৯.
ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে স্টাডি ট্যুরে গতবছর গিয়েছিলাম কক্সবাজারে। একদিন হুহু বাতাসে একজনের ডাকনাম রেখে দিয়েছিলাম। সবার অজ্ঞাতে একদিন বালির ওপর একজনের ডাকনাম লিখেছিলাম ওরই চোখের মতো বড় বড় হরফে। একদিন সারারাত সমুদ্রমেশিন শুধু একজনের ডাকনাম বুনে গিয়েছিলো— মোটেলে বিশাল কক্ষে নিদ্রাহীন নিশা ব্যেপে তার শব্দ শুনেছিলাম। একদিন বনঝাউ-এর বীজ-এর মতো আমার সমস্ত সৈকত ধরে উড়ে-উড়ে গিয়ে পড়েছিলো একটি নাম।
১০.
রাতে, কারফিউ শুরু হওয়ার আগে-আগে ফিরি আড্ডা দিয়ে। আমরা কজন কবিবন্ধু শক্রর অধিক বন্ধু শস্তা রেস্তোরাঁকে মাৎ করে, কাপের পর কাপ চা খেয়ে, ফিরি রোজ রাতে যতোটা রাত করা যায়। ঘুরেঘুরে আসে বিদেশি কটি নাম, বাঙালি কটি নাম, শব্দশাস্ত্র, ছন্দশাস্ত্র গভীর মন্থন করা চলে। ফিরি যখন, শেষ বসন্তের হাওয়া চলছে রাস্তায় রাস্তায়, ছেঁড়া পাতা:আর ঝরা পাতা আর ছেঁড়া কাগজ আর টুকরো চাঁদ ফাঁকা রাস্তায় রাস্তায় বেজে ওঠে নর্তকীর মতো। আমার কানে পাওয়ার হাউসের স্বর ময়ূরের পালকের মতো খুঁজে আছে। আমার কণ্ঠে কবিতার দুটি পঙক্তি বারবার আবৃত্ত হয় : তোমাকে আমার চাই ক্রমাগত অসিত কুকুর। ভিতরে কাঁদে রৌদ্রের অধিক পূর্ণিমায়।
সারা বাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। দরোজা খুলে দ্যায় কাজের মেয়েটি। অকারণে হাসে কেন-যেন। যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমি, মাঝে-মাঝে মদ্যপান করে বাড়ি ফিরলে পা যেমন টলটল করে, সমস্ত চেনা যেমন টলমল করে, মাথায় ভিতরে যেমন ভূমিকম্প হয়, আস্তে-আস্তে কবিতার লাইন যেমন অনন্ত থেকে চলে আসে, মুঠোর মধ্যে সূর্য, কন্ঠে চাঁদ— তেমনি, আশ্চর্য, মদ না খেয়েই যেন কী একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। যেন আবৃত্ত হতে-হতে তোমাকে আমার চাই ক্রমাগত অসিত কুকুর / ভিতরে আমার কাঁদে রৌদ্রের অধিক পূর্ণিমায়, এই লাইন দুটি পরিণত হয়েছিলো এক গভীর ইদারায়, যার ভিতরে লাফ দিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম আমি। মেয়েটার হাসি যেন সেই ইদারার মুখ মুহূর্তে বুজিয়ে দ্যায়, মুহূর্তে বাস্তবে ফিরে আসি। আশ্চর্য, মেয়েটাকে কোনোদিন ভালো করে দেখি নি। এখন আশ্চর্য হয়ে। দেখি ঈশ্বর-রচিত এক প্রাকৃতিক ভাস্কর্য : ফুলকপির মতো স্তন, বাঁধাকপির মতো পাছা। কবিতার শব্দগুলি যেন ঘাসের মধ্যে এদিক-ওদিক নিঃশব্দে লুকিয়ে পড়ে। আমি নিজের ঘরের উদ্দেশে চলে যাই।
১১.
