্মকটা? পঁচিশ বছরের নওজোয়ান! কী জানি, বোধ হয় ব্রাউনিং রোমান্সের শখ। লোকটা নাকি আবার চিত্রশিল্পী, প্যারি ঘুরে এসেছে। গঁগা-লোত্ৰেকদের সমগোত্রীয় এ ধ্ব হতচ্ছাড়াদের তো আবার চরিত্রের বালাই নেই।