বেরিয়ে আসার সময়েও বিবি যখন বলে আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো, স্যার— তখন ধক করে ওঠে বুকের ভেতরে। অসম্ভব-বেদনায় আর অসম্ভব-আনন্দে বিহ্বল হয়ে ‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে আসি।
৫.
ধবল অশ্বের মতো দিন। বছর ফুরিয়ে আসছে। চৈত্র শেষ হাড়ে হাড়ে সূচিত হয়ে গেছে। লাইব্রেরিতে গিয়ে ঠাণ্ডায় বসে থাকি। ম্যাগাজিনের পাতা পাল্টাই। বিদেশি কবিতার সুস্বাদ রঙিন শরবতের মতো পান করি। বিদেশি কাগজের ঘ্রাণ নিই সোফার আরামে ডুবে গিয়ে। আমার পাশে একটি কিশোর লুকিয়ে ম্যাগাজিনের পাতা থেকে ব্লেড দিয়ে এক নিতম্বিনীর ছবি কাটছে। আমি আড়চোখে দেখি। একটুও উত্তেজিত হই না। মুচকি হাসি। কবিতার শব্দে মৌমাছির মতো উড়ে-উড়ে বসে আমার চোখ। তিরিশ পেরিয়ে এসে আস্তে আস্তে জীবনের সবকিছু, নিরুত্তেজ শান্তিতে দেখতে পাই, অনেকটা মেয়েদের মতো নিরুত্তেজ শান্ত নির্মোহ দৃষ্টিতে, নিরাসক্ত নক্ষত্রের মতো। বয়সের দান? তবু পুরোপুরি সুস্থ ও শান্ত হতে পারছি কই। ভেতরে ছুটছে ঘোড়া, কবিতার শব্দ থেকে শব্দে তার খটাখট খটাখট শব্দ উঠছে, বুকের নক্ষত্র অব্দি ধুলো উড়ছে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। পৃথিবীর আদিম আঁধার নেমে আসে সভ্যতার কেন্দ্রমণি এই গ্রন্থাগারে। নিউইয়র্কের হাজার-হাজার আলো-জ্বলা রাত্রিতে ব্রাজিলের গভীর অরণ্যের অন্ধকার। হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠি, এতোক্ষণ তাহলে একটা ধ্বনিময়তার মধ্যে ছিলাম। আমি চলে যাবার পর এমনিভাবে কি জেগে উঠবে আমার লেখা? তারপরই নিহিত ঝিঝিদলের ঝংকার শুরু হয়ে যায়। আলো জ্বলে ওঠে। ওদের নিজস্ব জেনারেটর চালু হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তখন কোথায়?
৬.
পিকনিক করতে গেছি কোন্ দূর বনে। আমরা ক’জন। ডালিয়া একসময় চলে আসে ভিড়ের ভিক্স থেকে আমার পাশে। কলাগাছের দঙ্গলে অন্ধ চামচিকে ঘোরে। ওমা! ডালিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে। কলাগাছের বনে ওড়ে অন্ধ চামচিকে।
৭.
চৈত্রমাস হা-হা করছে নগরীর পথে-পথে।
বিবি আর আমি গিয়ে বসি আইসক্রিমের ঠাণ্ডা দোকানে। মেয়েদের নিয়ে বসবার ভেতরের রুমটায় দুটি ছেলেমেয়ে এমন ভঙ্গিতে বসে যে, বাধ্য হয়ে বাইরে বসতে হয়। দুপুরবেলা এখন ভিড় নেই।
এখানে আবার কেউ দেখবে না তো? কেন তোমার ভয় লাগছে নাকি?