রাত্রিবেলা জেগে ওঠে আমার ঘর— নিঃশব্দায়মান। টেবিল ল্যাম্পের আলোর বলয়ে এসে বসতে না বসতেই কোত্থেকে চলে আসে মায়াবীর মতো জাদুবলে চারটি নিবিড় পঙক্তি :
‘তোমাকে আমার চাই’ ক্রমাগত অসিত কুক্কুর
ভিতরে আমার কাঁদে রৌদ্রের অধিক পূর্ণিমায় :
‘তোমাকে আমার চাই’ এই কান্না রাত্রিনীলিমায়
স্বপ্নে চড়ে ঘুরে-ঘুরে উঠে যায় দূর–বহুদূরে।
লাইনগুলি লিখে ফেলতে দেরি হয় না আমার।
সব বদলে যায় রাত্রিবেলা। ফ্যান ঘুরছে না তো, যেন মনে হচ্ছে গলায় দড়ি বাঁধা হরিণের ক্রমচক্কর। ব্রা-খোলা মিনার স্তন দুটি বাল্বের মতো দীপ্যমান, তার আলো একটা নীলাভকালো গোলাপের পাপড়ির ওপর পড়ে থাকে। আমার ঘরের সবুজ ডিসটেম্পার করা দেয়াল দেখে মনে হয় যে আমি দোতলা অরণ্যশিবিরে আছি। যেন ওআর্ডরোব দুটি ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় বিশাল প্রাচীনকালের পাখির মতো। ছাদের ওপর বাতাসে পাতা গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজ বাজে নাচিয়ে মেয়ের পদসঞ্চালনের অতিদ্রুত বৃষ্টির মতো।
আহ, কতো টুকরো-টুকরো বিভক্ত হয়ে গেছি আমি। দিনের টুকরো, রাতের টুকরো, বাস্তবের টুকরো, স্বপ্নের টুকরো। টুকরো লাইন ছাড়া আমার দেবার আর কিছু নেই। এমন করে নিজেকে আত্মবিভক্ত আর কে করেছে? আমি তো ঈশ্বর নই, টুকরোগুলো জোড়া লাগাবো কী করে। নিজের জন্যে করুণার জল এসে যায় আমার
ওকে শাস্তি দাও— ওকে শাস্তি দাও ওকে শাস্তি দাও–
ওকে…
যে কাঁদে বিনিদ্র রাতে আমি ওকে করেছি আলাদা,
শিল্প রচা অন্য-আমি বিদেশী দূরত্বে আছি বাঁধা,
ওকে তুমি শাস্তি দাও, আমি ডুবে থাকি তীব্র শোকে।
অনন্তই হয়তো জীবনে–যদি একজনের কেন্দ্রে স্থিত হতো জীবন। নাকি এই আমাদের নিয়তি?
জানালা দিয়ে চোখে পড়ে, আকাশে চাঁদ উঠেছে একগুচ্ছ সাগরকলার মতো জ্বলজ্বলে সোনালি-হলুদ। তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখে একফোঁটা পানি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি একসময়।
১২.
মাঝরাতে কি গভীর বৃষ্টি নেমেছিলো? হরিণেরা জলপান করতে এসেছিলো মানুষের তৈরি লেকে? মনের মধ্যে একটি মুখের মতন সেই বৃষ্টিতে ভেসে যায়। ছাদের ওপর ঝিমিয়ে আসে জীবনের গহন নর্তকী। যেন নিশি-পাওয়া মানুষের মতো এসে বসি টেবিলে—
কখন প্রহর যায়, চন্দ্ররাত্রি ঘুমে ঢলে আসে,
দুই আমি জেগে ঘুমোবার সাধ ভালোবাসে;
ঘুমে-জাগরণে তারপর পরস্পরের সকাশে
এসে মেশে দু’জন আলাদা আমি— দুই পরস্পর;
ঘুম-চোখে দ্যাখে : এক চুল-চোখ-মন-কণ্ঠস্বর।
আধেক আমার জন্ম হয়ে ওঠে আধেক ঈশ্বর।
১৩.
আম্মা বললেন, এই ক’টা টাকা? এই ক’টা টাকায় আমি মাস চালাবো কী করে?
দেখি, আমি বলি, পরে আর-কিছু দেবোখন।
পেয়ে আর দিয়েছো তুমি। সে তো সব মাসেই শুনি। পর আর আসে না তোমার। তোমাদের সংসার তোমরাই নাও, বাবা আমাকে এই আজাব দেওয়া কেন?