ঘোরপডে-উচ্ছেদ এবং সাবস্ত-বাড়ী অধিকার
১৬৬৪ সালের এপ্রিল মাসে বিজাপুরী ওমরারা আবার বিদনুর আক্রমণ করিল কারণ, সেখানে রাজপরিবার-মধ্যে কলহ ও খুনোখুনি আরম্ভ হইয়াছিল। সেই সুযোগে শিবাজী ঐ বৎসরের কয়েক মাস যাবৎ এই প্রদেশের ভিতর দিয়া ইচ্ছামত দেশলুঠ ও নগর-অধিকার করিয়া ঘুরিতে লাগিলেন। অক্টোবব ও নবেম্বর মাসে বহলোল খাঁর সহিত তাঁহার দুইবার যুদ্ধ হয়;প্রথমটায় তাঁহার হার, এবং দ্বিতীয়টায় জিত হয়। এই সময় তিনি মুদহোল গ্রাম আক্রমণ করিয়া তথাকার জমিদার ঘোরপডে বংশ প্রায় নির্ম্মূল করিয়া দেন। মারাঠ প্রবাদ এই যে, যখন (১৬৪৮ সালে) বিজাপুরী উজীর জিঞ্জির নিকট শাহজীকে কয়েদ করেন, তখন বাজী ঘোরপড়ে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া শাহজীর পলায়নে বাধা দিয়া তাহাকে ধরাইয়া দেয়, এবং সে জন্য শাহজী শিবাজীকে পত্র লেখেন—“যদি তুমি আমার পুত্র হও, তবে এই দুষ্কার্য্যের জন্য ঘোরপড়ের উপর প্রতিহিংসা লইও।” কিন্তু এই গল্প বিশ্বাসের অযোগ্য, কারণ মুদহোল-জয়ের দশ মাস আগে শাহজীর মৃত্যু হইয়াছিল। ১৬৬৪ ডিসেম্বর মাসে শিবাজী রত্নগিরি জেলার দক্ষিণ-পূর্ব্ব অংশ, বর্তমান সাবন্ত-বাড়ী জমিদারী, দখল করেন। এখানকার ছোট ছোট দেশাই (জমিদার)-গুলি বিজাপুরের অধীন ছিল; তাহারা শিবাজীর ভয়ে সর্বস্ব ছাড়িয়া প্রথমে জঙ্গলে পরে গোয়াতে আশ্রয় লইল, এবং সেখানে বসিয়া নিজ নিজ রাজ্য ফিরিয়া পাইবার বিফল চেষ্টায় অনেক বার সৈন্য সংগ্রহ করিয়াছিল। তজ্জন্য শিবাজী রাগিয়া পত্র লেখায়, পোর্তুগীজ-রাজপ্রতিনিধি শেষে এইসব দেশাইকে নিজ এলাকা হইতে বাহির করিয়া দিলেন (মে ১৬৬৮)। ইহার পর কুডালের দেশাই লখম সাবন্ত(বর্তমান সাব-বাড়ী-রাজ্যের আদিপুরুষ এবং জাতিতে ভোসলে) শিবাজীর বশ্যতা স্বীকার করিয়া তাঁহার অধীনে জাগীরদার হইয়া নিজ জমিদারী ফিরিয়া পাইলেন, কিন্তু তাহাকে দুর্গ নির্মাণ করিতে ও নিজের সৈন্য রাখিতে নিষেধ করা হইল।
রুস্তম-ই-জমান গোপনে শিবাজীর সহায়ক হওয়ায়, এমন কি মারাঠাদের সহিত একজোটে নিজ রাজার প্রজাদের নিকট হইতে লুঠকরা সম্পত্তি ভাগাভাগি করায়, ঐ প্রদেশে শিবাজীর বিরুদ্ধে দাঁড়াইবার মত কেহই রহিল না, সর্ব্বত্রই ধনী ও বণিকের। মারাঠাদের ভয়ে ত্রাহি ত্রাহি করিতে লাগিল, ঘরবাডী ছাড়িয়া পাইল, ঐ দেশের অত বড় ও বিখ্যাত বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হইয়া গেল। কোন স্থানই তাঁহার গ্রাস হইতে রক্ষা পাইত না।
বসরুব এবং কাবোয়ার লুণ্ঠন
