গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই বিরাটকায় অ্যালসেশিয়ানটা পেছনের দু’পায়ের ওপর ভর দিয়ে সামনের পা দুটো তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আতিয়া বেগম দু’হাত দিয়ে কুকুরটার দুই পা মর্দন করে চুপ করাবার জন্য আঙুলের ইশারা করেন। কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে আবার গেটের কাছ গিয়ে শুয়ে পড়ে।
ঘরে-পরার স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল পায়েই তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন; তাই সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময়ও শব্দ হল না একটু।
অস্পষ্ট কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যায়। এত রাত্রে কার সঙ্গে কথা বলছেন?
নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে যা আতিয়া বেগম। প্রথম জানালাটার কাছে যেতেই তিনি দেখতে পান-মিষ্টার আফতাব টেলিফোনে কথা বলছেন।
শুনুন, রহমান সাহেব! যে রকম বোঝা যাচ্ছে, ফ্যামিলি ল’ অর্ডিন্যান্সটা শিগগিরই পাশ হয়ে যাবে। তাই আমি বলছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজটা শেষ করে ফেলা দরকার।
আতিয়া বেগম দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকেন।
আঁ, আগামী মাসে? না না, সে অনেক দেরি। এ মাসের মধ্য হতে অসুবিধাটা কী?…. তবে আর দেরি করে লাভ কী? আপনি ব্যবস্থা করে ফেলুন। কোন জাঁকজমকের দরকার নেই। ….হ্যাঁ, আর একটা কথা, ঢাকার বাইরে হলেই ভালো হয়।… কোথায়? কুষ্টিয়ায়? তা আমার দিক থেকে কোন অসুবিধে নেই…..। আচ্ছা, ওদের জিজ্ঞেস করে এসে আমায় বলুন। আমি ধরে আছি।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে। তা হলে পঁচিশ তারিখ….কী বার পড়ে? …বুঝবার? হ্যাঁ, তা হলে এটাই ঠিক রইল। সব ব্যবস্থা করে ফেলুন। পনেরো দিন তো মাত্র বাকি।……অ্যাঁ কোনটা? ‘বি’ টাইপ কোয়াটার্স? ওটার টেন্ডার খুলবে পরশু। আসা করি কন্ট্রাক্টটা পেয়ে যাব। ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা হয়েছিল। সে তো আমার পুরনো হয়। …অ্যাঁ? ও হ্যাঁ–হ্যাঁ —তা আমি ভুলব না। আপনারা না ভুললেই হয়।…..হ্যাঁ তা টেন পারসেন্ট? তা আপনি যদি ম্যানেজ করতে পারেন, আমার আপত্তি নেই। …আচ্ছা, টিক আছে হালো রহমান সাহেব, সুরাইয়া ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?…একটু ডেকে দিন। অফিসের একটা দরকারি ব্যাপারে ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই।…আচ্ছা আমি ধরে আছি।
হ্যালো, কে সুরাইয়া? সিভিল সাপ্লাইয়ের বিলটা চলে গেছে? …..আচ্ছা, ঠিক কাছে। আচ্ছা শোন, তোমার দুলাভাই কিছু বলেছে?…..কী আবার, পঁচিশ তারিখের কথা বলেননি?…..থাক, আর নেকামো করো না।….একা একা কী করছ? চলে এসো না?…হ্যাঁ, ডিক্টেশানই দেব।
…শোন একা একা ভালো লাগছে না। কথা বলার লোক নেই।….ইন্সপেকট্রেস? সে তো নেই। তিন-চারদিন হল সে তার সরকারি বাসায় চলে গেছে। ….হা? তা ঝগড়া একটু হয়েছে বৈ কি। তুমি চলে এসো। …আঁ, পঁচিশ তারিখের পর? নাহ্, তোমাদের নিয়ে আর পারা গেল না। শোন সুরাইয়া, দিন তো আর বেশি নেই, মাত্র পনেরো দিন। গয়নাগাটির অর্ডার কালই দেয়া দরকার। আমার এখানে গয়নার ক্যাটালগ আছে দুটো। তুমি এসে যদি পছন্দ করে দিয়ে যেতে।….না, অফিসে এ সব চলে না। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।…অ্যাঁ? …না, না ওরা টের পাবে না। তোমার ঘর তো সিঁড়ির কাছেই। চোখ রেখো, সিগারেট জ্বললেই চুপি চুপি বেরিয়ে এসো। …..আচ্ছা।
আফতাব রিসিভারটা রেখে দিয়ে দাঁড়ান। টেবিল থেকে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে তিনি দরজার দিকে এক পা বাড়িয়েই হঠাৎ চমকে ওঠেন।
কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
আতিয়া বেগমের কণ্ঠে উষ্ণতার আভাস পেয়ে হকচকিয়ে যান আফতাব। আমতা আমতা করে বলেন, না একটু বাইরে যাচ্ছি।
বাইরে কোথায় যাচ্ছ?
