সাম্প্রতিককালে আফ্রিকান উপন্যাসে আমরা অন্যরকম দৃষ্টান্ত পাই। নাইজিরীয় লেখক চিনুয়া আটিবির উপন্যাসে নাইজিরিয়ার গ্রাম্যজীবনের গভীর ভেতরে ঢোকার সফল প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। সেখানকার মানুষের জীবনযাপনের পরিচয় তো আছেই, উপরন্তু সেই জীবনযাপন জীবন্ত হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক এবং তাদের বিশ্বাস ও সন্দেহ, সংস্কার ও কুসংস্কারের অপূর্ব ব্যবহারের ফলে। এই উপন্যাসগুলো ইংরেজিতে লেখা। অথচ সম্পূর্ণ আলাদা–সবদিক থেকেই আলাদা–ভিন্ন মহাদেশীয়, ভিন্ন সভ্যতার ভিন্ন করি, ভিন্ন সংস্কৃতির একটি ভাষায় নাইজিরিয় সংস্কৃতি উঠে এসেছে তার অস্থিমজ্জা নিয়ে। এখানে ব্যবহৃত অনেক কথা ও প্রবাদ, ফী ছড়া ও শ্লোক, ইংরেজি কী পাশ্চাত্য এমনকী আধুনিক মধ্যবিত্ত বাঙালি রুচি অনুসারে অশ্লীল ও স্থূল। কিন্তু নাইজিরিয়ার পাশ্চাত্য শিক্ষাবর্জিত গ্রাম্য মানুষের সর্বাঙ্গীণ ও জীবও কপায়ণের জন্য লেখক সেগুলোকে তুলে এনেছেন অপরিবর্তিত অবস্থায় এবং একই সঙ্গে তাকে নতুন মাত্রা দিয়ে তাকে তার উন্নত দার্শনিক চিন্তার বাহনে পরিণত করেছেন।
চিনুয়া আচিবির মানের লেখক বাংলা সাহিত্যেও পাওয়া যাবে, দক্ষতা ও নৈপুণ্য তাদের কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু গল্পের জায়গাজমি ও মানুষের জন্য যে-মুরীদবোধ ও দায়িত্ববোধ নাইজিরীয় লেখককে উপন্যাসনায় উদ্বুদ্ধ করে তার শোচনীয় অভাবে মাতৃভাষায় লিখেও আমাদের শ্রেষ্ঠ লেখকগণ বাংলা ভাষার প্রবাদ প্রবচন, শ্লোক, হড়া এবং সামগ্রিকতাবে লোকসংস্কৃতির উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারেন না।
এর মানে কিন্তু এ নয় যে লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্যে প্রদর্শনী ও আলোচনায় কিছুমাত্র ভাটা পড়েছে। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কীর্তন ও বাউলের জনপ্রিয়তা শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যেও খুব লক্ষ করা যাচ্ছে। মেলা বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও পতি অধ্যাপকগণ লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির সগ্রহ ও সংরক্ষণে অত্যন্ত উৎপর। এতে আপত্তির কী আছে? এর সাহায্যে শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যদি গ্রামবাসী নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতির সামান্যতম অংশের পরিচয় পান তো তাতে পরস্পরের ব্যবধান কমে আসে। কিন্তু সেরকম পরিচয় তো মার্কিন কোটিপতিদের সজির সঙ্গে প্রত্যেক দিনই ঘটছে টেলিভিশনের পর্দায় দিকে একটু কষ্ট করে তাকালেই চোখ ভরে সেই সতিচর্চা দেখা যায়। আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতি আমাদের কাছে আজ কেবল প্রদর্শনীর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সঙ্গতি যদি আধুনিক ডিঙ্গিসম্পন্ন শিল্পীর হাতে নতুন ব্যঞ্জনা না-পায়, তার শিল্পকর্মে শিল্পী যদি এর নতুন মাত্রা দিতে না-পারেন, আধুনিক শিল্পী ও লেখক যদি সেমিনারে-সেমিনারে তাকে প্রশংসাই করে চলেন, কিন্তু নিজের শিল্পচর্চাকে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে দেন তো নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতির প্রাণশক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং তার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। এবং একই সঙ্গে মধ্যবিত্তের আধুনিক শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চা দেশের সংস্কৃতিচর্চার মূল প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিণত হয় উদ্ভব ও নিষ্প্রাণ ব্যায়ামে।
