সাবন্তবাড়ীর লখম সাবন্ত এবং অন্যান্য দেশাই, শিবাজীর আক্রমণে নিজ রাজ্য ছাড়িয়া গোয়ায় পলাইয়া গিয়া, সেখান হইতে তাহার নিযুক্ত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যে-সব ষড়যন্ত্র করিত, তাহার শাস্তি দিবার জন্য ১৭ই নবেম্বর ১৬৬৭ একদল মারাঠা-সৈন্য গোয়ার অধীন বার্দেশ জেলায় ঢুকিয়া কতকগুলি প্রজা ও গরু ধরিয়া লইয়া যায়। কিন্তু এই বিবাদ দূত পাঠাইয়া বন্ধুভাবে মিটমাট করা হইল; বন্দীরা খালাস পাইল; এবং গভর্ণর দেশাইদের পোর্তুগীজ-সীমানার বাহির করিয়া দিলেন (১৬৬৮)।
গোয়া-অধিকারের বিফল চেষ্টা
গোয়ার পূর্বদিক পাহাড়ে ঘেরা; তাহার মধ্যে দুএকটি সরু উঁচু পথ ভিন্ন যাওয়া যায় না। পশ্চিমে ও দক্ষিণে সমুদ্র ও খড়ী, প্রবল জাহাজ ও তোপ না থাকিলে সেইদিক দিয়া গোয়াবআক্রমণ করা অসম্ভব। ১৬৬৮ সালের অক্টোবর মাসে শিবাজী এই গোয়া প্রদেশে ঢুকিবার এক ফন্দী করিলেন। তিনি চারি পাঁচশত মারাঠা-সৈন্যকে ছোট ছোট দলে ভাগ করিয়া নানা ছদ্মবেশে ক্রমে ঐ গিরিসঙ্কট দিয়া গোয়া-রাজ্যে পাঠাইয়া দিলেন, এবং শিখাইয়া দিলেন যে যখন এইরূপে হাজার লোক একত্র হইবে, তখন তাহারা একত্রে হঠাৎ উঠিয়া পোর্তুগীজ রক্ষীদের মারিয়া একটা পাহাডের পথ (“ঘাটি”) দখল করিবে, এবং সেই পথ দিয়া শিবাজী সদলবলে ঐ রাজ্যে ঢুকিয়া দেশটা জয় করিবেন। কিন্তু হয় কেহ ষড়যন্ত্রটা ফাঁস করিয়া দিল, অথবা পোর্তুগীজ গভর্ণরের সন্দেহ এমনি জাগিয়া উঠিল। তিনি তাঁহার এলাকাভুক্ত শহরগুলিতে কড়া খানাতল্লাশ করিয়া ঐ লুকান মারাঠা সৈন্যগুলিকে গেরেফতার করিলেন এবং মারের চোটে তাহাদের নিকট হইতে সব কথা বাহির করিয়া লইলেন। তাহার পর শিবাজীর দূতকে ডাকিয়া স্বহস্তে তাহার কানে দুই-তিন ঘুষি দিয়া তাহাকে ও বন্দী মারাঠা সৈন্যদের গোয়া-রাজ্য হইতে দূর করিয়া দিলেন।
- এই শহব এখন বম্বে প্রদেশের একটি তালুকের সদর। এখানে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজ করিতেন, এবং রবীন্দ্রনাথ প্রথম বয়সে এখানে তাঁহার প্রবাসের সুখ-স্মৃতি লিখিয়াছেন।
- এই চাঁঁদায় ইংরাজের ৯ শত টাকা দিয়াছিল, কারণ কারোয়ার শহরে তাহাদের সম্পত্তির মূল্য ছিল চল্লিশ হাজার টাকা।
- ইহার মধ্যে বম্বে-দ্বীপ ১৬৬৮ সালে ইংলণ্ড-রাজাকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। আবাব তেমনি বর্ত্তমান পোর্তুগিজ-ভারতে অনেক গান, যথা—ফোন্ডা, বিচোলী, পেড়লে, সাকলী-শিবাজীর মৃত্যুর পঞ্চাশ বৎসর পরে পোর্তুগিজদের দখলে আসে।
১৩. শিবাজীর রাজ্য এবং শাসন-প্রণালী
ত্রয়োদশ অধ্যায় – শিবাজীর রাজ্য এবং শাসন-প্রণালী
শিবাজীর রাজ্যের বিস্তৃতি এবং বিভাগ