বিদরের প্রধান বন্দর বসরুর (ম্যাপের Barcelore); এটা হিন্দুর রাজ্য, ইহার রাজা শিবাজীর নিকট কোন অপরাধ করেন নাই, এবং মহারাষ্ট্রের ত্রিসীমার কাছেও যাইতেন না। কিন্তু বাণিজ্যের ও শিল্পবিক্রয়ের ধনে ঐ অঞ্চলে বসরুর অতুলনীয় ঐশ্বর্য্যশালী হইয়া উঠিয়াছিল। অতএব শিবাজী ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৬৬৫ সালে, ৮৮খানা জাহাজে সৈন্য চড়াইয়া রত্নগিরি জেলার তীর হইতে রওনা হই। হঠাৎ বসরুবে আসিয়া হাজির হইলেন। এখানে যে তাঁহার আগমন হইবে তাহা কেহ স্বপ্নেও ভাবে নাই, সুতরাং অত্মরক্ষার জন্য কেই প্রস্তুত ছিল না। মারাঠারা একদিনের অবাধ লুঠই অগণিত ধনরত্ন পাইল পরদিন ঐ শহর ছাড়িয়া। শিবাঙ্গী সমুদ্র তীবে গোকর্ণ নামক ভাব বিখ্যাত তীর্থে নামিয়া তথাকার শিবমন্দিবের সামনে স্নান পূজাদি পুণ্যক্রিয়া সারিলেন। তাহার পর হাত গুলিকে দেশে পাঠাইয়া দিয়া, নিজে চাবি হাজার পদাতিকের সঙ্গে উত্তবাদকে কুচ কবিয়া আঙ্কোল হইযা কাবোয়ার নগরে[১] (পৌঁছিলেন)।
এই বন্দরে ইংরাজদের একটি বড় কুঠী ছিল তাঁহারা ভয়ে শিবাজীর রাজ্যে নানাস্থানে বেতনভোগী চর রাখিয়া তাঁহার গতিবিধি ও অভিসন্ধির পাক। খবর আগে হইতে অনাইত। এখন শিবাজীর এদিকে আগমনের সংবাদ পাইবামাত্র তারা কোম্পানীর টাকাকড়ি ও মাল একখানা ছোট ভাড়াটে জাহাজে বোঝাই করিয়া কুঠী ছাডিয়া তাহাতে আশ্রয় লইল। সেই রাত্রে বহলোল খাঁর অনুচব শের খাঁ(হাবশী), প্রভুর মাতাব মক্কা-যাত্রার জন্য জাহাজ ঠিক করিতে এই বন্দরে উপস্থিত হইলেন, এবং পৌঁছিবার পর প্রথম শুনিলেন যে শিবাজীও সেখানে আসিয়াছেন। তিনি তাড়াতাড়ি নিজ বাসা দুর্গের মত ঘিরিয়া, সঙ্গের পাঁচ শত বক্ষ-সৈন্যকে চারিদিকে দাঁড় করাইয়া, মাল ও টাকা সুরক্ষিত করিয়া, শিবাজীকে সেই রাত্রেই সংবাদ পাঠাইলেন যে তিনি যেন ঐ শহরে না ঢুকেন, কারণ ঢুকিতে চেষ্টা করিলে শের খাঁ যতক্ষণ প্রাণ থাকিবে তাঁহার সঙ্গে লড়বেন। শের খার সাহস এবং নেতৃত্বের যশ কাহারও অজানা ছিল না। আর বহলোলও বিজাপুরের সর্বশ্রেষ্ঠ ওমরা। এই সব কারণে শিবাজী শের খাঁকে আক্রমণ করতে সাহসী হইলেন না, এবং কারোয়ার শহরের কোন ক্ষতি না করিয়া কিছু দূরে নদীতীরে শিবির ফেলিলেন।
এখান হইতে পরদিন (২৩ ফেব্রুয়ারি) দূত পাঠাইয়া তিনি শের খাঁকে জানাইলেন, “হয় ইংরাজদের ধরিয়া আমার হাতে দাও, না হয় তুমি শহর ছাড়িয়া চলিয়া যাও, আমি ওখানে গিয়া ইংরাজদের উপর প্রতিহিংসা লইব, কারণ তাহারা আমার চিরশত্রু!” শের খাঁ কি উত্তর দিবেন ইংরাজদের জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন। তাহারা জানাইল, “আমাদের কাছে এই জাহাজে বারুদ ও গোলা ভিন্ন আর কোন ধনদৌলৎ নাই। শিবাজী আসিয়া তাহা লইয়া যাইতে পারেন, যদি তিনি মনে করেন যে তাহাতে টাকার মত কাজ দিবে।” এই উত্তর শুনিয়া শিবাজী অত্যন্ত রাগিয়া বলিলেন, “যাইবার আগে ইংরাজদের দেখিয়া লইব।” স্থানীয় বণিকেরা তখন ভয়ে চাঁঁদা[২] তুলিয়া তাহাকে কিছু নজর দিল। তাহা লইয়া শিবাজী ঐদিন চলিয়া গেলেন; যাইবার সময় বলিতে লাগিলেন, “শের খাঁ এবার আমার হোলীর সময়ের শিকার মাটি করিয়াছে। তাহার পর ভীমগড় (১৪ মার্চ) হইয়া শিবাজী দেশে ফিরিলেন, কারণ এই মাসেই জয়সিংহ তাঁহার আশ্রয় পুরন্দর-দুর্গ আক্রমণ করেন।