নিষ্ঠাবান শিল্পী এবং বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মী নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতিকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনবেন কী উপায়ে? নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সঙ্গে কেবল মেলামেশা করলেই এই পরিচয় সম্পন্ন হয় না, মানুষের প্রতি গভীর মর্যাদবোধ–কেবল ভালোবাসা নয়–জাতীয় মর্যাদাবোধই তাকে উদ্ভুদ্ধ করবে শ্রমজীবীর সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে।
বুদ্ধিজীবী ও বামপন্থি রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই, বোধহয় অধিকাংশই, মানুষের প্রতি এই মর্যাদাবোধের পরিচয় দেননি। দফায়-দফায় বন্দুকের মাথায় যারা ক্ষমতায় আসে তারা হল পেশাদার খুনি। মানুষ তাদের কাছে চমৎকার গেম, শিকার-মাত্র। পার্লামেন্টারি রাজনীতিবিদদের কাছে শ্রমজীবী মানুষের একমাত্র পরিচয় ভোটার হিসাবে। ছলে-বলে কৌশলে মহামূল্যবান ভোটটি নিংড়ে নিয়ে পার্লামেন্টারি রাজনীতিবিদ শ্রমজীবী নিম্নবিত্তকে ছিবড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলেন। বামপন্থি রাজনীতিবিদের কাছে শ্রমজীবী মানুষ হল আন্দোলনের হাতিয়ার। তাঁকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পারলেই বামপন্থি রাৰ্জনীতিবিদদের অনেকেই নিজেদের সফল বিপ্লবী ভাবেন। কিন্তু বামপন্থি রাজনৈতিক আন্দোলন তো পরিচালিত হয় শ্রমজীবীর শাসনপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তা হলে তাদের কেবল হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার অধিকার রাজনীতিবিদরা পান কোত্থেকে শ্রমজীবীকে উদ্ধার করার ব্রত নিয়ে বামপন্থি রাজনীতিবিদদের মাঠে নামবার আর দরকার নেই। শ্রমজীবীর প্রতি মর্যাদাবোখ না-থাকলে বামপন্থি আন্দোলন চালাবার উৎসাহ কি শেষ পর্যন্ত টেকে? বরং তাদের প্রতি এই মর্যাদাবোধ নিয়ে এলিয়ে এলে বামপন্থি রাজনীতিবিদ বা কর্মী ইতিহাসের সকল ধারায় নিজেকে প্রয়োগ করার সুযোগ লাভ করবেন। মানুষ শুধু ইতিহাসের উপাদান নয়। কিংবা কোনো তত্ত্বপ্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ কেবল প্রয়োজনীয় উপকরণমাত্র নয়। শ্রমজীবী মানুষ ইতিহাসের নির্মাতা। তাঁদের জীবনযাপনকে তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা চলে না এবং শ্রমজীবীর জীবনযাপন ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে জীবনের গভীর সত্যকে অনুসন্ধানের ভেতর শিল্পচর্চার অর্ধময়তা নির করে। তরে ভেতর যে-সত্য আছে, তাও উন্মোচিত হবে এই অনুসন্ধানের ফলেই। শিল্পসাহিত্যে প্রমাণ করার কোনো বিষয় থাকে না, অনুসন্ধান ও সিদ্ধান্তু সেখানে পাশাপাশি চলে, পরস্পরের সঙ্গে তারা সংলগ্ন, একটি থেকে আরেকটিকে ছিঁড়ে দেখানো চলে না। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে শিল্পী যদি বিন্নি হল তো এই অনুসন্ধানে তাৎপর্যময় মাত্রা থাকে না, এটা ক্রমেই নিস্তেজ ও পানসে অভ্যাসে পরিণত হয়। শিল্পচর্চার প্রাণ ও গতিরক্ষার জন্য এই বিচ্ছিন্নতা দূর করা একেবারে অপরিহার্য, নইলে মধ্যবিত্তের শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চা তো বটেই তার গোটা জীবনযাপন ভিত্তিহীন ও শূন্যতার ওপর এমনভাবে ঝুলবে যে তাকে সংস্কৃতিচর্চা এবং জীবনযাপনের ক্যারিকেচার বলে শনাক্ত করতে হবে।