শিবাজী দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর অবিরাম পরিশ্রম এবং নিদ্রাহীন চেষ্টার ফলে যে-রাজ্য গঠন করিয়া যান, তাহার বিবরণ এক কথায় দেওয়া অসম্ভব, কারণ নানা স্থানে তাঁহার স্বত্ব নানা প্রকারের এবং তাঁহার প্রভাব বিভিন্ন পরিমাণের ছিল।
প্রথম হইল তাঁহার নিজের দেশ; ইহাকে মারাঠীতে “শিব-স্বরাজ” এবং ফারসীতে “পুরাতন-রাজ্য” (মমালিক-ই-কদিমি) বলা হইত। এখানে তাঁহার অধিকার ও ক্ষমতা স্থায়ী এবং সকলেই তাহা মানিয়া চলিত। ইহার বিস্তৃত সুরত শহরের ষাট মাইল দক্ষিণে কোলী দেশ হইতে আরম্ভ করিয়া গোয়ার দক্ষিণে কারোয়ার নগর পর্যন্ত; মাঝে শুধু পশ্চিম উপকুলে পোর্তুগীজদের গোয়া ও দমন প্রদেশ দুইটি বাদ। এই দেশের পূর্বসীমার রেখা বগলানা ঘুরিয়া দক্ষিণ দিকে নাসিক ও প্রণা জেলার মধ্যস্থল ভেদ করিয়া, সাতারা ও কোলাপুর জেলা বেড়িয়া, উত্তর কানাড়ার কুলে গঙ্গাবতী নদীতে গিয়া শেষ হয়। মৃত্যুর দুই বৎসর পূর্ব্বে তিনি পশ্চিম কর্ণাটকে বেলগাঁও-এর পূর্ব্বে তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে কোপল প্রভৃতি জেলা অধিকার করেন; এগুলি তাঁহার স্থায়ী লাভ। এই শিব-স্বরাজ তিন প্রদেশে বিভক্ত এবং তিনজন সুবাদারের শাসনাধীন ছিল:—
(১) দেশ, অর্থাৎ নিজ মহারাষ্ট্র; পেশোয়ার শাসনে,
(২) কোঁকন, অর্থাৎ সহ্যাদ্রির পশ্চিমাঞ্চল; অন্নাজী দত্তোর অধীনে,
(৩) দক্ষিণ-পূর্ব্ব বিভাগ, অর্থাৎ দক্ষিণ-মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমকর্ণাটক; দত্তাজী পণ্ডের শাসনে।
দ্বিতীয়ত, পূর্ব্ব-কর্ণাটক অর্থাৎ মাদ্রাজে (১৬৭৭-৭৮) দিগ্বিজয়ের ফলে জিঞ্জি বেলুর প্রভৃতি জেলা তাঁহার হাতে আসিয়াছিল বটে, কিন্তু সেখানে তাহার ক্ষমতা তখনও স্থায়িত্ব লাভ করিতে পারে নাই; তাঁহার সৈন্যেরা যতটুকু জমি দখলে রাখিতে বা যেখানে রাজস্ব আদায় করিতে পারিত, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিতে হইত; অন্য সর্ব্বত্র অরাজকতা এবং পুরাতন ছোট ছোট সামন্তদের সংঘর্ষ। মহীশূরে বিজিত স্থান কয়টিও সেই দশা। তাঁহাব মৃত্যুর পূর্ব্ব পর্যন্ত কানাড়া অধিত্যকায়, অর্থাৎ বর্তমান বেলগাঁও ও ধারোয়ার জেলায় এবং সোন্দা ও বিদনুর রাজ্যে, যুদ্ধ চলিতেছিল, সেখানে তার ক্ষমতা নিঃসন্দেহভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। তৃতীয়তঃ, এই-সব স্থানের বাহিরে নিকটবর্তী দেশগুলিতে তাঁহার সৈন্যেরা প্রতি বৎসর শরৎকালে গিয়া ছয় মাস বসিয়া থাকিয়া চৌথ আদায় করত। এই কর রাজার প্রাপ্য রাজার রাজস্ব নহে, ইহা ডাকাতদের খুশী রাখিবার উপায় মাত্র। ইহার মারাঠী নাম “খণ্ডনী”। অর্থাৎ “এই টাকা লইয়া আমাকে রেহাই দাও, বাবা!”) হইতেই তাহা স্পষ্ট বুঝা যায়। কিন্তু চৌথ আদায় করা সত্ত্বেও মারাঠার অপর শত্রুর আক্রমণ হইতে সেই দেশ রক্ষা করা কর্ত্তব্য বলিয়া স্বীকার করিত; তাহারা নিজেরা ঐ দেশ লুটিবে না, এইটুকু মাত্র অনুগ্রহ দেখাইত।