আমি সকৌতুকে জিজ্ঞেস করি।
না, আমার কী। আপনাকে নিয়েই তো ভয়। আপনি আবার, স্যার, অধ্যাপক মানুষ। কে কোথায় ছাত্র-টাত্র দেখে–।
ওরকম ভয় যে নেই, সত্যি কথা যদি বলতে হয় তাহলে তা আমি বলতে পারি না। ভেতরের রুমটায় বসতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু যা অবস্থা। আইসক্রিম খেতে-খেতে বারবার ভেতরে গিয়ে পড়ছে চোখ ভালো করে তাকাতে পারছি না। ছেলেটা বসে বসে কী করছে, কোথায় হাত দিচ্ছে জানি না, কিন্তু মেয়েটা বসেবসেও বারবার পা-টা লম্বা করে শুয়ে পড়ার মতো করছে। শীৎকারের ধ্বনি কি ভেসে এলো একবার? আমি তো ভাবতেই পারি না। ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়ে নাকি? প্রেমিক প্রেমিকা নাকি? আমরাও তো একসময় ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে শুধু বুকের ভেতর না, পা অব্দি কাঁপতো।
বিবির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওরও চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। ওর সঙ্গে আমার এমন সম্পর্ক না, যে, এই নিয়ে একটু ঠাট্টা করতে পারি। কেমন অস্বস্তি বোধ করছিলো, আইসক্রিম খাওয়া হতে বললো, “চলেন, স্যার, যাই’। বাধ্য হয়ে উঠতে হলো আমাকে।
৮.
শুয়ে আছি। দেখি, রান্নাঘরের কাজের ফাঁকে ঘরে এলো মিনা, এরকম মাঝে-মাঝে আসে, আঁচল হলদে দাগ, আধ-ময়লা, মুখ ঘামে তেলতেলে, চুল রুখু। খুটখাট করে কী কাজ করে ঘরের মধ্যে। একবার দেখে আমি আবার বই-এর মধ্যে ডুবে যাই।
ও, এই শোনো, একদম ভুলে গিছলাম, গা ঘেঁষে বসলো খাটে, আমার পাশে। আচ্ছা, সত্যি করে একটা কথা বলবে?
বলো না।
ঠিক বলবে কি না, বলো–
আহা, তুমি দেখছি একেবারে প্রেমিকার মতো গা ঘেঁষে আদুরে গলায়–
সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে বেরিয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম, আমার বলা উচিত হয় নি। সত্যি, আমিই না কতো মধুভাষী বিবির কাছে। কী যেন কেন, মিনার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, ভেতরের বিরক্তি আর অনীহা চেপে বসে কথায়, কথায় সুরে। অবৈধ সঙ্গম ছাড়া সুখ নেই? নিজেরই খারাপ লাগে শেষে, গ্লানি হয়। তখন বারবার খোশামোদ করি আবার। উঠে গিয়ে মিনাকে কাছে এনে বসাই।
শেষে নরম হয় মিনা, স্বাভাবিক হয়, হাসিখুশি মুখে বলে, আচ্ছা, ডালিয়া মেয়েটি কে সত্যি করে বলবে আমাকে? চোখেমুখে কৌতুক আর কৌতূহলের দ্যুতি ঠিকরে পড়ে মিনার।
বসন্তের ছুরি এসে পৃথিবীর মমতলে বিধলে তার যে চিৎকার জ্বলে ওঠে পলাশে আর কৃষ্ণচূড়ায় তেমনি আমূল রক্তিম চমকে উঠি। মুখে ঠিক হাসি টানতে পারি না, কে–কই আমি তো চিনি না!
নাহ, চেনে না— মেয়েলি ভঙ্গিতে হেসে ওঠে মিনা, ঘুমের মধ্যে ডালিয়া ডালিয়া বলে সে কী দীর্ঘশ্বাস!
যাহ! কী বলো! ভেতরে-ভেতরে অবাক হচ্ছিলাম, এখন বুঝলাম কী করে নাম জানলো মিনা, কিন্তু লজ্জায় আমার মুখ-চোখ লাল হয়ে যায়। হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে মিনা রক্তোচ্ছাসে সোনালি ফরসা মুখ ভরে যায় ওর, ওকে এমন হাসতে কোনোদিন দেখি নে, গভীর হাসতে হাসতে চোখে পানি এনে ফ্যালে। শল্যবিদ্ধ আমি মুগ্ধ তাকিয়ে থাকি।