একটু শাহবাগ হোটেলে যাব। করাচি থেকে—
থাক, মিছে কথা বলার চেষ্টা করো না।
মিছে কথা!
হ্যাঁ মিছে কথা। তুমি কোথায় যাচ্ছা, জানি। সব শুনেছি।
এবার আরও থতমত খেয়ে যান আফতাব। পাশের টেবিলটার একটা কোনা ধরে তিনি মরিয়া হয়ে বলেন, ও আড়ি পেতে শোনা হয়েছে?
হ্যাঁ, আড়ি পেতেই শুনেছি।
তা বেশ করেছ। আমার যেখানে খুশি আমি সেখানে যাব। আফতাবের রাগ এবার গা মোড়ামুড়ি দেয়।
যেখানে খুশি সেখানে যাবে? নিশ্চয় যাব। আরও শুনে রাখ, এ মাসের পঁচিশ তারিখে আমাদের বিয়ে।
হ্যাঁ, ধ্বই তো শুনলাম।
ব্যস, আর কী? এবার যেতে পারো।
হ্যাঁ যাব। তার আগে আমার কথার জবাব দাও।
কী তোমার কথা?
আমি জানতে চাই, এ বয়সে কেন এ পাগলামি করতে যাচ্ছ?
পাগলামি! পাগলামির কী দেখলে তুমি?
পাগলামি নয়? লোকে বলবে কি, বল তো?
কী বলবে আর। শুধু দুটো কেন, আমি চারটে বিয়ে করতে পারি সে সামর্থ্য আমার আছে।
হ্যাঁ, আর্থিক সামর্থ্য তো আছে। তারপর বলো দৈহিক সামর্থ্য আছে!
নিশ্চয়ই আছে।
হ্যাঁ, তা তো আছেই।
উত্তেজনার মুখে কথাটা বলেই অস্বস্তি বোধ করেন আতিয়া বেগম। আর আফতাব তার চোখের দিকে চেয়ে মিইয়ে যান।
আতিয়া বেগম বলেন, বসো, কথা শোনো।
অন্যমনস্কভাবে আফতাব একটা সোফায় বসে পড়েন। তার সুমুখে আর একটায় বনে আতিয়া বেগম। বলেন, দ্যাখো, কেলেঙ্কারি করো না।
কেলেঙ্কারি! আমি রা শরীয়ত মতো বিয়ে করব তাতে কেলেঙ্কারির কী আছে?
হ্যাঁ, শরীয়ত পুরুষদের চারটে বিয়ে করবার বিধান দিয়েছে। কিন্তু যেসব কঠিন শর্তের উল্লেখ করেছে, তা পালন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
নিশ্চয়ই সম্ভব।
মোটেই নয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে সব স্ত্রীকে সমান চোখে দেখা কখনও সম্ভব নয়। কোরান শরীফে অসম্ভব শর্ত জুড়ে দিয়ে পরোক্ষভাবে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে